PREFACE.
The above original Novel in Bengali being the first work of the kind, is now submitted to the publie with considerable diffidence. It chiefly treats of the pernicious effects of allowing children to be improperly brought up, with remarks on the existing system of education, on self-formation and religioni eulture, and is illustrative of the condition of Hindu society, manners, customs, de. and partly of the state of things in the Moffusil. The work has boon written in a simple style, and to foreigners desirous of sequiring an idiomatic knowledge of the Bengali language and an aoguaintance with Hindu domestic life, it will perhaps be found useful. The writer thinks it well to add that a large portion of this Tale appeared originally in a monthly publication, which met with the approval of the number of friends, at whose request he han been induced to conclude and publish it in the present form.
Price per copy, … … 12 Annas, cash.
ভূমিকা।
অন্যান্য পুস্তক অপেক্ষা উপন্যাসাদি পাঠ করিতে প্রায় সকল লোকেরই মনে স্বভাবতঃ অনুরাগ জন্মিয়া থাকে এবং যে স্থলে এতদ্দেশীয় অধিকাংশ লোক কোন পুস্তকাদি পাঠ করিয়া সময় ক্ষেপণ করিতে রত নহে সে স্থলে উক্ত প্রকার গ্রন্থের অধিক আবশ্যক, এতদ্বিবেচনায় এই ক্ষুদ্র পুস্তক খানি রচিত হইল। ইহার তাৎপর্য্য কি পাঠ করিলেই প্রকাশ হইবে। এ প্রকার পুস্তক লেখনের প্রণালী এতদ্দেশ মধ্যে বড় প্রচলিত নাই, ইহাতে প্রথমোদ্যমে অবশ সদোষ হইবার সম্ভাবনা, পাঠকবর্গ অনুগ্রহ করিয়া ঐ দোষ ক্ষমা করিবেন। গ্রন্থের নির্ঘণ্ট দেখিলেই গল্পসকলের আভাস ও অন্যান্য প্রকরণ জানা যাইবে।
পুস্তকের মূল্য, … … ৸৹ নগদ।
আলালের ঘরের দুলাল
১. বাবুরাম বাবুর পরিচয়
মতিলালের বাঙ্গালা, সংস্কৃত ও ফার্সী শিক্ষা।
বৈদ্যাবাটীর বাবুরাম বাবু বড় বৈষয়িক ছিলেন। তিনি মাল ও ফৌজদারী আদালতে অনেক কর্ম করিয়া বিখ্যাত হন। কর্মকাজ করিতে প্রবৃত্ত হইয়া উৎকোচাদি গ্রহণ না করিয়া যথার্থ পথে চলা বড় প্রাচীন প্রথা ছিল না – বাবুরাম সেই প্রথানুসারেই চলিতেন। একে কর্মে পটু – তাতে তোষামোদ ও কৃতাঞ্জলি দ্বারা সাহেব-সুবাদিগকে বশীভূত করিয়াছিলেন এজন্য অল্পদিনের মধ্যেই প্রচুর ধন উপার্জন করিলেন। এদেশে ধন অথবা পদ বাড়িলেই মান বাড়ে, বিদ্যা ও চরিত্রের তাদৃক্ গৌরব হয় না। বাবুরাম বাবুর অবস্থা পূর্বে বড় মন্দ ছিল, তৎকালে গ্রামে কেবল দুই এক ব্যক্তি তাঁহার তত্ত্ব করিত। পরে তাঁহার সুদৃশ্য অট্টালিকা বাগ বাগিচা তালুক ও অন্যান্য ঐশ্বর্য সম্পত্তি