প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য

চণ্ডীগড় : গ্রাম্যপথ

[বেলা অপরাহ্নপ্রায়। চণ্ডীগড়ের সঙ্কীর্ণ গ্রাম্যপথের ’পরে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া নামিয়া আসিতেছে। অদূরে বীজগাঁ’র জমিদারী কাছারিবাটীর ফটকের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। জন-দুই পথিক দ্রুতপদে চলিয়া গেল; তাহাদেরই পিছনে একজন কৃষক মাঠের কর্ম শেষ করিয়া গৃহে ফিরিতেছিল, তাহার বাঁ কাঁধে লাঙ্গল, ডান হাতে ছড়ি, অগ্রবর্তী অদৃশ্য বলদযুগলের উদ্দেশে হাঁকিয়া বলিতে বলিতে গেল, “ধলা, সিধে চ’ বাবা, সিধে চল্! কেলো, আবার আবার! আবার পরের গাছপালায় মুখ দেয়!”

কাছারির গোমস্তা এককড়ি নন্দী ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল এবং উৎকণ্ঠিত শঙ্কায় পথের একদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় গলা বাড়াইয়া কিছু একটা দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। তাহার পিছনের পথ দিয়া দ্রুতপথে বিশ্বম্ভর প্রবেশ করিল। সে কাছারির বড় পিয়াদা, তাগাদায় গিয়াছিল, অকস্মাৎ সংবাদ পাইয়াছে বীরগাঁ’র নবীন জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী চণ্ডীগড়ে আসিতেছেন। ক্রোশ-দুই দূরে তাঁহার পাল্‌কি নামাইয়া বাহকেরা ক্ষণকালের জন্য বিশ্রাম লইতেছিল, আসিয়া পড়িল বলিয়া।]

বিশ্বম্ভর। নন্দীমশাই, দাঁড়িয়ে করতেছ কি? হুজুর আসছেন যে!

এককড়ি। (চমকিয়া মুখ ফিরাইল। এ দুঃসংবাদ ঘণ্টা-খানেক পূর্বে তাহার কানে পৌঁছিয়াছে। উদাস-কণ্ঠে কহিল) হুঁ।

বিশ্বম্ভর। হুঁ কি গো? স্বয়ং হুজুর আসছেন যে!

এককড়ি। (বিকৃত-স্বরে) আসছেন ত আমি করব কি? খবর নেই, এত্তালা নেই—হুজুর আসছেন। হুজুর বলে ত আর মাথা কেটে নিতে পারবে না!

বিশ্বম্ভর। (এই আকস্মিক উত্তেজনার অর্থ উপলব্ধি না করিতে পারিয়া একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া শুধু কহিল) আরে, তুমি কি মরিয়া হয়ে গেলে নাকি?

এককড়ি। মরিয়া কিসের! মামার বিষয় পেয়েছে বৈ ত কেউ আর বাপের বিষয় বলবে না! তুই জানিস বিশু, কালীমোহনবাবু ওকে দূর করে দিয়েছিল, বাড়ি ঢুকতে পর্যন্ত দিত না। তেজ্যপুত্তুরের সমস্ত ঠিকঠাক, হঠাৎ খামকা মরে গেল বলেই ত জমিদার! নইলে থাকতেন আজ কোথায়? আমি জানি নে কি?

বিশ্বম্ভর। কিন্তু জেনে সুবিধেটা কি হচ্চে শুনি? এ মামা নয়, ভাগ্নে। ও-কথা ঘুণাগ্রে কানে গেলে ভিটেয় তোমার সন্ধ্যে দিতেও কাউকে বাকি রাখবে না। ধরবে আর দুম করে গুলি করে মারবে। এমন কত গণ্ডা এরই মধ্যে মেরে পুঁতে ফেলেছে জানো? ভয়ে কেউ কথাটি পর্যন্ত কয় না।

এককড়ি। হাঁঃ—কথা কয় না! মগের মুল্লুক কিনা!

