শেষ প্রশ্ন

কল্যাণীয়াসু,—

হাঁ, ‘শেষ প্রশ্ন’ নিয়ে আন্দোলনের ঢেউ আমার কানে এসে পৌঁচেছে। অন্ততঃ, যেগুলি অতিশয় তীব্র এবং কটু সেগুলি যেন না দৈবাৎ আমার চোখ কান এড়িয়ে যায়, যাঁরা অত্যন্ত শুভানুধ্যায়ী তাঁদের সেদিকে প্রখর দৃষ্টি। লেখাগুলি সযত্নে সংগ্রহ করে লাল-নীল-সবুজ-বেগনী নানা রঙের পেন্সিলে দাগ দিয়ে, তাঁরা ডাকের মাশুল দিয়ে অত্যন্ত সাবধানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এবং পরে আলাদা চিঠি লিখে খবর নিয়েছেন পৌঁছল কিনা। তাঁদের আগ্রহ, ক্রোধ ও সমবেদনা হৃদয় স্পর্শ করে।

নিজে তুমি কাগজ পাঠাও নি বটে, কিন্তু তাই বলে রাগও কম করোনি। সমালোচকের চরিত্র, রুচি, এমন কি পারিবারিক জীবনকেও কটাক্ষ করেছো। একবারও ভেবে দেখোনি যে শক্ত কথা বলতে পারাটাই সংসারে শক্ত কাজ নয়! মানুষকে অপমান করায় নিজের মর্যাদাই আহত হয় সব চেয়ে বেশি। জীবনে এ যারা ভোলে তারা একটা বড় কথাই ভুলে থাকে। তা ছাড়া এমন ত হতে পারে ‘পথের দাবী’ এবং ‘শেষ প্রশ্ন’ এর সত্যিই খুব খারাপ লেগেছে। পৃথিবীতে সব বই সকলের জন্যে নয়,—সকলেরই ভাল লাগবে এবং প্রশংসা করতে হবে এমন ত কোন বাঁধা নিয়ম নেই। তবে, সেই কথাটা প্রকাশ করার ভঙ্গীটা ভালো হয়নি, এ আমি মানি। ভাষা অহেতুক রূঢ় এবং হিংস্র হয়ে উঠেছে, কিন্তু এইটেই ত রচনা-রীতির বড় সাধনা।

মনের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনার যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও যে ভদ্রব্যক্তির অসংযত ভাষা প্রয়োগ করা চলে না, এই কথাটাই অনেক দিনে অনেক দুঃখে আয়ত্ত করতে হয়। তোমার চিঠির মধ্যে এ ভুল তুমি তাঁর চেয়েও করেছো। এতবড় আত্ম-অবমাননা আর নেই।

ভাবে বোধ হয় তুমি অল্প দিনই কলেজ ছেড়েচো। লিখেচো তোমার সখীদেরও এমনি মনোভাব। যদি হয় সে দুঃখের কথা। এ লেখা যদি তোমার হাতে পড়ে তাঁদের দেখিয়ো। শীলতা মেয়েদের বড় ভূষণ, এ সম্পদ কারো জন্যে, কোন কিছুর জন্যেই তোমাদের ক্ষোয়ানো চলে না।

জানতে চেয়েছো আমি এ সকলের জবাব দিইনি কেন? এর উত্তর—আমার ইচ্ছে করে না, কারণ ও আমার কাজ নয়—আত্মরক্ষার ছলেও মানুষের অসম্মান করা আমার ধাতে পোষায় না। দেখো না লোকে বলে আমি পতিতাদের সমর্থন করি। সমর্থন আমি করিনে, শুধু অপমান করতেই মন চায় না। বলি, তারাও মানুষ, তাদেরও নালিশ জানাবার অধিকার আছে, এবং মহাকালের দরবারে এদের বিচারের দাবী একদিন তোলা রইলো। অথচ, সংস্কারের অন্ধতায় লোকে এ কথাটা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না।