হওয়াতে অনুগত ও অমাত্য বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অসংখ্য হইল। অবকাশ কালে বাটিতে আসিলে তাঁহার বৈঠকখানা লোকারণ্য হইত, যেমন মেঠাইওয়ালার দোকানে মিষ্ট থাকিলেই তাহা মক্ষিকায় পরিপূর্ণ হয় তেমন ধনের আমদানি হইলেই লোকের আমদানি হয়। বাবুরামবাবুর বাটীতে যখন যাও তাঁহার নিকট লোক ছাড়া নাই—কি বড়, কি ছোট, সকলেই চারিদিকে বসিয়া তুষ্টিজনক নানা কথা কহিতেছে, বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিরা ভঙ্গিক্রমে তোষামোদ করিত আর এলোমেলো লোকেরা একেবারেই জল উঁচু-নিচু বলিত। এইরূপে কিছু কাল যাপন করিয়া বাবুরাম বাবু পেন্সন লইলেন ও আপন বাটীতে বসিয়া জমিদারী ও সওদাগরী কর্ম করিতে আরম্ভ করিলেন।
লোকের সর্ব প্রকারে সুখ প্রায় হয় না ও সর্ব বিষয়ে বুদ্ধিও প্রায় থাকে না। বাবুরাম বাবু কেবল ধন উপার্জনেই মনোযোগ করিতেন। কি প্রকারে বিষয় বিভব বাড়িবে, কি প্রকারে দশজন লোক জানিবে— কি প্রকারে গ্রামস্থ লোক-সকল করজোড়ে থাকিবে— কি প্রকারে ক্রিয়াকাণ্ড সর্বোত্তম হইবে— এই সকল বিষয় সর্বদা চিন্তা করিতেন। তাঁহার এক পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। বাবুরামবাবু বলরাম ঠাকুরের সন্তান, এজন্য জাতিরক্ষার্থ কন্যাদ্বয় জন্মিবামাত্র বিস্তর ব্যয় ভূষণ করিয়া তাহাদের বিবাহ দিয়াছিলেন, কিন্তু জামাতারা কুলীন, অনেক স্থানে দারপরিগ্রহ করিয়াছিল— বিশেষ পারিতোষিক না পাইলে বৈদ্যবাটীর শ্বশুরবাটীতে উঁকিও মারিত না। পুত্র মতিলাল বাল্যাবস্থা অবধি আদর পাইয়া সর্বদা বাইন করিত—কখন বলিত বাবা চাঁদ ধরিব—কখন বলিত বাবা তোপ খাব। যখন চীৎকার করিয়া কান্দিতে আরম্ভ করিত নিকটস্থ সকল লোক বলিত ঐ বান্কে ছেলেটার জ্বালায় ঘুমান ভার! বালকটি পিতা-মাতার নিকট আস্কারা পাইয়া পাঠশালায় যাইবার নামও করিত না। যিনি বাটীর সরকার তাঁহার উপর শিক্ষা করাইবার ভার ছিল। প্রথম প্রথম গুরু মহাশয়ের নিকটে গেলে মতিলাল আঁ আঁ করিয়া কান্দিয়া তাঁহাকে আঁচড় ও কামড় দিত—গুরুমহাশয় কর্তার নিকট গিয়া বলিতেন, মহাশয়! আপনার পুত্রকে শিক্ষা করান আমার কর্ম নয়। কর্তা প্রত্যুত্তর দিতেন—ও আমার সবেধন নীলমণি—ভুলাইয়া টুলাইয়া গায় হাত বুলাইয়া শেখাও। পরে বিস্তর কৌশলে মতিলাল পাঠশালায় আসিতে আরম্ভ করিল। গুরুমহাশয় পায়ের উপর পা, বেত হাতে, দেয়ালে ঠেসান দিয়া ঢুল্ছেন ও বল্ছেন “ল্যাখ রে ল্যাখ।” মতিলাল ঐ অবকাশে উঠিয়া তাঁহার মুখের নিকট কলা দেখাচ্ছে আর নাচ্ছে — গুরুমশায় নাক ডাকিতেছেন—শিষ্য কি করিতেছে তাহা কিছুই জানেন না। তাঁহার চক্ষু উন্মীলিত হইলেই মতিলাল আপন পাততাড়ির নিকট বসিয়া কাগের ছা বগের ছা লিখিত। সন্ধ্যাকালে ছাত্রদিগকে ঘোষাইতে আরম্ভ করিলে মতিলাল গোলে হরিবোল দিত—কেবল গণ্ডার এণ্ডা ও বুড়িকা ও পণিকার শেষ অক্ষর বলিয়া ফাঁকি সিদ্ধান্ত করিত,—মধ্যে মধ্যে গুরুমহাশয় নিদ্রিত হইলে তাঁহার নাকে কাটি দিয়া ও কোঁচার উপর জলন্ত অঙ্গার ফেলিয়া তীরের ন্যায় প্রস্থান করিত। আর আহারের সময় চুনের জল ঘোল বলিয়া অন্য লোকের হাত দিয়া পান করাইত। গুরুমহাশয় দেখিলেন বালকটি অতিশয় ত্রিপণ্ড, মা সরস্বতীকে একবারে জলপান করিয়া বসিল, অতএব মনে করিলেন যদি এত বেত্রাঘাতে সুযুত না হইল, কেবল গুরুমারা বিদ্যাই শিক্ষা করিল তবে এমত শিষ্যের হাত হইতে ত্বরায় মুক্ত হওয়া কর্তব্য, কিন্তু কর্তা ছাড়েন না—অতএব কৌশল করিতে হইল। বোধ হয় গুরুমহাশয়গিরি অপেক্ষা সরকারি ভাল, ইহাতে বেতন দুই টাকা ও খোরাক-পোষাক—উপরি লাভের মধ্যে তালপাত কলাপাত ও কাগজ ধরিবার কালে এক একটা সিধে ও এক এক জোড়া কাপড় মাত্র, কিন্তু বাজার সরকারি কর্মে নিত্য কাঁচা কড়ি। এই বিবেচনা করিয়া কর্তার নিকট গিয়া কহিলেন—মতিবাবুর কলাপাত ও কাগজ লেখা শেষ হইয়াছে এবং এক প্রস্থ জমিদারী কাগজও লেখান গিয়াছে। বাবুরামবাবু এই সংবাদ পাইয়া আহ্লাদে মগ্ন হইলেন, নিকটস্থ পারিষদেরা বলিল— না হবে কেন! সিংহের সন্তান কি কখন শৃগাল হইতে পারে?
পরে বাবুরাম বাবু বিবেচনা করিলেন ব্যাকরণাদি ও কিঞ্চিত ফার্সী শিক্ষা করানো আবশ্যক। এই স্থির করিয়া বাটীর পূজারী ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলেন—কেমন হে তোমার ব্যাকরণ ট্যাকরণ পড়াশুনা আছে? পূজারী ব্রাহ্মণ গণ্ড মুর্খ—মনে করিল যে চাউল-কলা পাই তাতে তো কিছুই আঁটে না—এত দিনের পর বুঝি কিছু প্রাপ্তির পন্থা হইল, এই ভাবিয়া প্রত্যুত্তর করিল— আজ্ঞে হাঁ, আমি কুইনমোড়ার ঈশ্বরচন্দ্র বেদান্তবাগীশের টোলে ব্যাকরণাদি একাদিক্রমে পাঁচ বৎসর অধ্যয়ন করি, কপাল মন্দ, পড়াশুনার দরুন কিছুই লাভবান হয় না, কেবল আদা জল খাইয়া মহাশয়ের নিকট পড়িয়া আছি। বাবুরাম বাবু বলিলেন—তুমি অদ্যাবধি আমার পুত্রকে ব্যাকরণ শিক্ষা করাও। পূজারী ব্রাহ্মণ আশা বায়ুতে মুগ্ধ হইয়া মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের দুই-এক পাত শিক্ষা করিয়া পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। মতিলাল মনে করিলেন গুরুমহাশয়ের হাত হইতে তো মুক্ত হইয়াছি এখন এ বেটা চাউলকলাখেকো বামুনকে কেমন করিয়া তাড়াই? আমি বাপ মার আদরের ছেলে—লিখি বা না লিখি, তাঁহারা আমাকে কিছুই বলিবেন না—লেখাপড়া শেখা কেবল টাকার জন্য—আমার বাপের অতুল বিষয়—আমার লেখাপড়ায় কাজ কি? কেবল নাম সহি করিতে পারিলেই হইল। আর যদি লেখাপড়া শিখিব তবে আমার এয়ারবক্সিদিগের দশা কি হইবে? আমোদ করিবার এই সময়,—এখন কি লেখা-পড়ার যন্ত্রণা ভাল লাগে?
