উপসংহার

পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে যে-সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ ও বিচারবিশ্লেষণের সমাবেশ করা হয়েছে তা থেকে যুক্তিসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, ইংরেজদের বাংলা বিজয় কোনওক্রমেই ‘আকস্মিক’ বা ‘অনিচ্ছাকৃত’ ঘটনা নয়। পলাশির বিপ্লব বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকটের ফলও নয়। এটাকে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে নবাবের বিরোধের ফলে উদ্ভূত ঘটনাও বলা যায় না। অনুরূপভাবে, পলাশি সম্বন্ধে ‘কোলাবোরেশন’ থিসিসও অচল—যাতে বলা হয়, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে (বিশেষ করে ইংরেজদের সঙ্গে) বাংলার ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার শ্রেণীর স্বার্থ এমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল যে তারা, নবাব বাংলা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করবেন, এটা কোনওমতেই সহ্য করতে পারেনি এবং সেজন্যই নবাবকে তাড়াতে তারা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। আসলে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এইসব কর্মচারীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে প্রভূত ধনোপার্জন করা এবং তা নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে তোফা আরামে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বাকি জীবন অতিবাহিত করা। কিন্ত মধ্য-অষ্টাদশ শতকে এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য চরম সংকটের সম্মুখীন হয় এবং ফলে এই বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কমে যায়। আর এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করার জন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা সাব-ইম্পিরিয়ালিজম (sub-imperialism) বা স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ তারা নিজেদের কার্য ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাংলায় কোম্পানির আর্থিক ও সামরিক শক্তিকে কাজে লাগায় এবং তার ফলেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় সম্ভব হয়।

ইংরেজরাই যে মূলত পলাশি বিপ্লব সংগঠিত করেছিল সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে বাংলায় পাঠাবার সময় মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল যে-নির্দেশ তাঁদের দিয়েছিল তার মধ্যেই পলাশি বিপ্লবের বীজ নিহিত ছিল এবং তাতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা খুলে গিয়েছিল। অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করা যায় না যে, মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নবাবের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত করার চেষ্টা করছিল। তবে এ-ব্যাপারে যেটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হল, ইংরেজদের মদতেই এই চক্রান্ত চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং তাদের সক্রিয় অংশ ছাড়া এই ষড়যন্ত্র পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটাতে পারত না। ইংরেজরাই নবাবের বিরুদ্ধে দরবারের অমাত্যদের একটা বড় অংশকে নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তাদের নিজেদের পরিকল্পিত বিপ্লব সফল করতে ওই অভিজাতবর্গকে নিজেদের দলে টেনে আনে। পলাশি যুদ্ধের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তারা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল, যাতে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠানোয় স্থিরসংকল্প থাকে। তা ছাড়া পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি সফল করা যায় তার জন্য ইংরেজরাই ভারতীয় যড়যন্ত্রকারীদের চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। সুতরাং এটা ঠিক নয় যে, পলাশির ষড়যন্ত্র ‘দেশীয় ষড়যন্ত্র’। স্থানীয় চক্রান্তকারীরা ইংরেজদের পরিকল্পনার পুরো ছকের তাৎপর্য উপলব্ধিই করতে পারেনি এবং সেই নির্বুদ্ধিতার জন্য অচিরেই তাদের বিরাট মূল্য দিতে হয়েছিল। নতুন বিজেতাদের হাতে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ধনেপ্রাণে মারা পড়ল, ভবিষ্যতের কোনও আশাও রইল না।

এ-প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায়—মুর্শিদাবাদ দরবারের প্রভাবশালী একটি বেশ বড় অংশ নবাবের বিরুদ্ধে গেল কেন এবং কেনই বা তারা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাল? তার মূল কারণ, খামখেয়ালি ও দুঃসাহসী তরুণ সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ায় উপরোক্ত অমাত্যগোষ্ঠী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠীতে ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার, জমিদার ও অভিজাত সেনানায়করাও ছিল। এরাই নবাবি আমলে এতদিন সম্পদ পুঞ্জীভবনে লিপ্ত ছিল। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর এরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে যে এদের অবিরত সম্পদ আহরণের মূল উৎসগুলি সিরাজ বন্ধ করে দিতে পারেন এবং ফলে এদের বৈভবের পথে তিনি এক মূর্তিমান বাধা।

