» » সে কোন বনের হরিণ

বর্ণাকার
🕮

ছয়

সায়মা ফাইন্যাল পরীক্ষা নিয়ে দু’মাস ব্যস্ত রইল। এরমধ্যে একদিনও আপুকে আব্দুস সাত্তারের ব্যাপারে কোনো কথা বলে নি। গতকাল পরীক্ষা শেষ হলেও রাতে তাকে কিছু বলে নি। আজ সকালে নাস্তা খাওয়ার পর বলল, তুই কী আব্দুস সাত্তার সাহেবের কোনো খোঁজ টোজ নিয়েছিলি?

তাসনিম খুব রাগের সঙ্গে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, না।

তুই রেগে যাচ্ছিস কেন আপু? সত্যিই তিনি বিয়ে করেছেন কিনা জানা উচিত ছিল তোর।

দেখ ওর সম্পর্কে আর একটা কথা বলবি না।

তুই ভুল করছিস আপু, বাসার কাজের বুয়ার কথাকে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা তোর ঠিক হয় নি।

তাসনিম আরো রেগে উঠে বলল, কথাটা যদি সত্য না হবে, তা হলে ওই বা এতদিন ফোন করে নি কেন?

ফোন না করার হয়তো কারণ থাকতে পারে।

তাসনিম বিদ্রুপকণ্ঠে বলল, ফোন না করার যে কারণ থাকতে পারে, তা তো। জানি না। আগে তুই তাকে ফ্রড বলতিস, এখন তার ফরে কেন কথা বলছিস বুঝতে পারছি না। আমার তো মনে হচ্ছে, সে সত্যিই একটা ফ্রড। বড়লোকের ছেলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। আমার মতো কতো মেয়ের সঙ্গে যে প্রেম করে। বেড়ায়, তার কোনো ঠিক আছে? ওদের মতো ছেলে অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলেও বিয়ে করে মা বাবার পছন্দ মতো মেয়েকে।

সায়মা চিন্তা করল, বেশি কিছু বললে, আপু আরো রেগে যাবে। তার চেয়ে সে গোপনে আব্দুস সাত্তারের খোঁজ খবর নেবে।

দুপুরে খেয়ে এসে রেষ্ট নেওয়ার সময় সায়মা ভাবল, আপু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ড্রইংরুম থেকে আব্দুস সাত্তারের বাসায় ফোন করবে। তাই ঘুমের ভান করে। অনেকক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর আপু ঘুমিয়ে গেছে বুঝতে পেরে খাট থেকে নেমে। দরজার বাইরে এসেছে, এমন সময় ফোন বেজে উঠতে ফিরে আসতে লাগল।

সায়মা আসার আগেই তাসনিমের ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়িয়ে রিসিভার কানের কাছে নিতে আব্দুস সাত্তারের গলা শুনতে পেল “আসসালামু আলায়কুম।”

তাসনিম ধড়ফড় করে উঠে বসল। তখন তার হার্টবিট অনেক বেড়ে গেল। সালামের উত্তর দিতে পারল না; রাগে ফুলতে লাগল।

কী হল তাসনিম? চুপ করে আছ কেন? জান না, হাদিসে আছে, “সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজীব?” না দিলে গুনাহ হবে। তা ছাড়া তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য পাগল হয়ে আছি। প্লীজ, কথা বল।

তাসনিম কর্কশ কণ্ঠে বলল, একজন প্রতারক, ছোটলোক, ইতরের মুখে হাদিসের পবিত্র বাণী শুনতে চাই না।

আব্দুস সাত্তার খুব আশ্চর্য হয়ে আহতকণ্ঠে বলল, এ তুমি কী বলছ তাসনিমঃ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

একজন ফ্রড ও বেঈমানের মুখে আমার নামও শুনতে চাই না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি বলে রিসিভার রেখে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

সায়মা এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়েছিল। বুঝতে পারল, আবদুস সাত্তার ফোন করেছেন। আপুর কথা শুনে সেও খুব আশ্চর্য হল। তাড়াড়াড়ি রিসিভার তুলে কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে যখন কোনো সাড়া পেল না তখন রিসিভার রেখে বলল, তার সম্পর্কে কিছু না জেনেই এসব কথা বলা তোর মোটেই উচিত হয়। নি।

