1আমি প্রচারের একজন লেখক। তাহা জানিয়া প্রচারের একজন পাঠক আমাকে বলিলেন, “প্রচারে অত ধর্ম্মবিষয়ক প্রবন্ধ ভাল লাগে না। দুই একটা আমাদের কথা না থাকিলে পড়িতে পারা যায় না৷”
আমি বলিলাম, “কেন, উপন্যাসেও কি তোমার আমোদ নাই? প্রতি সংখ্যায় একটি উপন্যাস প্রকাশিত হইয়া থাকে৷”
তিনি বলিলেন, “ঐ একটু বৈ ত নয়৷”
তিন ফর্ম্মা প্রচার, তাহার কখন এক ফর্ম্মা উপন্যাস, কখন বেশী, কখন কম। তাহাও অপ্রচুর। তারপর তিনি ফর্ম্মার যেটুকু থাকে, তাহারও কিয়দংশ কবিতা ইত্যাদিতে কতকটা ভরিয়া যায়, ধর্ম্মবিষয়ক প্রবন্ধ এক কোণে এক আধটা পড়িয়া থাকে। তথাপি এই পাঠকের তাহা ভাল লাগে না। বোধ হয়, আরও অনেক পাঠক আছেন, যাঁহাদিগের ধর্ম্মবিষয়ক প্রবন্ধ তিক্ত লাগে। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য, তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করা, ধর্ম্ম কেন তিক্ত লাগে, উপন্যাস রঙ্গরস কেন ভাল লাগে?
আমাদিগের ইচ্ছা, পাঠক আপনি একটু চিন্তা করিয়া ইহার উত্তর স্থির করেন। আপনা আপনি উত্তর স্থির করিলে তাঁহাদিগের যত উপকার হইবে, কেহ কোন প্রকার শিক্ষা দিয়া সেরূপ উপকার করিতে পারিবে না। তবে আমরা তাঁহাদের কিছু সাহায্য করিতে পারি।
সাধারণ ধর্ম্মশিক্ষকের দ্বারা ধর্ম্ম যে মূর্ত্তিতে পৃথিবীতে সংস্থাপিত হইয়াছে, তাহা অপ্রীতিকর বটে। এদেশের আধুনিক ধর্ম্মের আচার্য্যেরা যে হিন্দুধর্ম্ম ব্যাখ্যাত ও রক্ষিত করেন, তাহার মূর্ত্তি ভয়ানক। উপবাস, প্রায়শ্চিত্ত, পৃথিবীর সমস্ত সুখে বৈরাগ্য, আত্মপীড়ন, ইহাই অধ্যাপক ও পুরোহিত মহাশয়ের নিকট ধর্ম্ম। গ্রীষ্মকালে অতিশয় উত্তপ্ত তৃষাপীড়িত হইয়া যদি এক পাত্র বরফজল খাইলাম, তবে আমার ধর্ম্ম নষ্ট হইল! জ্বরবিকারের রুগ্ন শয্যায় কষ্টে প্রাণ যায় যায় হইয়াছে, ডাক্তার আমার প্রাণরক্ষার্থে যদি ঔষধের সঙ্গে আমায় পাঁচ ফোঁটা ব্রাণ্ডী খাওয়াইলেন, তবেই আমার ধর্ম্ম গেল2! আট বৎসরের কুমারী কন্যা বিধবা হইয়াছে, যে ব্রহ্মচর্য্যের সে কিছু জানে না, যাহা ষাট বৎসরের বুড়ারও দূরাচরণীয়, সেই ব্রহ্মচর্য্যের পীড়নে পীড়িত করিয়া তাহাকে কাঁদাইতে হইবে, আপনি কাঁদিতে হইবে, পরিবারবর্গকে কাঁদাইতে হইবে, নহিলে ধর্ম্ম থাকে না। ধর্ম্মোপার্জ্জনের জন্য কেবল পুরোহিত মহাশয়কে দাও, গুরুঠাকুরকে দাও, নিষ্কর্ম্মা, স্বার্থপর, লোভী, কুকর্ম্মাসক্ত ভিক্ষোপজীবী ব্রাহ্মণদিগকে দাও, আপনার প্রাণপতনে উপার্জ্জিত ধন সব অপাত্রে ন্যস্ত কর। এই মূর্ত্তি ধর্ম্মের মূর্ত্তি নহে—একটা পৈশাচিক কল্পনা। পাঠক যে ইহাকে পিশাচ বা রাক্ষসের ন্যায় ভয় করিবেন, এবং নাম শুনিবামাত্র পরিত্যাগ করিবেন, ইহা সঙ্গত বটে।
