» » ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণে

বর্ণাকার

ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণে1

অকস্মাৎ মধ্যদিনে গান বন্ধ ক’রে দিল পাখি,

ছিন্নভিন্ন সন্ধ্যাবেলা প্রাত্যহিক মিলনের রাখী;

ঘরে ঘরে অনেকেই নিঃসঙ্গ একাকী।

ক্লাব উঠে গিয়েছে সফরে,

শূন্য ঘর, শূন্য মাঠ,

ফুল ফোটা মালঞ্চ প’ড়ে

ত্যক্ত এ ক্লাবের কক্ষে নিষ্প্রদীপ অন্ধকার নামে।

সূর্য অস্ত গিয়েছে কখন্,

কারো আজ দেখা নেই—

কোথাও বন্ধুর দল ছড়ায় না হাসি,

নিষ্প্রভ ভোজের স্বপ্ন;

একটি কথাও শব্দ তোলে না বাতাসে—

ক্লাব-ঘরে ধুলো জমে,

বিনা গল্পে সন্ধ্যা হয়;

চাঁদ ওঠে উন্মুক্ত আকাশে।

খেলোয়াড় খেলে নাকো,

গায়কেরা গায় নাকো গান—

বক্তারা বলে না কথা,

সাঁতারুর বন্ধ আজ স্নান।

সর্বস্ব নিয়েছে গোরা তারা মারে ঊরুতে চাপড়,

যে পথে এ ক্লাব গেছে কে জানে সে পথের খবর?

সন্ধ্যার আভাস আসে,

জ্বলে না আলোক ক্লাব কক্ষের কোলে,

হাতে হাতে নেই সিগারেট—

তর্কাতর্কি হয় নাকো বিভক্ত দু’দলে;

অযথা সন্ধ্যায় কোন অচেনার পদশব্দে

মালীটা হাঁকে না।

মনে পড়ে লেকের সে পথ?

মনে পড়ে সন্ধ্যাবেলা হাওয়ার চাবুক?

অনেক উজ্জ্বল দৃশ্য এই লেকে

করেছিল উৎসাহিত বুক।

কেরানী, বেকার, ছাত্র, অধ্যাপক, শিল্পী ও ডাক্তার

সকলের কাছে ছিল অবারিত দ্বার,

কাজের গহ্বর থেকে পাখিদের মতো এরা নীড়

সন্ধানে, সন্ধ্যায় ডেকে এনেছিল এইখানে ভিড়।

রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সিনেমার কথা,

এদের রসনা থেকে প্রত্যহ স্খলিত হ’ত অলক্ষে অযথা;

মাঝে মাঝে অনর্থক উচ্ছ্বসিত হাসি,

বাতাসে ছড়াত নিত্য শব্দ রাশি রাশি।

তারপর অকস্মাৎ ভেঙে গেল রুদ্ধশ্বাস মন্ত্রমুগ্ধ সভা,

সহসা চৈতন্যোদয়; প্রত্যেকের বুকে ফোটে ক্ষুব্ধ রক্তজবা

সমস্ত গানের শেষে যেন ভেঙে গেল এক গানের আসর,

যেমন রাত্রির শেষে নিঃশেষে কাঙাল হয় বিবাহ-বাসর।

‘জীবন-রক্ষক’ এই সমাজের দারুণ অভাবে,

এদের ‘জীবন-রক্ষা’ হয়তো কঠিন হবে,

হয়তো অনেক প্রাণ যাবে॥

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ‘ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণ উপলক্ষে শোকোচ্ছ্বাস (শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-কে)’ — এই শিরোনামায় কবিতাটি লেখা হয়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার লেক অঞ্চলের ‘ইণ্ডিয়ান লাইফ সেভিং সোসাইটি’র সদস্য ছিলেন শ্রীশচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। লেকে যুদ্ধকালীন মিলিটারী ক্যাম্প হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলে সুকান্ত এই কবিতাটি লিখেছিলেন।