পাঁচ
বাসায় ঢুকে তাসনিম চিন্তা করল, আংটিটা খুলে লুকিয়ে রাখাই ভালো। সায়মা দেখতে পেলে হাজার প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলবে।
সায়মা কলেজে গিয়েছিল। আড়াইটায় ফিরে তাসনিমকে বলল, এবার বল, কোথায় গিয়েছিলি।
এক বান্ধবীর বাসায় বলতে গিয়েও থেমে গেল। ভাবল, একটা মিথ্যে বললে, তাকে সাতটা মিথ্যে দিয়েও কভার দেওয়া যায় না। বলল, একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
সেই একজনটা কে? অত সকালে তার সঙ্গে দেখা করতেই বা গেলি কেন?
ওসব আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, বলা যাবে না।
কিন্তু তোর অনেক কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার আমাকে বলিস, এটাই বা বলবি না। কেন?
অনেক কিছু বললেও এটা বলা যাবে না।
সায়মা ক্রমশঃ রেগে যাচ্ছিল। তবু সংযত হয়ে বলল, কিন্তু যাওয়ার সময় তো বলেছিলি, ফিরে এসে বলবি?
হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
বেশি রেগে গেলে সায়মা কেঁদে ফেলে। এখনও তার কান্না পেল। বলল, ঠিক আছে, তোর কোনো ব্যাপারেই আমি আর কোনো দিন নাক গলাব না। কথা শেষ করে চলে যেতে লাগল।
তাসনিম তাকে কাঁদাবার জন্য এতক্ষণ ঘটনাটা বলে নি। কান্নাভেজা কণ্ঠ শুনে বলল, রাগ করে চলে যাচ্ছিস কেন? শোন।
সায়মা দাঁড়িয়ে পড়লেও ঘুরল না। বলল, কী বলবি বল।
বিকেলে কোথায় যেন নিয়ে যাবি বলেছিলি, নিয়ে যাবি তো? না আমার উপর রাগ করে নিয়ে যাবি না?
আপুর উপর রাগের চেয়ে অভিমানই বেশি হয়েছিল সায়মার। অভিমানের চোটে কান্না পাচ্ছিল। কিছু বলতে গেলে কেঁদে ফেলবে। তাই চুপ করে রইল।
রূপা তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, যেখানে নিয়ে যাবি বলেছিলি সেখানে যাওয়ার আর দরকার নেই। আমি সকালে আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তোকে বললে কলেজ কামাই করে যেতে চাইতিস। তাই বলি। নি। তোর অনুমান ঠিক, আসিফ সাহেবই আব্দুস সাত্তার। তোর কাছে হেরে গেলাম। একটু আগে যা বললাম, তোকে রাগাবার জন্য বলেছি।
সায়মা দ্রুত ঘুরে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি বলছিস আপু? ততক্ষণে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
তাসনিম তাকে পাশে বসিয়ে চোখ মুছে দিতে দিতে বলল, হারে সত্যি। এত সামান্য ব্যাপারে আমার উপর রাগ অভিমান করে কেঁদে ফেললি, বিয়ের পর যখন আমি শ্বশুরবাড়ি চলে যাব তখন কার উপর রাগ অভিমান করবি?
সেজেগুজে বেরোতে দেখেই বুঝেছিলাম, তুই আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস। আজ তোদের প্রথম সাক্ষাৎ, যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে জিদ করি নি। নচেৎ তোর নিষেধ অমান্য করে যেতাম। জিজ্ঞেস করল, ওঁকে নিশ্চয় তোর পছন্দ হয়েছে?
তোর কী মনে হয়?
একশ পার্সেন্ট হয়েছে। তারপর হেসে উঠে বলল, এই আপু বল না, তোর কত পার্সেন্ট হয়েছে?
