» » আলালের ঘরের দুলাল

বর্ণাকার

আলালের ঘরের দুলাল

PREFACE.

The above original Novel in Bengali being the first work of the kind, is now submitted to the publie with considerable diffidence. It chiefly treats of the pernicious effects of allowing children to be improperly brought up, with remarks on the existing system of education, on self-formation and religioni eulture, and is illustrative of the condition of Hindu society, manners, customs, de. and partly of the state of things in the Moffusil. The work has boon written in a simple style, and to foreigners desirous of sequiring an idiomatic knowledge of the Bengali language and an aoguaintance with Hindu domestic life, it will perhaps be found useful. The writer thinks it well to add that a large portion of this Tale appeared originally in a monthly publication, which met with the approval of the number of friends, at whose request he han been induced to conclude and publish it in the present form.

Price per copy,             …            …            12 Annas, cash.

ভূমিকা।

অন্যান্য পুস্তক অপেক্ষা উপন্যাসাদি পাঠ করিতে প্রায় সকল লোকেরই মনে স্বভাবতঃ অনুরাগ জন্মিয়া থাকে এবং যে স্থলে এতদ্দেশীয় অধিকাংশ লোক কোন পুস্তকাদি পাঠ করিয়া সময় ক্ষেপণ করিতে রত নহে সে স্থলে উক্ত প্রকার গ্রন্থের অধিক আবশ্যক, এতদ্বিবেচনায় এই ক্ষুদ্র পুস্তক খানি রচিত হইল। ইহার তাৎপর্য্য কি পাঠ করিলেই প্রকাশ হইবে। এ প্রকার পুস্তক লেখনের প্রণালী এতদ্দেশ মধ্যে বড় প্রচলিত নাই, ইহাতে প্রথমোদ্যমে অবশ সদোষ হইবার সম্ভাবনা, পাঠকবর্গ অনুগ্রহ করিয়া ঐ দোষ ক্ষমা করিবেন। গ্রন্থের নির্ঘণ্ট দেখিলেই গল্পসকলের আভাস ও অন্যান্য প্রকরণ জানা যাইবে।

পুস্তকের মূল্য,             …            …            ৸৹ নগদ।


আলালের ঘরের দুলাল

১. বাবুরাম বাবুর পরিচয়—মতিলালের বাঙ্গালা, সংস্কৃত ও ফার্সী শিক্ষা।

বৈদ্যাবাটীর বাবুরাম বাবু বড় বৈষয়িক ছিলেন। তিনি মাল ও ফৌজদারী আদালতে অনেক কর্ম করিয়া বিখ্যাত হন। কর্মকাজ করিতে প্রবৃত্ত হইয়া উৎকোচাদি গ্রহণ না করিয়া যথার্থ পথে চলা বড় প্রাচীন প্রথা ছিল না – বাবুরাম সেই প্রথানুসারেই চলিতেন। একে কর্মে পটু – তাতে তোষামোদ ও কৃতাঞ্জলি দ্বারা সাহেব-সুবাদিগকে বশীভূত করিয়াছিলেন এজন্য অল্পদিনের মধ্যেই প্রচুর ধন উপার্জন করিলেন। এদেশে ধন অথবা পদ বাড়িলেই মান বাড়ে, বিদ্যা ও চরিত্রের তাদৃক্ গৌরব হয় না। বাবুরাম বাবুর অবস্থা পূর্বে বড় মন্দ ছিল, তৎকালে গ্রামে কেবল দুই এক ব্যক্তি তাঁহার তত্ত্ব করিত। পরে তাঁহার সুদৃশ্য অট্টালিকা বাগ বাগিচা তালুক ও অন্যান্য ঐশ্বর্য সম্পত্তি হওয়াতে অনুগত ও অমাত্য বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অসংখ্য হইল। অবকাশ কালে বাটিতে আসিলে তাঁহার বৈঠকখানা লোকারণ্য হইত, যেমন মেঠাইওয়ালার দোকানে মিষ্ট থাকিলেই তাহা মক্ষিকায় পরিপূর্ণ হয় তেমন ধনের আমদানি হইলেই লোকের আমদানি হয়। বাবুরামবাবুর বাটীতে যখন যাও তাঁহার নিকট লোক ছাড়া নাই—কি বড়, কি ছোট, সকলেই চারিদিকে বসিয়া তুষ্টিজনক নানা কথা কহিতেছে, বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিরা ভঙ্গিক্রমে তোষামোদ করিত আর এলোমেলো লোকেরা একেবারেই জল উঁচু-নিচু বলিত। এইরূপে কিছু কাল যাপন করিয়া বাবুরাম বাবু পেন্‌সন লইলেন ও আপন বাটীতে বসিয়া জমিদারী ও সওদাগরী কর্ম করিতে আরম্ভ করিলেন।

লোকের সর্ব প্রকারে সুখ প্রায় হয় না ও সর্ব বিষয়ে বুদ্ধিও প্রায় থাকে না। বাবুরাম বাবু কেবল ধন উপার্জনেই মনোযোগ করিতেন। কি প্রকারে বিষয় বিভব বাড়িবে, কি প্রকারে দশজন লোক জানিবে— কি প্রকারে গ্রামস্থ লোক-সকল করজোড়ে থাকিবে— কি প্রকারে ক্রিয়াকাণ্ড সর্বোত্তম হইবে— এই সকল বিষয় সর্বদা চিন্তা করিতেন। তাঁহার এক পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। বাবুরামবাবু বলরাম ঠাকুরের সন্তান, এজন্য জাতিরক্ষার্থ কন্যাদ্বয় জন্মিবামাত্র বিস্তর ব্যয় ভূষণ করিয়া তাহাদের বিবাহ দিয়াছিলেন, কিন্তু জামাতারা কুলীন, অনেক স্থানে দারপরিগ্রহ করিয়াছিল— বিশেষ পারিতোষিক না পাইলে বৈদ্যবাটীর শ্বশুরবাটীতে উঁকিও মারিত না। পুত্র মতিলাল বাল্যাবস্থা অবধি আদর পাইয়া সর্বদা বাইন করিত—কখন বলিত বাবা চাঁদ ধরিব—কখন বলিত বাবা তোপ খাব। যখন চীৎকার করিয়া কান্দিতে আরম্ভ করিত নিকটস্থ সকল লোক বলিত ঐ বান্‌কে ছেলেটার জ্বালায় ঘুমান ভার! বালকটি পিতা-মাতার নিকট আস্কারা পাইয়া পাঠশালায় যাইবার নামও করিত না। যিনি বাটীর সরকার তাঁহার উপর  শিক্ষা করাইবার ভার ছিল। প্রথম প্রথম গুরু মহাশয়ের নিকটে গেলে মতিলাল আঁ আঁ করিয়া কান্দিয়া তাঁহাকে আঁচড় ও কামড় দিত—গুরুমহাশয় কর্তার নিকট গিয়া বলিতেন, মহাশয়! আপনার পুত্রকে শিক্ষা করান আমার কর্ম নয়। কর্তা প্রত্যুত্তর দিতেন—ও আমার সবেধন নীলমণি—ভুলাইয়া টুলাইয়া গায় হাত বুলাইয়া শেখাও। পরে বিস্তর কৌশলে মতিলাল পাঠশালায় আসিতে আরম্ভ করিল। গুরুমহাশয় পায়ের উপর পা, বেত হাতে, দেয়ালে ঠেসান দিয়া ঢুল্‌ছেন ও বল্‌ছেন “ল্যাখ রে ল্যাখ।” মতিলাল ঐ অবকাশে উঠিয়া তাঁহার মুখের নিকট কলা দেখাচ্ছে আর নাচ্ছে — গুরুমশায় নাক ডাকিতেছেন—শিষ্য কি করিতেছে তাহা কিছুই জানেন না। তাঁহার চক্ষু উন্মীলিত হইলেই মতিলাল আপন পাততাড়ির নিকট বসিয়া কাগের ছা বগের ছা লিখিত। সন্ধ্যাকালে ছাত্রদিগকে ঘোষাইতে আরম্ভ করিলে মতিলাল গোলে হরিবোল দিত—কেবল গণ্ডার এণ্ডা ও বুড়িকা ও পণিকার শেষ অক্ষর বলিয়া ফাঁকি সিদ্ধান্ত করিত,—মধ্যে মধ্যে গুরুমহাশয় নিদ্রিত হইলে তাঁহার নাকে কাটি দিয়া ও কোঁচার উপর জলন্ত অঙ্গার ফেলিয়া তীরের ন্যায় প্রস্থান করিত। আর আহারের সময় চুনের জল ঘোল বলিয়া অন্য লোকের হাত দিয়া পান করাইত। গুরুমহাশয় দেখিলেন বালকটি অতিশয় ত্রিপণ্ড, মা সরস্বতীকে একবারে জলপান করিয়া বসিল, অতএব মনে করিলেন যদি এত বেত্রাঘাতে সুযুত না হইল, কেবল গুরুমারা বিদ্যাই শিক্ষা করিল তবে এমত শিষ্যের হাত হইতে ত্বরায় মুক্ত হওয়া কর্তব্য, কিন্তু কর্তা ছাড়েন না—অতএব কৌশল করিতে হইল। বোধ হয় গুরুমহাশয়গিরি অপেক্ষা সরকারি ভাল, ইহাতে বেতন দুই টাকা ও খোরাক-পোষাক—উপরি লাভের মধ্যে তালপাত কলাপাত ও কাগজ ধরিবার কালে এক একটা সিধে ও এক এক জোড়া কাপড় মাত্র, কিন্তু বাজার সরকারি কর্মে নিত্য কাঁচা কড়ি। এই বিবেচনা করিয়া কর্তার নিকট গিয়া কহিলেন—মতিবাবুর কলাপাত ও কাগজ লেখা শেষ হইয়াছে এবং এক প্রস্থ জমিদারী কাগজও লেখান গিয়াছে। বাবুরামবাবু এই সংবাদ পাইয়া আহ্লাদে মগ্ন হইলেন, নিকটস্থ পারিষদেরা বলিল— না হবে কেন! সিংহের সন্তান কি কখন শৃগাল হইতে পারে?