ব্যাপারটা একটু বিশদ করে বললে বুঝতে সুবিধে হবে। জগৎশেঠদের বিপুল ঐশ্বর্য নানারকম একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে সঞ্চিত হয়েছিল। এগুলি হল, টাঁকশালের প্রায় একচ্ছত্র অধিকার, পুরনো মুদ্রাকে নতুন মুদ্রায় পরিবর্তিত করার একচেটিয়া ব্যবসা, বাট্টা নিয়ে অন্য জায়গার মুদ্রা বিনিময় করা, রাজস্ব আদায়ের অধিকার ইত্যাদি। সিরাজের পূর্ববর্তী বাংলার নবাবরাই এই বিশেষ সুযোগসুবিধেগুলি তাঁদের ব্যক্তিগত দাক্ষিণ্য ও অনুগ্রহ হিসেবে জগৎশেঠদের প্রদান করেছিলেন এবং এগুলির মাধ্যমেই শেঠদের বিপুল সমৃদ্ধি। ঠিক এভাবেই উমিচাঁদ পেয়েছিলেন সোরা, শস্য ও আফিং-এর একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার। আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের লবণ ও সোরার একচেটিয়া ব্যবসাও নবাবের দাক্ষিণ্যে। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর এইসব বণিকরাজাদের আশঙ্কা হল যে, তাঁরা নবাবদের দাক্ষিণ্যে এতদিন যে-সব সুযোগসুবিধে ভোগ করছিলেন এবং যার জন্য তাঁদের এত সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে, সেগুলি থেকে সিরাজ এখন তাঁদের বঞ্চিত করতে পারেন। মীরজাফর, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লতিফের মতো অভিজাত সেনানায়ক ও ভূস্বামী শ্রেণী, যাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার শ্ৰেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাঁরাও শঙ্কিত হলেন যে, তাঁদের পক্ষে অনুকূল ক্ষমতার যে কায়েমী ব্যবস্থা চলে আসছে তরুণ নবাব তার আমূল পরিবর্তন করতে পারেন। এক কথায় বলতে গেলে, মুর্শিদাবাদ দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ, যার মধ্যে বণিক-ব্যাঙ্কার থেকে জমিদার ও অভিজাত সেনানায়ক পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল, সিরাজদ্দৌল্লাকে তাদের সমৃদ্ধি অক্ষুন্ন ও অব্যাহত রাখার পক্ষে বিপজ্জনক বাধা হতে পারে ভেবে আশঙ্কিত হয়ে পড়ে।

তাদের আশঙ্কা যে খুব অমূলক নয় এবং তাদের সামনে যে বিপদ তার স্পষ্ট সংকেত পাওয়া গেল মীরবক্সির পদ থেকে মীরজাফরের অপসারণ, রাজা মাণিকচাঁদের কারাদণ্ড এবং সর্বোপরি বাংলা থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ হাকিম বেগের বিতাড়নের মধ্যে। একদিকে এই সব ঘটনা এবং অন্যদিকে নতুন ও উদীয়মান একটি গোষ্ঠীর—যার মধ্যে মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আব্দুল হাদি খান প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং যাঁরা এখনও পর্যন্ত সম্পদ পুঞ্জীভবনে লিপ্ত হয়ে পড়েননি—সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দেওয়াললিখন স্পষ্ট দেখতে পেল। হাকিম বেগকে অপসারণ করায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সিরাজ নবাব আলিবর্দির একান্ত ঘনিষ্ঠ অমাত্যদের ওপরও আঘাত হানতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। হাকিম বেগ ছিলেন আলিবর্দির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং মুর্শিদাবাদের পরাক্রমশালী ‘পাচোত্রা দারোগা’ (শুল্ক বিভাগের দারোগা)। তাঁর ক্ষমতার প্রধান উৎস ছিল আলিবর্দির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। নানারকমের জোরজুলুম ও একচেটিয়া ব্যবসা করে তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী ও কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। এত প্রভাবশালী ও পূর্ববর্তী নবাব আলিবর্দির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এমন একজন অমাত্যকে সিরাজদ্দৌল্লা দেশ থেকে বিতাড়ন করায় দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