কাঁদার জন্য তাসনিম কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তারপর সামলে নিয়ে ভিজে গলায় বলল, তুই আমার মনের অবস্থা যদি জানতিস, তা হলে উচিত অনুচিতের কথা বলতিস না। তুই এখান থেকে যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

সায়মা চুপচাপ বেরিয়ে এসে ড্রইংরুম থেকে আব্দুস সাত্তারের বাসায় ফোন করল। কিন্তু তাদের ফোন খারাপ, তাই রিং বাজল না। হঠাৎ সায়মার মাথায়। একটা বুদ্ধি এল। ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে তাকে কিছু ইনস্ট্রাকসান দিয়ে গাড়ি নিয়ে আব্দুস সাত্তারের বাসায় পাঠাল।

প্রায় এক ঘণ্টা পর ড্রাইভার ফিরে এসে বলল, তাকে দারোয়ান গেটের ভিতরে ঢুকতে দিলেও বাসায় যেতে দেয় নি। তার কাছে জেনেছে, প্রায় দু’মাস আগে সাহেব এ্যাকসিডেন্ট করে দেশের হাসপাতালে ছিলেন। একটা পা ভেঙে গেছে। সেখানে প্লাস্টার করে দিয়েছিল। ইনফেকসান হয়ে গেছে। তাই কাল ঢাকায় নিয়ে এসে ইবনেসিনা ক্লিনিকে কাল রাতেই অপারেশন করে আবার প্লস্টার করে দিয়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন, আর দু’চার দিন দেরি হলে পুরো পাটা কেটে বাদ দিতে হত। আজ দুপুরের দিকে জ্ঞান ফিরেছে। বাসার সবাই সেখানে আছে। তাই দারোয়ান বাসায় যেতে দেয় নি।

সায়মা বলল, সাহেব বিয়ে করেছেন কিনা জিজ্ঞেস করেন নি?

সাহেবের সম্পর্কে এইসব জানার পর বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না ভেবে করি নি।

সায়মা চিন্তা করল, বিয়ে করলে আব্দুস সাত্তার কিছুতেই আপুকে ফোন করতেন না। তার এ্যাকসিডেন্টের কথা আপুকে বললে বিশ্বাস তো করবেই না, বরং উল্টো পাল্টা অনেক প্রশ্ন করবে। তার চেয়ে তাকে নিয়ে ক্লিনিকে গেলেই সবকিছু জানা যাবে।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ড্রাইভার বলল, আমি এবার যাই?

আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন। তারপর আসছি বলে সায়মা রুমে এসে দেখল, আপু আসরের নামায পড়ছে। সেও অজু করে এসে নামায পড়ল। তারপর তাসনিমকে বলল, তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে নে।

তাসনিম বলল, আমার মন খারাপ। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না, তুই যা।

বাসায় থাকলে আরো খারাপ লাগবে। বাইরে গেলে মন ভালো হয়ে যাবে। একা যেতে আমার ইচ্ছা করছে না। প্লীজ আপু, চল।

কোথায় যাবি?

আহা চল না। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে গেলেই তোর মন যে ভালো হয়ে যাবে, তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল, না গেলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব।

ঠিক আছে ছাড়, কাপড় পাল্টে নিই। তুইও পাল্টে নে।

গাড়ি ইবনেসিনা ক্লিনিকে ঢুকতে দেখে তাসনিম বলল, এখানে এলি কেন? রুগী দেখে তো মন আরো খারাপ হয়ে যাবে?

এমন অনেক রুগী থাকে, যাকে দেখলে খারাপ মন ভালো হয়ে যায়।

গাড়ি থামার পর সায়মা বলল, তুই নেমে একটু দাঁড়া, আমি এসে তোকে নিয়ে যাব। তারপর ইনকোয়ারী কাউন্টারে গিয়ে আব্দুস সাত্তারের কেবিন নম্বার জেনে ফিরে এসে বলল, চল।

গতকাল ঢাকায় এসেই আব্দুস সাত্তার তাসনিমকে ফোন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ডাক্তারদের পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যস্ততায় ও অপারেশনের কারণে তা সম্ভব হয়। নি। আজ দুপুরের দিকে জ্ঞান ফেরার পর উম্মে কুলসুমকে বলল, তুই তাসনিমদের বাসায় ডায়েল করে রিসিভারটা আমাকে দে।