পরে বাবুরাম বাবু বিবেচনা করিলেন ব্যাকরণাদি ও কিঞ্চিত ফার্সী শিক্ষা করানো আবশ্যক। এই স্থির করিয়া বাটীর পূজারী ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলেন—কেমন হে তোমার ব্যাকরণ ট্যাকরণ পড়াশুনা আছে? পূজারী ব্রাহ্মণ গণ্ড মুর্খ—মনে করিল যে চাউল-কলা পাই তাতে তো কিছুই আঁটে না—এত দিনের পর বুঝি কিছু প্রাপ্তির পন্থা হইল, এই ভাবিয়া প্রত্যুত্তর করিল— আজ্ঞে হাঁ, আমি কুইনমোড়ার ঈশ্বরচন্দ্র বেদান্তবাগীশের টোলে ব্যাকরণাদি একাদিক্রমে পাঁচ বৎসর অধ্যয়ন করি, কপাল মন্দ, পড়াশুনার দরুন কিছুই লাভবান হয় না, কেবল আদা জল খাইয়া মহাশয়ের নিকট পড়িয়া আছি। বাবুরাম বাবু বলিলেন—তুমি অদ্যাবধি আমার পুত্রকে ব্যাকরণ শিক্ষা করাও। পূজারী ব্রাহ্মণ আশা বায়ুতে মুগ্ধ হইয়া মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের দুই-এক পাত শিক্ষা করিয়া পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। মতিলাল মনে করিলেন গুরুমহাশয়ের হাত হইতে তো মুক্ত হইয়াছি এখন এ বেটা চাউলকলাখেকো বামুনকে কেমন করিয়া তাড়াই? আমি বাপ মার আদরের ছেলে—লিখি বা না লিখি, তাঁহারা আমাকে কিছুই বলিবেন না—লেখাপড়া শেখা কেবল টাকার জন্য—আমার বাপের অতুল বিষয়—আমার লেখাপড়ায় কাজ কি? কেবল নাম সহি করিতে পারিলেই হইল। আর যদি লেখাপড়া শিখিব তবে আমার এয়ারবক্সিদিগের দশা কি হইবে? আমোদ করিবার এই সময়,—এখন কি লেখা-পড়ার যন্ত্রণা ভাল লাগে?

মতিলাল এই স্থির করিয়া পূজারী ব্রাহ্মণকে বলিল—অরে বামুন, তুই যদি হ, য, ব, র, ল, শিখাইতে আমার নিকট আর আস্‌বি ঠাকুর ফেলিয়া দিয়া তোর চাউল-কলা পাইবার উপায় সুদ্ধ ঘুচাইয়া দিব— কিন্তু বাবার কাছে গিয়া একথা বললে ছাতের উপর হতে তোর মাথায় এমন এক এগারঞ্চি ঝাড়িব যে তোর ব্রাহ্মণীকে কালই হাতের নোয়া খুলিতে হইবে। পূজারী ব্রাহ্মণ হ, য, ব, র, ল প্রসাদাৎ ক্ষণেক কাল হ, য, ব, র, ল হইয়া থাকিলেন পরে আপনা আপনি বিচার করিলেন—ছয় মাস প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছি এক পয়সাও হস্তগত হয় নাই, আবার “লাভঃ পরং গোবধঃ” —প্রাণ নিয়া টানাটানি—এক্ষণে ছেড়ে দিলে কেঁদে বাঁচি। পূজারী ব্রাহ্মণ যৎকালে এই সকল পর্যালোচনা করিতেছিলেন মতিলাল তাঁহার মুখাবলোকন করিয়া বলিল—বড় যে বসে বসে ভাবছিস্? টাকা চাই? এই নে—কিন্তু বাবার কাছে গিয়া বল্‌গে আমি সব শিখেছি। পূজারী ব্রাহ্মণ কর্তার নিকট গিয়া বলিল—মহাশয় মতিলাল সামান্য বালক নহে—তাহার অসাধারণ মেধা, যাহা একবার শুনে তাহাই মনে করিয়া রাখে। বাবুরাম বাবুর নিকট একজন আচার্য ছিল—বলিল, মতিলালের পরিচয় দিবার আবশ্যক নাই। উটি ক্ষণজন্মা ছেলে— বেঁচে থাকিলে দিক্‌পাল হইবে।

অনন্তর পুত্রকে ফার্সী পড়াইবার জন্য বাবুরাম বাবু একজন মুন্‌সি অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। অনেক অনুসন্ধানের পর আলাদি দরজির নানা হবিবলহোসেন তেল কাঠ ও ১৷৷৹ টাকা মাহিনাতে নিযুক্ত হইল। মুন্‌সি সাহেবের দন্ত নাই, পাকা দাড়ি, শনের ন্যায় গোঁফ, শিখাইবার সময় চক্ষু রাঙা করেন ও বলেন, ‘আরে বে পড়’ ও কাফ গাফ আয়েন গায়েন উচ্চারণে তাঁহার বদন সর্বদা বিকট হয়। একে বিদ্যা শিক্ষাতে কিছু অনুরাগ নাই তাতে ঐরূপ শিক্ষক অতএব মতিলালের ফার্সি পড়াতে ঐরূপ ফল হইল। এক দিবস মুন্‌সি সাহেব হেঁট হইয়া কেতাব দেখিতেছেন ও হাত নেড়ে সুর করিয়া মস্‌নবির বয়েত পড়িতেছেন ইত্যবসরে মতিলাল পিছন দিগ্ দিয়া একখান জ্বলন্ত টিকে দাড়ির উপর ফেলিয়া দিল। তৎক্ষণাৎ দাউদাউ করিয়া দাড়ি জ্বলিয়া উঠিল। মতিলাল বলিল—কেমন রে বেটা শোরখেকো নেড়ে আমাকে পড়াবি? মুন্‌সি সাহেব দাড়ি ঝাড়িতে ঝাড়িতে ও তোবা তোবা বলিতে বলিতে প্রস্থান করিলেন এবং জ্বালার চোটে চিৎকার করিয়া বলিলেন—এস্ মাফিক বেতমিজ আওর বদ্‌জাৎ লেড়্‌কা কবি দেখা নেই—এস্ কাম্‌সে মুল্কমে চাস কর্ণা আচ্ছি হ্যায়। এস্ জেগে আনা বি হারাম হ্যায়—তোবা-তোবা-তোবা!!!


আলালের ঘরের দুলাল

২. মতিলালের ইংরাজী শিখাবার উদ্‌যোগ ও বাবুরাম বাবুর বালীতে গমন

মুন্‌সি সাহেবের দুর্গতির কথা শুনিয়া বাবুরামবাবু বলিলেন—মতিলাল তো আমার তেমন ছেলে নয়—সে বেটা জেতে নেড়ে—কত ভাল হবে? পরে ভাবিলেন যে ফার্সির চলন উঠিয়া যাইতেছে, এখন ইংরেজী পড়ান ভাল। যেমন ক্ষিপ্তের কখন কখন জ্ঞানোদয় হয় তেমনি অবিজ্ঞ লোকেরও কখন কখন বিজ্ঞতা উপস্থিত হয়। বাবুরাম বাবু ঐ বিষয় স্থির করিয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন আমি বারাণসী বাবুর ন্যায় ইংরেজী জানি—‘‘সরকার কম স্পিক নাট’’ আমার নিকটস্থ লোকেরাও তদ্রূপ বিদ্বান্, অতএব একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট পরামর্শ লওয়া কর্তব্য। আপন কুটুম্ব ও আত্মীয়দিগের নাম স্মরণ করাতে মনে হইল বালীর বেণীবাবু বড় যোগ্য লোক। বিষয়কর্ম করিলে তৎপরতা জন্মে। এজন্য অবিলম্বে একজন চাকর ও পাইক সঙ্গে লইয়া বৈদ্যবাটীর ঘাটে আসিলেন।

আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মাঝিরা বৈঁতির জাল ফেলিয়া ইলিস মাছ ধরে ও দুই প্রহরে সময় মাল্লারা প্রায় আহার করিতে যায় এজন্য বৈদ্যবাটীর ঘাটে খেয়া কিম্বা চল্‌তি নৌকা ছিল না। বাবুরাম বাবু চৌগোঁপ্পা—নাকে তিলক—কস্তাপেড়ে ধুতি পরা—ফুলপুকুরে জুতা পায়—উদরটি গণেশের মত—কোঁচান চাদরখানি কাঁধে—একগাল পান—ইতস্ততঃ বেড়াইয়া চাকরকে বলছেন—ওরে হরে! শীঘ্র বালী যাইতে হইবে দুই চার পয়সায় একখানা চল্‌তি পান্‌সি ভাড়া কর তো। বড় মানুষের খানসামারা মধ্যে মধ্যে বেআদব হয়, হরি বলিল—মোশায়ের যেমন কাণ্ড! ভাত খেতে বস্তেছিনু—ডাকাডাকিতে ভাত ফেলে রেখে এস্তেচি—ভেটেল পান্‌সি হইলে অল্প ভাড়ায় হইত—এখন জোয়ার—দাঁড় টান্‌তে ও ঝিঁকে মার্‌তে মাঝিদের কাল ঘাম ছুটবে—গহনার নৌকায় গেলে দুই চার পয়সা হতে পারে—চল্‌তি পান্‌সি চার পয়সার ভাড়া করা আমার কর্ম নয়—এ কি থুতকুড়ি দিয়া ছাতু গোলা?

বাবুরাম বাবু দুটো চক্ষু কট্‌কট্ করিয়া বলিলেন—তোবেটার বড় মুখ বেড়েছে—ফের যদি এমন কথা কবি তো ঠাস্ করে চড় মার্‌বো। বাঙালী ছোট জাতিরা একটু ঠোকর খাইলেই ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপে, হরি তিরস্কার খাইয়া জড়সড় হইয়া বলিল—এজ্ঞে না, বলি এখন কি নৌকা পাওয়া যায়? এই বল্‌তে বল্‌তে একখানা বোট গুণ টেনে ফিরিয়া যাইতেছিল, মাঝির সহিত অনেক কস্তাকস্তি ধস্তাধস্তি করিয়া ৷৷৹ ভাড়া চুক্তি হইল—বাবুরাম বাবু চাকর ও পাইকের সহিত বোটের উপর উঠিলেন। কিঞ্চিৎদূর আসিয়া দুই দিগ্ দেখিতে দেখিতে বলিতেছেন—ওরে হরে! বোটখানা পাওয়া গিয়াছে ভাল—মাঝি! ও বাড়ীটা কার রে? ওটা কি চিনির কল? অহে চকমকি ঝেড়ে এক ছিলিম তামাক সাজো তো? পরে ভড় ভড় করিয়া হুঁকা টানিতেছেন—শুশুকগুলা এক এক বার ভেসে ভেসে উঠ্‌তেছে—বাবু স্বয়ং উঁচু হইয়া দেখ্‌তেছেন ও গুন গুন করিয়া সখীসম্বাদ গাইতেছেন—‘‘দেখে এলাম শ্যাম তোমার বৃন্দাবন ধাম কেবল আছে নাম।’’ ভাঁটা হাওয়াতে বোট সাঁ সাঁ করিয়া চলিতে লাগিল—মাঝিরাও অবকাশ পাইল—কেহ বা গলুয়ে বসিল, কেহ বা বোকা ছাগলের দাড়ি বাহির করিয়া চারি দিগে দেখিতে লাগিল ও চাটগেঁয়ে সুরে গান আরম্ভ করিল ‘‘খুলে পড়বে কানের সোনা শুনে বাঁশির সুর’’—