আবার মীরবক্সির পদ থেকে মীরজাফরের অপসারণের ফলে ওই গোষ্ঠীর মনে নবাবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহই রইল না। রায়দুর্লভ কোনও মতেই মেনে নিতে পারলেন না যে মোহনলাল তাঁর কাজকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করবেন। অন্যদিকে খাজা আব্দুল হাদি খান মীরজাফরের পদে নিযুক্ত হওয়ায় স্বভাবতই তা তাঁর অসহ্য মনে হয়েছিল। জগৎশেঠ ও অন্য দুই বণিকরাজা উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের আশঙ্কা হল তাদের বিপুল উপার্জনের প্রধান উপায় একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাবে এবং যে বিশেষ সুযোগসুবিধেগুলি তাঁরা এতদিন ভোগ করে আসছিলেন সেগুলি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তরুণ ও বেপরোয়া নবাব সিরাজদ্দৌল্লা থাকলে তাঁদের কায়েমী স্বার্থ ও ক্ষমতার সৌধ বিনষ্ট হয়ে যাবে। সেজন্য সিরাজকে হঠানো দরকার, যাতে তাঁদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের উপায়গুলি রুদ্ধ না হয়ে যায়, যাতে মোহনলাল ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে যে নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব হচ্ছে তাদের হাতে ক্ষমতা চলে না যায়, যাতে নবাবের ঘনিষ্ঠ এই নতুন গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ওপর আঘাত হানতে না পারে।

তা সত্ত্বেও ইংরেজদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া পলাশির বিপ্লব সম্ভব হত না। সিরাজদ্দৌল্লার উত্থান ইংরেজদের পক্ষেও বিপজ্জনক ছিল, বিশেষ করে, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের স্বার্থের দিক থেকে, যদিও কোম্পানির দিক থেকে ততটা নয়। তরুণ নবাব কোম্পানির কর্মচারীদের অসদুপায়ে অর্থোপার্জনের যে কল্পতরু— একদিকে বেআইনিভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যদিকে দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার—তার মূল ধরে সজোরে নাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের বিপুল উপার্জনের এই দুটি সহজ পথ থেকে সরে আসতে কোনওমতেই রাজি ছিল না। তার ওপর সিরাজ এ-সব অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুললেন এমন সময় যখন কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য এক নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন। তরুণ নবাব ইংরেজদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি আগেকার নবাবদের মতো দস্তকের অপব্যবহার বা কর্মচারীদের বেআইনি ব্যক্তিগত বাণিজ্য কোনওটাই বরদাস্ত করবেন না। এ-সব কর্মচারীরা এশীয় বণিকদের কাছে দস্তক বিক্রি করত যা দেখিয়ে এশীয় বণিকরা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতে পারত। দস্তক বিক্রি করে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর উপার্জন করত। তবে নবাব এটা বন্ধ করে দিতে পারেন বলে তারা খুব একটা ভয় পায়নি—তাদের আরও অনেক বেশি ভয়ের কারণ ছিল নবাব যদি তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। সেটা নিয়েই তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। কারণ বাংলায় তাদের ধনোপার্জনের সবচেয়ে বড় উপায় ছিল এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই তাদের কাছেও সিরাজদ্দৌল্লা ছিলেন বিপজ্জনক। ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ও ক্লাউন্সিলের সদস্যসহ কোম্পানির সব কর্মচারীই ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে ধনসম্পদ আহরণের এমন লোভনীয় উপায় বন্ধ করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক ছিল না। সুতরাং তারা সবাই নবাবকে হঠাতে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠল।

