» » সে কোন বনের হরিণ

বর্ণাকার

দুই

প্রায় চার মাস হতে চলল, আব্দুস সাত্তারের ফোন না পেয়ে রূপা চিন্তা করল, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। নচেৎ যে নাকি তিন মাস প্রতি রাতে ফোন করত, সে এতদিন ফোন না করে আছে কি করে? যাকগে, ভালই হল, কোথাকার কে না কে? ফোন করা বন্ধ করতে দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। এইসব ভাবলেও প্রতিদিন রাত সাড়ে বারটার সময় ফোনের সেটের দিকে পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই দৃষ্টি চলে যায়। তার মনে হয়, এক্ষুনি বুঝি রিং বেজে উঠবে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিরাশ হয়ে আবার পড়ায় মন দেয়। আব্দুস সাত্তার যখন ফোন করত তখন রূপা বিরক্ত হলেও মনের মধ্যে এক ধরণের রোমাঞ্চ অনুভব করত। ফোন না আসায় সেই রোমাঞ্চ থেকে বঞ্চিত হয়ে ব্যথা অনুভব করে।

আপুর হাবভাব সায়মার চোখ এড়াল না। একদিন সাড়ে বারটার সময় তাকে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, কী রে আপু, সেটের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? আব্দুস সাত্তার ফোন করে নি বলে তুই কী কিছু ফিল করছিস?

রূপা বড় বড় চোখে তার দিকে তাকাল।

আহ হা, তুই ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আমার মনে হচ্ছে, ছেলেটা সত্যিই ফ্রড। তুই দেখা করার কথা বলতে কেটে পড়ল। তা না হলে এতদিন ফোন না করার কারণ কী?

তার কথা শুনে রূপার মনে হল, সায়মা ঠিক কথাই বলেছে। দৃষ্টি সংযত করে বলল, তোকে লেকচার দিতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দে বলে পড়ায় মন দিল।

এরপর কয়েকদিন রূপা সাড়ে বারটার সময় ফোনের সেটের দিকে তাকাল না আব্দুস সাত্তারের কথা ভুলে যাওয়ার জন্য। আজ হঠাৎ অজান্তে ঐ সময়ে সেটের দিকে তাকিয়ে ভাবল, সত্যিই কি আব্দুস সাত্তার আর কোনোদিন ফোন করবে না? সে কি সত্যিই ফ্রড? তার মন বলে উঠল, না-না, আব্দুস সাত্তার কোনোদিন ফ্রড হতে পারে না।

আজও ব্যাপারটা সায়মার চোখ এড়াল না। বলল, আব্দুস সাত্তারের ফোন না করার দুটো কারণ থাকতে পারে।

রূপা তার দিকে তাকিয়ে একটু রাগের সঙ্গে বলল, তোকে আমার ব্যাপারে নাক গলাতে নিষেধ করেছি না?

রাগ করছিস কেন আপু? কথাটা হঠাৎ মনে হল তাই বলছি। প্রথমটা হল, তার মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষার পর গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। দ্বিতীয়টা হল, হয়তো কোনো কঠিন অসুখ হয়ে মারা গেছে।

গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে শুনে রূপা একটু কষ্ট অনুভব করলেও মারা যাওয়ার কথা শুনে খুব রেগে গেল। বলল, তুই একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে একজনের সম্পর্কে মারা যাওয়ার কথা বলতে বিবেকে বাধল না? জানিস না, কারো মৃত্যু কামনা করতে নেই? খবরদার ওরকম কথা আর মুখে আনবি না।

সরি আপু, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও বলব না।

আরো একমাস পর রূপার পরীক্ষা শুরু হল। শেষ হতে প্রায় দু’মাস সময় লাগল। যেদিন শেষ হল সেদিন রাতে দশটার সময় খেয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ল। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য দৈনিক প্রায় চৌদ্দ পনের ঘণ্টা পড়াশোনা করেছে। তাই বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে।

সায়মার দু’মাস পরে পরীক্ষা। তাই সে রাত দেড়টা দুটো পর্যন্ত পড়ে। আজও পড়ছিল। হঠাৎ এতদিন পর ফোন বেজে উঠতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সাড়ে। বারটা। ভাবল, নিশ্চয় আব্দুস সাত্তার ফোন করেছে। সেটটা রূপার খাটের মাথার দিকের টেবিলের উপর। ফোন বাজার শব্দে আপুর ঘুম ভাঙার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। পাঁচ ছ’বার রিং হওয়ার পরও যখন তার ঘুম ভাঙল না তখন উঠে এসে রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো, কে বলছেন?

আমি আব্দুস সাত্তার। তারপর সালাম দিয়ে বলল, আপনি সায়মা তাই না?

সালামের উত্তর দিয়ে সায়মা বলল, হ্যাঁ।

আপনার আপুকে একটু দিন তো?