আমারও একশ পার্সেন্ট হয়েছে বলে তাসনিম লজ্জা পেয়ে বলল, যা ভাগ। বড় বোনের এসব কথা জিজ্ঞেস করতে তোর লজ্জা করল না?
আহা আমার বড় রে? দু’আড়াই বছরের বড় আবার বড়? তা ছাড়া বড় বোন। হয়ে ছোট বোনের কাছে এসব কথা বলতে তোর যখন লজ্জা করে নি তখন আমার করবে কেন?
তুই দিন দিন বড় ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। খেয়েছিস? নামায পড়েছিস? না ওসব না করেই আমার সঙ্গে ফাজলামী করতে এসেছিস?
ওসব সেরেই তোমার কাছে এসেছি। এই আপু, আসিফ সাহেব নিজেই আব্দুস সাত্তার হয়ে ধরা দিলেন? না তুই কথার প্যাচে ফেলে ধরা দিতে বাধ্য করেছিস?
ও নিজেই ধরা দিল।
ওরে বাবা, প্রথম সাক্ষাতেই তুমি?
তাসনিম হেসে উঠে বলল, সাক্ষাৎ প্রথম হলেও সম্পর্কটা তো প্রায় দু’বছরের।
তা কি সব কথাবার্তা হল, একটু বল না শুনি।
আমার ডাক নাম রূপা বাদ দিতে বলেছে। তার বদলে তাসনিম দিয়েছে এবং আজ থেকে বাসার সবাই যেন তাসনিম নামে ডাকে, সে কথাও বলেছে।
ওমা, তাই নাকি? আর কি কি বলেছেন, বল না আপু?
দেব এক থাপ্পড়, যা এখান থেকে।
সায়মা একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি কি সব শুনতে চাচ্ছি? একটু আধটু বললে কী হয়? ভবিষ্যতে আমারও কাজে লাগতে পারে।
তবে রে দাঁড়া তোর ফাজলামী বের করছি বলে তাকে তাসনিম হাত বাড়িয়ে। ধরতে গেল।
সায়মা ছুটে পালাবার সময় বলল, আবার যেদিন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবি, সেদিন না নিয়ে গেলে আব্রু আম্মুকে বলব, তুই একটা বাজে ছেলের প্রেমে পড়েছিস।
তাসনিম তার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগল।
রাত বারটার সময় সায়মা ঘুমাতে এসে আপুকে বই পড়তে দেখে জিজ্ঞেস করল, ঘুমাবি, না আরো পড়বি?
তাসনিম টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বলল, তুই বড় লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়, বইটা শেষ করে ঘুমাব।
সায়মা জানে আপু আব্দুস সাত্তারের ফোনের অপেক্ষায় প্রতিদিন রাত সাড়ে বারটা একটা পর্যন্ত জেগে বই পড়ে। সে কথা বললে বকা খেতে হবে ভেবে শুধু একটু মৃদু হেসে ঘুমিয়ে পড়ল।
পড়তে পড়তে হঠাৎ তাসনিমের মনে হল, রিং বাজলে সায়মা জেগে যেতে পারে। তাই বারটা বিশে সে আব্দুস সাত্তারকে ফোন করল।
আব্দুস সাত্তার আজ সাড়ে দশটার সময় ফোন করতে চেয়েছিল, সায়মা জেগে আছে ভেবে করে নি। সাড়ে বারটা বাজার অপেক্ষায় সেও একটা বই পড়ছিল। ফোন বেজে উঠতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল, এ সময় আবার কে ফোন করল? বিরক্ত হয়ে রিসিভার তুলে সালাম দেওয়ার আগেই তাসনিমকে সালাম দিতে শুনে বিরক্ত ভাবটা কেটে গেল। উৎফুল্ল কণ্ঠে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কী ব্যাপার? আজ সময়ের আগেই তুমি ফোন করলে যে? আমি তো মনে করেছিলাম, তোমাদের বাসায় যাই নি বলে রাগ করে আমার ফোন রিসিভ করবে না।
রাগ অবশ্য ঠিকই করেছিলাম, তোমার প্রেম পানি ঢেলে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে।
শুনে খুশী হলাম।
আমিও খুশী হয়েছি।
তোমার খুশীর কারণটা তো বুঝলাম না।
বারে, তোমার খুশীতে আমি খুশী হব না?