মতিলাল এই স্থির করিয়া পূজারী ব্রাহ্মণকে বলিল—অরে বামুন, তুই যদি হ, য, ব, র, ল, শিখাইতে আমার নিকট আর আস্বি ঠাকুর ফেলিয়া দিয়া তোর চাউল-কলা পাইবার উপায় সুদ্ধ ঘুচাইয়া দিব— কিন্তু বাবার কাছে গিয়া একথা বললে ছাতের উপর হতে তোর মাথায় এমন এক এগারঞ্চি ঝাড়িব যে তোর ব্রাহ্মণীকে কালই হাতের নোয়া খুলিতে হইবে। পূজারী ব্রাহ্মণ হ, য, ব, র, ল প্রসাদাৎ ক্ষণেক কাল হ, য, ব, র, ল হইয়া থাকিলেন পরে আপনা আপনি বিচার করিলেন—ছয় মাস প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছি এক পয়সাও হস্তগত হয় নাই, আবার “লাভঃ পরং গোবধঃ” —প্রাণ নিয়া টানাটানি—এক্ষণে ছেড়ে দিলে কেঁদে বাঁচি। পূজারী ব্রাহ্মণ যৎকালে এই সকল পর্যালোচনা করিতেছিলেন মতিলাল তাঁহার মুখাবলোকন করিয়া বলিল—বড় যে বসে বসে ভাবছিস্? টাকা চাই? এই নে—কিন্তু বাবার কাছে গিয়া বল্গে আমি সব শিখেছি। পূজারী ব্রাহ্মণ কর্তার নিকট গিয়া বলিল—মহাশয় মতিলাল সামান্য বালক নহে—তাহার অসাধারণ মেধা, যাহা একবার শুনে তাহাই মনে করিয়া রাখে। বাবুরাম বাবুর নিকট একজন আচার্য ছিল—বলিল, মতিলালের পরিচয় দিবার আবশ্যক নাই। উটি ক্ষণজন্মা ছেলে— বেঁচে থাকিলে দিক্পাল হইবে।
অনন্তর পুত্রকে ফার্সী পড়াইবার জন্য বাবুরাম বাবু একজন মুন্সি অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। অনেক অনুসন্ধানের পর আলাদি দরজির নানা হবিবলহোসেন তেল কাঠ ও ১৷৷৹ টাকা মাহিনাতে নিযুক্ত হইল। মুন্সি সাহেবের দন্ত নাই, পাকা দাড়ি, শনের ন্যায় গোঁফ, শিখাইবার সময় চক্ষু রাঙা করেন ও বলেন, ‘আরে বে পড়’ ও কাফ গাফ আয়েন গায়েন উচ্চারণে তাঁহার বদন সর্বদা বিকট হয়। একে বিদ্যা শিক্ষাতে কিছু অনুরাগ নাই তাতে ঐরূপ শিক্ষক অতএব মতিলালের ফার্সি পড়াতে ঐরূপ ফল হইল। এক দিবস মুন্সি সাহেব হেঁট হইয়া কেতাব দেখিতেছেন ও হাত নেড়ে সুর করিয়া মস্নবির বয়েত পড়িতেছেন ইত্যবসরে মতিলাল পিছন দিগ্ দিয়া একখান জ্বলন্ত টিকে দাড়ির উপর ফেলিয়া দিল। তৎক্ষণাৎ দাউদাউ করিয়া দাড়ি জ্বলিয়া উঠিল। মতিলাল বলিল—কেমন রে বেটা শোরখেকো নেড়ে আমাকে পড়াবি? মুন্সি সাহেব দাড়ি ঝাড়িতে ঝাড়িতে ও তোবা তোবা বলিতে বলিতে প্রস্থান করিলেন এবং জ্বালার চোটে চিৎকার করিয়া বলিলেন—এস্ মাফিক বেতমিজ আওর বদ্জাৎ লেড়্কা কবি দেখা নেই—এস্ কাম্সে মুল্কমে চাস কর্ণা আচ্ছি হ্যায়। এস্ জেগে আনা বি হারাম হ্যায়—তোবা-তোবা-তোবা!!!