এতদিন কোথায় ছিলেন বিদ্রুপকণ্ঠে বলতে গিয়েও সায়মা সামলে নিল। বলল, আপু ঘুমাচ্ছে, ডাকা যাবে না।

কেন?

পরীক্ষা চলছিল, দিন রাত পড়াশোনা করেছে। আজ শেষ পরীক্ষা ছিল। তাই দশটায় খেয়ে এসে ঘুমিয়েছে। কাল সকালে না হয় ফোন করুন। আমি আপুকে আপনার ফোন করার কথা বলে রাখব।

ঠিক আছে, তাই করব। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনারা নিশ্চয় ভালো আছেন?

হ্যাঁ ভালো।

আপনার তো সামনে পরীক্ষা, পড়ছিলেন বুঝি?

হ্যাঁ তাই।

সকালে ক’টার সময় ফোন করলে আপনার আপুকে পাব?

সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। পরে হয়তো আপু কোথাও বেরিয়ে যেতে পারে।

এবার রাখছি তা হলে, বলে আব্দুস সাত্তার সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

সায়মা যত রাত জেগে পড়ুক না কেন? ফজরের নামাযের সময় ঘুম ভাঙবেই। নামায পড়ে ও কুরআন তেলাওয়াত করে ঘণ্টাখানেক ঘুমাবে। তারপর উঠে নাস্ত। খেয়ে পড়তে বসবে। এটাই তার প্রতিদিনের রুটিন।

সূর্য ওঠার আধঘণ্টা আগে ওঠা রূপার বরাবরের অভ্যাস। ফজরের নামায পড়ে পনের মিনিট কুরআন তেলাওয়াত করবে। তারপর আধঘণ্টা বাগানে হাঁটবে। কিন্তু আজ ফজরের নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করার সময় ঘুমে চোখ বুজে আসছিল বলে তেলাওয়াত বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফোন বাজার শব্দে জেগে গেল। হাত বাড়িয়ে রিসিভার কানের কাছে নিয়ে ঘুম জড়ান কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলল, হ্যালো, কাকে চান?

সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, যাকে চাই তিনিই ফোন ধরেছেন। মনে হচ্ছে, আজ বাগানে হাঁটতে না গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙিয়ে নিশ্চয় অন্যায় করে ফেললাম। সেজন্য ক্ষমা চাইছি।

আব্দুস সাত্তারের গলা বুঝতে পেরে রূপার ঘুমের ভাবটা দ্রুত কেটে গেল। তখন তার তনুমনে আনন্দের শিহরণ বইতে শুরু করল। ধড়ফড় করে উঠে বসে। কিছু বলতে গিয়েও পারল না। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

কী হল? ক্ষমা চাইলাম, তবু চুপ করে আছেন যে?

কাল ফোন করার কথা বলে ছ’মাস ডুব মেরে ছিলেন কেন?

সেজন্যও ক্ষমা চাইছি।

ডুব মারার কারণ আগে বলুন। তারপর ক্ষমা করার কথা চিন্তা করব।

প্রথম কারণ, ঐদিন ফোনে যা কিছু বলেছি, আম্মু সব শুনে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটা কে? বললাম, ঐ মেয়েকে আমি ভালবাসি। আম্মু পরীক্ষার আগে আপনাকে ফোন না করার ওয়াদা করিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কারণ, আমার ও আপনার পরীক্ষার ব্যাপার ছিল। তৃতীয় কারণ, পরীক্ষার পরের দিন আমাকে নিয়ে আম্মু তার বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানে ফোন নেই। এমন কি আট দশ মাইলের মধ্যেও নেই। গতকাল ফিরে রাতে ফোন করেছিলাম। সায়মা ফোন ধরে বললেন, “আপনি ঘুমাচ্ছেন, জাগান যাবে না। আগামীকাল সকালে ফোন করবেন। আমি আপাকে আপনার কথা বলে রাখব?” তিনি কি বলেন নি?

না। হয়তো জানাতে ভুলে গেছে অথবা সময় পাই নি।

উনি এখন কোথায়?

ঘুমাচ্ছ।

এবার তা হলে বলুন ক্ষমা করেছেন?

আপনি দু’টা ব্যাপারে ক্ষমা চেয়েছেন। প্রথমটা ক্ষমা করলাম। দ্বিতীয়টার ব্যাপারে সামনা-সামনি না হলে ক্ষমা করব না। বলুন, কখন আমাদের সাক্ষাৎ হচ্ছে?

