যখন রাম, সীতার বধূবেশ মনে করিয়া বলিলেন,

প্রতনুবিরলৈঃ প্রান্তোন্মীলন্মনোহরকুন্তলৈ—

র্দ্দশনমুকুলৈর্মুগ্ধালোকং শিশুর্দধতী মুখম্।

ললিতললিতৈর্জাৎস্নাপ্রায়ৈরকৃত্রিমবিভ্রমৈ—

রকৃত মধুরৈরম্বানাং মে কুতূহলমঙ্গকৈঃ॥[১]

যখন গোদাবরীতীর স্মরণ করিয়া কহিলেন,

কিমপি কিমপি মন্দং মন্দমাসসত্তিযোগা—

দবিরলিতকপোলং জল্পতোরক্রমেণ।

অশিথিলপরিরম্ভব্যাপৃতৈকৈকদোষ্ণো—

রবিদিতগতযামা রাত্রিরেব ব্যরংসীৎ॥[২]

যখন যমুনাতটস্থ শ্যামবট স্মরণ করিয়া কহিলেন,

অলসলুলিতমুগ্ধান্যধ্বসঞ্জাতখেদা—

দশিথিলপরিরম্ভৈর্দত্তসংবাহনানি।

পরিমৃদিতমৃণালীদুর্ব্বলান্যঙ্গকানি,

ত্বমুরসি মম কৃত্বা যত্র নিদ্রামবাপ্তা॥[৩]

যখন নিদ্রাভঙ্গান্তে রামকে দেখিতে না পাইয়া কৃত্রিম কোপে সীতা বলিলেন,—

ভোদু, কুবিস্মং জই তং পেক্‌খমাণা অত্তণো পহবিস্মং।[৪]

তখন কত প্রেম উছলিয়া উঠিতেছে! কিন্তু এই অতি বিচিত্র কবিত্বকৌশলময় চিত্রদর্শনে আরও কতই সুন্দর কথা আছে! লক্ষ্মণের সঙ্গে সীতার কৌতুক, “বচ্ছ ইঅং বি অবরা কা?”—মিথিলা হইতে বিবাহ করিয়া আসিবার কথায় দশরথকে রামের স্মরণ—“স্মরামি! হস্ত স্মরামি!” মন্থরার কথায় রামের কথা অন্তরিকতকরণ ইত্যাদি। সূর্পনখার চিত্র দেখিয়া সীতার ভয় আমাদের অতি মিষ্ট লাগে,—

সীতা। হা অজ্জউত্ত এত্তিঅং দে দংসণং।

রামঃ। অয়ি বিপ্রয়োগত্রস্তে! চিত্রসমেতৎ।

সীতা। যধাতধা হোদু দুজ্জণো অসুহং উপ্পাদেই।[৫]

স্ত্রীচরিত্র সম্বন্ধে এটি অতি সুমিষ্ট ব্যঙ্গ; অথচ কেবল ব্যঙ্গ নহে।

কালিদাসের বর্ণনাশক্তি অতি প্রসিদ্ধ, কিন্তু ভবভূতির বর্ণনাশক্তিও উত্তম। কালিদাসের বর্ণনা তাঁহার অতুল উপমাপ্রয়োগের দ্বারা অত্যন্ত মনোহারিণী হয়। ভবভূতির উপমাপ্রয়োগ অতি বিরল; কিন্তু বর্ণনীয় বস্তু তাঁহার লেখনীমুখে স্বাভাবিক শোভার অধিক শোভা ধারণ করিয়া বসে। কালিদাস, একটি একটি করিয়া বাছিয়া বাছিয়া সুন্দর সামগ্রীগুলি একত্রিত করেন; সুন্দর সামগ্রীগুলির সঙ্গে তদীয় মধুর ক্রিয়া সকল সূচিত করেন, তাহার উপর আবার উপমাচ্ছলে আরও কতকগুলিন সুন্দর সামগ্রী আনিয়া চাপাইয়া দেন। এজন্য তাঁহার কৃত বর্ণনা, যেমন স্বভাবের অবিকল অনুরূপ, তেমনি মাধুর্য্যপরিপূর্ণ হয়; বীভৎসাদি রসে কালিদাস সেই জন্য সফল হয়েন না। ভবভূতি বাছিয়া বাছিয়া মধুর সামগ্রী সকল একত্রিত করেন না; যাহা বর্ণনীয় বস্তুর প্রধানাংশ বলিয়া বোধ করেন, তাহাই অঙ্কিত করেন। দুই চারিটা স্থূল কথায় একটা চিত্র সমাপ্ত করেন—কালিদাসের ন্যায় কেবল বসিয়া বসিয়া তুলি ঘষেন না। কিন্তু সেই দুই চারিটা কথায় এমন একটু রস ঢালিয়া দেন যে, তাহাতে চিত্র অত্যন্ত সমুজ্জ্বল, কখন মধুর, কখন ভয়ঙ্কর, কখন বীভৎস হইয়া পড়ে। মধুরে কালিদাস অদ্বিতীয়—উৎকটে ভবভূতি।