এ্যাকসিডেন্ট করে জ্বরের ঘোরে আব্দুস সাত্তার যখন তাসনিমের নাম বলত তখন তার মা-বাবা ফুফু বুঝতে না পারলেও উম্মে কুলসুম বুঝেছিল। আজও। সবাই রয়েছেন। উম্মে কুলসুমকে তাসনিমদের বাসায় ফোন করার কথা বলতে সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

উম্মে কুলসুম না দেখার ভান করে ডায়েল করে রিসিভার ছোট ভাইয়ার হাতে দিল। তারপর কথা বলতে বলতে তার মুখ বিবর্ণ হতে ও হাত থেকে রিসিভার পড়ে যেতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলল, কী হল ছোট ভাইয়া? ততক্ষণে আব্দুস সাত্তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। উম্মে কুলসুম হাত ধরে নাড়া দিতে লাগল। তারপর সাড়া না পেয়ে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্যে ছুটল।

ডাক্তার এসে পালস ও হার্ট পরীক্ষা করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। কোনো কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে। জ্ঞান ফেরার পর আপনারা রুগীর সঙ্গে কথা বলবেন না। আর রুগীকেও কথা বলতে দেবেন না।

প্রায় আধঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে এলে আব্দুস সাত্তার মা ও ফুফুকে বলল, তোমরা আমার বুকে একটু হাত বুলিয়ে দাও তো।

উম্মে হাফসা ছেলের বুকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কাকে ফোন করেছিলি?

আব্দুস সাত্তার কিছু বলার আগে উম্মে কুলসুম বলল, আহ আম্মু, ডাক্তার। সবাইকে কথা বলতে নিষেধ করে গেলেন না? তোমাদেরকে আমি পরে বলব।

কেবিনের কাছে এসে সায়মা দাঁড়িয়ে পড়ল।

তাসনিম বলল, কী রে? দাঁড়ালি কেন?

সায়মা বলল, যাকে দেখতে এসেছি, তার সম্পর্কে তোর জানা দরকার। তারপর কিভাবে ড্রাইভারকে আব্দুস সাত্তারের বাসায় পাঠিয়ে তার এ্যাকসিডেন্টের কথা ও গতকাল ঢাকায় আসার পর অপারেশনের কথা জেনেছে, সে সব বলে বলল, ভিতরে হয়তো ওর সব আত্মীয়রা আছেন। প্লীজ আপু, অশোভনীয় কোনো সীন ক্রিয়েট করবি না।

তাসনিম খুব অবাক হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সায়মা একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে ভিতরে ঢুকল।

সবাইর অবাক দৃষ্টি তাদের উপর পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উম্মে কুলসুম সামলে নিয়ে এগিয়ে এল।

সায়মা সালাম দিল।

উম্মে কুলসুম সালামের উত্তর দিয়ে তাসনিমের একটা হাত ধরে বেডের কাছে নিয়ে এল।

তাসনিম সবাইর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে নিল।

উম্মে হাফসা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কে মা তোমরা তোমাদেরকে তো চিনতে পারছি না।

উম্মে কুলসুম বলল, আমরা ডাক্তারের সাবধান বাণী কেউ মানছি না। ইনারা ছোট ভাইয়ার পরিচিত। খবর পেয়ে দেখতে এসেছেন।

তাসনিম আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে দেখল, অনেক রোগা হয়ে গেছে। মুখটা খুব মলিন। চোখে চোখ পড়তে অপলক দৃষ্টিতে দু’জনেই তাকিয়ে রইল।

চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে আব্দুস সাত্তার মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর সামলে নিয়ে উম্মে কুলসুমকে বলল, ওদেরকে চলে যেতে বল।

উম্মে কুলসুম ওদেরকে কেবিনের বাইরে নিয়ে এসে তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় ছোট ভাইয়া অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছেন, তার কথা বলা একদম নিষেধ। প্লীজ, আপনারা এখন চলে। যান। ছোট ভাইয়া সুস্থ হওয়ার পর আমি ফোন করে জানাব, তখন আসবেন।

আব্দুস সাত্তারের অবস্থা দেখে তাসনিমের দুঃখ হলেও বিয়ের ব্যাপারটা জানতে পারে নি বলে রাগটা এখনো রয়েছে। তাই রাগের সঙ্গে বলল, বিয়ের পরে নিশ্চয় এ্যাকসিডেন্টটা হয়েছে? তা আপনার ভাবিকে দেখলাম না যে?

তার কথা শুনে উম্মে কুলসুম প্রথমে হকচকিয়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ছোট ভাইয়া বিয়ে করেছে, কে বলেছে আপনাকে?