তা বলব, তবে তার আগে বলতে হবে, “আমাকে ভালবাসেন।”

বোকার মতো কথা বলছেন কেন? আপনি এতকিছু জানেন, আর একথা জানেন, ভালবাসা মনের ব্যাপার? আপনাকে কখনও দেখি নি। দেখার পর যদি মনে ভালবাসা জন্মায় অথবা আপনার আচার-আচরণ ভালো মনে হয়, তখন না হয় বলতে পারি? তা ছাড়া শুধু মুখে ভালবাসি বললে তো আর সত্যিকার ভালবাসা হয় না।

আপনি ঠিক কথা বলেছেন। তবে কী জানেন? আমার খুব ভয় হয়, আমাকে দেখে যদি আপনার মনে ভালবাসা না জন্মায়? তখন হয়তো নিজেকে সামলাতে পারব না। কিছু অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারি।

তার কথা শুনে রূপা একটু ঘাবড়ে গিয়ে চিন্তা করল, বড় লোকের বখে যাওয়া ছেলে নয়তো? যদি সত্যিই তাই হয় তা হলে তার সামনে যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। কি করা উচিত বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করতে লাগল।

কী ব্যাপার, চুপ করে আছেন কেন? আমার কথা শুনে খুব ভয় পেয়েছেন, তাই?

রূপা আমতা আমতা করে বলল, না, মানে, ভয় পাব কেন? ||||||

|||| আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, আমি সিওর, আমার কথা শুনে আপনি ভয় পেয়েছেন। শুনুন, আমাকে দেখার পর আপনার মনে ভালবাসা জন্মান অথবা না জন্মান আল্লাহ পাকের মর্জি। এতে আপনার কোনো দোষ হবে কেন? অঘটন ঘটার কথা যে বললাম, তা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে বিশ্বাস রাখতে পারেন, আপনার এতটুকু ক্ষতি করব না। একটা কথা জেনে রাখুন, কেউ কাউকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবাসলে একবিন্দু পরিমাণ ক্ষতি তার করতে পারে না। যে করে, সে ভালবাসার মর্ম বোঝে না অথবা সত্যিকার ভালবাসা কাকে বলে জানে না। ঠিক আছে, আপাততঃ সামনা-সামনি হওয়ার দরকার নেই। আরো কিছুদিন যাক। তারপর আপনার মন যখন চাইবে তখন সামনা-সামনি হওয়া যাবে। তবে ইচ্ছা করলে এখন আমাকে দূর থেকে দেখতে পারেন। কাছে গিয়ে আলাপ করার প্রয়োজন নেই।

কথাটা রূপার মনে ধরল। বলল, তা হলে বলুন, কিভাবে আপনাকে দেখব?

আজ পাঁচটার সময় সংসদ ভবন চত্বরে একটা লাইট পোস্ট সামনে রেখে আমি আসরের নামায পড়ব। সে সময় আমাকে দেখতে পারেন। যদি আপনার। বায়নোকুলার থাকে, তা হলে কাছে না গিয়ে দূর থেকে খুব ভালোভাবে দেখতে পাবেন।

ঠিক আছে, তাই হবে। এবার রাখি তা হলে?

তার আগে বলুন, কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

তা জানার দরকার নেই।

কেন?

লোকে আপনজনের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। আমি তো আপনার তেমন কেউ নই।

কথাটা ঠিক বলেন নি। আপনজন না হলেও এমনি আলাপ পরিচয় থাকলে সবাই-ই ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। আর এটা করাও ভদ্রতা। যেমন আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।

আপনি অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। তবে আপনাকে আমি আপনজন ভাবি। তাই জিজ্ঞেস করেছি। যাই হোক, পাঁচটার সময় সংসদ ভবন চত্বরে নিশ্চয় আসছেন?

ইনশাআল্লাহ আসব। এবার রাখছি বলে রূপা সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

ফোন বাজার সাথে সাথে সায়মারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘড়ি দেখে বুঝতে পারে আব্দুস সাত্তার ফোন করেছে। আপুর ঘুম ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করে। তারপর তাকে ফোন ধরে কথা বলতে দেখে এতক্ষণ ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিল। লাইন কেটে দিতে জিজ্ঞেস করল, আব্দুস সাত্তার ফোন করেছিল, তাই না?

রূপা বলল, হ্যাঁ।

ইনশা আল্লাহ আসব বললি, নিশ্চয় তার সঙ্গে দেখা করতে যাবি?

হ্যাঁ যাব।

কখন? কোথায়?

আজ পঁচটার সময় সংসদ ভবন চত্বরে।

আমিও তোর সঙ্গে যাব।

কেন?

কেন আবার? সেদিন বললাম না, ছেলেটা ফ্রড হতে পারে? একা পেয়ে তোর ক্ষতি করতে পারে? তাই বলছিলাম কি, ওমর ভাইকেও আমাদের সঙ্গে নিলে ভালো হয়।

তুই যেতে চাচ্ছিস যাবি। ওমর ভাইকে টানছিস কেন? জানিস তো, তাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না।

ওমর ওদের মামাতো ভাই। তার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো। ধানমণ্ডিতে বাড়ি করেছেন। গাড়িও আছে। ওমর পল সাইন্সে মাষ্টার্স করেছে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। দেখতেও খুব সুন্দর। কলেজ লাইফ থেকে কমিউনিষ্ট পার্টি করে। মাষ্টার্স করার পর পুরোপুরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। আত্মিয়তার সুবাদে রূপাও সায়মার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা করে। রূপা যে বছর অনার্সে ভর্তি হয়, সে। সময় ওমর একদিন তাকে বলল, তোকে আমার ভীষন পছন্দ। পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করব। তুই যেন এর মধ্যে আবার কারো প্রেমে-ট্রেমে পড়ে যাস নি।