অবশ্য ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে মুর্শিদাবাদ দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তাদের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় সামিল করতে না পারলে বিপ্লব করা সম্ভব হবে না। এই কারণেই কলকাতা আসার কিছুদিন পরে এবং চন্দননগরের পতনের আগেই ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির সঙ্গে একযোগে কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন যথাসাধ্য চেষ্টা করে যান যাতে জগৎশেঠ পরিবার আমাদের স্বার্থের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন।’ তা ছাড়াও নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ সদস্যদের সমর্থন ও সাহায্য পাওয়ার জন্য ইংরেজরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দরবারের অধিকাংশ অমাত্যই ছিল চুপচাপ, সুযোগের সন্ধানে—পলাশিতে ইংরেজ বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা যাকে বলে বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, কিছুমাত্রও এগিয়ে আসেনি। খুব সম্ভবত তাদের পরিকল্পনা ছিল, শেষপর্যন্ত যে-দল জিতবে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া অর্থাৎ ইংরেজরা নবাবকে পরাজিত ও বহিস্কৃত করলে একমাত্র তখনই তারা ইংরেজদের স্বাগত জানাবে কারণ নবাব ইংরেজদের মতো তাদেরও স্বার্থের পরিপন্থী। কিন্তু পাছে নবাবের জয় হয় এবং সেক্ষেত্রে তাঁর রোষানলে পড়ার ভয়ে প্রায় কেউই সামনাসামনি ইংরেজদের সমর্থন করতে এগিয়ে আসেনি।

অন্যদিকে ইংরেজদের পক্ষে নবাবের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না কারণ এই নবাব রাজত্ব করতে থাকলে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের, যেটা তখন খুবই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল, পুনরুদ্ধার কোনওমতেই সম্ভব ছিল না। একমাত্র সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারলে তা সম্ভব হবে। তাই সিরাজদ্দৌল্লার পর কে নবাব হবে বা কে হলে ভাল হয় তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। ভালমন্দ যে কেউ নবাব হলেই চলবে, যদি সে সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। সেইজন্য যখন ইয়ার লতিফকে নবাব পদে প্রার্থী হিসেবে পাওয়া গেল, তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু না জেনে বা খোঁজখবর না নিয়ে তারা তাঁকে লুফে নিল। এমনকী ক্লাইভ ইয়ার লতিফের প্রার্থীপদ অনুমোদন করলেও লতিফ হিন্দু না মুসলমান, ব্যক্তি হিসেবে ভাল না মন্দ, এ-সব কিছুই জানতেন না। তারপর যখন ইংরেজরা জানল যে মীরজাফর নবাব হতে আগ্রহী তখন সঙ্গে সঙ্গে তারা ইয়ার লতিফকে বাতিল করে তাঁকেই নবাব পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করল। কারণ, মীরজাফর যোগ্যতর ব্যক্তি বলে নয়, তিনি ইয়ার লতিফের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী, নবাবের প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ এবং অনেক বেশি জোরালো প্রার্থী। অবশ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তিনি জগৎশেঠদের খুব কাছের লোক। ইংরেজরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিল যে, জগৎশেঠদের অনুমোদন ছাড়া বাংলায় কোনও বিপ্লব সম্ভব নয় এবং সেজন্যই তাদের ইয়ার লতিফকে ছেড়ে মীরজাফরকে প্রার্থী করতে হল। আবার এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ইংরেজরা পলাশি বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য শুধু নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ অমাত্যদের ওপর নির্ভর করে বসে ছিল না। সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে তারা এতটাই আগ্রহী এবং অস্থির হয়ে পড়েছিল যে, যদি কোনও কারণে মুর্শিদাবাদের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সাহায্যে তারা বিপ্লব সংগঠিত করতে না পারে, তা হলে তারা বাংলা বিজয়ের জন্য মারাঠা অথবা দিল্লির বাদশাহের প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য নেওয়ার পরিকল্পনাও করেছিল।

সুতরাং আমাদের চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরেজদের এবং মুর্শিদাবাদ দরবারের অমাত্যদের একটা বড় অংশের, উভয়ের স্বার্থেই, সিরাজদ্দৌল্লার সিংহাসনচ্যুতি অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল এবং সেজন্যই পলাশি বিপ্লব। ইংরেজরাই পলাশি চক্রান্তের মূল উদ্যোক্তা, ষড়যন্ত্রে তাদেরই মুখ্য ভূমিকা। তারাই নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পিত বিপ্লবের ষড়যন্ত্রে টেনে আনে এবং এভাবে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটায়। সেই পতনে শেষপর্যন্ত কারা এবং কী পরিমাণ লাভবান হয়েছিল ভারতবর্ষের পরবর্তী দু’শো বছরের ইতিহাস তার সাক্ষী।