সূর্য অস্ত না হইতে হইতে বোট দেওনাগাজীর ঘাটেতে গিয়া লাগিল। বাবুরামবাবুর শরীরটি কেবল মাংসপিণ্ড—চারি জন মাঝিতে কুঁতিয়া ধরাধরি করিয়া উপরে তুলিয়া দিল। বেণীবাবু কুটুম্বকে দেখিয়া ‘‘আস্‌তে আজ্ঞা হউক, বস্‌তে আজ্ঞা হউক’’ প্রভৃতি নানবিধ শিষ্টালাপ করিলেন। বাবুর বাটীর চাকর রাম তৎক্ষণাৎ তামুক সাজিয়া আনিয়া দিল। বাবুরাম বাবু ঘোর হুঁকারি, দুই এক টান টানিয়া বলিলেন—ওহে হুঁকাটা পীসে পীসে বল্‌ছে, খুড়া খুড়া বল্‌ছে না কেন? বুদ্ধিমান লোকের নিকট চাকর থাকিলে সেও বুদ্ধিমান্ হয়। রাম অমনি হুঁকায় ছিঁচ্‌কা দিয়া—জল ফিরাইয়া—মিঠেকড়া তামাক সেজে—বড় দেকে নল করে হুঁকা আনিয়া দিল। বাবুরাম বাবু হুঁকা সম্মুখে পাইয়া একবারে যেন ইজারা করিয়া লইলেন—ভড়র ভড়র টানছেন— ধুঁয়া সৃষ্টি করছেন—ও বিজর বিজর বক্‌ছেন।

বেণীবাবু। মহাশয় একবার উঠে একটা পান খেলে ভাল হয় না?

বাবুরাম বাবু। সন্ধ্যা হল—আর জল খাওয়া থাকুক্—এ আমার ঘর—আমাকে বল্‌তে হবে কেন?

দেখ মতিলালের বুদ্ধিশুদ্ধি ভাল হইয়াছে—ছেলেটিকে দেখে চক্ষু জুড়ায়, সম্প্রতি ইংরেজী পড়াইতে বাঞ্ছা করি—স্বল্প অল্প মাহিনাতে একজন মাস্টার দিতে পার?

বেণীবাবু। মাস্টার অনেক আছে, কিন্তু ২০/২৫ টাকা মাসে দিলে একজন মাঝারি গোছের লোক পাওয়া যায়।

বাবুরাম বাবু। কতো— ২৫ টাকা!!! অহে ভাই, বাটীতে নিত্য নৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ—প্রতিদিন একশত পাত পড়ে—আবার কিছুকাল পরেই ছেলেটির বিবাহ দিতে হইবে। যদি এত টাকা দিব তবে তোমার নিকট নৌকা ভাড়া করিয়া কেন এলাম?

এই বলিয়া—বেণীবাবুর গায়ে হাত দিয়া হা হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।

বেণীবাবু। তবে কলিকাতার কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়া দিউন। একজন আত্মীয় কুটুম্বের বাটীতে ছেলেটি থাকিবে, মাসে ৩/৪ টাকার মধ্যে পড়াশুনা হইতে পারিবে।

বাবুরাম বাবু। এত? তুমি বলে কয়ে কমজম করিয়া দিতে পারো না? স্কুলে পড়া কি ঘরে পড়ার চেয়ে ভাল?

বেণীবাবু। যদ্যপি ঘরে একজন বিচক্ষণ শিক্ষক রাখিয়া ছেলেকে পড়ানো যায় তবে বড় ভাল হয়, কিন্তু তেমন শিক্ষক অল্প টাকায় পাওয়া যায় না, স্কুলে পড়ার গুণও আছে—দোষও আছে। ছেলেদিগের সঙ্গে একত্র পড়াশুনা করিলে পরস্পরের উৎসাহ জন্মে কিন্তু সঙ্গদোষ হইলে কোন কোন ছেলে বিগড়িয়া যাইতে পারে, আর ২৫/৩০ জন বালক এক শ্রেণীতে পড়িলে হট্টগোল হয়, প্রতিদিন সকলের প্রতি সমান তদারকও হয় না, সুতরাং সকলের সমানরূপ শিক্ষাও হয় না।

বাবুরাম বাবু। তা যাহা হউক—মতিকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিব, দেখেশুনে যাহাতে সুলভ হয় তাহাই করিয়া দিও। যে সকল সাহেবের কর্মকাজ করিয়াছিলাম এক্ষণে তাহাদের কেহ নাই—থাকিলে ধরে পড়ে অমনি ভর্তি করিতে পারিতাম। আর আমার ছেলে মোটামুটি শিখিলেই বস্ আছে, বড় পড়াশুনা করিলে স্বধর্মে থাকিবে না। ছেলেটি যাহাতে মানুষ হয় তাহাই করিয়া দিও—ভাই সকল ভার তোমার উপর।

বেণীবাবু। ছেলেকে মানুষ করিতে গেলে ঘরে বাইরে তদারক চাই। বাপকে স্বচক্ষে সব দেখ্‌তে হয়—ছেলের সঙ্গে ছেলে হইয়া খাট্‌তে হয়। অনেক কর্ম বরাতে চলে বটে কিন্তু এ কর্মে পরের মুখেঝাল খাওয়া হয় না।

বাবুরাম বাবু। সে সব বটে—মতি কি তোমার ছেলে নয়? আমি এক্ষণে গঙ্গাস্নান করিব—পুরাণ শুনিব—বিষয় আশয় দেখিব—আমার অবকাশ কই ভাই? আর আমার ইংরেজী শেখা সেকেলে রকম। মতি তোমার—তোমার—তোমার!!! আমি তাকে তোমার কাছে পাঠাইয়া দিয়া নিশ্চন্ত হইব, তুমি যা জান তাই করিবে কিন্তু ভাই! দেখো যেন বড় ব্যয় হয় না—আমি কাচ্ছাবাচ্ছাওয়ালা মানুষ—তুমি সকল তো বুঝতে পার?

অনন্তর অনেক শিষ্টালাপের পর বাবুরামবাবু বৈদ্যবাটীতে প্রত্যাগমন করিলেন।


আলালের ঘরের দুলাল

৩. মতিলালের বালীতে আগমন ও তথায় লীলাখেলা পরে ইংরাজী শিক্ষার্থে বহুবাজারে অবস্থিতি

রবিবারে কুঠীওয়ালারা বড় ঢিলে দেন—হচ্ছে হবে—খাচ্ছি খাব—বলিয়া অনেক বেলায় স্নান আহার করেন—তাহার পরে কেহ বা বড়ে টেপেন—কেহ বা তাস পেটেন—কেহ বা মাছ ধরেন—কেহ বা তবলায় চাঁটি দেন— কেহ বা সেতার লইয়া পিড়িং পিড়িং করেন—কেহ বা শয়নে পদ্মনাভ ভাল বুঝেন—কেহ বা বেড়াতে যান—কেহ বা বহি পড়েন। কিন্তু পড়াশুনা অথবা সৎ কথার আলোচনা অতি অল্প হইয়া থাকে। হয় তো মিথ্যা গালগল্প কিংবা দলাদলির মোট, কি শম্ভু তিনটা কাঁঠাল খাইয়াছে এই প্রকার কথাতেই কাল ক্ষেপণ হয়। বালীর বেণীবাবুর অন্য প্রকার বিবেচনা ছিল। এদেশের লোকদিগের সংস্কার এই যে স্কুলে পড়া শেষ হইলে লেখাপড়ার শেষ হইল। কিন্তু এ বড় ভ্রম, আজন্ম মরণ পর্যন্ত সাধনা করিলেও বিদ্যার কুল পাওয়া যায় না, বিদ্যার চর্চা যত হয় ততই জ্ঞান বৃদ্ধি হইতে পারে। বেণীবাবু এ বিষয় ভাল বুঝিতেন এবং তদনুসারে চলিতেন। তিনি প্রাতঃকালে উঠিয়া আপনার গৃহকর্ম সকল দেখিয়া পুস্তক লইয়া বিদ্যানুশীলন করিতেছিলেন। ইতিমধ্যে চৌদ্দ বৎসরের একটি বালক—গলায় মাদুলি—কানে মাকড়ি, হাতে বালা ও বাজু, সম্মুখে আসিয়া টিপ করিয়া একটি গড় করিল। বেণীবাবু এক মনে পুস্তক দেখিতেছিলেন বালকের জুতার শব্দে চম্‌কিয়া উঠিয়া দেখিয়া বলিলেন, “এসো বাবা মতিলাল এসো—বাটীর সব ভাল তো?” মতিলাল বসিয়া সকল কুশল সমাচার করিল। বেণীবাবু কহিলেন—অদ্য রাত্রে এখানে থাক কল্য প্রাতে তোমাকে কলিকাতায় লইয়া স্কুলে ভর্তি করিয়া দিব। ক্ষণেক কাল পরে মতিলাল জলযোগ করিয়া দেখিল অনেক বেলা আছে। চঞ্চল স্বভাব—এক স্থানে কিছু কাল বসিতে দারুণ ক্লেশ বোধ হয়—এজন্য আস্তে আস্তে উঠিয়া বাটীর চতুর্দিকে দাঁদুড়ে বেড়াইতে লাগিল— কখন ঢেঁস্কেলের ঢেঁকিতে পা দিতেছে—কখন বা ছাতের উপর গিয়া দুপদুপ করিতেছে—কখন বা পথিকদিগকে ইট পাটকেল মারিয়া পিট্টান দিতেছে; এইরূপে দুপদাপ করিয়া বালী প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল—কাহারো বাগানে ফুল ছেঁড়ে—কাহারো গাছের ফল পাড়ে—কাহারো মট্‌কার উপর উঠিয়া লাফায়—কাহারো জলের কলসী ভাঙিয়া দেয়।

বালীর সকল লোকেই ত্যক্ত হইয়া বলাবলি করিতে লাগিল—এ ছোঁড়া কে রে? যেমন ঘরপোড়া দ্বারা লস্কা ছারখার হইয়াছিল আমাদিগের গ্রামটা সেইরূপ তচ্‌নচ্‌ হবে নাকি? কেহ কেহ ঐ বালকের পিতার নাম শুনিয়া বলিল—আহা বাবুরাম বাবুর এ পুত্র—না হবে কেন? “পুত্রে যশসি তোয়েচ নরাণাং পুণ্যক্ষণম্‌।”