ওমর ভাই যে কোনো অংশে তার অনুপযুক্ত নয়, তা রূপা জানে। শুধু সে রাজনীতি করে বলে তাকে অপছন্দ করে। তাই বলল, কারো প্রেমে-ট্রেমে পড়ব। কিনা জানি না; তবে তুমি যে কথা বললে, তা কখনই সম্ভব নয়।

ওমর বলল, কেন?

কোনো মুসলমান মেয়ে কমিউনিষ্ট ছেলেকে বিয়ে করতে পারে না। কমিউনিষ্টরা কুরআন-হাদিস বিশ্বাস করে না। তারা ধর্মকে অফিসের সঙ্গে তুলনা। করে। এক কথায় কমিউনিষ্টরা ইসলামের দুশমন।

তোর কথা ঠিক নয়। পৃথিবীর অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে কমিউনিষ্ট পার্টি আছে।

দেখ ওমর ভাই, তুমি আমার থেকে অনেক জ্ঞানী। তোমার সঙ্গে যুক্তি তর্কে পারব না। তবু একটা কথা না বলে পারছি না। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব মতবাদ আছে। আর তা একের সঙ্গে অন্যের মিলে না। ফলে যে যার মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ ও হানা-হানিতে জড়িয়ে পড়ছে। এর কারণ কোনো মানুষের মতবাদ যত ভালো হোক না কেন, তা তার যুগের জন্য প্রযোজ্য হলেও সর্বযুগের জন্য হতে পারে না। কারণ মানুষ যত বড় জ্ঞানীই হোক, তার জ্ঞান সসীম। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ। রাব্দুল আল-আমিন অসীম জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর সৃষ্টিকূলের মঙ্গলের জন্য যে মতবাদ আমাদের নবী (দঃ) এর মারফত জানিয়েছেন, তা সর্বযুগের ও সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। যারা প্রকৃত মুসলমান, তারা তাঁর সেই মতবাদ ছাড়া মানুষের মতবাদ গ্রহণ করতে পারে না। যারা করে তারা মুসলমান নামের অযোগ্য। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছ, কেন আমি তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয় বললাম?

ওমর বলল, ধর্ম মানুষকে অলস ও অকর্মণ্য করে দেয়, সভ্যতাকে বাধা দেয়, সম্মুখে অগ্রসর হতে দেয় না, অন্ধকার যুগের দিকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায়। তাই কমিউনিষ্টরা ধর্মকে স্বীকার করে না।

চুপ কর ওমর ভাই, চুপ কর। তাই যদি হত, তা হলে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) যখন ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন তখন সমগ্র আরব অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবেছিল। মানুষ অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার-ব্যভিচার, মদ-জুয়া, হিংসা-বিদ্বেষ ও হানা-হানিতে লিপ্ত ছিল। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তারা কি আরো অসভ্য ও বর্বর হয়েছিল? না সত্য জ্ঞানের আলোতে সভ্যতার চরম শিখরে উঠেছিল? তুমি বোধহয় ইসলামের ইতিহাস পড় নি অথবা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মণিষীদের উক্তিও পড় নি। যদি ঐ সব পড়তে ও জানতে, আরবের মরুভূমিতে যে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা আল্লাহ পাক বপন করেছিলেন, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। সেই আলো সারা পৃথিবীর অন্ধকার দূর করে আলোয় আলোকিত করেছে। জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এর বেশি কিছু তোমাকে বলতে পারলাম না। আমার কথা শুনে তুমি আবার মনে করো না, আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তবে তোমার পার্টির মতবাদকে ঘৃণা করি।

এরপরও ওমর মাকে দিয়ে ফুফু-ফুফার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। তারা জানতেন, রূপা কমিউনিষ্ট ছেলেকে বিয়ে করবে না। তাই না করে দেন।

ওমর ভাই আপুকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করতে চায়, সায়মা জানে; কিন্তু আপু যে কেন তাকে পছন্দ করে না, তা জানে না। তাই রূপা যখন বলল, “ওমর ভাইকে টানছিস কেন? জানিস তো তাকে আমি ঘৃণা করি” তখন বলল, কেন যে। তুই তাকে সহ্য করতে পারিস না, তা বুঝি না। ওমর ভাইয়ের মতো হ্যান্ডসাম ও ভালো ছেলে আজকাল দেখাই যায় না।

রূপা বলল, তুই যে দেখছি কলেজে ঢুকতে না ঢুকতেই পেকে খয়ের হয়ে। গেছিস। ভার্সিটিতে ঢুকে কী হবি আল্লাহই জানে।

পেকে খয়ের হওয়া কি জিনিস জানি না। আমার যা মনে হয়েছে বলেছি।

ওমর ভাইকে যদি তোর এতই পছন্দ, তা হলে বল, আম্মুকে বলে এনগেজমেন্ট করে রাখতে বলি।

কথাটা মন্দ বলনি। তবে মাঝ পথে তিনটে বাধা। প্রথম বাধা হল, ওমর ভাই তোমাকে পছন্দ করে। দ্বিতীয় বাধা, সে আমাকে কিছুতেই বিয়ে করবে না। আর। তৃতীয় বাধা, যে তোমাকে পছন্দ করে তাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব। নয়। এসব কথা রেখে আমাকে সঙ্গে নেবে কিনা বল?