তাসনিম রাগের সঙ্গেই বলল, যেই বলুক, কথাটা সত্য কিনা বলুন?

উম্মে কুলসুম এবার রেগে উঠে বলল, না বলব না। যে প্রেমের মূল্য জানে না, কদর জানে না। প্রেমিককে বিশ্বাস করে না, তার কথার উত্তর দেব না। যান চলে। যান, আর কোনো দিন আসবেন না। ছোট ভাইয়াকেও বলে দেব, সে যেন। আপনাকে আর কোনো দিন বিরক্ত না করে। কথা শেষ করে কেবিনে ঢুকে গেল।

আপুর কথায় সায়মা রেগে গিয়েছিল। উম্মে কুলসুম কেবিনে ঢুকে যাওয়ার পর রাগের সঙ্গে বলল, বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করা তোর উচিত হয় নি।

উম্মে কুলসুমের কথা শুনে তাসনিম বুঝতে পেরেছে, বিয়ের কথাটা সত্য নয়। অনুতপ্ত কণ্ঠে বলল, আব্দুস সাত্তার আমাদেরকে চলে যেতে বলায় আমার মাথা। গরম হয়ে গিয়েছিল।

কেন উনি চলে যেতে বলেছেন, ভেবে দেখেছিস? ফোনে ওকে কি কি বলে অপমান করেছিস মনে নেই?

ছলছল চোখে তাসনিম বলল, এখন কি করব বলতে পারিস?

এখন বাসায় চল, ভেবে চিন্তে যা করার করা যাবে।

উম্মে কুলসুম ঢুকতেই উম্মে হাফসা আতঙ্কিত স্বরে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আব্দুস সাত্তার আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে।

সেকি বলে উম্মে কুলসুম ডাক্তারকে খবর দিতে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

তখনও দু’বোন কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তাকে তন্তদন্ত হয়ে বেরোতে দেখে সায়মা জিজ্ঞেস করল, এভাবে কোথায় যাচ্ছেন?

উম্মে কুলসুম যেতে যেতে বলল, ছোট ভাইয়া আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে, ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।

সায়মা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোর কারণেই উনি বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহ না করুক, যদি কিছু হয়ে যায়, সেজন্য তুই-ই দায়ী হবি। ওঁর মা-বাবা ও আত্মীয়রা ব্যাপারটা জানেন না, তারা তোকে দায়ী করবেন না ঠিক; কিন্তু উম্মে কুলসুম তোকে দায়ী করবেই। আর তুইও কী নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি?

তাসনিম ভুল বুঝতে পেরে মুখ নিচু করে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগল; কিছু বলতে পারল না।

উম্মে কুলসুম ডাক্তার ডাকতে যাওয়ার সময় দোতলার বারান্দা থেকে স্বামীকে আসতে দেখে তরতর করে সিড়ি বেয়ে নেমে এসে সালাম দিল।

আব্দুল মজিদ বিদেশ থেকে ফিরে এসে মাসখানেক হল পি.জি.তে প্রফেসার হিসাবে জয়েন করেছে। সেই-ই আব্দুস সাত্তারকে ঢাকায় নিয়ে এসে ইবনেসিনায় ভর্তি করেছে। ডিউটি সেরে ক্লিনিকে এসেছে। স্ত্রীর সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কী ব্যাপার? তোমাকে খুব পেরেশান মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চল। দুপুরের দিকে ছোট ভাইয়ার জ্ঞান ফিরে। কিছুক্ষণ পর ফোনে তাসনিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যায়। আধঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে আসে। একটু আগে তাসনিম ও সায়মা এসেছিলেন তাদেরকে চলে যাওয়ার কথা বলে আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি ডাক্তারকে খবর দিতে যাচ্ছিলাম, তোমাকে দেখতে পেয়ে নেমে এলাম।

আব্দুল মজিদ স্ত্রীর কাছে বন্ধুর প্রেম কাহিনী শুনেছে। হাঁটতে শুরু করে বলল, ওঁরা চলে গেছেন।

না, কেবিনের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর ওদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির ব্যাপারটা বলল।