সন্ধ্যা হইল—শৃগালদিগের হোয়া হোয়া ও ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ শব্দে গ্রাম শব্দায়মান হইতে লাগিল। বালীতে অনেক ভদ্রলোকের বসতি—প্রায় অনেকের বাটীতে শালগ্রাম আছেন এজন্য শঙ্খ-ঘণ্টা ধ্বনির ন্যূনতা ছিল না। বেণীবাবু অধ্যয়নানন্তর গামোড়া দিয়া তামাক খাইতেছেন— ইত্যবসরে একটা গোল উপস্থিত হইল। পাঁচ সাত জন লোক নিকটে আসিয়া বলিল—মশাই গো! বৈদ্যবাটীর জমিদারের ছেলে আমাদের উপর ইট মারিয়াছে—কেহ বলিল—আমার ঝাঁকা ফেলিয়া দিয়াছে—কেহ বলিল আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়াছে—কেহ বলিল আমার মুখে থুতু দিয়াছে—কেহ বলিল আমার ঘিয়ের হাঁড়ি ভাঙিয়াছে। বেণীবাবু পরদুঃখে কাতর—সকলকে তুষেতেষে ও কিছু কিছু দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন, পরে ভাবিলেন এ ছেলের তো বিদ্যা নগদ হইবে—এক বেলাতেই গ্রাম কাঁপিয়া দিয়াছে—এক্ষণে এখান হইতে প্রস্থান করিলে আমার হাড় জুড়ায়।

গ্রামের প্রাণকৃঞ্চ খুড়ে, ভগবতী ঠাকুরদাদা ও ফচ্‌কে রাজকৃষ্ণ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—বেণীবাবু এ ছেলেটি কে? —আমরা আহার করিয়া নিদ্রা যাইতেছিলাম—গোলের দাপটে উঠে পড়েছিলাম—কাঁচা ঘুম ভাঙাতে শরীরটা মাটি মাটি করিতেছে। বেণীবাবু কহিলেন—আর ও কথা কেনে বল? একটা ভারি কর্মভোগে পড়িয়াছি—আমার একটি জমিদার ষণ্ডা কুটুম্ব আছে—তাহার হ্রস্ব দীর্ঘ কিছুই জ্ঞান নাই—কেবল কতকগুলো টাকা আছে। ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য আমার নিকট পাঠাইয়াছে—কিন্তু এর মধ্যেই হাড় কালি হইল—এমন ছেলেকে তিনদিন রাখিলেই বাটীতে ঘুঘু চরিবে। এইরূপ কথোপকথন হইতেছে—জন কয়েক চেংড়া পশ্চাতে মতিলাল— “ভজ নর শম্ভুসুতেরে” বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে আসিল। বেণীবাবু বলিলেন—ঐ আসছে রে বাবু—চুপ কর—আবার দুই-এক ঘা বসিয়ে দেবে না-কি? পাপকে বিদায় করিতে পারিলে বাঁচি। মতিলাল বেণীবাবুকে দেখিয়া দাঁত বাহির করিয়া ঈষদ্ধাস্য করত কিঞ্চিৎ সঙ্কুচিত হইল। বেণীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন—বাবু কোথায় গিয়েছিলে? মতিলাল বলিল—মহাশয়দের গ্রামটা কত বড় তাই দেখে এলেম।

পরে বাটীর ভিতর যাইয়া মতিলাল রাম চাকরকে তামাক আনিতে বলিল। অম্বুরি অথবা ভেলসায় সানে না—কড়া তামাকের উপর কড়া তামাক খাইতে লাগিল। রাম তামাক যোগাইয়া উঠিতে পারে না—এই আনে—এই নাই। এইরূপ মুহুর্মুহু তামাক দেওয়াতে রাম অন্য কোন কর্ম করিতে পারিল না। বেণীবাবু রোয়াকে বসিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলেন ও এক-এক বার পিছন ফিরিয়া মিট মিট করিয়া উঁকি মারিয়া দেখিতে লাগিলেন।

আহারের সময় উপস্থিত হইল। বেণীবাবু অন্তঃপুরে মতিলালকে লইয়া উত্তম অন্ন-ব্যঞ্জন ও নানা প্রকার চর্চ্য চোষ্য লেহ্য পেয় দ্বারা পরিতোষ করাইয়া তাম্বুলগ্রহণান্তর আপনি শয়ন করিতে গেলেন। মতিলাল শয়নগারে গিয়া পান তামাক খাইয়া বিছেনার ভিতর ঢুকিল। কিছু কাল এপাশ ওপাশ করিয়া ধড়মড়িয়া উঠিয়া এক-এক বার পায়চারি করিতে লাগিল ও এক-এক বার নীলু ঠাকুরের সখীসংবাদ অথবা রাম বসুর বিরহ গাইতে লাগিল। গানের চোটে বাটীর সকলের নিদ্রা ছুটে পালাইল।

চণ্ডীমণ্ডপে রাম ও কাশীজোড়া নিবাসী পেলারাম মালী শয়ন করিয়াছিল। দিবসে পরিশ্রম করিলে নিদ্রাটি বড় আরামে হয়, কিন্তু ব্যঘাত হইলে অত্যন্ত বিরক্তি জন্মে। গানের চিৎকারে চাকরের ও মালীর নিদ্রা ভাঙিয়া গেল।

পেলারাম। অহে বাপা রাম! এ সড়ার চিড়কারে মোর লিদ্রা হতেছে না—উঠে বাগানে বীজ গুঁড়া কি পেড়াইব?

রাম। (গা মোড় দিয়া) আরে রাত ঝাঁ ঝাঁ কচ্চে—এখন কেন উঠ্‌বি? বাবু ভাল নালা কেটে জল এনেছে—এ ছোঁড়া কান ঝালা-পালা কল্লে—গেলে বাঁচি।

পরদিন প্রভাতে বেণীবাবু মতিলালকে লইয়া বৌবাজারের বেচারাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। বেচারাম বাবু কেনারামবাবুর পুত্র—বুনিয়াদী বড় মানুষ—সন্তানাদি কিছুই নাই—সাদাসিধে লোক কিন্তু জন্মাবধি গঁর্ণখাঁদা—অল্প অল্প পিট্‌পিটে ও চিড়চিড়ে। বেণীবাবুকে দেখিয়া স্বাভাবিক নাকিস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন “আরে কও কি মনে করে?”

বেণীবাবু। মতিলাল মহাশয়ের বাটীতে থাকিয়া স্কুলে পড়িবে—শনিবার শনিবার ছুটি পাইলে বৈদ্যবাটী যাইবে। বাবুরামবাবুর কলিকাতায় আপনার মত আত্মীয় আর নাই এজন্য এই অনুরোধ করিতে আসিয়াছি।

বেচারাম। তার আটক কি—এও ঘর সেও ঘর। আমার ছেলেপুলে নাই—কেবল দুই ভাগিনেয় আছে—মতিলাল স্বচ্ছন্দে থাকুক।

বেচারাম বাবুর নাকিস্বরের কথা শুনিয়া মতিলাল খিল খিল করিয়া হাসিতে লাগিল। অমনি বেণীবাবু উহুঁ উহুঁ করত চোখ টিপ্‌তে লাগিলেন ও মনে করিলেন এমন ছেলে সঙ্গে থাকিলে কোথাও সুখ নাই। বেচারাম বাবু মতিলালের হাসি শুনিয়া বলিলেন—বেণী ভায়া! ছেলেটা কিছু বেদ্‌ড়া দেখতে পাই যে? বোধ হয় বালককালাবধি বিশেষ নাই পাইয়া থাকিবে। বেণীবাবু অতি অনুসন্ধনী—পূর্বকথা সকলি জানেন, আপনিও ভুগেছেন—কিন্তু নিজ গুণে সকল ঢেকে ঢুকে লইলেন—গুপ্ত কথা ব্যক্ত করিলে মতিলাল মারা যায়—তাহার কলিকাতায় থাকাও হয় না ও স্কুলে পড়াও হয় না। বেণীবাবু নিতান্ত বাসনা সে কিছু লেখাপড়া শিখিয়া কোন প্রকার মানুষ হয়।

অনন্তর অন্যান্য প্রকার অনেক আলাপ করিয়া বেচারাম বাবুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া বেণীবাবু মতিলালকে সঙ্গে করিয়া শরবোরণ সাহেবের স্কুলে আসিলেন। হিন্দু কলেজ হওয়াতে শরবোরণ সাহেবের স্কুল কিঞ্চিৎ মেড়ে পড়িয়াছিল এজন্য সাহেব দিন রাত্রি উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন—তাঁহার শরীর মোটা—ভুরুতে রোঁ ভরা—গালে সর্বদা পান—বেত হাতে—এক একবার ক্লাসে ক্লাসে বেড়াইতেন ও এক একবার চৌকিতে বসিয়া গুড়গুড়ি টানিতেন। বেণীবাবু তাঁহার স্কুলে মতিলালকে ভর্তি করিয়া দিয়া বালীতে প্রত্যাগমন করিলেন।


আলালের ঘরের দুলাল

৪. কলিকাতায় ইংরাজী শিক্ষার বিবরণ, শিশুশিক্ষার প্রকরণ, মতিলালের কুসঙ্গ ও ধৃত হইয়া পুলিশে আনয়ন।

প্রথম যখন ইংরাজেরা কলিকাতায় বাণিজ্য করিতে আইসেন, সে সময়ে সেট বসাখ বাবুরা সওদাগরী করিতেন, কিন্তু কলিকাতার একজনও ইংরাজী ভাষা জানিত না। ইংরাজদিগের সহিত কারবারের কথাবর্তা ইশারা দ্বারা হইত। মানব স্বভাব এই যে, চাড় পড়িলেই ফিকির বেরোয়, ইশারা দ্বারাই ক্রমে ক্রমে কিছু কিছু ইংরাজী কথা শিক্ষা হইতে আরম্ভ হইল। পরে সুপ্‌রিম্ কোর্ট্ স্থাপিত হইলে, আইন-আদালতের ধাব্‌কায় ইংরাজী চর্চা বাড়িয়া উঠিল। ঐ সময় রামরাম মিশ্রী ও আনন্দিরাম দাস অনেক ইংরাজী কথা শিখিয়াছিলেন। রামরাম মিশ্রীর শিষ্য রামনারায়ণ মিশ্রী উকিলের কেরানিগিরি করিতেন ও অনেক লোকের দরখাস্ত লিখিয়া দিতেন, তাঁহার একটি স্কুল ছিল তথায় ছাত্রদিগকে ১৪/১৬ টাকা করিয়া মাসে মাহিনা দিতে হইত। পরে রামলোচন নাপিত, কৃষ্ণমোহন বসু প্রভৃতি অনেকেই স্কুল-মাস্টারগিরি করিয়াছিলেন। ছেলেরা তামস্‌ডিস্‌ পড়িত ও কথার মানে মুখস্থ করিত। বিবাহে অথবা ভোজের সভায়, যে ছেলে জাইন ঝাড়িতে পারিতে, সকলে তাহাকে চেয়ে দেখিতেন ও সাবাস বাওহা দিতেন।

