সাত
পরের দিন সকালে উম্মে কুলসুম ছোট ভাইয়াকে বলল, তাসনিম আপা খুব টেনসান নিয়ে ফোনের অপেক্ষায় আছেন। ফোন করে আসতে বলি?
আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, তার আর দরকার নেই। এক্ষুনি হয়তো এসে পড়বে।
উম্মে কুলসুমও মৃদু হেসে বলল, তা হলে রাতেই তোমাদের মিটমাট হয়ে গেছে?
তোর কী মনে হয়?
যা মনে হয় তাইতো বললাম।
সামান্য ভুলের জন্য বেচারী অনেক দুঃখ পেয়েছে তাই রাতে ফোন করে মিটমাট করে ফেললাম।
এমন সময় তাসনিম কেবিনে ঢুকে সালাম দিল।
উম্মে কুলসুম সালামের উত্তর দিয়ে হাসি মুখে বলল, এক্ষুনি আপনাকে ফোন করার জন্য ছোট ভাইয়ার কাছে পারমিশান চাচ্ছিলাম। তারপর জিজ্ঞেস করল, সায়মা আসেন নি?
ও আসতে চেয়েছিল, না করে দিয়েছি।
আপনি ছোট ভাইয়ার সাথে কথা বলুন, তারপর আসছি বলে উম্মে কুলসুম বেরিয়ে বারান্দার রেলিং এর কাছে এসে গেটের দিকে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে তাদের গাড়ি গেটের কাছে দাঁড়াতে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এল। ততক্ষণে আব্দুল মজিদ ও উম্মে হাফসা নেমে দাঁড়িয়েছেন। উম্মে কুলসুম সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুল মজিদ জিজ্ঞেস করল, ছোট ভাইয়া কেমন আছে?
আল্লাহর রহমতে ভালো। তারপর স্বামীকে চোখ টিপে বলল, তুমি ডিউটিতে যাও, ফেরার সময় আসবে। আমি আম্মুকে নিয়ে যাচ্ছি।
আব্দুল মজিদ বুঝতে পারল, তাকে এখন যেতে নিষেধ করছে। বলল, ঠিক আছে; তা হলে আসি। তারপর গাড়িতে উঠে বলল, গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি বাসায় গিয়ে গোসল করে খেয়ে ফুফুআম্মাকে নিয়ে এসে আম্মুকে পাঠিয়ে দিও।
গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর উম্মে কুলসুম উম্মে হাফসাকে বলল, আম্মু চল। বারান্দায় এসে বলল, আমরা কিছুক্ষণ রিসেপসন রুমে বসি। ভাইয়ার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।
রিসেপসন রূমে বসার পর উম্মে হাফসা জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছে চিনিস?
হ্যাঁ চিনি। কাল বিকেলে যে দুটো মেয়ে এসেছিল, তাদের বড় জন। নাম তাসনিম। জান আম্মু, ও না এক মন্ত্রীর মেয়ে।
উম্মে হাফসা অবাক হয়ে বললেন, তাই না কী?
হ্যাঁ আম্মু। ওর বাবার নাম বললে তুমিও চিনবে। আমাদের পাশের গ্রামের রোকন উদ্দিন।
উম্মে হাফসা চমকে উঠে গম্ভীর হয়ে বললেন, তার মেয়ের সঙ্গে আব্দুস সাত্তারের কি এমন সম্পর্ক যে, সাত সকালে দেখা করতে এসেছে?
ছোট ভাইয়া ওকে ভালবাসে। ও-ও ছোট ভাইয়াকে ভালবাসে।
উম্মে হাফসা আবার চমকে উঠে বললেন, কী বললি?
