☼ জসীম উদ্দীন ☼
ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়
‘ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়’ পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। গ্রন্থটির প্রকাশিকা নন্দিতা বসু; গ্রন্থপ্রকাশ, ৬-১ রমানাথ মজুমদার স্ট্রীট, কলিকাতা -৯। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কানাই পাল। মুদ্রাকর কার্তিকচন্দ্র পাণ্ডা; মুদ্রণী, ৭১ নং কৈলাসবোস ষ্ট্রীট, কলিকাতা ৬। গ্রন্থটির উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেলেন—
আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু—
বিনয়েন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
বীরেন ঘোষ
ও
বীরেন ভঞ্জের
করকমলে
জসীম উদ্দীন
‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’ ফুটে উঠেছে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের চোখে তিন মহীরূহের চিত্র— বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তুলিতাত্ত্বিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম, ঝর্ণার মত চঞ্চল কাজী নজরুল ইসলাম। আলোচনায় উঠে এসেছেন আরও অনেকে, এবং কবি জসিম উদ্দীনের স্ট্রাগলিং সময়ের গল্পও।
কলিকাতায় পড়াশোনা করছিলেন জসীম উদ্দীন। এমনসময় তার সাথে পরিচয় হয় ঠাকুরবাড়ির অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্র মোহনলালের। এই পরমসুহৃদ মোহনলালই তাকে নিয়ে যান রবীন্দ্রনাথেরর কাছে, পরিচয় করিয়ে দেন তাকে।
যে কবির কবিতা, গল্প আর উপন্যাস এতকাল পড়ে এসেছেন এবার তারঁ সান্নিধ্য পাচ্ছেন তা তরুণ জসীম উদ্দীনকে আন্দোলিত করে, অনুপ্রাণিত করে সাহিত্য চর্চায়। রবিঠাকুরের শান্তিনিকেতন আর ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত যেন অনেকটা নিয়মিত হয়ে যায় তরুণ কবি জসীম উদ্দীনের জন্য। ঠাকুরবাড়িতে ঘরভাড়া নিয়ে দীর্ঘকাল কাটান তিনি।
রবীন্দ্রনাথ জসীম উদ্দীনকে কাব্য রচনায় কিভাবে প্রভাবিত করেছেন তার সহজ-সরল অথচ অতিমুগ্ধকর বর্ণনা রয়েছে এই বইতে।
ঠাকুরবাড়ির আরেক জিনিয়াস অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও জসীম উদ্দীনের বেশভাল সস্পর্ক গড়ে ওঠে। কবি তার সংগৃহীত পল্লীগীতি, পালাগান প্রায়শই অবনীন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ আর গগনেন্দ্রনাথকে শোনাতেন। আর তাঁরাও এই তরুণটিকে স্নেহের চোখে দেখতেন। “নকশিকাঁথার মাঠ” রচনায় অবনীন্দ্রনাথের প্রভাব জসীম উদ্দীন অবলীলায় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। অবন ঠাকুরের সাহচর্য জসীম উদ্দীনের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সুসমৃদ্ধ করেছে।
জসীম উদ্দীন রাতারাতি কবি হিসেবে খ্যাতি পাননি। তাকেও অনেক সংগ্রাম করে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়েছে। স্কুল ছাত্র থাকাকালে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলিকাতায় চলে এলেন জসীম উদ্দীন। উদ্দেশ্য ছিল কবি হবেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে হলেন হকার। অচেনা, অজানা কলিকাতায় পত্রিকা ফেরি করে দিন কেটেছে কবির। সেই কাব্যচর্চা, গদ্যচর্চার সংগ্রামকে জসীম উদ্দীন কখনই ভুলতে পারেননি—যার প্রমাণ সেইসব দিনগুলোর কথা অনেকবার তিনি লিখেছেন বইতে।
১৯৩১-১৯৩৭ সাল দীর্ঘ ৬ বছর। এই সময়ে পুরোটা বেকার ছিলেন জসীম উদ্দীন। দিনরাত এখানে সেখানে চাকরির আবেদন করে যাচ্ছেন অথচ কাজ হচ্ছে না। কলিকাতার রিপন কলেজ বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে বাংলার শিক্ষক পদে আবেদন করলেন। কিন্তু কাজ হ’ল না লবিং নেই বলে। উপায়ন্তর না দেখে গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবিঠাকুর মৃদু সুপারিশনামা লিখে দিলেও কাজ হ’ল না, কেননা যাকে জসীম উদ্দীনের বদলে নেয়া হ’ল তার পক্ষে আগেই কবিগুরু সুপারিশ করেছিলেন। যাইহোক, রবীন্দ্রনাথের সুপারিশেই তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-গবেষকের পদটা পেলেন বলা চলে।
আমরা জানি, জসীম উদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু কিভাবে পেলেন সেই চাকরি?