সত্যি, তোমার কোনো জওয়াব নেই।
তোমারও কোনো জওয়াব নেই।
লা জওয়াবের মতো আমি কিছু করেছি কী?
একটা গ্রাম্য ছেলে হয়ে একজন মন্ত্রীর মেয়েকে প্রেমের বানে ঘায়েল করা কম কৃতিত্বের কথা নয়।
এই কথার উত্তর দিতে না পেরে আব্দুস সাত্তার চুপ করে রইল।
কিছু বলছ না যে?
প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য আব্দুস সাত্তার বলল, আমার আগেই তুমি ফোন করলে কেন বলবে না?
কিছুক্ষণ আগে সায়মা ঘুমিয়েছে। ভাবলাম, রিং হলে জেগে যাবে। তাই করলাম। কী করছিলে?
একসঙ্গে দু’টো কাজ করছিলাম।
তাসনিম হেসে উঠে বলল, একসঙ্গে আবার দু’টো কাজ করা যায় বুঝি?
তা জানি না। তবে আমি বই পড়ছিলাম আর তোমাকে ফোন করব বলে মাঝে মাঝে ঘড়িতে সময় দেখছিলাম।
তাসনিম হাসতে হাসতেই বলল, এটা আবার দু’টো কাজ হল বুঝি? বোকার মতো কথা বলছ কেন?
প্রেমে পড়লে সবারই বুদ্ধি লোপ পায়, তাই বোকামী করে। তুমিও কর।
ওমা, আমি আবার কি বোকামী করলাম?
আমি তোমার প্রেমে পড়ে তোমাদের সব খবর নিয়েছি। কিন্তু তুমি আমার কিছুই নাও নি। বুদ্ধিমতী মেয়েরা প্রেমিকের সঙ্গে প্রথম আলাপের সময়েই তার সবকিছু জেনে নেয়।
কথাটা ঠিক বল নি। অনেক আগেই জানতে চেয়েছি, তুমি বল নি। আজ অবশ্য বাসা থেকে বেরোবার সময় তোমার সবকিছু জানার কথা ভেবেছিলাম, তোমার কথা শুনতে শুনতে ভুলে গেছি। আর এজন্য দায়ী তোমার প্রেম। এখন তাড়াতাড়ি পূর্ণ বায়োডাটা বলে ফেল।
তাড়াতাড়ি কেন?
শুধু তোমার প্রেমে নয়, কথাতেও যাদু আছে। ফট করে এমন কথা বলবে, যা শুনে আমি আবার ভুলে যাব।
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, তাই নাকি?
জ্বি তাই। ফোনে তোমার কথার যাদুতেই তো প্রেমে পড়ে গেলাম।
আব্দুস সাত্তার হাসতে হাসতেই বলল, যাদু কি জিনিস জান?
দেখেছ? বায়োডাটা না বলে কেমন অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছ? যাদু সম্পর্কে কিছু জানি আর না জানি, তোমার জানার দরকার নেই। যা জানতে চেয়েছি বল।
আমি গ্রামের ছেলে তা তো আগেই বলেছি, আমার আব্বা গ্রামের বেসরকারী কলেজে শিক্ষকতা করেন। জমি-জায়গা, আগান-বাগান ও পুকুর ডোবা কিছু আছে। মোটামুটি স্বচ্ছল অবস্থা। আমরা তিন বোন, দুই ভাই। দু’বোন সবার বড়। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর একভাই। তিনি বিয়ে করার আগে মারা গেছেন। ঐ ভায়ের পরে আমি। আমার পরে উম্মে কুলসুম। ওর আকদ হয়েছে। আমার এখনো বিয়ে হয় নি। এতেই হবে? না আরো কিছু লাগবে?
