পূবের হাওয়া১
(ঝড় : পূর্ব-তরঙ্গ)
আমি ঝড় পশ্চিমের প্রলয়-পথিক–
অসহ যৌবন-দাহে লেলিহান-শিখ
দারুণ দাবাগ্নি-সম নৃত্য-ছায়ানটে
মাতিয়া ছুটিতেছিনু, চলার দাপটে
ব্রহ্মাণ্ড ভণ্ডুল করি। অগ্রে সহচরী
ঘূর্ণা-হাতছানি দিয়া চলে ঘূর্ণি-পরী
গ্রীষ্মের গজল গেয়ে পিলু-বারোয়াঁয়
উশীরের তার-বাঁধা প্রান্তর-বীণায়।
করতালি-ঠেকা দেয় মত্ত তালিবন
কাহারবা-দ্রুততালে।–আমি উচাটন
মন্মথ-উম্মদ আঁখি রাগরক্ত ঘোর
ঘূর্ণিয়া পশ্চাতে ছুটি, প্রমত্ত চকোর
প্রথম-কামনা-ভিতু চকোরিণী পানে
ধায় যেন দুরন্ত বাসনা-বেগ-টানে।
সহসা শুনিনু কার বিদায়-মন্থর
শ্রান্ত শ্লথ গতি-ব্যথা, পাতা-থরথর
পথিক-পদাঙ্ক-আঁকা পুব-পথ-শেষে।
দিগন্তের পর্দা ঠেলি হিম-মরু-দেশে
মাগিছে বিদায় মোর প্রিয়া ঘূর্ণি-পরী,
দিগন্ত ঝাপসা তার অশ্রুহিমে ভরি।
গোলে-বকৌলির দেশে মেরু-পরিস্থানে
মিশে গেল হাওয়া-পরী। অযথা সন্ধানে
দিক্চক্ররেখা ধরি কেঁদে কেঁদে চলি
শ্রান্ত অশ্বশ্বসা-গতি। চম্পা-একাবলী
ছিন্ন ম্লান ছেয়ে আছে দিগন্ত ব্যাপিয়া,—
সেই চম্পা চোখে চাপি ডাকি, ‘পিয়া পিয়া’!
বিদায়-দিগন্ত ছানি নীল হলাহল
আকণ্ঠ লইনু পিয়া, তরল গরল –
সাগরে ডুবিল মোর আলোক-কমলা,
আঁখি মোর ঢুলে আসে – শেষ হল চলা!
জাগিলাম জন্মান্তর-জাগরণ-পারে
যেন কোন্ দাহ-অন্ত ছায়া-পারাবারে
বিচ্ছেদ-বিশীর্ণ তনু, শীতল-শিহর!
প্রতি রোমকূপে মোর কাঁপে থরথর।
কাজল-সুস্নিগ্ধ কার অঙ্গুলি-পরশ
বুলায় নয়ন মোর, দুলায়ে অবশ
ভার-শ্লথ তনু মোর ডাকে – ‘জাগো পিয়া।
জাগো রে সুন্দর মোরি রাজা শাঁবলিয়া।’
জল-নীলা ইন্দ্রনীলকান্তমণি-শ্যামা
এ কোন মোহিনী তন্বী জাদুকরী বামা
জাগাল উদয়-দেশে নব মন্ত্র দিয়া
ভয়াল-আমারে ডাকি –‘হে সুন্দর পিয়া!’
–আমি ঝড় বিশ্ব-ত্রাস মহামৃত্যুক্ষুধা,
ত্র্যম্বকের ছিন্নজটা–ওগো এত সুধা,
কোথা ছিল অগ্নিকুণ্ড মোর দাবদাহে?
এত প্রেমতৃষা সাধ গরল প্রবাহে?–
আবার ডাকিল শ্যামা, ‘জাগো মোরি পিয়া!’
এতক্ষণ আপনার পানে নিরখিয়া
হেরিলাম আমি ঝড় অনন্ত সুন্দর
পুরুষ-কেশরী বীর! প্রলয়কেশর
স্কন্ধে মোর পৌরুষের প্রকাশে মহিমা!
চোখে মোর ভাস্বরের দীপ্তি-অরুণিমা
ঠিকরে প্রদীপ্ত তেজে! মুক্ত ঝোড়ো কেশে
বিশ্বলক্ষ্মী মালা তার বেঁধে দেন হেসে!
এ কথা হয়নি মনে আগে,–আমি বীর
পরুষ পুরুষ-সিংহ, জয়লক্ষ্মী-শ্রীর
স্নেহের দুলাল আমি; আমারেও নারী
ভালোবাসে, ভালোবাসে রক্ত-তরবারি
ফুল-মালা চেয়ে! চাহে তারা নর
অটল-পৌরুষ বীর্যবন্ত শক্তিধর!
জানিনু যেদিন আমি এ সত্য মহান –
হাসিল সেদিন মোর মুখে ভগবান
মদনমোহন-রূপে! সেই সে প্রথম
হেরিনু, সুন্দর আমি সৃষ্টি-অনুপম!