তখন ঢাবির ভিসি স্যার এফ রহমান। তার কাছে গেলে তিনি সরাসরি জসীম উদ্দীনকে বললেন, জসীম উদ্দীন যদি স্বনামধন্য সাহিত্যিক অধ্যাপক বা রবীন্দ্রনাথের সুপারিশ আনতে পারেন তবে কাজ হতে পারে।
প্রথমেই, খুশি মনে তিনি গেলেন তার নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় কলিকাতায়। যে দুই নামী অধ্যাপক তাকে পছন্দ করতেন তারা তার হয়ে সুপারিশ করতে রাজি হলেন না কারণ, তাতে হিন্দু চাকরিপ্রার্থীরা ক্ষেপে যেতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস! এবার তিনি গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবিঠাকুর সাথে সাথে সুপারিশনামা লিখে দিলেন আর তাতেই ঢাবিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পারলেন জসীম উদ্দীন—রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ি কেন্দ্রীক এমনই নানা ঘটনাকে উপজীব্য করে একেবারে সাদামাটা ভাষায় অথচ অতিসুখপাঠ্য করে জসীম উদ্দীন লিখেছেন ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’।
এবার বলি বইতে নজরুলের প্রসঙ্গে,
জসীম উদ্দীন যখন কলিকাতায় পত্রিকা ফেরি করতেন, তখন তার সাথে পরিচয় হয় স্বভাবে চিরশিশু নজরুলের সাথে। তার ‘কবিভাই’ নজরুলকে অনেক কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল জসীম উদ্দীনের। আমৃত্যু তিনি স্বভাবে চিরশিশু নজরুলের সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করেছেন।
এবার আসি লেখনী প্রসঙ্গে,
জসীম উদ্দীনের কী গদ্য, কী পদ্য সবেতেই এক সহজিয়া মনোমুগ্ধকর ছন্দে লেখা আবর্তিত হয়—তার ব্যতিক্রম ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’ও হয়নি।
বেশ সুখপাঠ্য গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘রবি তীর্থে’। এই অধ্যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখা। ‘রবি তীর্থে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন, কাজ, ও ব্যক্তিত্বকে এক নতুন আলোকে দেখতে পাবেন। বিশ্বকবি কোন লেখা মনোমত হওয়ার আগে পর্যন্ত বারবার সংশোধন ও পরিবর্তন করেন, নাটক মঞ্চায়নের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সংলাপ আর কাহিনীতে পরিবর্তন করতে থাকেন সবচেয়ে ভালভাবে কাজটি করার জন্য, ভোরে উঠে সারাদিন লেখায় মশগুল থাকেন, আবার তাঁর দর্শন না পেয়ে কোনও দর্শনার্থী ফিরে গেলে মনঃক্ষুণ্ণ হন, সকলের সাথে দেখা এবং কথা বলেন, সাধ্যমত সকলের জন্য করেন, আবার কেউ উপকার পেয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে এলে অবাক হয়ে যান। সাহিত্যের এত দিকে তাঁর বিস্তর পদচারণা, অথচ বিশ্বভারতী আর শান্তিনিকেতনের মত বড় দুটো প্রতিষ্ঠান চালিয়ে গিয়েছেন সফলভাবে। এই বই থেকে জানা যাবে এতরকম কাজ করতে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির বাকি সকলের এবং আরও কতজনের কত নীরব ত্যাগ এবং অবদান ইন্ধন জুগিয়েছে।
বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ‘অবন ঠাকুরের দরবারে’ এবং তৃতীয় অধ্যায়ের নাম ‘নজরুল’।
জানলাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং তাঁর আরও দুই ভাইয়ের সাধনার কথা; ছবি আঁকা নিয়ে তাঁদের দিন রাত পার করে দেয়ার গল্প।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের লেখায় গ্রামবাংলার যে মায়াভরা রূপটা দেখতে পাই, তাঁর লেখায় যে মাটির গন্ধ পাই, সেইরকম মায়া রয়েছে এই বইটা জুড়েও। মিষ্টি সব উপমা, সহজ সরল মুগ্ধতার ভাষা, আর লেখাজুড়ে আপনজনকে নিয়ে লেখার মায়া যে মনের ভেতর থেকে আসা ভালবাসা আর শ্রদ্ধা মিলেই গড়ে উঠেছে— তাতে সন্দেহ হবার অবকাশ নেই।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন এমন দরদ দিয়ে বইটা লিখেছেন যে কবির লেখনীর জোরে চোখের সামনে ভেসে উঠে শান্তিনিকেতন, রবিঠাকুর আর অবনঠাকুরের বাসভবন, তাদের সৃষ্টিকর্ম। অবনীন্দ্রনাথের জীবনের শেষদিকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির করুণ অবস্থাও কিছুটা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। তবুও পাঠকের ভাল লাগবে অবন ঠাকুরের একাকীত্বের গল্প।
শেষে এলেন ‘হাবিলদার কবি’ — নুরু — নজরুল ইসলাম। তাঁর সম্পর্কে জসিম উদ্দীন লিখেছেন পর্বতসম দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রেখে, আক্ষেপ ঢেকে। বোঝা যায়, শুরুতে নজরুলের চাঞ্চল্যমাখা সব কাহিনীর সাথে বড্ড বেখাপ্পা লাগে তার জীবন্মৃত সমাপ্তি।
ধুমকেতুর মূল শরীর যদি হয় তিরিশ কিলো লম্বা, তাহলে তার ল্যাজ নাকি বড় হয় সূর্যের ব্যাসের সমান। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ধুমকেতু —নজরুলের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে বোধহয়। যা দিয়েছেন, তার তৃপ্তি অপেক্ষা; যা দিতে পারতেন, সেই সম্ভাবনার অকাল মৃত্যুর আপসোসটা অনেক অনেক বেশি। গ্রিক ট্রাজেডির নায়ক।