তাসনিম হেসে উঠে বলল, বাবার নাম, গ্রামের নাম ও জেলার নাম লাগবে।
ওগুলো পরে বলব।
ওগুলো না হলে বায়োডাটা সম্পূর্ণ হয় না। আব্বকে জানাব কী করে?
যখন জানাবে তখন বলব।
তাসনিম আবার হেসে উঠে বলল, তুমি তো আচ্ছা পাগল। তখন তোমাকে পাব কোথায়?
কী বললে? আমি পাগল?
কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ বলে ফেলেছি। তাই বলে সত্যি সত্যি তুমি তো আর পাগল না।
তা হলে কথা প্রসঙ্গে আমিও তোমাকে পাগলি বলব?
আপত্তি নেই।
সায়মা নিশ্চিত ছিল, আব্দুস সাত্তার আজও ফোন করবেন। তাই আপু তার সঙ্গে কি কথা বলে শোনার জন্য এতক্ষণ ঘুমের ভান করে জেগে ছিল। এবার খাট থেকে নেমে নিঃশব্দে পিছন থেকে এসে তাসনিম বুঝে উঠার আগেই চিলের মতো ছোঁ মেরে তার হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে বলল, এই যে পাগল সাহেব, রাত কত হয়েছে খেয়াল করেছেন? পাগল পাগলির পাগলামীর কারণে অন্য একজনের যে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে, তাও খেয়াল নেই বুঝি? আর কোনো দিন এতক্ষণ ধরে পাগলামী করবেন না। মানুষে ঠিকই বলে, “পাগলরাই প্রেম করে।” রিসিভার রেখে দিন। নচেৎ আল্লুকে বলে প্রেম করার মজা বুঝিয়ে দেব।
সরি, তোমার, সরি আপনার ঘুম পাতলা জানলে এত দেরি করতাম না। ক্ষমা করে দিন।
বার বার সরি বলার দরকার নেই। আমাকে তুমি করেই বলবেন। রিসিভার রেখে দিন, তারপর ক্ষমা করার কথা চিন্তা করব।
রিসিভার রেখে দিলে তো তোমার আপু কষ্ট পাবে। তুমি বরং রিসিভারটা ওকে দাও। ও রাখতে বললে রেখে দেব।
মাত্র একবার দেখেই আপুর জন্য দরদ যে উথলে উঠছে দেখছি। বিয়ের কিছুদিন পর তো স্বামীরা বৌ এর সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে?
পুরুষরা কোমর বেঁধে ঝগড়া করে না, করে মেয়েরা। আমার মরহুম দাদাজী বলতেন, “বিয়ের প্রথম বছর স্বামী কথা বলে স্ত্রী শোনে। দ্বিতীয় বছর স্ত্রী বলে স্বামী। শোনে। আর তৃতীয় বছর থেকে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বলে পাড়া-পড়শী শোনে।” আমার মনে হয় দাদাজী ঠিক কথাই বলেছেন। কারণ এক হাতে তালি বাজে না।
আপনার দাদাজীর বচন শোনার ধৈর্য আপুর থাকলেও আমার নেই।
তা হলে আর কষ্ট করছ কেন? রিসিভারটা তোমার আপুকে দিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।
আচ্ছা বাচাল ছেলে তো? আপনার কী ভদ্ৰতা জ্ঞান নেই?