ফ্রেন্‌কো ও আরাতুন পিট্রস প্রভৃতির দেখাদেখি শরবোরণ সাহেব কিছু কাল পরে স্কুল করিয়াছিলেন। ঐ স্কুলে সম্ভ্রান্ত লোকের ছেলেরা পড়িত।

যদি ছেলেদিগের আন্তরিক ইচ্ছা থাকে, তবে তাহারা যে স্কুলে পড়ুক আপন আপন পরিশ্রমের জোরে কিছু না কিছু অবশ্যই শিখিতে পারে। সকল স্কুলেরই দোষ গুণ আছে, এবং এমন এমন অনেক ছেলেও আছে যে এ স্কুল ভাল নয়, ও স্কুল ভাল নয় বলিয়া, আজি এখানে কালি ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়—মনে করে, গোলমালে কাল কাটাইয়া দিতে পারিলেই বাপ-মাকে ফাঁকি দিলাম। মতিলাল শরবোরণ সাহেবের স্কুলে দুই-একদিন পড়িয়া, কালুস সাহেবের স্কুলে ভর্তি হইল।

লেখাপড়া শিখিবার তৎপর্য এই যে, সৎ স্বভাব ও সৎ চরিত্র হইবে—সুবিবেচনা জন্মিবে ও যে যে বিষয় কর্মে লাগিতে পারে, তাহা ভাল করিয়া শেখা হইবে। এই অভিপ্রায় অনুসারে বালকদিগের শিক্ষা হইলে তাহারা সর্বপ্রকারে ভদ্র হয় ও ঘরে বাহিরে সকল কর্ম ভালরূপ বুঝিতেও পরে—করিতেও পারে। কিন্তু এমত শিক্ষা দিতে হইলে, বাপ-মারও যত্ন চাই—শিক্ষকেরও যত্ন চাই। বাপ যে পথে যাবেন, ছেলেও সেই পথে যাবে। ছেলেকে সৎ করিতে হইলে, আগে বাপের সৎ হওয়া উচিত। বাপ মদে ডুবে থাকিয়া ছেলেকে মদ খেতে মানা করিলে, সে তাহা শুন্‌বে কেন? বাপ অসৎ কর্মে রত হইয়া নীতি উপদেশ দিলে, ছেলে তাকে বিড়াল তপস্বী জ্ঞান করিয়া উপহাস করিবে। যাহার বাপ ধর্মপথে চলে তাহার পুত্রের উপদেশ বড় আবশ্যক করে না—বাপের দেখাদেখি পুত্রের সৎ স্বভাব আপনা আপনি জন্মে ও মাতারও আপন শিশুর প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। জননীর মিষ্টি বাক্যে, স্নেহে এবং মুখচুম্বনে শিশুর মন যেমন নরম হয়, এমন কিছুতেই হয় না। শিশু যদি নিশ্চয়রূপে জানে যে এমন এমন কর্ম করিলে আমাকে মা কোলে লইয়া আদর করিবে না, তাহা হইলেই তাহার সৎ সংস্কার বদ্ধমূল হয়। শিক্ষকের কর্তব্য যে শিষ্যকে কতকগুলা বহি পড়াইয়া কেবল তোতা পাখী না করেন। যাহা পড়িবে তাহা মুখস্থ করিলে স্মরণশক্তির বৃদ্ধি হয় বটে, কিন্তু তাহাতে যদ্যপি বুদ্ধির জোর ও কাজের বিদ্যা না হইল, তবে সে লেখাপড়া শেখা কেবল লোক দেখাবার জন্য। শিষ্য বড় হউক বা ছোট হউক, তাহাকে এমন করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবেক যে, পড়াশুনাতে তাহার মন লাগে—সেরূপ বুঝান শিক্ষার সুধারা ও কৌশলের দ্বারা হইতে পারে—কেবল তাঁইস করিলে হয় না।

বৈদ্যবাটীর বাটীতে থাকিয়া মতিলাল কিছুমাত্র সুনীতি শেখে নাই। এক্ষণে বহুবাজারে থাকিতে হিতে বিপরীত হইল। বেচারাম বাবুর দুই জন ভাগিনেয় ছিল, তাহাদের নাম হলধর ও গদাধর, তাহারা জন্মাবধি পিতা কেমন দেখে নাই। মাতার ও মাতুলের ভয়ে এক একবার পাঠশালায় গিয়া বসিত, কিন্তু সে নামমাত্র, কেবল পথে ঘাটে—ছাতে মাঠে—ছুটাছুটি হুটোহুটি করিয়া বেড়াইত। কেহ দমন করিলে দমন শুনিত না—মাকে বলিত, তুমি এমন করো তো আমরা বেরিয়ে যাব। একে চায় আরে পায়—তাহারা দেখিল মতিলালও তাহাদেরই একজন। দুই-এক দিনের মধ্যেই হলাহলি গলাগলি ভাব হইল। এক জায়গায় বসে—এক জায়গায় খায়—এক জায়গায় শোয়। পরস্পর এ ওর কাঁধে হাত দেয় ও ঘরে-দ্বারে বাহিরে-ভিতরে হাত ধরাধরি ও গলা জড়াজড়ি করিয়া বেড়ায়। বেচারাম বাবুর ব্রাক্ষ্ণণী তাহাদিগকে দেখিয়া এক এবার বলিতেন—আহা এরা যান এক মার পেটের তিনটি ভাই।

কি শিশু কি যুবা কি বৃদ্ধ ক্রমাগত চুপ করিয়া, অথবা এক প্রকার কর্ম লইয়া থাকিতে পারে না। সমস্ত দিন রাত্রির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন কর্মে সময় কাটাইবার উপায় চাই। শিশুদিগের প্রতি এমন নিয়ম করিতে হইবেক যে তাহারা খেলাও করিবে—পড়াশুনাও করিবে। ক্রমাগত খেলা করা অথবা ক্রমাগত পড়াশুনা করা ভাল নহে। খেলাধুলা করিবার বিশেষ তাৎর্পয এই যে, শরীর তাজা হইয়া উঠিলে তাহাতে পড়াশুনা করিতে অধিক মন যায়। ক্রমাগত পড়াশুনা করিলে মন দুর্বল হইয়া পড়ে—যাহা শেখা যায় তাহা মনে ভেসে ভেসে থাকে— ভাল করিয়া প্রবেশ করে না। কিন্তু খেলারও হিসাব আছে, যে-যে খেলায় শারীরিক পরিশ্রম হয়, সেই খেলাই উপকারক। তাস পাশা প্রভৃতিতে কিছুমাত্র ফল নাই—তাহাতে কেবল অলস্য স্বভাব বাড়ে—সেই আলস্যেতে নানা উৎপাত ঘটে। যেমন ক্রমাগত পড়াশুনা করিলে পড়াশুনা ভাল হয় না, তেমন ক্রমাগত খেলাতেও বুদ্ধি হোঁতকা হয়। কেননা খেলায় কেবল শরীর সবল হইতে থাকে—মনের কিছুমাত্র শাসন হ্য় না, কিন্তু মন একটা না একটা বিষয় লইয়া অবশ্যই নিযুক্ত থকিবে, এমন অবস্থায় তাহা কি কুপথে বই সুপথে যাইতে পারে? অনেক বালক এইরূপেই অধঃপাতে গিয়া থাকে।

হলধর, গদাধর ও মতিলাল গোকুলের ষাঁড়ের ন্যায় বেড়ায়— যাহা মনে যায় তাই করে— কাহারো কথা শুনে না— কাহাকেও মানে না। হয় তাস—নয় পাশা— নয় ঘুড়ি—পায়রা—নয় বুলবুল, একটা না একটা লইয়া সর্বদা আমোদেই আছে।

খাবার অবকাশ নাই—শোবার অবকাশ নাই—বাটীর ভিতর যাইবার জন্য চাকর ডাকিতে আসিলে, অমনি বলে—যা বেটা যা, আমরা যাব না। দাসী আসিয়া বলে অগো মা-ঠাকুরানী যে শুতে পান না। তাহাকেও বলে—দূর হ হারামজাদী! দাসী মধ্যে মধ্যে বলে, আ মরি, কী মিষ্ট কথাই শিখেছ! ক্রমে ক্রমে পাড়ার যত হতভাগা লক্ষ্ণীছাড়া—উনপাজুরে—বরাখুরে ছোঁড়ারা জুটিতে আরম্ভ হইল। দিবারাত্রি হট্রগোল—বৈঠকখানায় কান পাতা ভার—কেবল হো হো শব্দ— হাসির গর্‌রা ও তামাক-চরস গাঁজার ছররা, ধোঁয়াতে অন্ধকার হইতে লাগিল। কার সাধ্য সে দিক দিয়া যায়— কার বাপের সাধ্য যে মানা করে। বেচারাম বাবু এক একবার গন্ধ পান—নাক টিপে ধরেন আর বলেন— দূঁর দূঁর।

সঙ্গদোষের ন্যায় আর ভয়ানক নাই। বাপ-মা ও শিক্ষক সর্বদা যত্ন করিলেও সঙ্গদোষে সব যায়, যে স্থলে ঐরূপ যত্ন কিছুমাত্র নাই, সে স্থলে সঙ্গদোষে কত মন্দ হয়, তাহা বলা যায় না।