আম্মুর দু’বার চমকে উঠার কারণ উম্মে কুলসুম জানে। তাই দেখেও না দেখার ভান করে বলল, তুমি তো কাল তাসনিমকে ভালো করে দেখ নি, তার। সাথে আলাপও কর নি। আজ দেখলে ও আলাপ করলে বুঝতে পারবে, মেয়েটা কি দারুণ সুন্দরী আর ব্যবহারও কত সুন্দর। মন্ত্রীর মেয়ে হলেও এতটুকু অহঙ্কার। নেই। একদম সহজ সরল। ওকে তোমার পছন্দ হবেই।
উম্মে হাফসা রেগে উঠে বললেন, চুপ কর। মন্ত্রীর মেয়ে হোক, আর যতই রূপবতী-গুণবতী হোক, তোর আব্ব কিছুতেই বৌ করবে না। আর মেয়ের। আব্বাও আব্দুস সাত্তারকে জামাই করবেন না। বরং ওদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে মেয়েকে কি করবেন জানি না, আব্দুস সাত্তারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করবেন। ভেবে খুব আশ্চর্য হচ্ছি, সবকিছু জেনেও আব্দুস সাত্তার ঐ পথে পা বাড়াল কেন?
আমিও সবকিছু জানি আম্মু।
কার কাছে জেনেছিস?
ছোট ভাইয়ার কাছে।
তবু তুই মেয়েটার গুণগান করছিস? আব্দুস সাত্তারকে বাধা দিস নি কেন?
বাধা দিয়েছি, কাজ হয় নি। বলল, সে নিজেও তাসনিমকে ভুলে যেতে চেষ্টা করেও সফল হয় নি।
আব্দুস সাত্তার জেনে শুনে একি আগুন নিয়ে খেলছে? মেয়ের বাবা ওদের সম্পর্কের কথা জানেন?
না।
জানলে যে কি হবে আল্লাহই জানে। আচ্ছা, মেয়েটা কি তোদের আব্বুর পরিচয় জানে?
ছোট ভাইয়া তাকে এখনও পরিচয় বলে নি।
আমার খুব ভয় করছে। আল্লাহ বড় ছেলেকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন। আব্দুস সাত্তার কত বড় বিপদ থেকে মরতে মরতে বাঁচল। এখন আবার আর এক বিপদের কথা শোনালি। আল্লাহ তকদিরে কি রেখেছেন কি জানি। কথা শেষ করে আঁচলে চোখ মুছলেন।
তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না তো আম্মু। মেয়ে যদি ভাইয়াকে সাপোর্ট করে, তা হলে মন্ত্রী হোক আর যেই হোক, ছোট ভাইয়ার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না। ছোট ভাইয়াকে অত কাঁচা ছেলে মনে করো না, সে জেনে শুনেই এই পথে পা বাড়িয়েছে। আমি যখন ঐসব বলে বাধা দিয়েছিলাম তখন বলল, তাসনিমকে বিয়ে করে আব্বুর সঙ্গে ওর আব্বুর পুরানো বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনবে।
উম্মে হাফসা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তা যদি করতে পারে, তা হলে তোর আব্বুর থেকে আর কেউ বেশি খুশী হবে না। দোয়া করি, “আল্লাহ যেন ওর মনের উদ্দেশ্য পূরণ করেন। তারপর বললেন, চলতো দেখি মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করি।”
কেবিনের দরজার কাছে এসে পর্দার বাইরে থেকে উম্মে কুলসুম বলল, ছোট ভাইয়া, আম্মু এসেছে।
তাসনিম তখন বেডে বসে আব্দুস সাত্তারের বুকে হাত রেখে বলছিল, আল্লাহ কবে এখানে মাথা রাখার সুযোগ দেবেন, তা তিনিই জানেন। উম্মে কুলসুমের গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আব্দুস সাত্তার বলল, বাইরে রয়েছিস কেন? আম্মুকে নিয়ে ভিতরে আসবি
ওরা ঢুকতেই তাসনিম সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে উম্মে হাফসাকে কদমবুসি করল।
উম্মে হাফসা থাক মা থাক বলে তার মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক, হায়াতে তৈয়েবা দিক।” তারপর চিবুক ধরে কয়েক সেকেন্ড মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে সুবহান আল্লাহ, মাশাআল্লাহ বলে বললেন, বাহ! কী সুন্দর চেহারা? যেমন চোখ মুখ, তেমনি নাক। গায়ের রংও দুধে আলতা। যে বাড়ির বৌ হয়ে যাবে, তারা খুব ভাগ্যবান। দাঁড়িয়ে আছ কেন মা, বস। তারপর ছেলের বেডের কাছে এসে বললেন, কেমন আছিস বাবা?
আব্দুস সাত্তার বলল, আল্লাহর রহমতে ও তোমার দোয়ার বরকতে গতকালের চেয়ে অনেকটা ভালো। একটু আগে ডাক্তার এসেছিলেন। বললেন, আর কোনো ভয় নেই।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে উম্মে হাফসা বললেন, মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে নিয়ে বসে একটু আলাপ করি। এত সুন্দর মেয়েকে কাল আসতে না আসতেই তুই তাড়িয়ে দিয়ে ভালো করিস নি। তারপর তাসনিমের একটা হাত ধরে বললেন, এস মা, আমরা আলাপ করি। বসার পর তাসনিমকে বললেন, তুমি মন্ত্রীর মেয়ে উম্মে কুলসুম বলেছে। নিশ্চয় লেখাপড়া করছ?
উম্মে হাফসা যখন চিবুক ধরে রূপের প্রশংসা করছিলেন তখন থেকে তাসনিম লজ্জায় মুখ নিচু করেছিল। এখন লজ্জা একটু কমেছে। মুখ তুলে তার দিকে। তাকিয়ে বলল, জি, বাংলায় অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি।
আল্লাহ তোমাকে রূপের সাথে গুণও দিয়েছেন।
ততক্ষণে উম্মে কুলসুম আম্মুর সঙ্গে তাসনিমের ব্যাপারে যা আলাপ হয়েছিল, তার সারমর্ম সটকাটে ছোট ভাইয়াকে ফিস ফিস করে বলছিল। মায়ের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে যদি তোমার এতই পছন্দ তখন বৌ করে ঘরে নিলেই পার।
তাসনিম লজ্জা পেয়ে আবার মুখ নিচু করে নিল।
অত ভাগ্য কী আমাদের হবে?
ভাগ্যে কি আছে না আছে, তা আল্লাহ জানেন। মেয়ে যখন পাশে বসে আছে, মতামত নিতেও তো পার?
উম্মে হাফসা তাসনিমকে বললেন, তুমি তো আমার মেয়ের কথা শুনলে মা, আব্দুস সাত্তার সুস্থ হওয়ার পর একদিন বাসায় এস।
তাসনিম আরো বেশি লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করেই বলল, জুি আসব। তারপর দাঁড়িয়ে বলল, এবার আসি খালা আম্মা।
আর একটু বস। মনে হচ্ছে, তুমি নাস্তা না খেয়ে এসেছ। আমি নাস্তা নিয়ে এসেছি, ওদের সঙ্গে নাস্তা খেয়ে তারপর যাবে।
আজ নয় খালা আম্মা, অন্য দিন খাব অনেকক্ষণ এসেছি, আব্বু নাস্তার টেবিলে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।
তা হলে তো আর জোর করব না। শোন, আব্দুস সাত্তার সুস্থ হওয়ার পর বাসায় আসতে বলেছি বলে যেন আবার মনে করো না, এখানে আসতে নিষেধ করেছি। কী? এখানে আসবে না?
তাসনিম মৃদু হেসে জ্বি আসব বলে সালাম বিনিময় করে বেরিয়ে এল।
রোকন উদ্দিন সাহেব প্রতিদিন সকাল আটটায় স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে নাস্তা করেন। আজ এসে বড় মেয়েকে দেখতে না পেয়ে ছোট মেয়েকে বললেন, রূপাকে দেখছি না কেন?
সায়মা বলল, আপু ভোর সাড়ে ছ’টায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করতে বলল, এসে বলবে। বললাম, আব্ব তো তোকে নাস্তার। টেবিলে খুঁজবে, কী বলব? বলল, তার আগেই ফিরব। সঙ্গে যেতে চাইলাম নিল না।
তাই না কী? তা হলে তো এতক্ষণ ফিরে আসার কথা। এখন তো রাস্তায় যানজট নেই, তবু দেরি হচ্ছে কেন? কোনো অসুবিধায় পড়ল না তো? আচ্ছা, ড্রাইভারকে নিয়েছে?