যথেষ্ট ছিল, তুমিই সব খরচ করে দিচ্ছ।
সামনে পেলে বাচালতা ছাড়িয়ে দিতাম।
ঠিকানা তো জান, ড্রাইভারকে বল, পৌঁছে দিতে।
সায়মা বুঝতে পারল, কথায় ওঁকে হারাতে পারবে না। বলল, বকমবাজরাই বেশি কথা বলে।
তুমি কিন্তু আমার চেয়ে বেশি কথা বলছ।
উঁহ, কী সাংঘাতিক ছেলে রে বাবা, বলে তাসনিমার হাতে রিসিভার দিয়ে বলল, তোর পাগলকে তুই সামলা। আমার ঘুম পাচ্ছে। তারপর বেড়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
গভীর নিঝুম রাত। তাই আব্দুস সাত্তারের কথাগুলোও তাসনিম শুনতে পেয়েছে। রিসিভার কানের কাছে নিয়ে বলল, সায়মার কথায় কিছু মনে কর নি তো? ও কিন্তু তোমার সঙ্গে দুষ্টুমী করেছে। আমার সঙ্গেও প্রায়ই করে।
আব্দুস সাত্তার বলল, তা কি আর আমি বুঝি না। শোন, আর দেরি করা উচিত হচ্ছে না। এবার রাখি কেমন?
কাল ফোন করবে তো?
তাতো করবই।
ঠিক আছে রাখছি বলে তাসনিম সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
সায়মা বলল, কোনো জিনিস বাড়াবাড়ি ভালো না। তোরা কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছিস।
হয়েছে, তোকে আর পাকামী করতে হবে না, ঘুমিয়ে পড়।
পরের দিন ফোনের অপেক্ষায় তাসনিম রাত দুটো পর্যন্ত জেগে রইল। সাড়ে বারটায় ফোন না আসায় দশ মিনিট অপেক্ষা করে বেশ কয়েকবার সে ফোন করেছে। রিং বাজার শব্দ না হয়ে শুধু ঘড় ঘড় শব্দ হয়েছে। তাতেই বুঝেছে ফোন খারাপ। তবু দু’টো পর্যন্ত জেগে থেকে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে নাস্তা খেয়ে তাসনিম আবার ফোন করল আব্দুস সাত্তারের বাসায়। রাতের মতো একই শব্দ শুনে। নিশ্চিত হল ফোন খারাপ। ভাবল, আজ নিশ্চয় ফোন সারাবার ব্যবস্থা করবে অথবা অন্য কোথাও থেকে ফোন করবে। কিন্তু তিন চার দিন পার হয়ে যেতেও যখন ফোন এল না তখন বেশ চিন্তিত হল।
এই ক’দিন সায়মা আপুর অস্থিরতা লক্ষ্য করেও কিছু বলে নি। আজ কলেজ থেকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আপু, তোর মন খারাপ কেন বলবি?
তাসনিম বলল, মানুষের মন সব সময় ভালো থাকে না, মাঝে মাঝে খারাপও থাকে।
তা আমিও জানি। আর মন খারাপের পিছনে যে কারণ থাকে, তাও জানি। তোর মন খারাপের কারণটা জানতে চাচ্ছি। আব্দুস সাত্তার সাহেবের সঙ্গে কিছু। হয়েছে নাকি?
কী আবার হবে? এমনিই মন খারাপ।
আমি তোর মুখ দেখে বুঝতে পারছি কিছু হয়েছে। কি হয়েছে বল, সম্ভব হলে সমাধান করে দেব।
তাসনিম জানে, সায়মার হাত থেকে সহজে নিস্তার পাওয়া যাবে না। বলল, প্রত্যেক দিন ফোন করার কথা থাকলেও আজ চার পাঁচ দিন করে নি।
সায়মা হেসে উঠে বলল, ও এই কথা। কোনো কারণে হয়তো করতে পারে নি। এতে মন খারাপের কী হল?
ও তুই বুঝবি না।
তা ফোন না করার কারণ কিছু বুঝতে পারলি?
না।
তুই ফোন করিস নি?
করেছি, রিং হয় নি। মনে হয় ফোন খারাপ।
ওর বাসায় গিয়ে খোঁজ নিতে পারতিস?
বাসার ঠিকানা জানি না।
আমি জানি।
সত্যি বলছিস?