এটা তুমি ঠিক করো নি। ওর মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করা তোমার উচিত ছিল। উনি নিশ্চয় কারো কাছে আব্দুস সাত্তার ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনেছেন। ভেবে দেখ, আমি ফেরার আগে তুমি যদি খবর পেতে আমি সেখানে একটা বিয়ে করেছি, তা হলে তোমার মানসিক অবস্থা কী হত? যাক গে, যা হওয়ার হয়েছে। ওর ভুল ভাঙিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিও। ততক্ষণে তারা দোতলায় উঠে। কেবিনের কাছে চলে এল।

সায়মা উম্মে কুলসুমকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার ছোট ভাইয়ার জ্ঞান ফেরার পর একটু বাইরে আসবেন।

উম্মে কুলসুম কিছু বলল না।

আব্দুল মজিদ এক নজর দু’বোনের দিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে বলল, ওঁরাই না কী?

হ্যাঁ, তারপর স্বামীকে নিয়ে কেবিনে ঢুকল।

ওরা ঢোকার একটু আগে আব্দুস সাত্তারের জ্ঞান ফিরেছে।

আব্দুল মজিদ বেডের কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, এখন কেমন লাগছে?

আব্দুস সাত্তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর উম্মে কুলসুমকে বলল, তুই কোথায় গিয়েছিলি?

তুমি অজ্ঞান হয়ে যেতে ডাক্তারকে খবর দিতে যাচ্ছিলাম, ওকে আসতে দেখে বলে লজ্জা পেয়ে থেমে গেল।

আব্দুল মজিদ স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, আব্বাকে দেখছি না যে? বাসায় গেছেন।

না, দুপুরে ছোট ভাইয়ার জ্ঞান ফেরার পর ড্রাইভারকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। আব্বার কলেজে এবারও ইন্টারের পরীক্ষা কেন্দ্র হয়েছে। কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। তারপর একটু আসছি বলে বেরিয়ে এসে তাসনিম ও সায়মাকে বলল, ছোট ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে। এবার আপনারা বাসায় যান। পরে আপনাদের সঙ্গে ফোনে আলাপ করব।

সায়মা বলল, প্লীজ, একটু সময় দেবেন? কয়েকটা কথা বলব।

উম্মে কুলসুম স্বামীর কথাগুলো চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, চলুন রিসেপসনে বসি।

রিসেপসন রুমে লোকজন বসার জন্য সোফা সেট ও বেশ কয়েকটা চেয়ার রয়েছে। ওরা এক সাইডে বসল। বসার পর সায়মা বলল, দেখুন, আপুর কথায় আপনি মনে কিছু নেবেন না। আপনারা দেশে যাওয়ার তিন চার দিন পর আমরা আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। আপনাদের কাজের বুয়া বলল, আপনার ছোট। ভাই এর বিয়ে। তাই সবাই দেশে গেছেন। কথাটা শুনে আপু এ্যাবনরম্যাল হয়ে পড়েছিল। তারপর এই দীর্ঘ দু’আড়াই মাস হয়ে গেল আপনার ছোট ভাইয়া যোগাযোগ করেন নি। এ্যাকসিডেন্টের কথা কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আমরা জানতাম না। তাই উনি যখন আজ দুপুরের দিকে ফোন করেন তখন আপু কয়েকটা অশোভন কথা বলেছে। তারপর কিভাবে এ্যাকসিডেন্টের কথা জেনে আপুকে নিয়ে সে এসেছে বলে বলল, এবার আপনিই বলুন, আপুর কতটা দোষ?

সায়মা থেমে যেতে তাসনিম করুণস্বরে বলল, আমার মাথা ঠিক ছিল না। তাই কিছুক্ষণ আগে আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। দয়া করে মাফ করে দিন।

উম্মে কুলসুম বলল, আপনি উচ্চ ডিগ্রী নিচ্ছেন, অথচ এটা জানেন না, শোনা কথা যাচাই না করে বিশ্বাস করতে নেই? যাই হোক, মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আমিও না জেনে আপনাকে অনেক কিছু বলে ভুল করেছি। আপনিও আমাকে মাফ করে দিন।

তাসনিম বলল, আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুক। এখন আমি কী আপনার ছোট ভাইয়ার কাছে যেতে পারি।

এখন যাওয়া ঠিক হবে না। আপনাকে দেখে ছোট ভাইয়া হয়তো আবার জ্ঞান হারাবে। আমি বলি কী, আপনারা বাসায় চলে যান। আমি ছোট ভাইয়াকে। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। পরিস্থিতি বুঝে কাল সকালে ফোন করে আপনাদের আনাব। ফোনে কী বলেছিলেন জানি না, ছোট ভাইয়ার মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল, হাত থেকে রিসিভার পড়ে গিয়েছিল। তারপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। আপনাকে ছোট ভাইয়া যে কত ভালবাসে, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?

