» » সে কোন বনের হরিণ

বর্ণাকার
🕮

আট

আব্দুল হামিদ ও রাইসা বেগম ছাড়া তাদের আর কোনো ভাই বোন নেই। রাইসা বেগমের বিয়ে হয়েছিল একই জেলার খোকসাবাড়ীর বড় লোকের একমাত্র ছেলে আলি আশরাফের সঙ্গে। বিয়ের কয়েক বছর পর তার মা-বাবা মারা যান। আলি আশরাফ মা-বাবা মারা যাওয়ার পর জ্ঞাতী শত্রুর ষড়যন্ত্রের স্বীকার হন। ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অর্ধেক সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তখন ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলে আলি হোসেনকে নিয়ে থাকতেন। চার পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যবসায় উন্নতি করে রায়ের বাজারে জায়গা কিনে এই এ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির কাজ শুরু করেন। টাকার প্রয়োজনে দেশের বাকি সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। বাড়ি কমপ্লিট হওয়ার পর একমাত্র সন্তান আলি হোসেন মারা যায়। ছেলের শোকে রাইসা বেগম পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। পুরো পাগল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ডাক্তারের পরামর্শ মতো আব্দুল হামিদ ও উম্মে হাফসা ছোট ছেলে আব্দুস সাত্তারকে দিয়ে দেন। তখন আব্দুস সাত্তারের বয়স দশ বছর। বড় হয়ে তাদেরকে ছেড়ে মা-বাবার কাছে চলে না যায়, সেজন্য স্ত্রীর কথামতো আলি আশরাফ ব্যবসা ও এই বাড়ি আব্দুস সাত্তারের নামে উইল করে দেন। আলি আশরাফ ব্যবসার প্রয়োজনে বিদেশে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে প্লেন এ্যাকসিডেন্টে মারা যান। তারপর থেকে রাইসা বেগম ম্যানেজারকে দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।

আব্দুস সাত্তার মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে ফুফুআম্মার জিদে ব্যবসা দেখাশোনা করছে। ছোট বোনের বিয়ে ও পা ভেঙে যাওয়ার কারণে প্রায় পাঁচ মাস অফিসে যেতে পারে নি। তাই মা দেশের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর নিয়মিত অফিস করছে। এতদিন অফিস না করায় প্রচুর কাজের চাপে তাসনিমকে দিনে সময় দিতে পারে নি। তবে রাতে ফোনে আলাপ করে।

একদিন আলাপ করার সময় তাসনিম বলল, তোমার কথা আব্বুকে বলেছি। আলাপ করার জন্য নিয়ে আসতে বলেছে। কবে আসবে বল।

আমি কবে যাব বললে তো হবে না। তোমার আব্ব ব্যস্ত মানুষ। যখন যাব। তখন যদি উনি বাসায় না থাকেন? তা ছাড়া একটা অজানা অচেনা ছেলেকে। দারোয়ান ঢুকতে দেবে কী?

তাসনিম হেসে উঠে বলল, দারোয়ানের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। শোন, পরশু শুক্রবার। ঐদিন তোমার আসার কথা বলে আব্বকে বাসায় থাকতে বলব। কি বলে না বলে কাল রাতে জানাব।

তা জানিও। তবে শুক্রবার উনি যেতে বলুন আর নাই বলুন, তুমি কিন্তু কাল সকালে আসবে। কিছু আলাপ করব। এবার রাখি খুব টায়ার্ড লাগছে, ঘুমাব।

কী ব্যাপার বলতো? কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছি, ফোন করতে না করতে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়?

এই কয়েকদিন যে খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছে।

তাসনিম অবাক হয়ে বলল, খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছে মানে?

বারে, এত পড়াশোনা করলাম বসে থাকার জন্য নাকী? তুমি চী চাও না, তোমার স্বামী বেকার না থেকে কিছু কাজকর্ম করুক?

আমি সে কথা জানতে চাই নি। জানতে চাচ্ছি; সারাদিন এমন কী কাজ কর, যে জন্য রাতে এত টায়ার্ড হয়ে পড়?