হ্যাঁ সত্যি।
কীভাবে জানলি?
কিভাবে জেনেছিল সায়মা বলল।
ওমা, তাই নাকি? তুই তো খুব চাপা?
জানার পরের দিন তোকে ওঁদের বাসায় নিয়ে গিয়ে আসিফ সাহেবই যে আব্দুস সাত্তার প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। তুই তো সকালে তার সঙ্গে দেখা করে এলি। তাই কথাটা বলি নি।
তৈরি হয়ে নে, এক্ষুনি যাব।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ, এসময় কেউ কারো বাসায় যায়? আসরের নামায পড়ে যাব।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তাসনিম ও সায়মা ঠিকানা মতো একটা বেশ বড় গেটের কাছে এল। গেট বন্ধ দেখে তাসনিম ড্রাইভারকে হর্ণ বাজাতে বলল।
একটু পরে একজন খাকী পোশাক পরা যুবক গেট খুলে দিলে ড্রাইভার গাড়ি ভিতরে ঢুকিয়ে একসাইডে পার্ক করল।
তাসনিম ও সায়মা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি দেখে অবাক। এ্যাপার্টমেন্ট আকারে সাততলা বাড়ি। নিচতলাটা প্রায় সবটাই গ্যারেজ। বেশ কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা। গেট থেকে ঢুকে অনেকখানি প্রশস্ত জায়গা। এক পাশে ছোটখাট একটা মসজিদ। মসজিদের দক্ষিণ দিকে দুটো পাকা রুম। উত্তর দিকে ছোট একটা। দোতলা বাড়ি।
খাকি পোশাক পরা যুবকটা এগিয়ে এসে বলল, আপনারা কোন ফ্লাটে যাবেন?
তাসনিম বলল, আপনি নিশ্চয় দারোয়ান?
জ্বি, টয়লেটে গিয়েছিলাম। গেট খুলতে তাই একটু দেরি হয়ে গেছে।
ঠিক আছে, আমরা আব্দুস সাত্তার সাহেবের কাছে এসেছি। উনি কোন ফ্লাটে থাকেন বলেন নি।
দারোয়ান চিন্তিত মুখে বলল, এখানে তিনজন আব্দুস সাত্তার আছেন, কার কাছে এসেছেন বুঝব কী করে? এই বাড়ির মালিকের নামও আব্দুস সাত্তার।
আমরা বাড়ির মালিকের কাছে এসেছি। কোন ফ্লাটে থাকেন বলুন।
ওরা ফ্লাটে থাকেন না। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ যে মসজিদের উত্তর দিকে দোতলা বাড়িটা দেখছেন, ওখানে থাকেন? কিন্তু ওঁরা তো কেউ বাসায় নেই।
কোথায় গেছেন?
দারোয়ান মনে মনে হিসাব করে বলল, চারদিন হল সবাই দেশের বাড়িতে গেছেন। শুধু একজন কাজের বুয়া আছে।
তাসনিম বুঝতে পারল, যেদিন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার পরের দিন গেছেন। জিজ্ঞেস করল, কবে ফিরবেন জানেন?
না। তবে কাজের বুয়া হয়তো জানতে পারে। আসুন আমার সঙ্গে।
সাদামাটা অর্ডিনারী বাড়ি। নিচতলা ও উপরের তলায় গ্রীল দিয়ে ঘেরা বেশ। চওড়া বারান্দা। গ্রীলের ভিতরে চিক ফেলা।
গেটের কাছে এসে দারোয়ান কলিংবেলের বোতামে চাপ দিল।
একটু পরে একজন বয়স্কা মহিলা চিক সরিয়ে বলল, কে?