২. মতিলালের ইংরাজী শিখাবার উদ্যোগ
ও বাবুরাম বাবুর বালীতে গমন
মুন্সি সাহেবের দুর্গতির কথা শুনিয়া বাবুরামবাবু বলিলেন—মতিলাল তো আমার তেমন ছেলে নয়—সে বেটা জেতে নেড়ে—কত ভাল হবে? পরে ভাবিলেন যে ফার্সির চলন উঠিয়া যাইতেছে, এখন ইংরেজী পড়ান ভাল। যেমন ক্ষিপ্তের কখন কখন জ্ঞানোদয় হয় তেমনি অবিজ্ঞ লোকেরও কখন কখন বিজ্ঞতা উপস্থিত হয়। বাবুরাম বাবু ঐ বিষয় স্থির করিয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন আমি বারাণসী বাবুর ন্যায় ইংরেজী জানি—‘‘সরকার কম স্পিক নাট’’ আমার নিকটস্থ লোকেরাও তদ্রূপ বিদ্বান্, অতএব একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট পরামর্শ লওয়া কর্তব্য। আপন কুটুম্ব ও আত্মীয়দিগের নাম স্মরণ করাতে মনে হইল বালীর বেণীবাবু বড় যোগ্য লোক। বিষয়কর্ম করিলে তৎপরতা জন্মে। এজন্য অবিলম্বে একজন চাকর ও পাইক সঙ্গে লইয়া বৈদ্যবাটীর ঘাটে আসিলেন।
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মাঝিরা বৈঁতির জাল ফেলিয়া ইলিস মাছ ধরে ও দুই প্রহরে সময় মাল্লারা প্রায় আহার করিতে যায় এজন্য বৈদ্যবাটীর ঘাটে খেয়া কিম্বা চল্তি নৌকা ছিল না। বাবুরাম বাবু চৌগোঁপ্পা—নাকে তিলক—কস্তাপেড়ে ধুতি পরা—ফুলপুকুরে জুতা পায়—উদরটি গণেশের মত—কোঁচান চাদরখানি কাঁধে—একগাল পান—ইতস্ততঃ বেড়াইয়া চাকরকে বলছেন—ওরে হরে! শীঘ্র বালী যাইতে হইবে দুই চার পয়সায় একখানা চল্তি পান্সি ভাড়া কর তো। বড় মানুষের খানসামারা মধ্যে মধ্যে বেআদব হয়, হরি বলিল—মোশায়ের যেমন কাণ্ড! ভাত খেতে বস্তেছিনু—ডাকাডাকিতে ভাত ফেলে রেখে এস্তেচি—ভেটেল পান্সি হইলে অল্প ভাড়ায় হইত—এখন জোয়ার—দাঁড় টান্তে ও ঝিঁকে মার্তে মাঝিদের কাল ঘাম ছুটবে—গহনার নৌকায় গেলে দুই চার পয়সা হতে পারে—চল্তি পান্সি চার পয়সার ভাড়া করা আমার কর্ম নয়—এ কি থুতকুড়ি দিয়া ছাতু গোলা?