যাঁহারা “শিক্ষিত” অর্থাৎ যাঁহারা ইংরেজি পড়িয়াছেন, তাঁহারা এটাকে ধর্ম্ম বলিয়া মানেন না, কিন্তু তাঁহারা আর এক বিপদে পড়িয়াছেন। তাঁহারা ইংরেজির সঙ্গে খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মটাও শিখিয়াছেন। সে জন্য বাইবেল পড়িতে হয় না, বিলাতী সাহিত্য সেই ধর্ম্মে পরিপ্লুত। আমরা খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম গ্রহণ করি না করি, ধর্ম্ম নাম হইলে সেই ধর্ম্মই মনে করি। কিন্তু সে আর এক ভয়ঙ্কর মূর্ত্তিবিশেষ। পরমেশ্বরের নাম হইলে সেই খ্রীষ্টানের পরমেশ্বরকে মনে পড়ে। সে পরমেশ্বর এই পবিত্র নামের সম্পূর্ণ অযোগ্য। তিনি বিশ্বসংসারের রাজা বটে, কিন্তু এমন প্রজাপীড়ক অত্যাচারী বিচারশূন্য রাজা কোন নরপিশাচেও হইতে পারে না। তিনি ক্ষণকৃত অতি ক্ষুদ্র অপরাধে মনুষ্যকে অনন্তকালস্থায়ী দণ্ডের বিধান করেন। ছোট বড় সকল পাপেই অনন্ত নরক। নিষ্পাপেরও অনন্ত নরক—যদি সে খ্রীষ্টধর্ম্ম গ্রহণ না করে। সে কখন খ্রীষ্ট নাম শুনে নাই, সুতরাং খ্রীষ্টধর্ম্ম গ্রহণ যাহার সাধ্য নহে, তাহারও সেই অপরাধে অনন্ত নরক। যে হিন্দুর ঘরে জন্মিয়াছে, তার সেই হিন্দুজন্ম তাহার দোষ নহে, পরমেশ্বর স্বয়ং তাহাকে যেখানে প্রেরণ করিয়াছেন, সেইখানেই সে আসিয়াছে, যদি দোষ থাকে, তবে সে পরমেশ্বরের দোষ, তথাপি সে দোষে সে গরিবের অনন্ত নরক। যে খ্রীষ্টের পূর্ব্বে জন্মিয়াছে বলিয়াই খ্রীষ্টধর্ম্ম গ্রহণ করে নাই, তাহার সে ঈশ্বরকৃত জন্মদোষে তাহারও অনন্ত নরক। এই অত্যাচারকারী বিশ্বেশ্বরের একটি কাজ এই যে, ইনি রাত্রিদিন প্রজাবর্গের মনের ভিতর উঁকি মারিয়া দেখিতেছেন, কে কি পাপসঙ্কল্প করিল। যাহার এতটুকু ব্যতিক্রম দেখিলেন, তাহার অদৃষ্টে তখনই অনন্ত নরক বিধান করিলেন। যাহারা এই ধর্ম্মের আবর্ত্তমধ্যে পড়িয়াছে, তাহারা চিরদিন সেই মহাবিষাদের ভয়ে জড়সড় ও জীবন্মৃত হইয়া দিন কাটায়। পৃথিবীর কোন সুখই তাহাদের কাছে আর সুখ নহে। যাঁহারা এই পৈশাচিক ধর্ম্মকে ধর্ম্ম বলিতে শিখিয়াছেন, ধর্ম্মের নামে যে তাঁহাদের গায়ে জ্বর আসিবে, ইহা সঙ্গত।
সাধারণ ধর্ম্মপ্রচারকদিগের এই সকল দোষেই ধর্ম্মালোচনার প্রতি সাধারণ লোকের এত অননুরাগ জন্মিয়াছে। নহিলে ধর্ম্মের সহজ মূর্ত্তি যেরূপ মনোহারিণী, সকল ত্যাগ করিয়া সাধারণ লোকের ধর্ম্মালোচনাতেই অধিক অনুরাগ সম্ভব। আমারও বিশ্বাস যে, জগতে তাহাই হইয়া থাকে; কেবল এখনকার বিকৃতরুচি পাঠকদিগের সম্বন্ধে এ কথা খাটে না। তাঁহারা বিবেচনা করিয়া দেখিবেন যে, যেগুলি ধর্ম্ম বলিয়া হিন্দু খ্রিষ্টিয়ানের দোষে তাঁহাদিগের নিকট পরিচিত হইয়াছে, সেগুলি ধর্ম্ম নহে—অধর্ম্ম। ধর্ম্মে মূর্ত্তি বড় মনোহর। ঈশ্বর প্রজাপীড়ক নহেন—প্রজাপালক। ধর্ম্ম আত্মপীড়ন নহে,—আপনার উন্নতিসাধন, আপনার আনন্দবর্দ্ধনই ধর্ম্ম। ঈশ্বরে ভক্তি, মনুষ্যে প্রীতি, এবং হৃদয়ে শান্তি, ইহাই ধর্ম্ম। ভক্তি, প্রীতি, শান্তি, এই তিনটি শব্দে যে বস্তু চিত্রিত হইল, তাহার মোহিনী মূর্ত্তির অপেক্ষা মনোহর জগতে আর কি আছে? তাহা ত্যাগ করিয়া আর কোন্ বিষয়ের আলোচনা করিতে ইচ্ছা করে?