ছলছল চোখে তাসনিম বলল, জানি ভাই জানি। খবরটা যাচাই না করে যে কত বড় ভুল করেছি, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

উম্মে কুলসুম বলল, আমাদের কাজের বুয়ার মাথায় একটু গোলমাল আছে। কি বলতে কি বলে, কি শুনতে কি শুনে তার কোনো ঠিক নেই। ওর একমাত্র ও ছয় বছরের ছেলে ও স্বামীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনারা মেরে ফেলে ওকে ক্যাম্পে নিয়ে চলে গিয়েছিল। ও আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। আব্ব জানতে পেরে অনেক টাকার বিনিময়ে ওকে নিয়ে আসে। তারপর থেকে ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। আব্ব চিকিৎসা করিয়ে ভালো করে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভালো হয় নি। মাঝে মাঝে ভুল বকে, আর উল্টো পাল্টা কথা বলে। আপনাদেরকেও ঐরকম কিছু বলেছে। আসল ঘটনা হল, পাঁচ বছর আগে আমার আকদ হয়েছিল। একটু আগে আমার সঙ্গে যে ডাক্তার কেবিনে গেলেন, উনি আমার স্বামী। আকদ হওয়ার এক বছর পর উনি উচ্চ ডিগ্রী নিতে বিদেশে গিয়েছিলেন। যেদিন ফিরলেন, সেদিনই আমরা সবাই এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার কয়েকদিন পর আমার বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানের দিন পাশের গ্রাম থেকে। রাজনৈতিক পার্টির কিছু ছেলে এসে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। ছোট ভাইয়া দিতে অস্বীকার করে। ফলে তারা ভাইয়াকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা করে। গ্রামের ছেলেরা জানতে পেরে বাধা দিলে দুই দলে মারপিট শুরু হয়। ওরা নানারকম অস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে এসেছিল। আমাদের গ্রামের ছেলেদের সেসব ছিল না। লাঠিসোটা, বল্লম, দা, হেঁসো বের করতে দেরি হয়। ততক্ষণে আমাদের অনেকে জখম হয়। শেষে গ্রামশুদ্ধ লোক যখন তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল তখন তারা পালাতে বাধ্য হল। অবশ্য তাদেরও কয়েকজন আহত হয়েছিল। তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ছোট ভাইয়া গুরুতর জখম হয়েছিল। তার ডান পায়ের হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তারপরের ঘটনা তো আপনারা দারোয়ানের কাছে থেকে জেনেছেন। আর সময় দিতে পারছি না। ছোট ভাইয়া আমাকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। এতক্ষণে হয়তো আমার স্বামীকে খুঁজতে পাঠিয়েছে। তারপর আসি বলে উম্মে কুলসুম তাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে কেবিনে ফিরে এল।

তাকে দেখে উম্মে হাফসা একটু রাগের সঙ্গে বললেন, এতক্ষণ কোথায় গিয়েছিলি? আব্দুস সাত্তার তোকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছে। একটু আগে আব্দুল মজিদ তোকে খুঁজতে গেল। আব্দুল মজিদ ফিরে এলে তোর ফুফুকে নিয়ে তার সাথে বাসায় যা।

উম্মে কুলসুম বলল, আমি আজ রাতে এখানে থাকব। তুমি ও ফুফুআম্মা তোমাদের জামাইয়ের সাথে চলে যাও। ড্রাইভারকে দিয়ে আমাদের রাতের খাবার পাঠিয়ে দিও।

এমন সময় স্বামীকে ফিরতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আম্মু ও ফুফুআম্মাকে নিয়ে বাসায় যাও। মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে আসছে, বাসায় গিয়ে নামায পড়বে।

রাতে খাওয়ার পর উম্মে কুলসুম ছোট ভাইয়ার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, একটা কথা বলব, রেগে যাবে না অথবা টেনসান করবে না বল?

আব্দুস সাত্তার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তুই যা বলতে চাচ্ছিস, আমি বুঝতে পেরেছি। ওর কথা না বলাই ভালো।

ঠিক আছে, ওর কথা না হয় নাই বললাম; কিন্তু তুমি কী ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবে?

বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে।

তাতো অবশ্যই। হায়াত যতদিন আছে বাঁচবেই। কিন্তু সেরকম বেঁচে থাকার যে কি যন্ত্রণা তা তুমি ভালোভাবেই জান। এখনও কী কম যন্ত্রণা ভোগ করছ?

আচ্ছা বল, কী বলতে চাচ্ছিস।

তাসনিম কেন ছোট ভাইয়ার সাথে এত রূঢ় ব্যবহার করল, সে সব বলে বলল, যত নষ্টের গোড়া আমাদের কাজের বুয়া জমিলা খালা।

শুনে আব্দুস সাত্তার এত খুশী হল যে, মনে হল তার বুকের উপর থেকে হাজার মণ ওজনের পাথর কেউ সরিয়ে দিল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে চুপ। করে রইল।

কী হল ছোট ভাইয়া? কিছু বলছ না কেন?

একটা কথা ভেবে খুব আশ্চর্য হচ্ছি, তাসনিমের মতো উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে সত্য মিথ্যা যাচাই না করে কথাটা বিশ্বাস করল কি করে?

আমিও সে কথা ওকে বলেছিলাম। ওর বোন সায়মা বলল, বিয়ের কথা শুনে তাসনিম আপা এ্যাবনরম্যাল হয়ে পড়েছিলেন। তাই সত্য মিথ্যা যাচাই করার কথা মাথায় আসে নি।

তুই এসব জানলি কেমন করে?

তোমার বন্ধুকে নিয়ে যখন এলাম তখনও ওরা কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর কিভাবে জানল বলে বলল; তাসনিম আপা খুবই অনুতপ্ত। আমার কাছে সবকিছু শোনার সময় চোখ থেকে পানি পড়ছিল। তখনই ক্ষমা চাওয়ার জন্য তোমার কাছে আসতে চেয়েছিলেন। তাকে দেখে তুমি যদি আবার অজ্ঞান হয়ে যাও? তাই বলেছি, আমি ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাব এবং কাল সকালে তাকে ফোন করে জানাব।

প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য আব্দুস সাত্তার বলল, তুই যে আমার কাছে সব সময়। রয়েছিস, আমার বন্ধুর অসুবিধার কথা ভাবছিস না কেন?

উম্মে কুলসুম লজ্জা পেয়ে বলল, তা আবার ভাবি নি। তাকে খুশী রাখার জন্যই তো তোমার কাছে সব সময় রয়েছি। আমাদের কথা বাদ দাও, তাসনিম আপার ব্যাপারে কিছু বললে না তো? কাল সকালে কী তাকে আসতে বলব?

সে কথা কাল বলব। এখন যা ঘুমিয়ে পড়। রাত জেগে জেগে তুই অনেক রোগা হয়ে গেছিস।

উম্মে কুলসুম ঘুমিয়ে পড়ার পর সাড়ে বারটার সময় আব্দুস সাত্তার তাসনিমকে ফোন করল।

রাতে খাওয়ার পর সায়মা আপুকে বলল, মনে হয়, উম্মে কুলসুম আজই তার ছোট ভাইয়াকে সবকিছু বলবে এবং কাল সকালে আমাদেরকে ফোন করে জানাবে।

তাসনিম বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। তারপর তাকে শুতে দেখে বলল, কী রে? এক্ষুনি ঘুমাবি? আজ হাদিসের একটা বই পড়বি বলেছিলি না?

আজ ঘুম পাচ্ছে, কাল পড়ব বলে পাশ ফিরে শুল।

তাসনিম বড় লাইট অফ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে একটা বই নিয়ে বসল। কিন্তু পড়ায় মন দিতে পারল না। কেবল আব্দুস সাত্তারের মলিন মুখটা বই এর পাতায় ভেসে উঠতে লাগল। ভাবল, উম্মে কুলসুমের কাছে সবকিছু শোনার পর। কী তার মনের পরিবর্তন হবে? আমাকে কী ক্ষমা করবে? আবার ভাবল, উম্মে কুলসুম যদি ফোন করে যেতে বলে, তা হলে কোন মুখে তার সামনে গিয়ে। দাঁড়াব? সত্য মিথ্যা যাচাই না করে তাকে কি জঘন্য ভাষায় অপমান করেছি। তারপরও কী সে আমাকে ক্ষমা করতে পারবে? ক্ষমা করলেও কী আগের মতো ভালবাসবে? আমিও কি আগের মতো তার কাছে ফ্রি হতে পারব? এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে সাড়ে বারটা বেজে গেল টের পেল না। ফোন বেজে উঠতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল, নিশ্চয় ও ফোন করেছে। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে কানের কাছে নিতে আব্দুস সাত্তারের সালাম শুনে চোখে পানি এসে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামলে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে ভিজে গলায় বলল, তোমার এই নাদান তাসনিম ক্ষমাপ্রার্থী। বল ক্ষমা করে দিয়েছ?