বাবুরাম বাবু দুটো চক্ষু কট্কট্ করিয়া বলিলেন—তোবেটার বড় মুখ বেড়েছে—ফের যদি এমন কথা কবি তো ঠাস্ করে চড় মার্বো। বাঙালী ছোট জাতিরা একটু ঠোকর খাইলেই ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপে, হরি তিরস্কার খাইয়া জড়সড় হইয়া বলিল—এজ্ঞে না, বলি এখন কি নৌকা পাওয়া যায়? এই বল্তে বল্তে একখানা বোট গুণ টেনে ফিরিয়া যাইতেছিল, মাঝির সহিত অনেক কস্তাকস্তি ধস্তাধস্তি করিয়া ৷৷৹ ভাড়া চুক্তি হইল—বাবুরাম বাবু চাকর ও পাইকের সহিত বোটের উপর উঠিলেন। কিঞ্চিৎদূর আসিয়া দুই দিগ্ দেখিতে দেখিতে বলিতেছেন—ওরে হরে! বোটখানা পাওয়া গিয়াছে ভাল—মাঝি! ও বাড়ীটা কার রে? ওটা কি চিনির কল? অহে চকমকি ঝেড়ে এক ছিলিম তামাক সাজো তো? পরে ভড় ভড় করিয়া হুঁকা টানিতেছেন—শুশুকগুলা এক এক বার ভেসে ভেসে উঠ্তেছে—বাবু স্বয়ং উঁচু হইয়া দেখ্তেছেন ও গুন গুন করিয়া সখীসম্বাদ গাইতেছেন—‘‘দেখে এলাম শ্যাম তোমার বৃন্দাবন ধাম কেবল আছে নাম।’’ ভাঁটা হাওয়াতে বোট সাঁ সাঁ করিয়া চলিতে লাগিল—মাঝিরাও অবকাশ পাইল—কেহ বা গলুয়ে বসিল, কেহ বা বোকা ছাগলের দাড়ি বাহির করিয়া চারি দিগে দেখিতে লাগিল ও চাটগেঁয়ে সুরে গান আরম্ভ করিল ‘‘খুলে পড়বে কানের সোনা শুনে বাঁশির সুর’’—
সূর্য অস্ত না হইতে হইতে বোট দেওনাগাজীর ঘাটেতে গিয়া লাগিল। বাবুরামবাবুর শরীরটি কেবল মাংসপিণ্ড—চারি জন মাঝিতে কুঁতিয়া ধরাধরি করিয়া উপরে তুলিয়া দিল। বেণীবাবু কুটুম্বকে দেখিয়া ‘‘আস্তে আজ্ঞা হউক, বস্তে আজ্ঞা হউক’’ প্রভৃতি নানবিধ শিষ্টালাপ করিলেন। বাবুর বাটীর চাকর রাম তৎক্ষণাৎ তামুক সাজিয়া আনিয়া দিল। বাবুরাম বাবু ঘোর হুঁকারি, দুই এক টান টানিয়া বলিলেন—ওহে হুঁকাটা পীসে পীসে বল্ছে, খুড়া খুড়া বল্ছে না কেন? বুদ্ধিমান লোকের নিকট চাকর থাকিলে সেও বুদ্ধিমান্ হয়। রাম অমনি হুঁকায় ছিঁচ্কা দিয়া—জল ফিরাইয়া—মিঠেকড়া তামাক সেজে—বড় দেকে নল করে হুঁকা আনিয়া দিল। বাবুরাম বাবু হুঁকা সম্মুখে পাইয়া একবারে যেন ইজারা করিয়া লইলেন—ভড়র ভড়র টানছেন— ধুঁয়া সৃষ্টি করছেন—ও বিজর বিজর বক্ছেন।
বেণীবাবু। মহাশয় একবার উঠে একটা পান খেলে ভাল হয় না?
বাবুরাম বাবু। সন্ধ্যা হল—আর জল খাওয়া থাকুক্—এ আমার ঘর—আমাকে বল্তে হবে কেন?
দেখ মতিলালের বুদ্ধিশুদ্ধি ভাল হইয়াছে—ছেলেটিকে দেখে চক্ষু জুড়ায়, সম্প্রতি ইংরেজী পড়াইতে বাঞ্ছা করি—স্বল্প অল্প মাহিনাতে একজন মাস্টার দিতে পার?