না নেয় নি।
তা হলে তো খুব চিন্তার কথা। অত সকালে ড্রাইভারকে না নিয়ে একা বেরোন উচিত হয়নি।
এমন সময় তাসনিম এসে আব্বর শেষের কথা শুনতে পেয়ে বলল, কাছেই গিয়েছিলাম, তাই ড্রাইভারকে নিই নি।
রোকন উদ্দিন সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, আর কোনো দিন অত সকালে ড্রাইভার ছাড়া একা বেরোবি না। তা কোথায় গিয়েছিলি বল তো?
ইবনেসিনা ক্লিনিকে একজন রুগীকে দেখতে।
খেতে শুরু করে রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, নিশ্চয় রুগী তোর প্রিয় কেউ?
কী করে বুঝলে?
তা না হলে নাস্তা না খেয়ে অত সকালে কেউ কাউকে দেখতে যায়?
ঠিক বলেছ। জান আব্বু, ছেলেটার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসীরা চাদা নিতে এসেছিল। ছেলেটা প্রতিবাদ করে। যা হওয়ার তাই হল। সন্ত্রাসীরা ওকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যেতে চাইলে লোকজন প্রতিরোধ করতে গেলে দু’দলে যুদ্ধ হল! উভয়পক্ষের কয়েকজন করে আহত হল। ছেলেটার একটা পা ভেঙ্গে গেছে। ইবনেসিনায় চিকিৎসা চলছে।
ছেলেটা খুব সাহসী বল?
হ্যাঁ আব্ব, শুধু সাহসী নয়, শক্তিশালীও। কয়েক মাস আগে একদিন আমি ও সায়মা সংসদ ভবন চত্বরে গিয়েছিলাম। তিন চারটে বাজে ছেলে আমাদেরকে টিজ করছিল। ছেলেটা তখন আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রথমে তাদেরকে দ্রভাবে চলে যেতে বলল। ছেলেগুলো তর্ক করতে করতে এক পর্যায়ে তাদের একজন পিস্তল বের করে গুলি করল। ছেলেটা তড়িৎগতিতে সরে গেলেও গুলিটা কাঁধের কিছু মাংস নিয়ে বেরিয়ে গেল। তবু ছেলেটা ভয় পেল না। পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে তাদেরকে ভাগিয়ে দিল। আশেপাশের অনেকে ঘটনাটা দেখলেও কেউ ছেলেটাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি। আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। তারপর বাজে ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর যা কিছু হয়েছে বলে বলল, আমরা ছেলেটার কার্যকলাপে খুব অবাক হলাম। সব থেকে বড় কথা, তখন তাকে আমরা চিনতাম না।
রোকন উদ্দিন সাহেব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, বাহ, ছেলেটা সত্যিই খুব বাহাদুর। তা হারে, পরে ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হল কী করে?
ঐ ঘটনার কয়েকদিন পর সায়মার জুতো কেনার জন্য নিউমার্কেটে গিয়ে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ছেলেটাও তার বোনকে নিয়ে জুতো কিনতে এসেছিল। তখন থেকে পরিচয়।
মেয়ের কথাবার্তায় রোকন উদ্দিন সাহেব বুঝতে পারলেন, সে ছেলেটার প্রতি বেশ দুর্বল। বললেন, এতকিছু বললি, দেখতে কেমন, কতদূর লেখাপড়া করেছে উপার্জন-টুপার্জন করে কিনা, বাবা কি করেন, দেশের বাড়ি কোথায়, সেসব তো কিছুই বললি না?