দারোয়ান ওদেরকে দেখিয়ে বলল, ইনারা সাহেবের কাছে এসেছেন। সবাই দেশে গেছেন শুনে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
জমিলা গেট খুলে দিয়ে ওদেরকে ভিতরে আসতে বলল। তারপর তাদেরকে ড্রইংরুমে নিয়ে এসে বসতে বলে বেরিয়ে গেল।
তাসনিম ও সায়মা রুমের পরিবেশ দেখে খুব অবাক হল। সব আসবাবপত্র অর্ডিনারী। মেঝের কার্পেট, দরজা জানালার পর্দাও তাই। একপাশে বই ভর্তি একটা আলমারী। কোনো কিছুতে এতটুকু আভিজাত্যের ছাপ নেই।
তাসনিম চিন্তা করতে লাগল, যে এতবড় এ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির মালিক, যে প্রথম সাক্ষাতের দিন প্রেমিকাকে হীরের আংটি উপহার দিতে পারে, তার বাড়ির পরিবেশ এত সাধারণ, প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্বাস হত না।
সায়মাও যেন বিশ্বাস করতে পারল না। বলল, এই আপু, কিছু অনুমান করতে পারছিস?
তাসনিম বলল, কী অনুমান করব?
এমন সময় জমিলা ট্রেতে করে কেক, বিস্কুট ও দু’কাপ কফি নিয়ে এসে বলল, সাহেবদের কেউ নেই, যা ছিল নিয়ে এসেছি।
তাসনিম বলল, এসব আনতে গেলেন কেন? আমরা দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করেই চলে যাব।
তাতে কী হয়েছে? মেহমানকে যত্ন করা সওয়াবের কাজ।
দু’বোন কেক বিস্কুট না খেয়ে শুধু কফি খেল। তারপর তাসনিম জিজ্ঞেস করল, সাহেবরা কবে ফিরবেন জানেন?
জমিলা বলল, না।
তা হঠাৎ সবাই দেশে গেলেন কেন?
হঠাৎ হবে কেন? অনেক আগে সাহেবের আকদ হয়েছিল, এবার বৌ ওঠাবে। তাই সবাই দেশে গেছে।
দু’বোন চমকে উঠে একে অপরের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাসনিমের মনে হল, কেউ যেন তাকে হিমালয়ের চূড়া থেকে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
জমিলা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সাহেবের বিয়ের কথা শুনে খুশী হয় নি। বলল, এই দেখুন, আসল কথাটাই ভুলে গেছি, আপনাদের পরিচয় নেওয়া হয় নি। কেন এসেছেন তাও জানা হয় নি।
তাসনিম বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে সায়মার দিকে তখনও তাকিয়েছিল। তার কানে জমিলার কথা গেল না।
সায়মা তা বুঝতে পেরে জমিলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা দু’বোন। আমি ছোট। আপনাদের সাহেবের সঙ্গে খুব জানাশোনা। উনি আসতে বলেছিলেন। আচ্ছা, সাহেবের দেশের বাড়ি কোথায়?
নিলফামারী।
সায়মাদের দেশের বাড়িও নিলফামারী। তাই বেশ অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ওঁর আব্বার নাম জানেন?