মতিলাল যে সকল সঙ্গী পাইল, তাহাতে তাহার সুস্বভাব হওয়া দূরে থাকুক, কুস্বভাব ও কুমতি দিন দিন বাড়িতে লাগিল। সপ্তাহে দুই-এক দিন স্কুলে যায় ও অতিকষ্টে সাক্ষিগোপালের ন্যায় বসিয়া থাকে। হয় তো ছেলেদের সঙ্গে ফট্‌কি নাট্‌কি করে— নয় তো সিলেট লইয়া ছবি আঁকে— পড়াশুনায় পাঁচ মিনিটও মন দেয় না। সর্বদা মন উড়ু উড়ু, কতক্ষণে সমবয়সীদের সঙ্গে ধুমধাম ও আহলাদ আমোদ করিব! এমন এমন শিক্ষকও আছেন যে, মতিলালের মতো ছেলের মন কৌশলের দ্বারা পড়াশুনায় ভেজাইতে পারেন। তাঁহারা শিক্ষা করাইবার নানা প্রকার ধারা জানেন—যাহার প্রতি যে ধারা খাটে, সেই ধারা অনুসারে শিখা দেন। এক্ষণে সরকারী স্কুলে যেরূপ ভড়ুঙ্গে রকম শিক্ষা হইয়া থাকে, কালুস সাহেবের স্কুলেও সেইরূ্প শিক্ষা হইত। প্রত্যেক ক্লাসের প্রত্যেক বালকের প্রতি সমান তদারক হইত না—ভারি ভারি বহি পড়িবার অগ্রে সহজ সহজ বহি ভালরূপে বুঝিতে পারে কি-না, তাহার অনুসন্ধান হইত না—অধিক বহি ও অনেক করিয়া পড়া দিলেই স্কুলের গৌরব হইবে এই দৃঢ় সংস্কার ছিল— ছেলেরা মুখস্ত বলে গেলেই হইল, —বুঝুক না বুঝুক জানা অবশ্যক বোধ হইত না এবং কি কি শিক্ষা করাইলে উত্তরকালে কর্মে লাগিতে পারিবে তাহারও বিবেচনা হইত না। এমতো স্কুলে যে ছেলে পড়ে তাহার বিদ্যা শিক্ষা কপালের বড় জোর না হইলে হয় না।

মতিলাল যেমন বাপের বেটা—যেমন সহবাস পাইয়াছিল—যেমন স্থানে বাস করিত—যেমন স্কুলে পড়িতে লাগিল তেমনি তাহার বিদ্যাও ভারি হইল। এক প্রকার শিক্ষক প্রায় কোনো স্কুলে থাকে না, কেহ-বা প্রাণান্তিক পরিশ্রম করিয়া মরে—কেহ বা গোঁপে তা দিয়া উপর চাল চলিয়া বেড়ায়। বটতলার বক্রেশ্বরবাবু কালুস সাহেবের সোনার কাটি রুপার কাটি ছিলেন। তিনি যাবতীয় বড় মানুষের বাটীতে যাইতেন ও সকলেকেই বলিতেন—আপনার ছেলের আমি সর্বদা তদারক করিয়া থাকি—মহাশয়ের ছেলে না হবে কেন! সে তো ছেলে নয় পরশ পাথর! স্কুলের উপর উপর ক্লাসের ছেলেদিগকে পড়াইবার ভার ছিল, কিন্তু যাহা পড়াইতেন, তাহা নিজে বুঝিতে পারিতেন কি-না সন্দেহ। এ কথা প্রকাশ হইল ঘোর অপমান হইবে, এজন্য চেপে চুপে রাখিতেন। বালকদিগকে কেবল মথন পড়ায়তেন—মানে জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, ডিক্সনেরী দেখ। ছেলেরা যাহা তরজমা করিত, তাহার কিছু না কিছু কাটাকুটি করিতে হয়, সব বজায় রাখিলে মাস্টারগিরি চলে না, কার্য শদ্ব কাটিয়া কর্ম লিখিতেন, অথবা কর্ম শব্দ কাটিয়া কার্য লিখিতেন—ছেলেরা জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, তোমরা বড় বে-আদব, আমি যাহা বলিব তাহার উপর আবার কথা কও? মধ্যে মধ্যে বড়মানুষের ছেলেদের লইয়া বড় আদর করিতেন ও জিজ্ঞাসা করিতেন—তোমাদের অমুক জায়গার ভাড়া কত—অমুক তালুকের মুনাফা কত? মতিলাল অল্প দিনের মধ্যে বক্রেশ্বরবাবুর অতি প্রিয়পাত্র হইল। আজ ফুলটি, কাল ফলটি, আজ বইখানি, কাল হাত-রুমালখানি আনিত, বক্রেশ্বরবাবু মনে করিতেন মতিলালের মত ছেলেদিগকে হাতছাড়া করা ভাল নয়—ইহারা বড় হইয়া উঠিলে আমার বেগুন ক্ষেত হইবে! স্কুলের তদারকের কথা লইয়া খুঁটিনাটি করিলে আমার কি পরকালে সাক্ষী দিবে?

শারদীয় পূজার সময় উপস্থিত—বাজারে ও স্থানে স্থানে অতিশয় গোল—ঐ গোলে মতিলালের গোলে হরিবোল বাড়িতে লাগিল। স্কুলে থাকিতে গেলে ছটফটানি ধরে—একবার এদিগে দেখে—এবার ওদিগে দেখে—একবার বসে—একবার ডেক্স বাজায়,—এক লহমাও স্থির থাকে না। শনিবারে স্কুলে আসিয়া বক্রেশ্বরবাবুকে বলিয়া কহিয়া হাপ স্কুল করিয়া বাটী যায়। পথে পানের খিলি খরিদ করিয়া, দুই পাশে পায়রাওয়ালা ও ঘুড়িওয়ালা দোকান দেখিয়া যাইতেছে—অম্লান মুখ, কাহারও প্রতি দৃক্‌পাত নাই, ইতিমধ্যে পুলিশের একজন সারজন ও কয়েকজন পেয়াদা দৌড়িয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিল। সারজন কহিল—তোমারা নাম পর পুলিশমে গেরেফ্‌তারি হুয়া—তোমকো জরির জানে হোগা। মতিলাল হাত বাগড়া বাগড়ি করিতে আরম্ভ করিল। সারজন বলবান—জোরে হিড় হিড় করিয়া টানায়া লইয়া যাইতে লাগিল। মতিলাল ভূমিতে পড়িয়া গেল—সমস্ত শরীরে ছড়াই গিয়া ধুলায় পরিপূর্ণ হইল, তবুও একবার ছিনিয়া পলাইতে চেষ্টা করিতে লাগিল, সারজনও মধ্যে মধ্যে দুই এক কিল ও ঘুষা মারিতে লাগিল। অবশেষে রাস্তায় পড়িয়া বাপকে স্মরণ করিয়া কাঁদিতে লাগিল, এক এক বার তাহার মনে উদয় হইল যে কেন এমন কর্ম করিয়াছিলাম—কুলোকের সঙ্গী হইয়া আমার সর্বনাশ হইল। রাস্তায় অনেক লোক জমিয়া গেল। এ ওকে জিজ্ঞাসা করে—ব্যাপারটা কি? দুই একজন বুড়ী বলাবলি কেইতে লাগিল, আহ, কার বাছাকে এমন করিয়া মারে গা—ছেলেটির মুখ যেন চাঁদের মতো—ওর কথা শুনে আমাদের প্রাণ কেঁদে উঠে।

সূর্য অস্ত না হইতে হইতে মতিলাল পুলিশে আনীত হইল, তথায় দেখিল যে হলধর, গদাধর ও পড়ার রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ প্রভৃতিকেও ধরিয়া আনিয়াছে। তাহারা সকলে অধোমুখে একপাশে দাঁড়াইয়া আছে। বেলাকিয়র সাহেব ম্যাজেস্ট্রেট—তাঁহাকে তজ্‌বিজ্‌ করিতে হইবে, কিন্তু তিনি বাটী গিয়াছেন, এজন্য সকল আসামীকে বেনিগারদে থাকিতে হইল।


আলালের ঘরের দুলাল

৫. বাবুরামবাবুকে সংবাদ দেওনার্থে প্রেমনারায়ণকে প্রেরণ, বাবুরামের সভাবর্ণন, ঠকচাচার পরিচয়, বাবুরামের স্ত্রীর সহিত কথোপকথন, কলিকাতায় আগমন, প্রভাতকালীন কলিকাতার বর্ণন, বাবুরামের বাঞ্ছারামের বাটীতে গমন, তথায় আত্নীয়দিগের সহিত সাক্ষাৎ ও মতিলাল সংক্রান্ত কথোপকথন।

“শ্যামের নাগাল পালাম না গো সই—ওগো মরমেতে মরে রই”—টক্‌—টক্‌—পটাস্‌—পটাস্‌, মিয়াজান গাড়োয়ান এক একবার গান করিতেছে—টিটকারি দিতেছে ও শালার গোরু চলতে পারে না বলে লেজ মুচড়াইয়া সপাৎ সপাৎ মারিতেছে। একটু একটু মেঘ হইয়াছে—একটু একটু বৃষ্টি পড়িতেছে—গোরু দুটা হন্‌ হন্‌ করিয়া চলিয়া একখানা ছকড়া গাড়ীকে পিছে ফেলিয়া গেল। সেই ছকড়ায় প্রেমনারায়ণ মজুমদার যাইতেছিলেন—গাড়ীখানা বাতাসে দোলে—ঘোড়া দুটা বেটো ঘোড়ার বাবা—পক্ষিরাজের বংশ—টংয়স টংয়স ডংয়স ডংয়স করিয়া চলিতেছে—পটাপট্‌ পটাপট্‌ চাবুক পড়িতেছে কিন্তু কোনোক্রমেই চাল বেগড়ায় না। প্রেমনারায়ণ দুইটা ভাত মুখে দিয়া সওয়ার হইয়াছেন—গাড়ীর হোঁকোঁচ হোঁকোঁচে প্রাণ ওষ্ঠগত। গোরুর গাড়ী এগিয়ে গেল তাহাতে আরো বিরক্ত হইলেন। এ বিষয়ে প্রেমনারায়ণের দোষ দেওয়া মিছে—অভিমান ছাড়া লোক পাওয়া ভার। প্রায় সকলেই আপনাকে আপনি বড় জানে। একটুকু মনের ক্রটি হইলেই কেহ কেহ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে—কেহ কেহ মুখটি গোঁজ করিয়া বসিয়া থাকে। প্রেমনারায়ণ বিরক্ত হইয়া আপন মনের কথা আপনি বলিতে লাগিলেন—চাকরি করা ঝাক্‌মারি—চাকরে কুকুরে সমান—হুকুম করিলে দৌড়িতে হয়। মতে, হলা, গদার জ্বালায় চিরকালটা জ্বলে মরেছি—আমাকে খেতে দেয় নাই—শুতে দেয় নাই—আমার নামে গান বাঁধিত—সর্বদা ক্ষুদে পিঁপড়ার কামড়ের মতো ঠাট্টা করিত—আমাকে ত্যক্ত করিবার জন্য রাস্তার ছোঁড়াদের টুইয়ে দিত ও মধ্যে মধ্যে আপনারাও আমার পেছনে হাততালি দিয়া হো হো করিত। এ সব সহিয়া কোন্‌ ভাল মানুষ টিকিতে পারে? ইহাতে সহজ মানুষ পাগল হয়। আমি যে কলিকাতা ছেড়ে পলাই নাই এই আমার বাহাদুরি—আমার বড় গুরুবল যে অদ্যাপিও সরকারগিরি কর্মটি বজায় আছে। ছোঁড়াদের যেমন কর্ম তেমনি ফল। এখন জেলে পচে মরুক—আর যেন খালাস হয় না—কিন্তু এ কথা কেবল কথার কথা, আমি নিজেই খালাসের তদ্বিরে যাইতেছি। মানিবওয়ারি কর্ম, চারা কি? মানুষকে পেটের জ্বালায় সব করিতে হয়।