কাল সকালে এস, সারাদিন কি কাজ করি বলব।

ঠিক আছে, আসব।

আব্দুস সাত্তারের খুব ঘুম পাচ্ছিল। হাই তুলে “লা হাউলা ওয়া কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” পড়ে বলল, এবার রাখি তা হলে?

তাসনিম বুঝতে পারল, সত্যিই ও খুব টায়ার্ড। বলল, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। তারপর সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

আজ সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় রোকন উদ্দিন সাহেব বড় মেয়েকে বললেন, কই রে মা, অল রাউন্ডার ছেলেটাকে নিয়ে এলি না যে? এখনও সুস্থ হয় নি?

আব্বুর কথা শুনে সায়মা হেসে উঠল।

কি রে মা, তুই আবার হাসছিস কেন?

হাসি থামিয়ে সায়মা বলল, তুমি আব্দুস সাত্তারকে অলরাউন্ডার বললে কেন? ক্রিকেট প্লেয়ারদের মধ্যে যারা ভালো ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং করতে পারে, তাদেরকে তো অল রাউন্ডার বলে।

তুই বুঝি খুব ক্রিকেট খেলা দেখিস?

শুধু আমি নই, আপুও।

তা কোন দেশের টিম তোদের ফেভারিট?

আমার দক্ষিণ আফ্রিকা। আপুর পাকিস্তান। তবে এ বছর পেপসি কাপে পাকিস্তানের খেলা দেখে পাকিস্তান টিম আমারও ফেভারিট হয়ে গেছে। শোয়েব আখতারের বোলিং ও অলরাউন্ডার ওয়াসিম আকরামের জন্য পাকিস্তান মনে হয় এবারের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ান হবে।

রোকন উদ্দিন সাহেব এবার বড় মেয়েকে বললেন, তুই কী বলিস? এ বছর বিশ্বকাপে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ান হতে পারবে?

তাসনিম বলল, আমি সাত আট বছর ক্রিকেট খেলা দেখছি। আমার ধারণা, এই খেলাটা সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার। কখন কোন টিম জিতবে আর কখন হারবে, বলা খুব কঠিন। তবে এ বছর বিশ্বকাপের ব্যাপারে সায়মার সাথে আমি একমত।

তোরা নিজের দেশের টিমের ব্যাপারে কিছু বললি না যে?

আমরা নিজের দেশের টিমকে খুব ভালবাসি। এ বছর বিশ্বকাপে খেলতে গেছে জেনে গর্ববোধ করছি। যখন ভালে খেলবে এবং চ্যাম্পিয়ান হবে তখন শুধু নিজের দেশের টিমই ফেভারিট হবে।

ছেলেটার নাম আব্দুস সাত্তার বললি না?

হ্যাঁ।

আব্দুস সাত্তার ক্রিকেট খেলে না?

তা জানি না। তবে খেললে নিশ্চয় কোনো না কোনো টিমে খেলতে দেখতাম।

যাক গে, এখন তার খবর বল।

উনি সুস্থ হয়েছে। তুমি যদি শুক্রবার বাসায় থাক, তা হলে ওকে নিয়ে আসব।

রোকন উদ্দিন সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, সকালের দিকে নিয়ে আসিস। বিকেলে বেরোব।

রিডিং রুমে সায়মা পড়ছিল। তাসনিম সেজেগুজে এসে জিজ্ঞেস করল, তোর আজ ক্লাস আছে?

না, কোথাও যাবি মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ, গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।

সায়মা মিটি মিটি হাসতে লাগল।

কী রে, হাসছিস যে?

সাদা পোশাকে তোকে বেহেস্তের হুরের মতো লাগছে। আব্দুস সাত্তার সাহেবের মাথা না ঘুরে যায়।

তাসনিম মেকী রাগ দেখিয়ে বলল, বেহেস্তের হুর কখনও দেখেছিস? তার সঙ্গে তুলনা করলি যে?

