মা বললেন, ভালো মেয়ে তুই সদু, এলি কি করে? নালাটা ত জলে জলমগ্ন হয়েছে দেখে এলুম। সেই গাছটার ওপর দিয়ে বুঝি হেঁটে এলি? পড়ে মরতে পারলি নে?

না মা; সে পুণ্য থাকলে আর এ গল্প লেখবার দরকার হবে কেন?

তার পরদিন নরেন মামার সঙ্গে দেখা করতে এল। আমি সেইখানেই বসেছিলুম, তার পানে চাইতে পারলুম না, কিন্তু আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। ইচ্ছে হ’ল ছুটে পালাই, কিন্তু ঘরের পাকা মেঝে যে চোরাবালির মত আমার পা দুটোকে একটু একটু করে গিলতে লাগল, আমি নড়তেও পারলুম না, মুখ তুলে দেখতেও পারলুম না।

 

নরেনের যে কি অসুখ হ’ল, তা শয়তানই জানে, অনেকদিন পর্যন্ত আর সে কলকাতায় গেল না। রোজই দেখা হতে লাগল। মা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে আমাকে আড়ালে ডেকে পাঠিয়ে বলতে লাগলেন, ওদের পুরুষমানুষদের লেখাপড়ার কথাবার্তা হয়, তুই তার মধ্যে হাঁ করে বসে কি শুনিস বল ত? যা, বাড়ির ভেতরে যা। এতবড় মেয়ের যদি লজ্জা-শরম একটুকু আছে!

এক-পা এক-পা করে আমার ঘরে চলে যেতুম, কিন্তু কোন কাজে মন দিতে পারতুম না। যতক্ষণ সে থাকত তার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর অবিশ্রাম বাইরের পানেই আমাকে টানতে থাকত।

 

আমার মামা আর যাই হোন, তাঁর মনটা প্যাঁচালো ছিল না। তা ছাড়া, লিখে পড়ে তর্ক করে ভগবানকে উড়িয়ে দেবার ফন্দিতেই সমস্ত অন্তঃকরণটা তাঁর এমনি অনুক্ষণ ব্যস্ত হয়ে থাকত যে, তাঁর নাকের ডগায় কি যে ঘটচে তা দেখতে পেতেন না। আমি এই বড় একটা মজা দেখেচি, জগতের সবচেয়ে নামজাদা নাস্তিকগুলোই হচ্চে সবচেয়ে নিরেট বোকা। ভগবানের যে লীলার অন্ত নেই। তিনি যে এই ‘না’ রূপেই তাদের পনরো আনা মন ভরে থাকেন, এ তারা টেরই পায় না। সপ্রমাণ হোক, অপ্রমাণ হোক, তাঁর ভাবনাতে সারাদিন কাটিয়ে দিয়ে বলে, সংসারের মানুষগুলো কি বোকা! তারা সকাল-সন্ধ্যায় বসে মাঝে মাঝে ভগবানের চিন্তা করে। আমার মামারও ছিল সেই দশা। তিনি কিছুই দেখতে পেতেন না। কিন্তু মা ত তা নয়। তিনি যে আমারই মত মেয়েমানুষ। তাঁর দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া ত সহজ ছিল না! আমি নিশ্চয় জানি, মা আমাদের সন্দেহ করেছিলেন।

আর সামাজিক বাধা আমাদের দু’জনের মধ্যে যে কত বড় ছিল, এ শুধু যে তিনিই জানতেন, আমি জানতুম না, তা নয়। ভাবলেই আমার বুকের সমস্ত রস শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠত, তাই ভাবনার এই বিশ্রী দিকটাকে আমি দু’হাতে ঠেলে রাখতুম। কিন্তু শত্রুর বদলে যে বন্ধুকেই ঠেলে ফেলেচি, তাও টের পেতুম। কিন্তু হলে কি হয়? যে মাতাল একবার কড়া-মদ খেতে শিখেচে, জল দেওয়া মদে আর তার মন ওঠে না। নির্জলা বিষের আগুনে কল্‌জে পুড়িয়ে তোলাতেই যে তখন তার মস্ত সুখ।

আর একটা জিনিস আমি কিছুতেই ভুলতে পারতুম না। সেটা মজুমদারদের ঐশ্বর্যের চেহারা। ছেলেবেলা মায়ের সঙ্গে কতদিনই ত তাদের বাড়িতে বেড়াতে গেছি। সেই সব ঘরদোর, ছবি-দেয়ালগিরি, আলমারি, সিন্দুক, আসবাবপত্রের সঙ্গে কোন্‌ একটা ভাবী ছোট একতলা শ্বশুরবাড়ির কদাকার মূর্তি কল্পনা করে মনে মনে আমি যেন শিউরে উঠতুম।

 

মাস-খানেক পরে একদিন সকালবেলা নদী থেকে স্নান করে বাড়িতে পা দিয়েই দেখি, বারান্দার ওপর একজন প্রৌঢ়-গোছের বিধবা স্ত্রীলোক মায়ের কাছে বসে গল্প করচে। আমাকে দেখে মাকে জিজ্ঞাসা করলে, এইটি বুঝি মেয়ে?