তোকে নিতে পারি। তারপর আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করার পদ্ধতিটা বলে। বলল, তোর বায়নোকুলারটা নিবি।

সায়মা বলল, বায়নোকুলার নেওয়ার দরকার কী? নামায পড়া হয়ে গেলে আমরা কাছে গিয়ে আলাপ করব। নামায পড়ে যখন, ফ্রড হতে পারে না। তা ছাড়া ঐ সময় ওখানে অনেক লোকজন বেড়াতে আসে। কিছু ক্ষতি করার সম্ভাবনা নেই।

তবু তুই নিবি।

ঠিক আছে, নেব।

প্রতিদিন বিকেলে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংসদ ভবন চত্বরে লোকজন বেড়াতে আসে। তাদের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকা বেশি। আবার অনেকে স্বপরিবারেও বেড়াতে আসে। গ্রামদেশ থেকেও অনেকে সংসদ ভবন দেখার জন্য আসে।

রূপা ও সায়মা বেশ কয়েকবার বেড়াতে এসেছে। আজ দু’বোন পৌঁনে পাঁচটায় এল। গাড়ি থেকে নেমে রূপা ড্রাইভারকে বলল, আমাদের সঙ্গে আসতে হবে না, গাড়িতেই থাকুন। তারপর তারা হেঁটে এসে সংসদ ভবনের সিঁড়িতে বসল।

এমন সময় তিনটে ছেলে তাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একজন দেখ দেখ, কি খাসা দু’টা মাল বলে দাঁড়িয়ে অন্য দু’জনকে ইশারা করে দেখাল।

অন্য দু’জন রূপা ও সায়মার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলল, সত্যি দোস্ত, এরকম মাল জীবনে দেখি নি।

তাদের কথা শুনে দু’বোনই বিব্রত বোধ করল। সায়মা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রূপা বলে উঠল, এই যে দ্র ঘরের ছেলেরা, মাল শব্দটার লটা বাদ দিলে কি হয়?

এরকম প্রশ্ন শুনে দু’জন লজ্জা পেলেও যে ছেলেটা প্রথমে মাল বলে ইশারা করেছিল, সে পেল না। বরং হাসিমুখে বলল, আমরা বাদ দিলে কী হবে? বাবারা তো ছাড়বে না।

এবার রূপা কিছু বলার আগে সায়মা রাগের সঙ্গে বলল, আপনাদের ঘরে কী মা বোন নেই?

ঘরে তো সবারই মা বোন আছে। বাইরের মেয়েদের মা বোন ভাবলে বিয়ে করব কাকে?

এই কথার উত্তর দিতে না পেরে দু’বোন যেমন অপমান বোধ করল, তেমনি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল।

তাই দেখে ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠল। তাদের মধ্যে সেই ছেলেটা বলল, এই যে ম্যাডামদ্বয়, ঢিল ছুঁড়লে যে পাটকেল খেতে হয়। তা বুঝি জানা ছিল না?

রূপা ও সায়মা আসার আগে আব্দুস সাত্তার এসে কিছুটা দূরে বসে ছিল। ওদেরকে আসতে দেখে। কাছাকাছি এসে এতক্ষণ ঘটনাটা দেখছিল। রূপা ও সায়মার অবস্থা বুঝতে পেরে ছেলেগুলোর কাছে এসে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, বাইরের মেয়েদের মা বোনের মতো মনে না করলেও তাদেরকে সম্মানের চোখে দেখতে হয়।

ছেলেগুলো ভার্সিটির ছাত্র। নাম আজিজ, মহসিন ও ইউসুফ। তিন জনেই ধনী ও ভদ্র ঘরের ছেলে। চান্স পেয়ে একটু মজা করছিল। আজিজ ও ইউসুফ এক পার্টির সমর্থক হলেও পার্টির কাজ করে না। কিন্তু মহসীন করে। সে একই পার্টির। নেতার সহকারী। তাই তার কাছে সব সময় পিস্তল থাকে। বেশ একটু রাগী ধরণের ছেলে। দু’টো সুন্দরী ললনাকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে বেশ আনন্দ উপভোগ করছিল। বাধা পড়তে রেগে গিয়ে আব্দুস সাত্তারের দিকে কটমট করে তাকিয়ে। বলল, আপনি আবার কোথা থেকে এলেন? ভালো চান তো কেটে পড়ন।

আজিজ ও ইউসুফের দিকে তাকিয়ে আব্দুস সাত্তার হাসিমুখে বলল, আপনারাই বলুন তো ভাই, আমি কী কোনো খারাপ কথা বলেছি?