বিশ্বম্ভর। আরে মাতাল যে! তার কি হুঁশ পবন আছে, না দয়া-মায়া আছে! বন্দুক-পিস্তল-ছুরি-ছোরা ছাড়া এক পা কোথাও ফেলে না। মেরে ফেললে তখন করবে কি শুনি?

এককড়ি। তুই ত সেদিন সদরে গিয়েছিলি—দেখেচিস তাকে?

বিশ্বম্ভর। না, ঠিক দেখিনি বটে, তবে সে দেখাই। ইয়া গালপাট্টা, ইয়া গোঁফ, ইয়া বুকের ছাতি, জবাফুলের মত চোখ ভাঁটার মত বন্‌বন্‌ করে ঘুরচে—

এককড়ি। বিশু, তবে পালাই চ’।

বিশ্বম্ভর। আরে পালিয়ে ক’দিন তার কাছে বাঁচবে নন্দীমশাই? চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে এনে খাল খুঁড়ে পুঁতে ফেলবে।

এককড়ি। কি তবে হবে বল? মাতালটা যদি বলে বসে শান্তিকুঞ্জেই থাকব?

বিশ্বম্ভর। কতবার ত বলেছি নন্দীমশাই, এ কাজ করো না, করো না, করো না। বছরের পর বছর খাতায় কেবল শান্তিকুঞ্জের মিথ্যে মেরামতি খরচই লিখে গেলে, গরীবের কথায় ত আর কান দিলে না।

এককড়ি। তুইও ত কাছারির বড় সর্দার, তুইও ত—

বিশ্বম্ভর। দেখ, ও-সব শয়তানি ফন্দি করো না বলচি! আমার ওপর দোষ চাপিয়েছ কি—ওগো, ওই যে একটা পালকি দেখা যায়! [নেপথ্যে বাহকদিগের কণ্ঠধ্বনি শুনা গেল। বিশ্বম্ভর পলায়নোদ্যত এককড়ির হাতটা ধরিয়া ফেলিতেই সে নিজেকে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিতে করিতে]

এককড়ি। ছাড়্‌না হারামজাদা।

বিশ্বম্ভর। (অনুচ্চ চাপাকণ্ঠে) পালাচ্চো কোথায়? ধরলে গুলি করে মারবে যে!

[এমনি সময় পালকি সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইতে উভয়ে স্থির হইয়া দাঁড়াইল। পালকির অভ্যন্তরে জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী বসিয়াছিলেন, তিনি ঈষৎ একটুখানি মুখ বাহির করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন]

জীবানন্দ। ওহে, এ গ্রামে জমিদারের কাছারি বাড়িটা কোথায় তোমরা কেউ বলে দিতে পার?

এককড়ি। (করজোড়ে) সমস্তই ত হুজুরের রাজ্য।

জীবানন্দ। রাজ্যের খবর জানতে চাইনি। কাছারিটার খবর জানো?

এককড়ি। জানি হুজুর। ওই যে।

জীবানন্দ। তুমি কে?

[এককড়ি ও বিশ্বম্ভর উভয়ে হাঁটু গাড়িয়া ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল]

এককড়ি। হুজুরের নফর এককড়ি নন্দী।

জীবানন্দ। ওহো, তুমিই এককড়ি—চণ্ডীগড়-সাম্রাজ্যের বড়কর্তা? কিন্তু দেখ এককড়ি, একটা কথা বলে রাখি তোমাকে। চাটুবাক্য অপছন্দ করিনে সত্যি, কিন্তু তার একটা কাণ্ডজ্ঞান থাকাটাও পছন্দ করি! এটা ভুলো না। তোমার কাছারির তসিল কত?