দুনিয়ার কোনো মানুষই দেখে নি, আমি দেখব কী করে? বেহেস্তের হুরের বর্ণনা দাদির কাছে শুনেছিলেন। কিছুদিন আগে সুরা আর রহমানের ব্যাখ্যা পড়ে তুইও তো শোনালি।

তারপর বলল, কাল তাকে নিয়ে আসবি। আজ আবার যাচ্ছিস কেন? ফোন করে দিলেই তো পারিস?

তাই করতাম, গত রাতে ফোনে আজ সকালে যেতে বলেছে।

তা হলে অভিসারে যাচ্ছিস? যা যা, কাল আব্বর ইন্টারভিউতে যেন পাশ করতে পারে, শিখিয়ে পড়িয়ে আয়।

তোকে আর পাকামী করতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দে বলে তাসনিম বেরিয়ে এল।

আব্দুস সাত্তার নাস্তা না খেয়ে তাসনিমের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাইসা বেগম দু’বার তাগিদ দিয়েছেন। আব্দুস সাত্তার বলেছে, একটু পরে খাবে। তৃতীয়বার এলে বলল, ফুফুআম্মা বস, একটু আলাপ করি।

রাইসা বেগম বললেন, ক’টা বেজেছে দেখেছিস? নাস্তা খেয়ে নে, তারপর আলাপ করবি।

একদিন দেরিতে খেলে কিছু হবে না; তুমি বসতো বলে একটা হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিল।

কী পাগল ছেলে? আরো দেরি করলে তো সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে?

যাক ঠাণ্ডা হয়ে। জমিলা খালা গরম করে দেবে। আলাপটা সেরে নিই। আচ্ছা ফুফুআম্মা, তুমি কী তাসনিমের ব্যাপারে কিছু জান?

জানব না কেন? সব কিছু দেখছি, শুনছি। তোর মায়ের কাছেও সব কিছু জেনেছি।

ওকে তোমার পছন্দ হয়?

ওমা, পছন্দ হবে না কেন? ওর মতো সুন্দর মেয়ে আর কখনও দেখি নি।

ও যে আব্বুর বাল্যবন্ধু রোকন উদ্দিন সাহেবের মেয়ে, তা জান?

হ্যাঁ, তোর মা বলেছে। শোনার পর থেকে আমিও খুব দুশ্চিন্তায় আছি। তোর আব্বা রাজি হলেও তাসনিমের আব্বা কিছুতেই রাজি হবেন না।

তাসনিম ওর আব্বাকে রাজি করাবে। তুমি দুশ্চিন্তা করো না। আল্লাহ যা করবেন তাই হবে। ও আব্বুর পরিচয় জানে না। আজ জানাব বলে আসতে বলেছি। এখনও আসছে কেন বুঝতে পারছি না। ওকে নিয়ে নাস্তা খাব বলে অপেক্ষা করছি। এমন সময় কলিংবেলের শব্দ শুনে বলল, তুমি জমিলা খালাকে সবকিছু গরম করতে বল। আমি ওকে নিয়ে আসি। তারপর নিচে এসে গেট খুলে। সালাম বিনিময় করে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বলল, কেমন আছ?

তাসনিম বলল, ভালো। তুমি?

ভালো না, মন খারাপ।

মন খারাপের আবার কী কারণ ঘটল?

এখনও ঘটে নি, একটু পরে ঘটবে। সেকথা ভেবেই মন খারাপ।

হেঁয়ালী করছ কেন? আমি তো বুঝতে পারছি না।

ততক্ষণে তারা ডাইনিংরুমে এসে গেল। আব্দুস সাত্তার বলল, আগে নাস্তা খেয়ে নিই এস, তারপর বুঝিয়ে বলব। একসঙ্গে খাব বলে এখনও খাই নি।

সে কী? সেকথা তো তুমি কাল বল নি।

ভেবেছিলাম, সকালে যখন আসতে বলেছি, তুমি বুঝবে। যাক গে, আমারই ভুল হয়েছে। চা বা কফি তো চলবে?