তার কথার উত্তর না দিয়ে আজিজ মহসিনের একটা হাত ধরে বলল, বাদ দে দোস্ত, গ্যাঞ্জাম করে লাভ নেই, চল যাই।

ইউসুফ জানে মহসিন সামান্য কারণে রেগে যায় এবং প্রায় সময়ই কোনো না কোনো ঘটনা ঘটিয়ে বসে। তাই তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ছেলেটা হয়তো ওদের কাজিন। প্লীজ, কোনো সীন ক্রীয়েট করিস না। চারদিকে লোকজন রয়েছে, সমস্যা হয়ে যাবে।

মহসিন তাদের কথায় কান না দিয়ে আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা কী আপনার কাজিন? না ওদের কাছে নিজেকে হীরো প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন?

আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, আপনার দু’টো অনুমানই ভুল। আপনাদের মতো আমিও এখানে বেড়াতে এসেছি।

তা হলে আর কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়ন।

আব্দুস সাত্তার মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল, আপনারা প্রথম, তারপর আমি।

রূপা দাঁড়িয়ে বলল, প্লীজ, আপনারা চুপ করুন, আমরাই চলে যাচ্ছি।

আব্দুস সাত্তার বলল, না, আপনারা বসুন। তারপর মহসিনের দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন, আমরা একসঙ্গে যাই।

মহসিন বলল, না, আপনি চলে যান। আমরা যাব, কিনা যাব সেটা আমাদের ব্যাপার।

তা হলে কথা দিন, ওঁদেরকে আর অপমান করবেন না?

মহসিন এতক্ষণ রাগ সামলে রাখতে পারলেও এখন আর পারল না। বলল, আর একটা কথা বললে তোর নায়কগিরি ছাড়িয়ে দেব।

আব্দুস সাত্তার বলল, ভার্সিটির ছাত্র হয়েও ভদ্রতা শেখেন নি?

তবে রে ভদ্রতা শেখাচ্ছি বলে মহসিন তার গালে একটা চড় মেরে বলল, যা শালা, ভাগ।

চড়ের আঘাতে আব্দুস সাত্তারের ফর্সা গালটা লাল হয়ে গেল। গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ভার্সিটিতে পড়লে কি হবে, আপনার বংশ বোধহয় ভালো নয়।

কী? বংশ তুলে কথা বলছিস? এত বড় সাহস বলে মহসিন এবার তার মুখে। ঘুষি মারতে গেল।

আব্দুস সাত্তার হাতটা এক হাতে ধরে অন্য হাত দিয়ে তার গালে একটা চড় মেরে বলল, একটু আগে বললেন না, “ইট ছুঁড়লে পাটকেল খেতে হয়?” পাটকেল। আর ছুঁড়লাম না, আপনার ইটটাই ফিরিয়ে দিলাম। তবে এরপর যদি আবার কিছু ছুঁড়তে চান, তা হলে আপনার কথাটা বাস্তবে ঘটবে। আর শুনুন, কথায় আছে, “জন্ম হউক যথা তথা, কর্ম হউক ভালো।” কথাটা মনে রাখবেন। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, লেখাপড়া যখন করছেন তখন ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করুন।

মহসিন রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাতে দাতে চেপে বলল, শালা শুয়োরের বাচ্চা, দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি বলে পকেট থেকে পিস্তল বের করে তার দিকে তাক করল।

আব্দুস সাত্তার পিস্তল দেখেও নির্ভয় কণ্ঠে বলল, আপনাদের মতো গুটিকয়েক ছেলের জন্য ভার্সিটির এত দুর্নাম। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।

মহসিন কর্কশ কণ্ঠে বলল, খুব যে বড় বড় বুলি ছাড়ছিস, আমাকে চিনিস?

তা আর চিনি না, আপনি হলেন…..পার্টির সহকারী নেতা।

তোকে এক্ষুনি শেষ করে দিতে পারি, তা বোধহয় জানিস না?