এককড়ি। আজ্ঞে, চণ্ডীগড় তালুকের আয় প্রায় হাজার-পাঁচেক টাকা।

জীবানন্দ। হাজার-পাঁচেক?—বেশ।

[বাহকেরা পালকি নীচে নামাইল। জীবানন্দ অবতরণ করিলেন না, শুধু পা-দুটা বাহির করিয়া ভূমিতলে রাখিয়া সোজা হইয়া বসিয়া কহিলেন]

বেশ। আমি এখানে দিন পাঁচ-ছয় আছি, কিন্তু এরই মধ্যে আমার হাজার-দশেক টাকা চাই এককড়ি। তুমি সমস্ত প্রজাদের খবর দাও যেন কাল তারা এসে কাছারিতে হাজির হয়।

এককড়ি। যে আজ্ঞে। হুজুরের আদেশে কেউ গরহাজির থাকবে না।

জীবানন্দ। এ গাঁয়ে দুষ্টু বজ্জাত প্রজা কেউ আছে জানো?

এককড়ি। আজ্ঞে, না তা এমন কেউ—শুধু তারাদাস চক্কোত্তি—তা সে আবার হুজুরের প্রজা নয়।

জীবানন্দ। তারাদাসটা কে?

এককড়ি। গড়চণ্ডীর সেবায়েত।

জীবানন্দ। এই লোকটাই কি বছর-দুই পূর্বে একটা প্রজা-উৎখাতের মামলায় মামার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল?

এককড়ি। (মাথা নাড়িয়া) হুজুরের নজর থেকে কিছুই এড়ায় না। আজ্ঞে, এই সেই তারাদাস।

জীবানন্দ। হুঁ। সেবার অনেক টাকার ফেরে ফেলে দিয়েছিল। এ কতখানি জমি ভোগ করে?

এককড়ি। (মনে মনে হিসাব করিয়া) ষাট-সত্তর বিঘের কম নয়।

জীবানন্দ। একে তুমি আজই কাছারিতে ডেকে আনিয়ে জানিয়ে দাও যে, বিঘেপ্রতি আমার দশ টাকা নজর চাই।

এককড়ি। (সঙ্কুচিত হইয়া) আজ্ঞে, সে যে নিষ্কর দেবোত্তর, হুজুর।

জীবানন্দ। না, দেবোত্তর এ গাঁয়ে একফোঁটা নেই। সেলামি না পেলে সমস্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।

এককড়ি। আজই তাকে হুকুম জানাচ্ছি।

জীবানন্দ। শুধু হুকুম জানানো নয়, টাকা তাকে দু’দিনের মধ্যে দিতে হবে।

এককড়ি। কিন্তু হুজুর—

জীবানন্দ। কিন্তু থাক এককড়ি। এই সোজা বারুইয়ের তীরে আমার শান্তিকুঞ্জ, না? —মহাবীর, পালকি তুলতে বল।

[বাহকেরা পালকি লইয়া প্রস্থান করিল

এককড়ি। যা ভেবেচি তাই যে ঘটল রে বিশু! এ যে গিয়ে সোজা শান্তিকুঞ্জেই ঢুকতে চায়।

বিশ্বম্ভর। নয় ত কি তোমার কাছারির খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকতে চাইবে?

এককড়ি। সেখানে হয়ত ঢোকবার পথ নেই। হয়ত দোর-জানালা সব চোরে চুরি করে নিয়ে গেছে, হয়ত বা ঘরে ঘরে বাঘ-ভালুকে বসবাস করে আছে—সেখানে কি যে আছে আর কি যে নেই, কিছুই যে জানিনে বিশ্বম্ভর।

বিশ্বম্ভর। আমি কি জানি নাকি তোমার দোর-জানালার খবর? আর বাঘ-ভালুকের কাছে ত আমি খাজনা আদায়ে যাইনি গো!

এককড়ি। এই রাত্তিরে কোথায় আলো, কোথায় লোকজন, কোথায় খাবার-দাবার—

বিশ্বম্ভর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদলে লোকজন জুটতে পারে, কিন্তু আলো আর খাবার-দাবার—

এককড়ি। তোর কি! তুই ত বলবিই রে নচ্ছার পাজী ব্যাটা হারামজাদা—

[প্রস্থান