উপরে উত্তরচরিতের প্রথমাঙ্ক হইতে উদাহরণস্বরূপ কতকগুলিন বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে,—যথা রামচন্দ্র ও জানকীর পরস্পরের বর্ণিত বরকন্যা রূপ। ভবভূতির বর্ণনাশক্তির বিশেষ পরিচয়—দ্বিতীয় ও তৃতীয়াঙ্কে জনস্থান এবং পঞ্চবটী এবং ষষ্ঠাঙ্কে কুমারদিগের যুদ্ধ। প্রথমাঙ্ক হইতে আমরা আর একটি সংক্ষিপ্ত উদাহরণ উদ্ধৃত করি।

“বচ্ছ এসো কুসুমিদকঅম্বতরুতণ্ডবিদবরহিণো কিণ্ণামহেআ গিরী, জত্‌থ অনুভাবসোহগ্‌গমেত্তপরিসেসধূসরসিরী মুহুত্তং মুচ্ছন্তো তুত্র পরুদিত্রণ অবলম্বিদো তরুঅলে অজ্জউত্তো আলিহিদো।”[৬]

দুইটিমাত্র পদে কবি কত কথাই ব্যক্ত করিলেন! কি করুণরসচরমস্বরূপ চিত্র সৃজিত করিলেন!

চিত্র দর্শনান্তে সীতা নিদ্রা গেলেন। ইত্যবসরে দুর্ম্মুখ আসিয়া সীতাপবাদ সম্বাদ রামকে শুনাইল। রাম সীতাকে বিসর্জ্জন করিবার অভিপ্রায় করিলেন।

রামচন্দ্রের চরিত্র নির্দ্দোষ, অকলঙ্ক, দেবোপম বলিয়া ভারতে খ্যাত, কিন্তু বস্তুতঃ বাল্মীকি কখন রামচন্দ্রকে নির্দ্দোষ বা সর্ব্বগুণবিভূষিত বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে ইচ্ছা করেন নাই। রামায়ণগীত শ্রীরামচন্দ্রের চরিত্রের অনেক দোষ, কিন্তু সে সকল দোষ গুণাতিরেকমাত্র। এই জন্য তাঁহার দোষগুলিনও মনোহর। কিন্তু গুণাতিরেকে যে সকল দোষ, তাহা মনোহর হইলেও দোষ বটে। পরশুরাম অতিরিক্ত পিতৃভক্ত বলিয়া মাতৃহন্তা, তাহা বলিয়া কি মাতৃবধ দোষ নহে? পাণ্ডবেরা মাতৃ—কথার অতিরিক্ত বশ বলিয়া একটি পত্নীর পঞ্চ স্বামী, তাই বলিয়া কি অনেকের একপত্নীত্ব দোষ নয়?

রামচন্দ্রও অনেক নিন্দনীয় কর্ম্ম করিয়াছেন।—যথা বালিবধ। কিন্তু তিনি যে সকল অপরাধে অপরাধী, তন্মধ্যে এই সীতা বিসর্জ্জনাপরাধ সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর। শ্রীরামের চরিত্র কোন্ দোষে কলুষিত করিয়া কবি তাঁহাকে এই অপরাধে অপরাধী করিয়াছেন, তাহার আলোচনা করা যাউক।

যাঁহারা সাম্রাজ্য শাসনে ব্রতী হয়েন, প্রজারঞ্জন তাঁহাদিগের একটি মহদ্ধর্ম্ম। গ্রীক ও রোমক ইতিবৃত্তে ইহার অনেক উদাহরণ প্রকাশিত আছে। কিন্তু ইহার সীমাও আছে। সেই সীমা অতিক্রম করিলে, ইহা দোষরূপে পরিণত হয়। যে রাজা প্রজার হিতার্থ আপনার অহিত করেন, সে রাজার প্রজারঞ্জনপ্রবৃত্তি গুণ। ব্রুটস কৃত আত্মপুত্রের বধদণ্ডাজ্ঞা এই গুণের উদাহরণ। যে রাজা প্রজার প্রিয় হইবার জন্য হিতাহিত সকল কার্য্যেই প্রবৃত্ত, সেই রাজার প্রজারঞ্জনপ্রবৃত্তি দোষ। নাপোলেনদিগের যুদ্ধে প্রবৃত্তি ইহার উদাহরণ। রোবস্পীর ও দাতোকৃত বহু প্রজাবধ ইহার নিকৃষ্টতর উদাহরণ।