আব্দুস সাত্তার চড় মেরে হাত ছেড়ে দেওয়ার পর খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে মহসিন পিস্তল বের করে তার দিকে তাক করে রয়েছে।

শেষ করে দেওয়ার কথা শুনে আব্দুস সাত্তার তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, শেষ করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তবে আপনার হাতে আমার মৃত্যু লেখা থাকলে মরব। নচেৎ……।

তাকে থাটা শেষ করতে না দিয়ে মহসিন গর্জে উঠল, দাঁড়া বলছি। আর একপা এগোলে গুলি খাবি।

আজিজ ও ইউসুফ মহসিনকে জাপটে ধরে বলল, এ কী করছিস? তারপর আব্দুস সাত্তারকে বলল, আপনি চলে যান তো ভাই।

তোরা আমাকে ছেড়ে দে বলে আজিজ গুলি করল।

ধস্তাধস্তির ফলে গুলিটা আব্দুস সাত্তারের বুকে না লেগে বাম কাঁধের কিছু মাংস নিয়ে বেরিয়ে গেল।

আব্দুস সাত্তার তা গ্রাহ্য না করে মহসিনের হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিয়ে বলল, এবার আমি যদি আপনাকে গুলি করে শেষ করে দিই, তা হলে কী অন্যায় হবে? তারপর মৃদু হেসে বলল, ভয় নেই, গুলি করব না। আমি আপনাদের চিনি। আর কোনো সীন ক্রিয়েট না করে চলে যান। পিস্তলটা কাল আপনার পার্টির নেতার কাছ থেকে নেবেন।

আজিজ ও ইউসুফ মহসিনকে ধরে জোর করে বেশ কিছুটা দূরে নিয়ে আসার পর আজিজ বিরক্ত কণ্ঠে বলল, তুই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এমন কাণ্ড করিস, যা। মোটেই উচিত নয়।

আজিজ থেমে যেতে ইউসুফ বলল, এত ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে মাথা গরম করা তোর উচিত হয় নি। ছেলেটা তোকে চিনে বলল, নেতার কাছে নালিশ করতে পারে। নেতা অবশ্য তোকে কিছু বলবে না। তা জেনে ছেলেটা এ্যাকসান নিতে পারে।

মহসিন সরকারী পক্ষের এক এমপির ছেলে। তাই তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, আরে দূর, ও আবার কি এ্যাকসান নেবে? এ্যাকসান নিতে এসে শেষে জানটাই হারাবে।

ইউসুফ বলল, তুই নেতার সহকারী, তোকে ধৈর্যশীল হতে হবে।

হয়েছে হয়েছে, তোদেরকে আর উপদেশ দিতে হবে না। ঐ দিকটায় চল, বসে আড্ডা দিই।

গুলির শব্দ শুনে দূরের অনেকে তাদের দিকে তাকিয়েছিল। যারা কাছে ছিল, তারা দূরে সরে গিয়ে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করছিল। কেউ এগিয়ে আসার সাহস করে নি।

রূপা ও সায়মা আব্দুস সাত্তারের কার্যকলাপে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়েছিল।

ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর হঠাৎ রূপার লক্ষ্য পড়ল, সাহায্যকারী ছেলেটার ক্ষত থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে। এসে নিজের গায়ের ওড়না ছিঁড়ে বেঁধে দিয়ে বলল, শীঘ্রই সরওয়ার্দিতে চলুন।

আব্দুস সাত্তার যন্ত্রণা ভুলে একদৃষ্টে রূপার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বাধার পর রূপা যখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে সরওয়ার্দিতে যাওয়ার কথা বলল তখন। চোখে চোখ পড়ল। কয়েক সেকেন্ড কারো চোখের পলক পড়ল না।

প্রথমে রূপাই বলে উঠল, কই চলুন। বাঁধলেও রক্ত বন্ধ হয়নি। তারপর সায়মাকে দেখিয়ে বলল, আমার বোন। আমরা গাড়ি নিয়ে এসেছি, চলুন আমাদের সঙ্গে।

আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, ধন্যবাদ। আপনাদেরকে যেতে হবে না, আমি একাই যেতে পারব। তারপর সালাম দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

রূপা সায়মাকে আসতে বলে তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমাদের জন্য আপনার এই অবস্থা। আপনাকে সাহায্য করা কী উচিত নয়?

বাম হাতটা ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে ছিঁড়ে পড়ে যাবে। দাঁতে দাঁত চেপে আব্দুস সাত্তার সহ্য করছে। তাই কিছু বলতে পারল না।

রূপা ও সায়মার সঙ্গে একজন রক্তাক্ত ছেলেকে আসতে দেখে ড্রাইভার তাড়াতাড়ি গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিল। আব্দুস সাত্তার দু’বোনকে উদ্দেশ্য। করে বলল, দেখুন, আমি একটা রিক্সা…

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রূপা বলল, আপনার কোনো কথাই শুনব।, গাড়িতে উঠুন। এই অবস্থায় আপনি একা রিকসায় যেতে পারবেন না।

সরওয়ার্দি হাসপাতাল থেকে ড্রেসিং ও ব্যান্ডিজ করিয়ে বাইরে এসে রূপা বলল, চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই।

আব্দুস সাত্তার বলল, আমার জন্য আপনারা অনেক করেছেন। সে জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আগের থেকে অনেক সুস্থ বোধ করছি, একা যেতে কোনো অসুবিধে হবে না। তারপর আসি বলে সালাম বিনিময় করে একা স্কুটারে উঠে চলে গেল।

দুই বোন হাঁ করে স্কুটারের দিকে তাকিয়ে রইল। অদৃশ্য হয়ে যেতে সায়মা বলল, আপু, ছেলেটা কিন্তু দারুণ।

রূপা বলল, দারুণ মানে?