কথাগুলো আব্দুস সাত্তারের কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, ক্ষমা চাইছ কেন? তুমি যে ভুল করেছ, এতদিন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে তার থেকে কম ভুল আমিও করি নি। তা হলে তো তোমার কাছে আমারও ক্ষমা চাওয়া উচিত। অবশ্য কাউকে দিয়ে চিঠি বা টেলিগ্রাম করে জানাতে পারতাম, তুমি। দুশ্চিন্তা করবে ভেবে জানাই নি। আর যাওয়ার দিন আমার যাওয়ার কথা ছিল না, পরের দিন ছিল। এয়ারপোর্টে সবাইকে যখন গাড়িতে তুলে দিলাম তখন ছোট বোনের স্বামী কিছুতেই ছাড়ল না। ও আবার আমার ছেলেবেলার বন্ধু। তাই তোমাকে ফোন করে জানাবারও সুযোগ পাই নি। ভেবেছিলাম, উম্মে কুলসুমের বিয়ের অনুষ্ঠানের পরের দিন চলে আসব। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তা ছিল না। তাই এত কিছু ঘটে গেল।

তাসনিম কান্নাজড়িত স্বরে বলল, এতকিছু বলার দরকার ছিল না। আমি জানি, তুমি এতটুকু ভুল বা অন্যায় করতে পার না। তবু যে কেন তোমার বিয়ের কথা শুনে আমি এ্যাবনরম্যাল হয়ে পড়লাম, তা আল্লাহ জানেন। কাল ফোনে তোমাকে যেভাবে অপমান করেছি, সে কথা মনে পড়লে মরে যেতে ইচ্ছা করছে। তুমি ক্ষমা না করলে, আমাকে সেই পথ বেছে নিতে হবে।

এ তুমি কী বলছ তাসনিমঃ বেহেস্তের সোনালী ঝরণা নাম নিয়ে তুমি জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে চাচ্ছ? এক্ষুনি তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও বলছি। নচেৎ …….কথাটা শেষ করতে পারল না। কান্নায় তার গলা বুজে এল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামলে নিয়ে আবার বলল, বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, কাল তোমার কথা শুনে খুব আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম ঠিক, কিন্তু তোমার প্রতি ভালবাসা এক বিন্দু কমে নি। এরপরও যদি তুমি ক্ষমা করার কথা শুনতে চাও, তা হলে তোমাকেই আগে বলতে হবে, আমাকে ক্ষমা করেছ।

তাসনিম এতক্ষণ মনে মনে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তার কথা শুনছিল। আব্দুস সাত্তার থেমে যেতে বলল, আল্লাহ আমাদের দু’জনকেই ক্ষমা করুন। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার কাছে কে আছেন?

উম্মে কুলসুম।

তোমাকে কখন একা পাব বলবে?

আম্মু আটটার সময় আসতে পারেন, তুমি তার আগে এস। তোমাকে দেখলে উম্মে কুলসুম কেবিন থেকে বেরিয়ে যাবে।

ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ আসব। উম্মে কুলসুমের কাছে শুনেছি, ডাক্তার তোমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। অনেক কথা বলেছ। আর নয়, এবার। ঘুমিয়ে পড়।

কথা না হয় নাই বললাম; কিন্তু ঘুম কি আসবে? তোমাকে না দেখা পর্যন্ত ঘুম আসবে না। সারারাত হয়তো জেগে কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকব তোমার আসার অপেক্ষায়। কাল তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে যে কষ্ট পাচ্ছি, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

এই কথা শুনে তাসনিমের চোখে আবার পানি চলে এল। ভিজে গলায় বলল, প্লীজ, আর এসব কথা বলো না, আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি। বাকি রাতটুকু আমাকেও জেগে কাটাতে হবে তোমার কাছে যাওয়ার সময়ের প্রতিক্ষায়।