ভবভূতির রামচন্দ্র এই প্রজারঞ্জনপ্রবৃত্তির বশীভূত হইয়া সীতাকে বিসর্জ্জন করেন। অনেকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রজারঞ্জক ছিলেন। কিন্তু রামচন্দ্রের চরিত্রে স্বার্থপরতামাত্র ছিল না। সুতরাং তিনি স্বার্থ জন্য প্রজারঞ্জনে ব্রতী ছিলেন না। প্রজারঞ্জন রাজাদিগের কর্ত্তব্য বলিয়াই, এবং ইক্ষ্বাকুবংশীয়দিগের কুলধর্ম্ম বলিয়াই তাহাতে তাঁহার এতদূর দার্ঢ্য। তিনি অষ্টাবক্রের সমক্ষে পূর্ব্বেই বলিয়াছিলেন,

স্নেহং দয়াং তথা সৌখ্যং যদি বা জানকীমপি।

আরাধনায় লোকস্য মুঞ্চতো নাস্তি মে ব্যথা॥[৭]

এবং দুর্ম্মুখের মুখে সীতার অপবাদ শুনিয়া বলিলেন,

সত্যং কেনাপি কার্য্যেণ লোকস্যারাধনম্ ব্রতং।

যৎ পূজিতং হি তাতেন মাঞ্চ প্রাণাংশ্চ মুঞ্চতা॥[৮]

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. “মাতৃগণ তৎকালে বালা জানকীর অঙ্গসৌষ্ঠবাদি দেখিয়া কি সুখীই হইয়াছিলেন, এবং ইনিও অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ও অনতি—নিবিড় দন্তগুলি, তাহার উভয়পার্শ্বস্থ মনোহর কুন্তলমনোহর মুখশ্রী, আর সুন্দর চন্দ্রকিরণ—সদৃশ নির্ম্মল এবং কৃত্রিমবিলাসরহিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হস্ত পদাদি অঙ্গদ্বারা তাঁহাদের আনন্দের একশেষ করিয়াছিলেন।” নৃসিংহবাবুর অনুবাদ। এই কবিতাটি বালিকা বধূর বর্ণনার চূড়ান্ত।
  2. “একত্র শয়ন করিয়া পরস্পরের কপোলদেশ পরস্পরের কপোলের সহিত সংলগ্ন করিয়া এবং উভয়ে এক এক হস্ত দ্বারা গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া অনবরত মৃদুস্বরে ও যদৃচ্ছাক্রমে বহুবিধ গল্প করিতে করিতে অজ্ঞাতসারে রাত্রি অতিবাহিত করিতাম।”
  3. “যেখানে তুমি পথজনিত পরিশ্রমে ক্লান্তা হইয়া ঈষৎ কম্পবান্, তথাপি মনোহর এবং গাঢ় আলিঙ্গনকালে অত্যন্ত মর্দ্দনদায়ক, আর দলিত মৃণালিনীর ন্যায় ম্লান ও দুর্ব্বল হস্তাদি অঙ্গ আমার বক্ষঃস্থলে রাখিয়া নিদ্রা গমন করিয়াছিল।” নৃসিংহবাবুর অনুবাদ।
  4. হৌক— আমি রাগ করিব—যদি তাঁহাকে দেখিয়া না ভুলিয়া যাই।
  5. সীতা। হা আর্য্যপুত্র, তোমার সঙ্গে এই দেখা।
    রাম। বিরহের এত ভয়—এ যে চিত্র।
    সীতা। যাহাই হউক না—দুর্জ্জন হলেই মন্দ ঘটায়।
  6. বৎস, এই যে পর্ব্বত, যদুপুরে কুসুমিত ময়ূরেরা পুচ্ছ ধরিতেছে—উহার নাম কি? দেখিতেছি, তরুতলে আর্য্যপুত্র লিখিত—তাঁহার পূর্ব্বসৌন্দর্য্যের পরিশেষমাত্র ধূসর শ্রীতে তাঁহাকে চেনা যাইতেছে। তিনি মুহুর্ম্মুহুঃ মূর্চ্ছা যাইতেছেন—কাঁদিতে কাঁদিতে তুমি তাঁহাকে ধরিয়া আছ।
  7. “প্রজারঞ্জনের অনুরোধে স্নেহ, দয়া, আত্মসুখ, কিম্বা জানকীকে বিসর্জ্জন করিতে হইলেও আমি কোনরূপ ক্লেশ বোধ করিব না।” নৃসিংহবাবুর অনুবাদ।
  8. “লোকের আরাধনা করা সাধু ব্যক্তিদের পক্ষে সর্ব্বোতোভাবেই বিধেয়, এবং এইটি তাঁহাদের পক্ষে মহৎব্রতস্বরূপ। কারণ, পিতা আমাকে এবং প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াও তাহা প্রতিপালন করিয়াছিলেন।”—ঐ

১ Comment

  1. আমরা শুধু বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের কথাই জানি, তিনি যে অনেক ভাল প্রবন্ধ ও গ্রন্থ সমালোচনাও লিখেছেন, এই সাইটে না এলে জানতে পেতাম না।

Leave a Reply