কিন্তু এ-সব আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত কথা। আর না। তবে এ সম্বন্ধে আর একটা কথা বোধ হয় বলা ভালো। তোমরা হয়তো তখন ছোট, অধুনালুপ্ত একখানা মাসিক পত্রে তখন রবীন্দ্রনাথকে এবং তাঁর ভক্তশিষ্য বলে আমাকেও মাসের পর মাস আক্রমণ চলছে, গালি-গালাজ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের অবধি নেই—তার ভাষাও যেমন নিষ্ঠুর, অধ্যবসায়ও তেমনি দুর্দাম। কিন্তু কবি নীরব। আমি উত্ত্যক্ত হয়ে একদিন অভিযোগ করায় শান্তকণ্ঠে বলেছিলেন—উপায় কি! যে অস্ত্র নিয়ে ওরা লড়াই করে, সে অস্ত্র স্পর্শ করাও যে আমার চলে না। আর একদিন এমনিই কি একটা কথার উত্তরে বলেছিলেন—যাকে সুখ্যাতি করতে পারিনে, তার নিন্দে করতেও আমার লজ্জা বোধ হয়।

তাঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি—কিন্তু সব চেয়ে বড় এ দুটি আর ভুলিনি। আজ জীবনের পঞ্চান্ন বছর পার করে দিয়ে সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি যে আমি ঠকিনি। বরঞ্চ নিজের অজ্ঞাতসারে লাভের অঙ্কে অনেক জমা পড়েছে। মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছি, ভালবাসা পেয়েছি। বস্তুতঃ এই ত কালচার,—নইলে এর কি আর কোন মানে আছে? ভাষার দখল আমার যেটুকু আছে—হয়তো একটু আছেও—তাকে কি শেষকালে এই দুর্গতির মধ্যে টেনে নামাব?

এবার তোমার সাহিত্যের সম্বন্ধে বড় প্রশ্নটার উত্তর দিই।

তুমি সসঙ্কোচে প্রশ্ন করেছো, “অনেকে বলচেন আপনি ‘শেষ প্রশ্নে’ বিশেষ একটা মতবাদ প্রচার করবার চেষ্টা করেছেন,—একি সত্যি?”

সত্যি কিনা আমি বলবো না। কিন্তু ‘প্রচার করলে, প্রচার করলে—দুয়ো দুয়ো’ বলে রব তুলে দিলেই যারা লজ্জায় অধোবদন হয়, এবং না না বলে তারস্বরে প্রতিবাদ করতে থাকে আমি তাদের দলে নই। অথচ, উলটে যদি আমিই জিজ্ঞাসা করি এতে অতবড় অপরাধটা হলো কিসে, আমার বিশ্বাস বাদী-প্রতিবাদী কেউ তার সুনিশ্চিত জবাব দিতে পারবে না। তখন একপক্ষ বে-বুঝের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে কেবলই বলতে থাকবে—ও হয় না—ও হয় না। ওতে art for art’s sake নীতি জাহান্নমে যায়। আর অপর পক্ষের অবস্থাটা হবে আমাদের হরির মত।