বৈদ্যবাটীর বাবুরামবাবু বাবু হইয়া বলিয়াছেন। হরে পা টিপিতেছেন। এক পাশে দুই—একজন ভট্টাচার্য বসিয়া শাস্ত্রীয় তর্ক করতেছে—আজ লাউ খেতে আছে—কাল বেগুন খেতে নাই—লবণ দিয়ে দুগ্ধ খাইলে সদ্যগোমাংস ভক্ষণ করা হয় ইত্যাদি কথা লইয়া ঢেঁকির কচ্‌কচি করিতেছেন। এক পাশে কয়েকজন শতরঞ্চ খেলিতেছে। তাহার মধ্যে একজন খেলোয়াড় মাথায় হাত দিয়া ভাবিতেছে—তাহার সর্বনাশ উপস্থিত উঠসার কিস্তিতেই মাত। এক পাশে দুই-একজন গায়ক যন্ত্র মিলাইতেছে—তানপুরা মেঁও মেঁও করিয়া ডাকিতেছে। এক পাশে মুহুরীরা বসিয়া খাতা লিখিতেছে —সম্মুখে কর্জদার প্রজা ও মহাজন সকলে দাঁড়াইয়া আছে—অনেকের দেনা-পাওনা ডিক্রি ডিস্‌মিস হইতেছে—বৈঠকখানা লোকে থই থই করিতেছে। মহাজনেরা কেহ কেহ বলিতেছে—মহাশয় কাহারো তিন বৎসর—কাহারো চার বৎসর হইল আমরা জিনিস সরবরাহ করিয়াছি, কিন্তু টাকা না পাওয়াতে বড় ক্লেশ হইতেছে—আমরা অনেক হাঁটহাঁটি করিলাম—আমাদের কাজকর্ম সব গেল। খুচরা খুচরা মহাজনেরা যথা—তেলওয়ালা, কাঠওয়ালা, সন্দেশওয়ালা তাহারাও কেঁদে ককিয়ে কহিতেছে—মহাশয় আমরা মারা গেলাম—আমাদের পুঁটিমাছের প্রাণ—এমন করিলে আমরা—কেমন করে বাঁচিতে পারি? টাকার তাগাদা করিতে করিতে আমাদের পায়ের বাঁধন ছিড়িয়া গেল, —আমাদের দোকান-পাট সব বন্ধ হইল, মাগ ছেলেও শুকিয়ে মরিল। দেওয়ানজী এক একবার উত্তর করিতেছে—তোরা আজ যা, টাকা পাবি বই কি—এত বকিস্ কেন? তাহার উপর যে চোড়ে কথা কহিতেছে অমনি বাবুরামবাবু চোখ-মুখ ঘুরাইয়া তাহাকে গালিগালাজ দিয়া বাহির করিয়া দিতেছেন। বাঙালী বড়মানুষ বাবুরা দেশসুদ্ধ লোকের জিনিস ধারে লন—টাকা দিতে হইলে গায়ে জ্বর অইসে —বাক্সের ভিতর টাকা থাকে কিন্তু টাল-মাটাল না করিলে বৈঠকখানা লোকে সরগরম ও জমজমা হয় না। গরীব-দুঃখী মহাজন বাঁচিল কি মরিল তাহাতে কিছু এসে যায় না, কিন্তু এরূপ বড়মানুষি করিলে বাপ পিতামহের নাম বজায় থাকে। অন্য কতকগুলা ফতো বড়মানুষ আছে—তাহাদের উপরে চাকন চিকণ, ভিতরে খ্যাঁড়। বাহিরে কোঁচার পত্তন ঘরে ছুঁচার কীর্তন, আয় দেখে ব্যয় করিতে হইলেই যমে ধরে—তাহাতে বাগানও হয় না—বাবুগিরিও চলে না। কেবল চটক দেখাইয়া মহাজনের চক্ষে ধূলা দেয় —ধারে টাকা কি জিনিস পাইলে দুআওরি লয়— বড় পেড়াপীড়ি হইলে এর নিয়ে ওকে দেয় অবশেষে সমন-ওয়ারিন বাহির হইলে বিষয়-আশয় বেনামী করিয়া গা ঢাকা হয়।

বাবুরামবাবুর টাকাতে অতিশয় মায়া—বড় হাত ভারি—বাক্স থেকে টাকা বাহির করিতে হইলে বিষম দায় হয়। মহাজনদিগের সহিত কচ্‌কচি ঝক্‌ঝকি করিতেছেন, ইতিমধ্যে প্রেমনারায়ণ মজুমদার আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং কলিকাতার সকল সমাচার কানে কানে বলিলেন। বাবুরামবাবু শুনিয়া স্তব্ধ হইয়া থাকিলেন —বোধ হইল যেন বজ্র ভাঙিয়া তাহার মাথায় পড়িল। ক্ষণেক কাল পরে সুস্থির হইয়া ভাবিয়া মোকাজান মিয়াকে ডাকাইলেন। মোকাজান আদালতের কর্মে বড় পটু। অনেক জমিদার নীলকর প্রভৃতি সর্বদা তাহার সহিত পরামর্শ করিত। জাল করিতে —সাক্ষী সাজাইয়া দিতে— দারোগা ও আমলাদিগকে বশ করিতে —গাঁতের মাল লইয়া হজম করিতে —দাঙ্গা-হাঙ্গামের জোটপাট ও হয়কে নয় করিতে নয়কে হয় করিতে তাহার তুল্য আর একজন পাওয়া ভার। তাহাকে আদর করিয়া সকলে ঠকচাচা বলিয়া ডাকিত, তিনিও তাহাতে গলিয়া যাইতেন এবং মনে করিতেন আমার শুভক্ষণে জন্ম হইয়াছে— রমজান ঈদ শবেবরাত আমার করা সার্থক — বোধ হয় পীরের কাছে কষে ফয়তা দিলে আমার কুদ্‌রত আরও বাড়িয়া উঠিবে। এই ভাবিয়া একটা বদনা লইয়া অজু করিতেছিলেন, বাবুরামবাবুর ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে তাড়াতাড়ি করিয়া আসিয়া নির্জনে সকল সংবাদ শুনিলেন। কিছুকাল ভাবিয়া বলিলেন — ডর কি বাবু? এমন কত শত মকদ্দমা মুই উড়াইয়া দিয়েছি — এ বা কোন ছার? মোর কাছে পাকা পাকা লোক আছে — তেনাদের সাথে করে লিয়ে যাব — তেনাদের জবানবন্দিতে মকদ্দমা জিত্‌ব, কিছু ডর কর না — কেল খুব ফজরে এসবো, এজ্ চললাম।

বাবুরামবাবু সাহস পাইলেন বটে, তথাপি ভাবনায় অস্থির হইতে লাগিলেন। আপনার স্ত্রীকে বড় ভালবাসিতেন, স্ত্রী যাহা বলিতেন সেই কথাই কথা — স্ত্রী যদি বলিতেন এ জল নয় — দুধ, তবে চোখে দেখিলেও বলিতেন এ জল নয় — এ দুধ — না হলে গৃহিণী কেন বলবেন? অন্যান্য লোকে আপন আপন পত্নীকে ভালবাসে বটে, কিন্তু তাহারা বিবেচনা করিতে পারে যে স্ত্রীর কথা কোন্ বিষয়ে ও কতদূর পর্যন্ত শুনা উচিত। সুপুরুষ আপন পত্নীকে অন্তকরণের সহিত ভালবাসে কিন্তু স্ত্রীর সকল কথা শুনিতে গেলে পুরুষকে শাড়ী পরিয়া বাটীর ভিতর থাকা উচিত। বাবুরামবাবু স্ত্রী উঠ বলিলে উঠিতেন — বস বলিলে বসিতেন। কয়েক মাস হইল গৃহিণীর একটি নবকুমার হইয়াছে — কোলে লইয়া আদর করিতেছেন — দুই দিকে দুই কন্যা বসিয়াছে, ঘরকন্নার ও অন্যান্য কথা হইতেছে, এমতো সময়ে কর্তা বাটীর মধ্যে গিয়ে বিষণ্ণভাবে বসিলেন এবং বলিলেন—গিন্নী! আমার কপাল বড় মন্দ—মনে করিয়াছিলাম মতি মানুষমুনুষ হইলে তাহাকে সকল বিষয়ের ভার দিয়া আমরা কাশীতে গিয়া বাস করিব, কিন্তু সে আশায় বুঝি বিধি নিরাশ করলেন।

গৃহিণী। ওগো—কি—কি—শীঘ্র বলো, কথা শুনে যে আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল—আমার মতি তো ভাল আছে?

