দুটি কথা

সে আজ বন্দী। তার সত্য-মুক্ত প্রাণ যে ভৈরব-রুদ্র-ছায়ানটের হিল্লোলে নৃত্য-পাগল ছন্দে এক অভিনব সৃষ্টি-রচনা করে গেল, – সে আজ মুক্ত। কোনো রাজ-শক্তির ভ্রুকুটি সে মানে না, কোনো লৌহ-নিগড় কোনোদিন তারে বাঁধতে পারে না – সে আপনার তালে নেচে চলে, আর পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে যায় কত রক্ত-নয়ন, কত শাসন-বচন, কত শাস্তি-রচন। সে যে প্রলয়ানন্দে-ভরা রুদ্রনটের নৃত্য, ছন্দ যে তার কাল-বৈশাখীর নর্তনের মতো এলোমেলো, সুর যে তার সৃষ্টির ব্যথা-গৌরব ভরা। সুর আজ স্বেচ্ছাচারী, সুর-রাজ বন্দী।

সে আজ বন্দী। তবু সে একদিন যুগযুগান্ত-সঞ্চিত রুদ্ধহিমানীর বুকে অগ্নিকণা এনে দিয়েছিল, তার রুদ্র-বীণে কোন্ সর্বভুক দেবতা তার চিরমন্দির গড়ে নিল, আর সেই অগ্নি-বীণে তার দিবস-নিশার দহন-আলোয় আপন অন্তরে তার চিরবাসরের চিতা রচনা করে নিল, – সবার আড়ালে, সবার গোপনে, সবার উপরে – মানবের হাসি-কান্না, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বহু বহু দূরে; – সেখানে বসে সে তার অন্তর-অলকায় যে গাথা গেয়ে চলেছে তাতে বন্ধনের কৃষ্ণ রেখা নেই, দুর্বল কম্পিত হিয়ার ক্ষীণ রাগিণী নেই – সেখানে সে আর তার অন্তর-দেবতা, নিখিল নরনারী বাইরে দাঁড়িয়ে রুদ্ধ দুয়ার দেখে ফিরে আসে শুধু।

সে আজ বন্দী। রাজার দেওয়া লৌহ-নিগড়ে তার অন্তরের বিদ্রোহী-বীর কোন দেবতার আশিস-নির্মাল্য দেখতে পেল, তাই সাদরে বরণ করে নিল তাকে আপনার গলে। তারপর একদিন যখন বাংলার যুবক আবার জলদমন্দ্রে বাধা-বন্ধহারা হয়ে স্বাধীনচিত্ত ভরে বাংলার চিরশ্যামল চির-অমলিন মাতৃমূর্তি উন্মাদ আনন্দে বক্ষে টেনে নেবে, সেই শুভ আরতিলগ্নে ইমনকল্যাণ সুরে যে নহবতের রাগিণী বেজে উঠবে, তাতে হে কবি, তোমার প্রেম-বৈভব-গাথা – তোমার অন্তর-বহ্নি-ব্যথা সন্ধ্যা-রাগ-রক্তে আপনি বেজে উঠবে; জননীর শ্যামবক্ষে তোমার স্মৃতি ব্যথা-ভারাতুর হয়ে সকল পূজার মাঝে বারে বারে তোমাকেই স্মরণ করিয়ে দেবে, – হে কবি, সে আজ নয়। ইতি

শ্রীপবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়।