প্রায় দু’আড়াই মাস মানসিক যন্ত্রণায় ভোগার পর আজ আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করে সেই যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেয়েছে। তাই তার মন আনন্দে আপ্লুত হয়েছিল। আব্বুর কথার ইঙ্গিত তাসনিম বুঝতে পারল না। স্বতস্ফূর্ত কণ্ঠে বলল, দেশের বাড়ি কোথায় জানি না। আর দেখতে দারুণ। ফর্সা টকটকে দোহারা গড়ন, প্রায় ছ’ফুট লম্বা। এ বছর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে। দেখলে তোমারও ভালো লাগবে।
রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়ের মনের খবর এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলেন।
ছোট মেয়ের মনের খবর জানার জন্য তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, কীরে মা, তুই চুপ করে আছিস কেন? ছেলেটার সম্পর্কে তোর মতামতটা বলতো শুনি।
আপুর উচ্ছাসের বোকামী দেখে সায়মা মনে মনে হাসছিল। বলল, হ্যাঁ আব্বু, ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো। আপু যা বলল, একবর্ণ মিথ্যে নয়।
কি নাম ছেলেটার?
আব্দুস সাত্তার। জান আব্ব, উনি আপুর ডাক নাম রূপা বাদ দিতে বলে তাসনিম রেখেছেন এবং বাসার সবাইকে সেকথা জানাতে বলেছেন।
তাই নাকি?
তাসনিম ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে, আব্দুস সাত্তারের ব্যাপারে আব্বুর সামনে এত উচ্ছাস প্রকাশ করা বোকামী হয়েছে। তাই এবার সায়মা কিছু বলার আগে বলল, হ্যাঁ আব্বু; উনি একদিন আমার ডাক নাম রূপা শুনে আসল নাম জানতে চাইলেন। আমি বললাম, যাবিন তাসনিম। তারপর নামের ব্যাপারে আব্বুর সাত্তার যা কিছু বলেছে সব বলে বলল, খুব ধার্মিক ছেলে বলে মনে হয়, তাই না আব্বু?
তোদের কথা শুনে তাই তো মনে হচ্ছে। তারপর বললেন, ছেলেটাকে একদিন নিয়ে আসিস, আলাপ করব।
তাসনিম বলল, সুস্থ হওয়ার পর নিয়ে আসব।
আব্দুস সাত্তার একমাস ক্লিনিকে থেকে বাসায় ফিরে এলেও সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরো একমাস সময় লাগল। তাসনিম দু’একদিন পরপর তাকে ক্লিনিকে দেখতে গেলেও বাসায় সপ্তাহে একবার করে যায়। আর প্রতিদিন রাতে দীর্ঘ সময় ফোনে। আলাপ করে। উম্মে হাফসা তাকে মতামত জিজ্ঞেস করেন নি। তবে তাদের গভীর সম্পর্কের কথা বুঝতে পেরেছেন। ক্লিনিক থেকে বাসায় আসার পর একদিন ছেলেকে বললেন, উম্মে কুলসুম তোর ও তাসনিমের সম্পর্ক ও তোর উদ্দেশ্যের কথা আমাকে বলেছে। কিন্তু কাজটা কত কঠিন ভেবে দেখেছিস?
আব্দুস সাত্তার বলল, যত কঠিনই হোক, আমি আমার সংকল্প থেকে বিচ্যুত হব না। তুমি মা, তোমার কাছে কিছু লুকাব না। আমি তাসনিমকে ভীষণ ভালবাসি। তাসনিমও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। ওকে ছাড়া আমি যেমন বাঁচব না, আমাকে ছাড়া তাসনিমও হয়তো বাঁচবে না। অবশ্য বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে। হায়াত থাকলে বাচব ঠিক; কিন্তু সে বাচার থেকে না বাচাই ভালো। ওকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব কিনা জানি না, তবে একথা ঠিক, অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না। তা ছাড়া আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই বিয়ের মাধ্যমে ওর আব্বুর সঙ্গে আমার আব্বুর পূর্ব সম্পর্ক ফিরিয়ে আনবই। তুমি সবকিছু বলে আব্বুকে রাজি করাবে। আন্ধু তোমার কথা না রেখে পারবে না। আমি জানি আব্ব তোমাকে কত ভালবাসে।
এই বয়সেও সেই প্রথম জীবনের মতো স্বামী যে তাকে পাগলের মতো ভালবাসে, তা উম্মে হাফসা জানেন। তাই ছেলের মুখে সেই কথা শুনে লজ্জা পেলেও অন্তর জুড়িয়ে গেল। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে মৃদু হেসে বললেন, খুব সেয়ানা হয়ে গেছিস না?