কর্তা। হাঁ—ভাল আছে—শুনিলাম পুলিশের লোক আজ তাহাকে ধরে হিঁচুড়ে লইয়া গিয়া কায়েদ করিয়াছে।

গৃহিণী। কি বল্লে?—মতিকে হিঁচুড়িয়া লইয়া গিয়া কায়েদ করিয়াছে? ওগো, কেন কয়েদ করেছে? আহা বাছার গায়ে কতই ছড় গিয়াছে, বুঝি আমার বাছা খেতেও পায় নাই—শুতেও পায় নাই! ওগো কি হবে? আমার মতিকে এখুনি আনিয়া দাও।

এই বলিয়া গৃহিণী কাঁদিতে লাগিলেন—দুই কন্যা চক্ষের জল মুছাইতে মুছাইতে নানা প্রকার সান্ত্বনা করিতে আরম্ভ করিল। গৃহিণীর রোদন দেখিয়া কোলের শিশুটিও কাঁদিতে লাগিল।

ক্রমে ক্রমে কথাবার্তার ছলে কর্তা অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন মতিলাল মধ্যে মধ্যে বাড়িতে আসিয়া মায়ের নিকট হইতে নানা প্রকার ছল করিয়া টাকা লইয়া যাইত। গৃহিণী এ কথা প্রকাশ করেন নাই—কি জানি কর্তা রাগ করিতে পারেন—অথচ ছেলেটিও আদুরে—গোসা করিলে পাছে প্রমাদ ঘটে। ছেলেপুলের সংক্রান্ত সকল কথা স্ত্রীলোকদিগের স্বামীর নিকট বলা ভাল। রোগ লুকাইয়া রাখিলে কখনই ভাল হয় না। কর্তা গৃহিণীর সহিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ করিয়া পরদিন কলিকাতার যে স্থানে যাইবেন তথায় আপনার কয়েকজন আত্মীয়কে উপস্থিত হইবার জন্য রাত্রিতেই চিঠি পাঠাইয়া দিলেন।

সুখের রাত্রি দেখিতে দেখিতে যায়। যখন মন চিন্তার সাগরে ডুবে থাকে তখন রাত্রি অতিশয় বড় বোধ হয়। মনে হয় রাত্রি পোহাইল কিন্তু পোহাইতে পোহাইতেও পোহায় না। বাবুরামবাবুর মনে নানা কথা, নানা ভাব, নানা কৌশল, নানা উপায় উদয় হইতে লাগিল। ঘরে আর স্থির হইয়া থাকিতে পারিলেন না, প্রভাত না হইতে ঠকচাচা প্রভৃতিকে লইয়া নৌকায় উঠিলেন। নৌকা দেখিতে দেখিতে ভাঁটার জোরে বাগবাজারের ঘাঁটে আসিয়া ভিড়িল। রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে—কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে—বলদেরা গোরু লইয়া চলিতেছে—ধোবার গাধা থপাস থপাস করিয়া যাইতেছে—মাছের ও তরকারির বাজরা হু-হু করিয়া আসিতেছে, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন—মেয়েরা ঘাটে সারি সারি হইয়া পরস্পর মনের কথাবার্তা কহিতেছে। কেহ বলিছে, বাপ ঠাকুরঝির জ্বালায় প্রাণটা গেল—কেহ বলে, আমার শাশুড়ী মাগী বড় বৌকাঁটকি—কেহ বলে, দিদি, আমার আর বাঁচতে সাধ নাই—বৌছুঁড়ী আমাকে দু’পা দিয়া থেত্লায়, বেটা কিছুই বলে না; ছোঁড়াকে গুণ করে ভেড়া বানিয়েছে—কেহ বলে, আহা অমন পোড়া জাও পেয়েছিলাম দিবারাত্রি আমার বুকে বসে ভাত রাঁধে,—কেহ বলে, আমার কোলের ছেলেটির বয়স দশ বৎসর হইল— কবে মরি কবে বাঁচি এই বেলা তার বিয়েটি দিয়ে নি।

এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আকাশে স্থানে স্থানে কানা মেঘ আছে। রাস্তাঘাট সেঁত সেঁত করিতেছে। বাবুরামবাবু এক ছিলিম তামাক খাইয়া একখানা ভাড়া গাড়ী অথবা পাল্কির চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু ভাড়া বনিয়া উঠিল না—অনেক চড়া বোধ হইল। রাস্তায় অনেক ছোঁড়া একত্র জমিল। বাবুরামবাবুর রকম সকম দেখিয়া কেহ কেহ বলিল—ওগো বাবু, ঝাঁকা মুটের উপর বসে যাবে? তাহা হইলে দু-পয়সায় হয়। তোর বাপের ভিটে নাশ করেছে—বলিয়া যেমন বাবুরাম দৌড়িয়া মারিতে যাবেন অমনি দড়াম করিয়া পড়িয়া গেলেন। ছেঁড়াগুলো হো হো করিয়া দূরে থেকে হাততালি দিতে লাগিল। বাবুরামবাবু অধোমুখে শীঘ্র একখানা লকাটে রকম কেরাঞ্চিতে ঠকচাচা প্রভৃতিকে লইয়া উঠিলেন এবং খন্ খন্ ঝন্ ঝন্ শব্দে বাহির সিমলের বাঞ্ছারামবাবুর বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাঞ্ছারামবাবুর বৈঠকখানায় উকিল বটলর সাহেবের মুৎসুদ্ধি—আইন-আদালত মামলা-মকদ্দমায় বড় ধড়িবাজ। মাসের মাহিনা ৫০ টাকা কিন্তু প্রাপ্তির সীমা নাই, বাটীতে নিত্য ক্রিয়াকাণ্ড হয়। তাহার বৈঠকখানায় বালীর বেণীবাবু, বহুবাজারের বেচারাম বাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু আসিয়া অপেক্ষা করিয়া বসিয়াছিলেন।

বেচারাম। বাবুরাম। ভাল দুধ দিয়া কালসাপ পুষিয়াছিলে। তোমাকে পুনঃপুনঃ বলিয়া পাঠাইয়াছিলাম আমার কথা গ্রাহ্য করো নাই—ছেলে হতে ইহকালও গেল—পরকালও গেল। মতি দেদার মদ খায়—জোয়া খেলে—অখাদ্য আহার করে। জোয়া খেলিতে খেলিতে ধরা পড়িয়া চৌকিদারকে নির্ঘাত মারিয়াছে। হলা, গদা ও আর-আর ছোঁড়ারা তাহার সঙ্গে ছিল। আমার ছেলেপুলে নাই। মনে করিয়াছিলাম হলা ও গদা এক গণ্ডুষ জল দিবে এখন সে গুড়ে বালি পড়িল। ছোঁড়াদের কথা আর কি বলিব? দূঁর দূঁর।

বাবুরাম। কে কাহাকে মন্দ করিয়াছে তাহা নিশ্চয় করা বড় কঠিন —এক্ষণে তদ্বিরের কথা বলুন।

বেচারাম। বাবুরাম যা ইচ্ছা তাই করো—আমি জ্বালাতন হইয়াছি—রাত্রে ঠাকুরঘরের ভিতর যাইয়া বোতল বোতল মদ খায়—চরস গাঁজার ধোঁয়াতে কড়িকাট কালো করিয়াছে—রূপা-সোনার জিনিস চুরি করিয়া বিক্রি করিয়াছে। আবার বলে একদিন শালগ্রামকে পোড়াইয়া চুন করিয়া পানের সঙ্গে খাইয়া ফেলিব। আমি আবার তাহাদের খালাসের জন্য টাকা দিব? দূঁর দূঁর।

বক্রেশ্বর। মতিলাল এত মন্দ নহে—আমি স্বচক্ষে স্কুলে দেখিয়াছি তাহার স্বভাব বড় ভাল —সে তো ছেলে নয়, পরেশ পাথর, তবে এমনটা কেন হইল বলতে পারি না।

ঠকচাচা। মুই বলি এসব ফেল্‌ত বাতের দরকার কি? ত্যাল-খেড়ের বাতেতে কি মোদের প্যাট ভরবে? মকদ্দমাটার বনিয়াদটা পেকড়ে সেজিয়া ফেলা যাওক।

বাঞ্ছারাম। (মনে মনে বড় আহলাদ—মনে করিতেছেন বুঝি চিড়া-দই পেকে উঠিল) কারবারী লোক না হইলে কারবারের কথা বুঝে না। ঠকচাচা যাহা বলিতেছেন তাহাই কাজের কথা। দুই-একজন পাকা সাক্ষীকে ভাল তালিম করিয়া রাখিতে হইবে—আমাদিগকে বটলর সাহেবকে উকিল ধরিতে হইবে—তাতে যদি মকদ্দমা জিত না হয় তবে বড় আদালতে লইয়া যাব—বড় আদালতে কিছু না হয়—কৌন্সেল পর্যন্ত যাব,—কৌন্সেলে কিছু না হয় তো বিলাত পর্যন্ত করিতে হইবে। এ কি ছেলের হাতে পিটে? কিন্তু আমাদিগের বটলর সাহেব না থাকিলে কিছুই হইবে না। সাহেব বড় ধমিষ্ঠ—তিনি অনেক মকদ্দমা আকাশে ফাঁদ পাতিয়া নিকাশ করিয়াছেন আর সাক্ষীদিগকে যেন পাখী পড়াইয়া তইয়ার করেন।

বক্রেশ্বর। আপদে পড়িলেই বিদ্যা-বুদ্ধির আবশ্যক হয়। মকদ্দমার তদ্বির অবশ্যই করিতে হইবেক। বেতদ্বিরে দাঁড়াইয়া হারা ও হাততালি খাওয়া কি ভাল?

বাঞ্ছারাম। বটলর সাহেবের মতো বুদ্ধিমান উকিল আর দেখতে পাই না। তাঁহার বুদ্ধির বলিহারি যাই। এ সকল মকদ্দমা তিনি তিন কথাতে উড়াইয়া দিবেন। এক্ষণে শীঘ্র উঠুন—তাঁহার বাটিতে চলুন।

বেণী। মহাশয় আমাকে ক্ষমা করুন। প্রাণ বিয়োগ হইলেও অধর্ম করিব না। খাতিরে সব কর্ম করতে পারি কিন্তু পরকালটি খোয়াইতে পারি না। বাস্তবিক দোষ থাকলে দোষ স্বীকার করা ভাল—সত্যের মার নাই—বিপদে মিথ্যা পথ আশ্রয় করিলে বিপদ বাড়িয়া উঠে।

ঠকচাচা। হা-হা-হা-হা—মকদ্দমা করা কেতাবী লোকের কাম নয়—তেনারা একটা ধাব্‌কাতেই পেলিয়ে যায়। এনার বাত মাফিক কাম করলে মোদের মেটির ভিতর জলদি যেতে হবে—কেয়া খুব।

বাঞ্ছারাম। আপনাদের সাজ করিতে দোল ফুরাল। বেণীবাবু স্থিরপ্রজ্ঞ —নীতিশাস্ত্রে জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, তাঁহার সঙ্গে তখন একদিন বালীতে গিয়া তর্ক করা যাইবেক। এক্ষণে আপনারা গাত্রোত্থান করুন।

বেচারাম। বেণীভায়া! তোমার যে মত আমার সেই মত—আমার তিন কাল গিয়েছে—এককাল ঠেকেছে, আমি প্রাণ গেলেও অধর্ম করিব না—আর কাহার জন্যে বা অধর্ম করিব? ছোঁড়ারা আমার হাড় ভাজা ভাজা করিয়াছে—তাদের জন্যে আমি আবার খরচ করিব—তাদের জন্য মিথ্যা সাক্ষী দেওয়াইব? তাহারা জেলে যায় তো এক প্রকার আমি বাঁচি। তাদের জন্যে আমার খেদ কি? তাদের মুখ দেখিলে গা জ্বলে উঠে—দূঁর দূঁর!!!