তা চলবে।

জমিলার হাতে নাস্তার ট্রেসহ রাইসা বেগমকে ঢুকতে দেখে তাসনিম সালাম বিনিময় করে বলল, ফুফুআম্মা কেমন আছেন?

আল্লাহর রহমতে ভালো আছি মা। তুমি ভালো আছ?

জ্বি ভালো।

তুমি এত দেরি করলে কেন? নাও নাস্তা খাও।

আমি নাস্তা খেয়ে এসেছি, শুধু কফি খাব।

রাইসা বেগম অবাক কণ্ঠে আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই যে বললি, তাসনিম এখানে এসে নাস্তা করবে? তারপর তাসনিমকে বললেন, জান মা, সেই আটটা থেকে নাস্তা খেতে বলছি। বললেই বলে, তুমি এলে একসঙ্গে খাবে।

আব্দুস সাত্তার বলল, আমি ওকে শুধু আসতে বলেছিলাম। নাস্তা খাওয়ার কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।

রাইসা বেগম তাসনিমকে বললেন, তুমি দুপুরে এখানে খাবে। দরকার মনে করলে বাসায় ফোন করে দাও।

ঠিক আছে ফুফুআম্মা, তাই খাব।

নাস্তা খাওয়ার পর আব্দুস সাত্তার তাসনিমকে নিয়ে বেডরুমে এসে দু’জন দু’টো সোফায় বসল।

তাসনিম বলল, উম্মে কুলসুমকে দেখছি না যে?

ওরা একটা ফ্লাটে ভাড়া নিয়ে দুদিন আগে চলে গেছে।

আজ নাস্তার টেবিলে আব্ব বললেন, তোর সেই অলরাউন্ডার ছেলেটাকে একদিন নিয়ে আসতে বলেছিলাম, আনলি না যে?

আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, উনি আমাকে অলরাউন্ডার বললেন কেন?

যেদিন আল্লুকে তোমার কথা বলেছিলাম, সেদিন অনেকরকম গুণের কথাও বলেছিলাম। তাই বলেছেন।

কি কি গুণের কথা বলেছিলে বলতে শুনি।

তাসনিম আব্বুকে যা কিছু বলেছিল, সে সব বলে বলল, এত গুণের কথা শুনেই তোমাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছিলেন। আজ বেরোবার আগে তোমাকে কাল নিয়ে আসব বলতে থাকবেন বলেছেন। এবার মন খারাপের ব্যাপারটা বল।

তার আগে দু’একটা প্রশ্ন করব।

বেশ তো কর।

তুমি আমাকে কতটা ভালবাস বলতে পার?

তাসনিম আহত স্বরে বলল, তা কী তুমি জান না?

জানি, তবু তোমার মুখে শুনতে চাই।

ভালবাসার পরিমাণ বা পরিমাপ নেই, সেকথা তুমিও জান। তবু যখন শুনতে চাচ্ছ তখন বলব, সারা পৃথিবীর সাত সমুদ্রের জল রাশির যত পরিমাণ ও পরিমাপ তার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসি।

তুমি কী জান, “লাভ অলওয়েজ টিয়ার্স?”

জানি।

কোনো কারণে তোমার আব্ব যদি আমাকে ঘৃণা করেন অথবা আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে না চান, তাহলে কী করবে?

জানি না, এরকম প্রশ্ন কেন করছ। তবু বলব, ঐ সাত সমুদ্রের জলরাশিতে আজীবন সঁতার কেটে তীরে উঠার চেষ্টা করব।

তাসনিমের ভালবাসার গভীরতা জেনে আনন্দে ও আতঙ্কে আব্দুস সাত্তারের চোখে পানি আসার উপক্রম হল। সামলে নিয়ে বলল, শোন তা হলে, তোমার। আব্ব আমার আব্বুর বাল্যবন্ধু ছিলেন। তোমাদের দেশের বাড়ির পাশের গ্রামে। আমাদের বাড়ি। ক্লাস সিক্স থেকে এম.এ. পাশ করার পরও সেই বন্ধুত্ব ছিল। তারপর কিভাবে তাদের শত্রুতা হল সেসব বলে বলল, আব্ব কয়েকবার মিলমিশ করার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু উনি প্রতিবারেই অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমি এক রাজাকারের ছেলে। রাজাকারের ছেলের সঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বিয়ে দেবেন কি? নিশ্চয় দেবেন না। কথা শেষ করে তার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় কিনা জানার জন্য মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