মানে ছেলেটা যেমন দেখতে তেমনি সাহসী।

হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। চল বাসায় যাই।

সে কী? সংসদ ভবনে যাবে না? আব্দুস সাত্তার সাহেব হয়তো নামায পড়ে লাইট পোষ্টে হেলান দিয়ে তোর অপেক্ষায় তসবীহ পড়ছেন।

রূপা চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, তুই দিন দিন খুব ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। কেউ শুনে ফেললে কী মনে করত বলত?

সায়মা হেসে উঠে বলল, চারপাশে কেউ নেই দেখেই বলেছি। এখন কোথায় যাবি বল।

রূপা ঘড়ি দেখে বলল, সোয়া ছ’টা বাজে। এখন আর সংসদ ভবনে যেতে ইচ্ছা করছে না।

সায়মা হেসে উঠল।

কীরে হাসছিস যে?

হাসি পেল তাই হাসলাম।

শুধু শুধু কারো হাসি পায় না। কেন হাসি পেল বলবি তো?

সায়মা হাসি থামিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা পৌণে পাঁচটায় পৌঁছে পাঁচটা পঁচিশ পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। আমার ধারণা, এর মধ্যে আব্দুস সাত্তার সাহেব। নিশ্চয় কোনো একটা লাইট পোষ্টের কাছে নামায পড়েছেন এবং পুরো ঘটনাটা ও ছেলেটাকে নিয়ে ওখান থেকে চলে আসতে দেখেছেন। আমার গলায় বাইনোকুলার। ঝুলতে দেখে হয়তো ভেবেছেন, আমরা তাকে দেখেছি। কিন্তু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যে তার কথা একদম ভুলে গেছি, সে কথা জানতে পারেন নি। কথা শেষ করে সায়মা আবার হেসে উঠল।

রূপা ধমকের স্বরে বলল, এতে হাসবার কী হল?

সায়মা হাসি মুখেই বলল, বারে, এটা হাসির ব্যাপার নয় তো কী? তুই গেলি তোর প্রেমিককে দেখতে, তাকে দেখার কথা ভুলে নিজের গায়ের ওড়না ছিঁড়ে অন্য আর একজনের হাত বেঁধে দিলি। তারপর তাকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলি। এসব দেখে তোর বেচারা প্রেমিক নিশ্চয় ভাববেন, ছেলেটা তোর লাভার। অবশ্য কাজিনও ভাবতে পারেন।

রূপা রেগে উঠে বলল, তুই সময় সময় এমন আজে বাজে কথা বলিস, যা শুনে গা জ্বালা করে।

গা জ্বালা করুক আর অন্য কিছু করুক, রাতে ফোন এলেই বুঝতে পারবি। তোর বন্ধ কর তো, কান ঝালাপালা হয়ে গেল।

আমি কিছু বললেই বকবকানি হয়, আর নিজে যে পদে পদে ভুল করছিস, তা শুধরাবে কে?

রূপা একটু অবাক হয়ে বলল, আমি পদে পদে ভুল করছি মানে?

ছেলেটার নাম ঠিকানা নিয়েছিস? কেমন থাকেন না থাকেন জানার জন্য অন্ততঃ টেলিফোন নাম্বারটা নেওয়া উচিত ছিল নয় কী?

রূপা ভুলটা বুঝতে পারল। নরম স্বরে বলল, শুধু আমাকে দুষছিস কেন? তুই

তো জেনে নিতে পারতিস?

সবকিছুই জানতে আমার ইচ্ছা হয়েছিল; কিন্তু তুই কিছু মনে করতে পারিস ভেবে জিজ্ঞেস করি নি।

আমি আবার কী মনে করব?

যেভাবে ছেলেটার প্রতি দরদ দেখালি, ভাবলাম, তাকে তোর মনে ধরেছে, তুই তার পরিচয় নিবি। তাই তোকে ডিঙ্গিয়ে কিছু জানতে চাই নি।

রূপা হেসে উঠে বলল, এতদিন বলে এলি আমি আব্দুস সাত্তার সাহেবের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। একটু আগেও তাকে আমার প্রেমিক বলে উল্লেখ করলি। এখন বলছিস এই ছেলেটাকে পছন্দ করি। তোকে পাকা বলে ভুল করেছি। আসলে তোর বুদ্ধি একদম কাঁচা।

তা হলে আর একটা কাঁচা বুদ্ধির পরিচয় দিই, তাড়াতাড়ি আসরের নামায পড়ে নিই আয়, নচেৎ কাযা হয়ে যাবে। তারপর আপুকে কথা বলার সুযোগ না। দিয়ে অজু করার জন্য সায়মা বাথরুমে ঢুকল।