গল্পটা বলি। আমার এক দূর সম্পর্কের ভগ্নীর বছর-চারেকের একটি ছেলের নাম হরি,—সাক্ষাৎ শয়তান। মারধর গালিগালাজ, একপায়ে কোণে দাঁড় করিয়ে দেওয়া—কোন উপায়েই তার মা তাকে শাসন করতে পারলে না। বাড়িসুদ্ধ লোকে যখন একপ্রকার হার মেনেছে, তখন ফন্দিটা হঠাৎ কে যে আবিষ্কার করলে জানিনে, কিন্তু হরিবাবু একেবারে শায়েস্তা হয়ে গেল। শুধু বলতে হোতো এবার পাড়ার পাঁচজন ভদ্রলোক ডেকে এনে ওকে অপমান করো। অপমানের ধারণা তার কি ছিল সেই জানে,কিন্তু ভয়ে যেন শীর্ণকায় হয়ে উঠতো।এদেরও দেখি তাই। একবার বললে হোলো—প্রচার করেছে। Art for art’s sake হয়নি। কিন্তু কি প্রচার করেচি, কোথায় করেচি, কি তার দোষ, কোন্‌ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল—এ সব প্রশ্নই অবৈধ। তখন কেউবা দিতে লাগলো গালাগালি, কেউবা জোড় হাতে ভগবানের আরাধনায় লেগে গেল—”রূপকার যদি সংস্কারক হয়ে ওঠেন,তবে হে ভগবান ইত্যাদি ইত্যাদি”। ওরা বোধ হয় ভাবেন অনুপ্রাসটাই যুক্তি এবং গালিগালাজটাই সমালোচনা। তাঁদের এ কথা বলা চলবে না যে, জগতের যা’ চিরস্মরণীয় কাব্য ও সাহিত্য, তাতেও কোন না কোন রূপে এ বস্তু আছে। রামায়ণে আছে, মহাভারতে আছে, কালিদাসের কাব্যগ্রন্থে আছে,আনন্দমঠ, দেবীচৌধুরাণীতে আছে, ইবসেন-মেটারলিঙ্ক-টলস্টয়ে আছে, হামসুন-বোয়ার-ওয়েলসে আছে। কিন্তু তাতে কি? পশ্চিম থেকে বুলি আমদানি হয়েছে যে art for art’s sake—এ সব যেন ওদের নখাগ্রে! গল্পের গল্পত্বই মাটি, কারণ চিত্ত-রঞ্জন হোলো না যে! কার চিত্ত-রঞ্জন? না আমার! গাঁয়ের মধ্যে প্রধান কে? না, আমি আর মামা।

তুমি ‘চিত্ত-রঞ্জন’ কথাটা নিয়ে অনেক লিখেচো কিন্তু এটা একবার ভেবে দেখোনি যে ওটা দু’টো শব্দ। শুধু ‘রঞ্জন’ নয়, ‘চিত্ত’ বলেও একটা বস্তু রয়েছে! ও পদার্থটা বদলায়। চিৎপুরের দপ্তরীখানায় ‘গোলেবকাওলির’ স্থান আছে। ও অঞ্চলে চিত্ত-রঞ্জনের দাবী সে রাখে, কিন্তু সেই দাবীর জোরে বার্‌নার্ড শ’কে গাল দেবার তার অধিকার জন্মায় না।স্বীকার করি যে, বুলি আওড়ানোর মোহ আছে, ব্যবহারে আনন্দ আছে, পণ্ডিতের মতো দেখতেও হয়, কিন্তু উপলব্ধি করার জন্যে দুঃখ স্বীকার করতে হয়। অমুক for অমুক sake বললেই সকল কথার তত্ত্ব নিরূপণ করা হয় না।

নানা কারণে ‘পথের দাবী’ রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগেনি। সে কথা জানিয়েও চিঠির শেষের দিকে লিখেছিলেন,“এ বই প্রবন্ধের আকারে লিখিলে মূল্য ইহার সামান্যই থাকিত, কিন্তু গল্পের মধ্যে দিয়া যাহা বলিয়াছ দেশে ও কালে ইহার ব্যাপ্তির বিরাম রহিবে না”। সুতরাং কবি যদি একে গল্পের বই মনে করে থাকেন ত এটা গল্পের-ই বই। অন্ততঃ, এটুকু সম্মান তাঁকে দিয়ো।

উপসংহারে তোমাকে একটা কথা বলি। সমাজ-সংস্কারের কোন দুরভিসন্ধি আমার নাই। তাই, বইয়ের মধ্যে আমার মানুষের দুঃখ-বেদনার বিবরণ আছে, সমস্যাও হয়ত আছে, কিন্তু সমাধান নেই। ও কাজ অপরের, আমি শুধু গল্প লেখক, তাছাড়া আর কিছুই নই।

একটা মিনতি। তুমি অপরিচিতা, বয়সে হয়তো অনেক ছোট। আমি সরল মনে তোমার নানা প্রশ্নের দুই-একটার জবাব যথাশক্তি দিতে চেয়েছি। তবু, অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু’-একস্থানে কঠিন যদি কিছু লিখে থাকি রাগ কোরো না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ‘সুমন্দ ভবনে’র শ্রীমতী…সেনকে লিখিত পত্র। বিজলী, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ১৩শ সংখ্যা হইতে গৃহীত।