তাসনিমও তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। একসময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল এবং অল্পক্ষণের মধ্যে তা গাল বেয়ে টপটপ করে পড়তে লাগল।

আব্দুস সাত্তার বলল, জানতাম, একথা জানার পর তুমি প্রচণ্ড আঘাত পাবে এবং কাল যখন তোমার আব্ব আমার পরিচয় জানার পর তোমাকে জানিয়ে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলবেন তখন তুমি আমাকে ভুল বুঝতে। তাই এখন জানান উচিত ভেবে জানালাম। তোমাকে কয়েকদিন সময় দিলাম, চিন্তা ভাবনা করে জানাবে। আর এরপরও যদি কাল তোমাদের বাসায় নিতে চাও, তা হলে এস, যাব।

তাসনিম চোখ মুখ মুছে বলল, তুমি রাজাকারের ছেলে জেনে প্রচণ্ড আঘাত পাই নি। পেয়েছি, এতদিন কথাটা জানাও নি বলে। আর চোখের পানি ফেলেছি, তুমি আমার ভালবাসাকে খুব হালকাভাবে নিয়েছ বলে। একটা কথা মনে রেখ, তুমি আব্বুর শত্রুর ছেলে হও আর রাজাকারের ছেলে হও, তাতে আমার ভালবাসা একবিন্দু কমবে না। আমার ভালবাসাকে বিশ্বাস করতে পার নি জেনে খুব কষ্ট পাচ্ছি। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।

বিশ্বাস কর তাসনিম, তোমার ভালবাসার এতটুকু অবিশ্বাস করি নি। শুধু জানান উচিত ভেবে বলেছি। আর তোমাকে চিন্তা করার ও তোমাদের বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে যা বলেছি; তা সাত সমুদ্রের জলরাশির গভীরতা পরীক্ষা করার জন্য একটু দুষ্টুমী করেছি। এতে যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তা হলে ক্ষমাপ্রার্থী। প্লীজ তাসনিম, ক্ষমা করে দাও। আর তা না হলে, যা ইচ্ছা বলে আমারও পরীক্ষা নাও।

তাসনিম সামলে নিয়ে বলল, আমার ভালবাসার পরিধি ও গভীরতার চেয়ে তোমার যে কয়েক সহস্রগুণ বেশি, তা অনেক আগেই জেনেছি। পরীক্ষা করলে আমিই ঠকে যাব। আর ক্ষমা করার কথা যে বললে, তার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তুমি যে আমার ভালবাসাকে পরীক্ষা করেছ, তা বোঝা আমারই উচিত ছিল। এবার আমি দু’একটা প্রশ্ন করি?

আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, অফকোর্স।

তুমি সারাদিন কি এত কাজ কর যে, রাতে খুব টায়ার্ড ফিল কর? প্রশ্নটা অবশ্য কাল রাতেই করেছিলাম।

সুস্থ হওয়ার পর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত অফিসের কাজ করতে হয়।

তাসনিম খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি চাকরি কর?

না।

তা হলে?

নিজের অফিস।

কোনো ব্যবসা শুরু করেছ?

না।

তা হলে খোলাখুলি বলছ না কেন?

বললে রাগ করবে না বল?

