সৈয়দ মুজতবা আলী
পঞ্চতন্ত্র
‘পঞ্চতন্ত্র’ সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত বৈচিত্রময় একটি গ্রন্থ। দুই খণ্ডে প্রকাশিত এই গ্রন্থটিকে বৈচিত্রময় বলছি, কেননা, কেউ এটিকে রম্যরচনার সঙ্কলন, কেউ গল্প সঙ্কলন, কেউ প্রবন্ধ সঙ্কলন বলে আখ্যায়িত করেছেন। মূলত, একের ভিতরে বহু, এই কারণেই হয়ত সৈয়দ সাহেব গ্রন্থটির নাম রেখেছিলেন ‘পঞ্চতন্ত্র’।
গল্প শুনতে ও শোনাতে পছন্দ করতেন তিনি; এই কারণে, কলকাতায়, কাবুলে, প্যারিসে, বার্লিনে কিংবা কায়রোতে—যেখানেই সৈয়দ মুজতবা আলী, সেখানেই জমত গল্পের আসর, সাদামাটা কথায় আড্ডা। এই কারণেই নিশাচর শহরের প্রতি তাঁর ছিল দুর্মর পক্ষপাত; জনপরিসরে, আখড়ায় তাঁর আসর জমত নিয়মিত যাতে থাকত নানা সংস্কৃতির বহুবিচিত্র মানুষের সমাগম। আড্ডার শরিকেরা সবাই রসিক। রসের রসিক। উপভোগের রসিক। তথ্য-উপাত্ত আর পাণ্ডিত্যে তারা টইটম্বুর। কিন্তু মুজতবার আড্ডায় তথ্য আর পাণ্ডিত্য ভার হয়ে আসে না। প্রতিহত করে না। কারণ, সেখানে উপভোগের সাদর আমন্ত্রণ আছে। প্রধান শরিকদের পাশে আরও অনেকেই আছে। তারা কথা বলে না। কিন্তু আড্ডার রস উদ্যাপনে কোনও বাধা নেই। এরাই মূলত পাঠক। মুজতবার লেখা পড়া মানে আড্ডার সজীব সপ্রতিভ কথামালার অংশীদার হওয়া।
মুজতবা এমন জমানার মানুষ, যখন কলকাতায় ‘সংস্কৃতি’ একটি উচ্চতম বর্গ হিসেবে পরম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ওই সংস্কৃতি-ধারণায় সংকীর্ণতা ছিল, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল। মুজতবা এই সংকীর্ণতা ও বিদ্বেষ ভাব থেকে বেশ অনেক দূর পর্যন্ত মুক্ত ছিলেন। তখন ভারতীয়রা কেবল আর পশ্চিমের কথা শুনছিল না, পশ্চিমকে ভারতের কথাও শোনানো শুরু করেছিল। মুজতবা নিজের আবিষ্কৃত আড্ডার ফর্মে একজন ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিতেন। তাতে হীনম্মন্যতার লেশমাত্রও ছিল না। ছিল বহুজাতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে নিজের হিস্যা উপস্থাপনের আর আদায়ের সক্রিয়তা। উদারনৈতিক ভাব-পরিসরে নিজেকে মজলিসি কেতায় উদ্যাপনের ভঙ্গিতে হাজির করতে পেরেছিলেন বলেই সহস্র ভ্রমণকাহিনী আর রম্য রচনার ভিড়ে মুজতবাকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়।
জীবনকে উদ্যাপনের মত যাপনের প্রতি সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবল আগ্রহ ছিল, কিন্তু হাহাকার ছিল না। হাহাকার না থাকার কারণ, জীবন স্বয়ং উদ্যাপনের বিচিত্র বর্ণিল সাজে ধরা দিয়েছিল তাঁর জীবনে। তাঁর কলম ছিল সেই জীবনের বিশ্বস্ত আজ্ঞাবাহক।
অনেক দেশ ঘুরাঘুরি একই সাথে বিভিন্ন মানুষের কাছাকাছি থেকে তাদের সাথে নিজের ভাবের আদান প্রদান করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তা নিজের কাছে রেখেদেন নাই লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। বিভিন্ন সময়ের ভ্রমণের সেই অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছেন একই সাথে ভিন্ন দেশের মানুষের কাছাকাছি গিয়ে তাদের সেই গল্পও তিনি আমাদের শুনিয়েছেন।
‘পঞ্চতন্ত্রে’র কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর লেখা হয়নি; এর মধ্যে আছে ছোট ছোট গল্প, নিজের অভিজ্ঞতা, অন্যের কাছে শোনা কাহিনী, স্মৃতিকথা, সমসাময়িক বিষয়, ভ্রমণ কথা যাতে আছে নিজের ও অন্যদের গল্প।