বেণীবাবু। মাস্টার অনেক আছে, কিন্তু ২০/২৫ টাকা মাসে দিলে একজন মাঝারি গোছের লোক পাওয়া যায়।
বাবুরাম বাবু। কতো— ২৫ টাকা!!! অহে ভাই, বাটীতে নিত্য নৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ—প্রতিদিন একশত পাত পড়ে—আবার কিছুকাল পরেই ছেলেটির বিবাহ দিতে হইবে। যদি এত টাকা দিব তবে তোমার নিকট নৌকা ভাড়া করিয়া কেন এলাম?
এই বলিয়া—বেণীবাবুর গায়ে হাত দিয়া হা হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
বেণীবাবু। তবে কলিকাতার কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়া দিউন। একজন আত্মীয় কুটুম্বের বাটীতে ছেলেটি থাকিবে, মাসে ৩/৪ টাকার মধ্যে পড়াশুনা হইতে পারিবে।
বাবুরাম বাবু। এত? তুমি বলে কয়ে কমজম করিয়া দিতে পারো না? স্কুলে পড়া কি ঘরে পড়ার চেয়ে ভাল?
বেণীবাবু। যদ্যপি ঘরে একজন বিচক্ষণ শিক্ষক রাখিয়া ছেলেকে পড়ানো যায় তবে বড় ভাল হয়, কিন্তু তেমন শিক্ষক অল্প টাকায় পাওয়া যায় না, স্কুলে পড়ার গুণও আছে—দোষও আছে। ছেলেদিগের সঙ্গে একত্র পড়াশুনা করিলে পরস্পরের উৎসাহ জন্মে কিন্তু সঙ্গদোষ হইলে কোন কোন ছেলে বিগড়িয়া যাইতে পারে, আর ২৫/৩০ জন বালক এক শ্রেণীতে পড়িলে হট্টগোল হয়, প্রতিদিন সকলের প্রতি সমান তদারকও হয় না, সুতরাং সকলের সমানরূপ শিক্ষাও হয় না।
বাবুরাম বাবু। তা যাহা হউক—মতিকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিব, দেখেশুনে যাহাতে সুলভ হয় তাহাই করিয়া দিও। যে সকল সাহেবের কর্মকাজ করিয়াছিলাম এক্ষণে তাহাদের কেহ নাই—থাকিলে ধরে পড়ে অমনি ভর্তি করিতে পারিতাম। আর আমার ছেলে মোটামুটি শিখিলেই বস্ আছে, বড় পড়াশুনা করিলে স্বধর্মে থাকিবে না। ছেলেটি যাহাতে মানুষ হয় তাহাই করিয়া দিও—ভাই সকল ভার তোমার উপর।
বেণীবাবু। ছেলেকে মানুষ করিতে গেলে ঘরে বাইরে তদারক চাই। বাপকে স্বচক্ষে সব দেখ্তে হয়—ছেলের সঙ্গে ছেলে হইয়া খাট্তে হয়। অনেক কর্ম বরাতে চলে বটে কিন্তু এ কর্মে পরের মুখেঝাল খাওয়া হয় না।
বাবুরাম বাবু। সে সব বটে—মতি কি তোমার ছেলে নয়? আমি এক্ষণে গঙ্গাস্নান করিব—পুরাণ শুনিব—বিষয় আশয় দেখিব—আমার অবকাশ কই ভাই? আর আমার ইংরেজী শেখা সেকেলে রকম। মতি তোমার—তোমার—তোমার!!! আমি তাকে তোমার কাছে পাঠাইয়া দিয়া নিশ্চন্ত হইব, তুমি যা জান তাই করিবে কিন্তু ভাই! দেখো যেন বড় ব্যয় হয় না—আমি কাচ্ছাবাচ্ছাওয়ালা মানুষ—তুমি সকল তো বুঝতে পার?
অনন্তর অনেক শিষ্টালাপের পর বাবুরামবাবু বৈদ্যবাটীতে প্রত্যাগমন করিলেন।