মা ঘাড় নেড়ে বললেন, হাঁ মা, এই আমার মেয়ে। বাড়ন্ত গড়ন, নইলে—

স্ত্রীলোকটি হেসে বললে, তা হোক, ছেলেটির বয়সও প্রায় ত্রিশ, দু’জনের মানাবে ভাল। আর ঐ শুনতেই দোজবরে, নইলে যেন কার্তিক।

আমি দ্রুতপদে ঘরে চলে গেলুম। বুঝলুম, ইনি ঘটকঠাকরুন, আমার সম্বন্ধ এনেছেন।

মা চেঁচিয়ে বললেন, কাপড় ছেড়ে একবার এসে বস মা।

কাপড় ছাড়া চুলোয় গেল, ভিজে কাপড়েই দোরের আড়ালে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে লাগলুম। বুকের কাঁপুনি যেন আর থামতে চায় না। শুনতে পেলুম, চিতোর গ্রামের কে একজন রাধাবিনোদ মুখুয্যের ছেলে ঘনশ্যাম। পোড়াকপালে নাকি অনেক দুঃখ ছিল, তাই আজ যে নাম জপের মন্ত্র, সে নাম শুনে সেদিন গা জ্বলে যাবে কেন?

শুনলুম, বাপ নেই, কিন্তু মা আছেন। ছোট দু’টি ভাই, এক ভায়ের বিয়ে হয়েছে, একটি এখনও পড়ে। সংসার বড়রই ঘাড়ে, তাই এনট্রান্স পাশ করেই রোজগারের ধান্দায় পড়া ছাড়তে হয়েছে। ধান, চাল, তিসি, পাট প্রভৃতির দালালি করে উপায় মন্দ করেন না। তাঁরই উপর সমস্ত নির্ভর। তা ছাড়া ঘরে নারায়ণ-শিলা আছেন, দুটো গরু আছে, বিধবা বোন আছে—নেই কি?

নেই শুধু সংসারের বড়বৌ! সাত বছর আগে বিয়ের একমাসের মধ্যেই তিনি মারা যান, তারপর এতদিন বাদে এই চেষ্টা। সাত বছর! ঘটকীকে উদ্দেশ করে মনে মনে বললুম, পোড়ারমুখী, এতদিন কি তুই শুধু আমার মাথা খেতেই চোখ বুজে ঘুমুচ্ছিলি?

মায়ের ডাকাডাকিতে কাপড় ছেড়ে কাছে এসে বসলুম। সে আমাকে খুঁটিয়ে দেখে বললে, মেয়ে পছন্দ হয়েচে, এখন দিন স্থির করলেই হ’ল। মায়ের চোখ দুটিতে জল টলটল করতে লাগল, বললেন, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক মা, আর কি বলব!

 

মামা শুনে বললেন, এনট্রান্স? তবে বলে পাঠা, এখন বছর-দুই সদুর কাছে ইংরিজী পড়ে যাক, তবে বিয়ের কথা কওয়া যাবে।

মা বললেন, তোমার পায়ে পড়ি দাদা, অমত ক’রো না, এমন সুবিধে আর পাওয়া যাবে না। দিতে-থুতে কিছু হবে না—

মামা বললেন, তা হলে হাত-পা বেঁধে গঙ্গায় দিগে যা, সেও এক পয়সা চাইবে না।

মা বললেন, পনরয় পা দিলে যে—

মামা বললেন, তা ত দেবেই; পনর বছর বেঁচে রয়েছে যে!

মা রাগে-দুঃখে কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললেন, তুমি কি ওর তবে বিয়ে দেবে না দাদা? এর পরে একেবারেই পাত্র জুটবে না।

মামা বললেন, সেই ভয়ে ত আগে থেকে ওকে জলে ফেলে দিতে পারা যায় না!