তা আর জানব না। আমার বাড়িও তো ওখানে। হাজী আব্দুল হামিদকে গেরামের সবাই চেনে। আশপাশের গেরামের লোকেরাও চেনে। ওনার মতো বড়লোক দশ পাঁচটা গেরামে কেউ নেই। কত যে জমি-জায়গা তা কেউ বলতে পারে না। খুব ভালো মানুষ। গরিবের মা বাপ, গেরামের উন্নতির জন্য মাদ্রাসা, স্কুল, হাসপাতাল নিজের টাকায় করে দিয়েছেন।
আব্দুস সাত্তারের বাবার সুখ্যাতি শুনে সায়মা বিরক্ত বোধ করে বলল, তা বাসায় কেউ যখন নেই, এবার আমরা আসি। তারপর তাসনিমের দিকে তাকিয়ে বলল, আপু চল।
তাসনিম মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে এখনও স্তব্ধ হয়ে মুক ও বধিরের মতো বসেছিল। সায়মার কথাও তার কানে গেল না।
সায়মা তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে উঠে আপুর একটা হাত ধরে টান দিয়ে বলল, এই আপু, বাসায় চল।
তাসনিম এবার সম্বিত ফিরে পেয়ে ধীরে ধীরে তার সঙ্গে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল।
সায়মা ড্রাইভারকে বলল, বাসায় চলুন।
পথে কেউ কোনো কথা বলল না। বাসায় পৌঁছে সায়মা গাড়ি থেকে নামল; কিন্তু তাসনিম বসে রইল।
সায়মা বলল, এই আপু, নামবি তো।
তাসনিমের কোনো সাড়া নেই, বসেই রইল।
সায়মা তার একটা হাত ধরে টেনে নামিয়ে রুমে নিয়ে এসে বসিয়ে দিল।
তাসনিম তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
সায়মার মনে হল, আব্দুস সাত্তার সাহেবের বিয়ের কথা শুনে আপু এবনরম্যাল হয়ে পড়েছে। আতঙ্কিত স্বরে বলল, আপু তুই ওভাবে আমার দিকে। তাকিয়ে আছিস কেন? কোনো কথাই বা বলছিস না কেন?
তাসনিমের ঠোঁট দুটো শুধু একটু কেঁপে উঠল আর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
সায়মার ধারণা হল, মনে আঘাত পেয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আপু, তুই চুপ করে আছিস কেন? কথা বলবি তো? একটু পরে তাকে ফুলে ফুলে কাঁদতে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেয়ে বলল, একটা কাজের বুয়া কি বলতে কি বলেছে, আর তাতেই তুই আব্দুস সাত্তার সাহেবকে অবিশ্বাস করে ফেললি? তুই-ই তো বলেছিলি, “হাদিসে আছে, প্রমাণ না নিয়ে শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই,” আরো জোরে ফুলে ফুলে কাঁদতে দেখে চুপ করে গেল। কাদলে মানুষের অনেকটা হালকা হয়। তাই সায়মা তাকে কিছুক্ষণ সময় দিল। তারপর যখন বুঝতে পারল, কান্নার বেগ কমেছে তখন। তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তুই আমার থেকে বেশি কুরআন হাদিস পড়িস, আর এটা জানিস না, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) মানুষকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন? আমার মন বলছে, আব্দুস সাত্তার সাহেব তোর সঙ্গে কিছুতেই বেঈমানী করতে পারেন না। বিয়ের ব্যাপারটা আমি একদম বিশ্বাস করতে পারছি না। তুই। বোধহয় ওদের কাজের বুয়ার সব কথা শুনিস নি। আমি তার কাছ থেকে জেনেছি, দেশের বাড়ি নিলফামারী, ওর বাবার নাম হাজী আব্দুল হামিদ। তিনি খুব ধনী লোক। আশপাশের গ্রামের সবাই তাকে চেনে। আমাদের দেশের বাড়িও নিলফামারী। আলু নিশ্চয় ওদেরকে চেনে। আব্বুকে সবকিছু জানালে কেমন হয়?
তাসনিম চোখ মুখ মুছতে মুছতে বলল, আব্বকে কোন মুখে এসব কথা জানাব? হাদিসে পড়েছি, “আল্লাহ যার সঙ্গে জোড়া করে পয়দা করেছেন, তার সঙ্গে বিয়ে হয়।” কাজের বুয়ার কথা সত্য হোক, আর মিথ্যে হোক, আমি হাদিসের বাণী মোতাবেক ধৈর্য ধরব। দেখব, আল্লাহ কার সঙ্গে আমাকে জোড়া করে পয়দা করেছেন।
সায়মা খুশী হয়ে বলল, দোয়া করি, আল্লাহ তোকে ধৈর্য ধরার তওফিক দিক।