যিনি নাটক নবেল পড়িতে বড় ভালবাসেন, তিনি একবার মনে বিচার করিয়া দেখিবেন, কিসের আকাঙ্ক্ষায় তিনি নাটক নবেল পড়েন? যদি সেই সকলে যে বিস্ময়কর ঘটনা আছে, তাহাতেই তাঁহার চিত্তবিনোদন হয়, তবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি, বিশ্বেশ্বরের এই বিশ্বসৃষ্টির অপেক্ষা বিস্ময়কর ব্যাপার কোন্ সাহিত্যে কথিত হইয়াছে? একটি তৃণে বা একটি মাছির পাখায় যত আশ্চর্য্য কৌশল আছে, কোন্ উপন্যাস—লেখকের লেখায় তত কৌশল আছে? আর ইহার অপেক্ষা যাঁহারা উচ্চদরের পাঠক, যাঁহারা কবির সৃষ্ট পদার্থের লোভে সাহিত্যে অনুরক্ত, তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, ঈশ্বরের সৃষ্টির অপেক্ষা কোন্ কবির সৃষ্টি সুন্দর? বস্তুতঃ কবির সৃষ্টি সেই ঈশ্বরের সৃষ্টির অনুকারী বলিয়াই সুন্দর। নকল কখন আসলের সমান হইতে পারে না। ধর্ম্মের মোহিনী মূর্ত্তির কাছে সাহিত্যের প্রভাব বড় খাটো হইয়া যায়।
পাঠক বলিবেন, “এ কথা সত্য হইতে পারে না; কেন না, আমার নাটক নবেল পড়িতে ইচ্ছা হয়, পড়িয়াও আনন্দ নাই। কই, ধর্ম্মপ্রবন্ধ পড়িতে ত ইচ্ছা হয় না, পড়িয়াও কোন আনন্দ পাই না।” ইহার উত্তর বড় সহজ। তুমি সাহিত্য পাঠে অনুরক্ত এবং তাহাতে আনন্দ লাভ কর, তাহার কারণ এই যে, যে সকল বৃত্তির অনুশীলন করিলে সাহিত্যের মর্ম্ম গ্রহণ করা যায়, তুমি সেগুলির অনুশীলন কর নাই, এজন্য তাহার আলোচনায় তুমি আনন্দ লাভ কর না। কিন্তু এখন সেগুলির আলোচনা নিতান্ত প্রয়োজনীয় হইয়াছে। কেন না, তাহাতেই সুখ। সাহিত্যের আলোচনায় সুখ আছে বটে, কিন্তু যে সুখ তোমার উদ্দেশ্য এবং প্রাপ্য হওয়া উচিত, সাহিত্যের সুখ তাহার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। সাহিত্যও ধর্ম্ম ছাড়া নহে। কেন না, সাহিত্য সত্যমূলক। যাহা সত্য, তাহা ধর্ম্ম। যদি এমন কুসাহিত্য থাকে যে, তাহা অসত্যমূলক ও অধর্ম্মময়, তবে তাহা পাঠে দুরাত্মা বা বিকৃতরুচি পাঠক ভিন্ন কেহ সুখী হয় না। কিন্তু সাহিত্যে যে সত্য ও যে ধর্ম্ম, সমস্ত ধর্ম্মের তাহা এক অংশ মাত্র। অতএব কেবল সাহিত্য নহে, যে মহত্তত্ত্বের অংশ এই সাহিত্য, সেই ধর্ম্মই এইরূপ আলোচনীয় হওয়া উচিত। সাহিত্য ত্যাগ করিও না, কিন্তু সাহিত্যকে নিম্ন সোপান করিয়া ধর্ম্মের মঞ্চে আরোহণ কর।
কিন্তু ইহাও যেন স্মরণ থাকে যে, গোড়ায় কিছু দুঃখ কষ্ট না করিয়া কোন সুখই লাভ করা যায় না। বিলাসী ও পাপিষ্ঠ, যে ইন্দ্রিয়তৃপ্তিকেই সুখ মনে করে, তাহারও উপাদান যত্নে ও কষ্টে আহরণ করিতে হয়। ধর্ম্মালোচনায় যে অসীম অনির্ব্বচনীয় আনন্দ, তাহার উপভোগের জন্য প্রয়োজনীয় যে ধর্ম্মমন্দিরের নিম্ন সোপানে যে সকল কঠিন ও কর্কশ তত্ত্বগুলি বন্ধুর প্রস্তরের মত আছে, সেগুলিকে আগে আপনার আয়ত্ত কর। অতএব আপাততঃ ধর্ম্মবিষয়ক প্রবন্ধ কর্কশ বোধ হইলেও তাহার প্রতি অনাদর করা অনুচিত।