মা বললেন, ছেলেটিকে একবার নিজের চোখে দেখে এস না দাদা, পছন্দ না হয়, না দেবে।

মামা বললেন, সে ভাল কথা। রবিবার যাব বলে চিঠি লিখে দিচ্চি।

ভাঙচির ভয়ে কথাটা মা গোপনে রেখেছিলেন এবং মামাকেও সাবধান করে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন না, এমন চোখ-কানও ছিল, যাকে কোন সতর্কতা ফাঁকি দিতে পারে না।

 

বাগানে একটুকরো শাকের ক্ষেত করেছিলুম। দিন-দুই পরে দুপুরবেলা একটা ভাঙ্গা খুন্‌তি নিয়ে তার ঘাস তুলচি, পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে দেখি, নরেন। তার সে-রকম মুখের চেহারা অনেকদিন পরে আর একবার দেখেছিলুম সত্যি, কিন্তু আগে কখনও দেখিনি। বুকে এমন একটা ব্যথা বাজল যা কখন কোনদিন পাইনি। সে বললে, আমাকে ছেড়ে কি সত্যিই চললে?

কথাটা বুঝেও যেন বুঝতে পারলুম না। বলে ফেললুম, কোথায়?

সে বললে, চিতোর।

স্পষ্ট হ’বা-মাত্রই লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল, কোন উত্তর মুখে এল না।

সে পুনরায় বললে, তাই আমিও বিদায় নিতে এসেছি; বোধ হয় জন্মের মতই। কিন্তু তার আগে দু’টো কথা বলতে চাই—শুনবে?

বলতে বলতেই তার গলাটা যেন ধরে গেল। তবুও আমার মুখে কথা যোগাল না— কিন্তু মুখ তুলে চাইলুম। এ কি! দেখি, তার দু’চোখ বয়ে ঝরঝর করে জল পড়চে।

ওরে পতিত! ওরে দুর্বল নারী! মানুষের চোখের জল সহ্য করবার ক্ষমতা ভগবান তোকে যখন একেবারে দেননি, তখন তোর আর সাধ্য ছিল কি! দেখতে দেখতে আমারও চোখের জলে বুক ভেসে গেছে। নরেন কাছে এসে কোঁচার খুঁট দিয়ে আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে হাত ধরে বললে, চল, ওই গাছটার তলায় গিয়ে বসি গে, এখানে কেউ দেখতে পাবে।

মনে বুঝলুম, এ অন্যায়, একান্ত অন্যায়! কিন্তু তখনও যে তার চোখের পাতা ভিজে, তখনও যে তার কণ্ঠস্বর কান্নায় ভরা।

বাগানের একপ্রান্তে একটা কাঁটালী-চাঁপার কুঞ্জ ছিল, তার মধ্যে সে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসালে।

একটা ভয়ে আমার বুকের মধ্যে দুরদুর করছিল, কিন্তু সে নিজেই দূরে গিয়ে বসে বললে, এই একান্ত নির্জন স্থানে তোমাকে ডেকে এনেছি বটে, কিন্তু তোমাকে ছোঁব না, এখনও তুমি আমার হওনি।

তার শেষ কথায় আবার পোড়া চোখে জল এসে পড়ল। আঁচলে চোখ মুছে মাটির দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলুম।

তারপর অনেক কথাই হ’ল; কিন্তু থাক গে সে-সব। আজও ত প্রতিদিনকার অতি তুচ্ছ ঘটনাটি পর্যন্ত মনে করতে পারি, মরণেও যে বিস্মৃতি আসবে, সে আশা করতেও যেন ভরসা হয় না; একটা কারণে আমি আমার এতবড় দুর্গতিতেও কোনদিন বিধাতাকে দোষ দিতে পারিনি। স্পষ্ট মনে পড়ে, আমার চিত্তের মাঝে থেকে নরেনের সংস্রব তিনি কোনদিন প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেন নি। সে যে আমার জীবনে কত বড় মিথ্যে, এ ত তাঁর অগোচর ছিল না। তাই তার প্রণয়-নিবেদনের মুহূর্তের উত্তেজনা পরক্ষণের কতবড় অবসাদে যে ডুবে যেত, সে আমি ভুলিনি। যেন কার কত চুরি-ডাকাতি সর্বনাশ করে ঘরে ফিরে এলুম, এমনি মনে হ’ত। কিন্তু এমনি পোড়া কপাল যে, অন্তর্যামীর এতবড় ইঙ্গিতেও আমার হুঁশ হয়নি। হবেই বা কি করে? কোনদিন ত শিখিনি যে, ভগবান মানুষের বুকের মধ্যেও বাস করেন। এই সবই তাঁরই নিষেধ।