না করব না।

সবকিছু বলতে গেলে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। তুমি কিন্তু এখনও বাসায় ফোন কর নি।

টেবিলের উপর টেলিফোন সেট দেখে তাসনিম বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিল, “দুপুরে এক বন্ধুর বাসায় খাবে। বিকেলে ফিরবে।” তারপর রিসিভার রেখে। বলল, এবার বল।

আব্বুর নাম আব্দুল হামিদ ছাড়া আমার পুরো বায়োডাটা তোমাকে আগে বলেছি। তারপর ফুফা-ফুফুর সম্পর্ক ও কিভাবে সে এখানে, এল এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হল, সবকিছু বলে বলল, পরীক্ষার পর অফিস করছিলাম। দুর্ঘটনার কারণে প্রায় পাঁচ মাস অফিস করতে পারি নি। সুস্থ হওয়ার পর অফিসে গিয়ে দেখি প্রচুর কাজ পড়ে আছে। তা ছাড়া ম্যানেজার চাচা আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বলেছেন, এবার আমাকেই অফিস চালাতে হবে।

তাসনিম জিজ্ঞেস করল, এতবড় এ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির তত্ত্বাবধান কে করে?

গেটের পাশে দু’টো রুম দেখেছ না? ওটা একটা অফিস। তিনজন লোক কাজ করে। ওদের উপরেই দায়িত্ব দেওয়া আছে। আগে ফুফা শুধু হিসাব চেক করতেন। এখন আমি করি।

তুমি তো জানতে আব্ব কিছুতেই রাজাকারের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন না, তবু কেন আমাকে ভালবাসলে?

তুমি জান কিনা জানি না, সত্যিকার প্রেম ভালবাসা আল্লাহর ইশারাতেই হয়। অবশ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই তারই ইশারাতে হয়। আমাদের ব্যাপারটাও তাই। তা না হলে ছ’মাসের ব্যবধানে মাত্র দু’বার দেখে তোমার প্রতি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়লাম কেন? তারপর বায়োডাটা জেনে এত হতাশ হয়ে পড়লাম যে, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম হারাম হতে বসেছিল। তোমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য ছ’মাস আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। শরীর ও মন খুব ভেঙ্গে পড়ল। আল্লাহর ইশারায় হঠাৎ একদিন একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ব্যাস, তারপর থেকে ফোন করতে শুরু করে এই পর্যন্ত এলাম। কথা শেষ করে আব্দুস সাত্তার মৃদু হাসল।

তাসনিমও মৃদু হেসে বলল, তা না হয় বুঝলাম, বুদ্ধিটা তো ব্যাখ্যা করলে না?

আমি মনে করেছি, বুদ্ধিটা বুঝতে পেরেছ। বলছি শোন, তোমার আমার বন্ধনের দ্বারা উভয়ের আব্বুর দুশমনির বাঁধ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে পুনরায় বন্ধুত্বের বাঁধ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে দুশমনির অর্ধেক পথ ভেঙ্গেছি। আশা করি, তারই দয়ায় বাকি অর্ধেক ভেঙ্গে পুনরায় তাদের পুরোনো বন্ধুত্বের নতুন বাঁধ তৈরি করতে পারব ইনশাআল্লাহ।

সুবহান আল্লাহ বলে তাসনিম বলল, তোমার এই মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে একমত হয়ে দোয়া করছি, “আল্লাহ আমাদের দু’জনকে কবুল করে এই মহৎ উদ্দেশ্য যেন সফল করান।” তারপর বলল, আচ্ছা, আব্বু পরিচয় জানার পর যদি তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন?

আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, তাতো দেবেনই।

তাকে হাসতে দেখে তাসনিম অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

খুব অবাক হয়েছ না? ভাবছ, অপমান হওয়ার কথা শুনে হাসছি কেন? হ্যাঁ, তাই ভাবছি।

তুমি এত বোকা কেন? এটা তো সবাই জানে আগুনে হাত দিলে পুড়বেই। আমি জেনেশুনে হাত দিয়েছি। পুড়লে দোষ তো আগুনের না। পোড়ার কষ্ট তো আমাকে সহ্য করতেই হবে। রাজাকারের ছেলে হয়ে জেনেশুনে মুক্তিযোদ্ধার মেয়েকে ভালবেসেছি। তিনি তো অপমান করবেনই। আর সেই অপমান আমাকে সহ্য করতেই হবে। দুঃখ কষ্ট বা অপমান যখন পেতেই হবে তখন হাসিমুখে বরণ করাই তো পৌরুষ। আমি নিজের জন্য কিছু ভাবছি না, ভাবছি তোমার জন্য। উনি চেষ্টা করবেন আগুনে পানি ঢেলে ঠাণ্ডা করার। ঠাণ্ডা করার আরো অনেক। পদ্ধতি আছে। তুমি সেসব সহ্য করতে পারবে কি না ভেবে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। তাই মন খারাপের কথা বলেছিলাম।