বারে সেয়ানা হব না? কত বয়স হল, মা হয়ে তাতো ভালো করেই জান।
প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তোর আব্বর সঙ্গে তাসনিমের আব্বার আগের ও এখনকার সম্পর্কের কথা তুই কী ওকে বলেছিস?
না বলি নি। ভাবছি, কয়েকদিনের মধ্যে জানাব।
আমি না-হয় তোর আব্বকে রাজি করাব; কিন্তু তাসনিম যখন জানবে তুই রাজাকারের ছেলে তখন যদি তোকে ঘৃণা করে সরে যায় তখন কী করবি?
একথা যে ভাবিনি, তা নয়। এ ব্যাপারটা আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি। তিনি ভাগ্যে যা রেখেছেন, মুসলমান হিসাবে তা মেনে নিতেই হবে। তবু বান্দারা আল্লাহর কাছে মনের কামনা বাসনা জানায়। আমিও জানাচ্ছি। তুমি দোয়া করো আম্মু, আল্লাহ যেন আমার কামনা বাসনা পূরণ করেন।
উম্মে কুলসুমের মুখে তোর উদ্দেশ্যের কথা শোনার পর থেকেই প্রতি ওয়াক্ত নামাযের পর দোয়া করি। তারপর উম্মে কুলসুমের কাছে তাসনিমের বাবার কাছ থেকে যে বিপদ আসার কথা বলেছিলেন তা বললেন।
তুমি যে বিপদ আসার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছ, তা আমিও ভেবেছি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাসনিম আমার পরিচয় পাওয়ার পরেও দূরে সরে যাবে না। তারপর যখন আমার উদ্দেশ্যের কথা জানবে তখন আমাকে সাহায্য করবে। আর আমার অনুমান যদি সত্য না হয়, তা হলে ভাগ্যকে মেনে নেব। তুমি এসব নিয়ে এতটুকু দুশ্চিন্তা করো না।
আব্দুস সাত্তার সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার কয়েকদিন পর আজ দেশের বাড়িতে চলে যাওয়ার সময় উম্মে হাফসা ছেলেকে বললেন, তাসনিমকে সবকিছু জানাবার পর কি হয় না হয়, চিঠি দিয়ে জানাবি। কাল রাতে যে তুই বললি, বাড়ি চলে যাওয়ার কথা শুনে তাসনিম আজ আসবে। কই, এখনও তো এল না?
আব্দুস সাত্তার বলল, হয়তো কোনো কারণে লেট হচ্ছে।
এমন সময় তাসনিম পর্দা ঠেলে ঢুকে সালাম দিল।
উম্মে হাফসা সালামের উত্তর দিয়ে হাসিমুখে বললেন, এসেছো না? তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নচেৎ অনেক আগেই রওয়ানা হয়ে যেতাম। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবকিছু গাড়িতে তোলা হয়েছে?
এমন সময় রাইসা বেগম এসে বললেন, কখন রওয়ানা হবে? আরো দেরি করলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে তো?
উম্মে হাফসা বললেন, এই তো এক্ষুনি রওয়ানা হব।
তাসনিম এগিয়ে এসে উম্মে হাফসাকে কদমবুসি করে রাইসা বেগমকেও করল।
দু’জনেই মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করলেন। তারপর উম্মে হাফসা তার হাত ধরে নিচে এসে গাড়িতে উঠার সময় ছেলের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এই দুরন্ত ছেলেটা কারো কথা শোনে না, তুমি একটু শাসন করে দিওতো মা।
সবার অলক্ষ্যে আব্দুস সাত্তার ও তাসনিম একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।