আমার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করো না। আন্ধু আমাকে ভীষণ ভালবাসেন। আমার কথা না রেখে পারবেন না।

দোয়া করি আল্লাহ যেন তাই করেন। তবে কী জান, অধিকাংশ মা বাবা তাদের পছন্দমতো ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চান। ছেলেমেয়েরা নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করবে, এটা তারা পছন্দ করেন না। তার উপর যদি ছেলে বা মেয়ে শত্রুপক্ষের হয় অথবা তাদের মনের মতো না হয়। আমার তো মনে হচ্ছে, তুমি যত সহজ ভাবছ, ততটা সহজ নয়।

সহজ কঠিন যাই হোক না কেন, আব্বুকে যদি একান্ত রাজি করাতে না পারি, আম্মুকে পারবই। আর কাউকেই যদি না পারি, তোমার কাছে চলে আসব।

ওটা নিকৃষ্ট পথ। যারা কাপুরুষ তারাই ঐ পথ বেছে নেয়। ঐসব কাপুরুষের মধ্যে এমনও অনেকে আছে, যারা নাকি প্রেমাস্পদকে না পেয়ে আত্মহত্যা করে। ইসলাম এই পথ পরিহার করতে শিখিয়েছে। মা-বাবার মনে কষ্ট দিতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) নিষেধ করেছেন। আমরা মুসলমান হয়ে মা-বাবার মনে কষ্ট দিয়ে কিছু করব না। আমরা আধুনিক শিক্ষার যেমন শিক্ষিত, তেমন কুরআন-হাদিসের জ্ঞানও আমাদের আছে। সেইসব জ্ঞানের দ্বারা যুক্তির মাধ্যমে আমাদের মা-বাবাকে রাজি করাব। তারপর কি কি যুক্তি দেখাবে তা আলোচনা করে আব্দুস সাত্তার মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী? পারবে না?

তাসনিমও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ইনশাআল্লাহ পারব।

এমন সময় রাইসা বেগম দু’টো আইসক্রীম নিয়ে এসে বললেন, খুব গরম পড়েছে, খাও। আধঘণ্টা পরে কফি দেব। তারপর তাসনিমকে জিজ্ঞেস করলেন, বাসায় ফোন করেছ মা?

জ্বি, করেছি।

তোমরা গল্প কর, যাই দেখি, জমিলা আবার আরেক করতে এক করে বসবে।

রাইসা বেগম চলে যাওয়ার পর তাসনিম বলল, তোমার আম্মুর ও ফুফুআম্মার মনের ইচ্ছা আমি বুঝতে পেরেছি।

আব্দুস সাত্তার বলল, ওরাও প্রথমে রাজি ছিলেন না। যখন বললাম, তাসনিম আমার দীলের ধড়কন। দীলের ধড়কন থেমে গেলে যেমন মানুষ বাঁচে না। তেমনি ওকে না পেলে আমার দীলের ধড়কনও বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যাস, এই কথা শুনে রাজি হয়ে গেলেন। অবশ্য সেইসাথে তোমার আমার আব্বুর পূর্ব সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তটাও বলেছি। তুমিও আমার পদ্ধতিটা টুকলিফাই করে তোমার আম্মুকে রাজি করাতে পার। তারপর আব্বুকে রাজি করাবার পদ্ধতি প্রয়োগ করবে।

তাসনিম হেসে উঠে বলল, টুকলিফাই শেখানোর জন্য ধন্যবাদ।

বিকেলে তাসনিমকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময় আব্দুস সাত্তার বলল, তোমাকে কাল আসতে হবে না। আমি সকাল নটায় যাব।