» » » মার্ক টোয়েন গল্পসমগ্র

বর্ণাকার

মার্ক টোয়েন গল্পসমগ্র

The Complete Short Stories Of MARK TWAIN

মার্ক টোয়েনমণীন্দ্র দত্ত

অখণ্ড রাজ সংস্করণ

তুলি-কলম

১, কলেজ রো, কলকাতা-৯

প্রথম সংস্করণ : বৈশাখ ১৪০২, এপ্রিল ১৯৯৫

দ্বিতীয় সংস্করণ : বইমেলা ১৪১৪, ফেব্রুয়ারী ২০০৮

প্রকাশক : কল্যাণব্রত দত্ত॥ তুলি-কলম ॥ ১এ, কলেজ রো, কলকাতা-৯

অক্ষর বিন্যার : এস টি লেজার ইউনিট, কলকাতা-৭৩

মুদ্রক : এসার গ্রাফিক, ১ সি, গৌর লাহা স্ট্রিট, কলকাতা-৬

প্রচ্ছদ: নীল দত্ত॥ অলংকরণ : রাজা দত্ত

প্রাপ্তিস্থান : সাহিত্য তীর্থ॥ ৮/১ বি, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা-৭৩

মার্ক টোয়েন প্রসঙ্গে

আসল নাম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ণ ক্লিমেন্স; কিন্তু যে নামে তাঁর বিশ্ব-জোড়া খ্যাতি সেটি ছদ্মনাম মার্ক টোয়েন। এই ছদ্মনাম গ্রহণের একটু ইতিহাস আছে। ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দের গোড়ার কথা। ক্লিমেন্স তখন সাংবাদিকতা ও রস-রচনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। বিখ্যাত সংবাদপত্র “এন্টারপ্রাইজ”-এর সঙ্গে জড়িত। একদিন তাঁর মনে হল একটি ভাল ছদ্মনাম চাই। ঘটনাক্রমে ঠিক সেই সময়ই তাঁর পূর্ব-পরিচিত বৃদ্ধ নৌ-চালক ক্যাপ্টেন সেলার্স-এর মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছল। ক্লিমেন্স-এর মনে পড়ে গেল, ক্যাপ্টেন সেলার্স নিজের নাম স্বাক্ষর করতেন—”মার্ক টোয়েন।” নামটি তাঁর মনে ধরল। এর একটি নিজস্ব ঐশ্বর্য আছে। কথাটার অর্থ “নিরাপদ জলরাশি।” অন্ধকার সমুদ্রের বুকে চলতে চলতে যে কোন নাবিকের কানে নামটি বড়ই শ্রুতিসুখকর। ২রা ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত একটি রচনাতেই ক্লিমেন্স-এর এই ছদ্মনাম সর্বপ্রথম স্বাক্ষরিত হয়েছিল। মহাকালের পথ ধরে সেই ছদ্মনাম আজ আসল নামের গণ্ডীকে অতিক্রম করে সর্বমানবের স্মৃতিতে অমর হয়ে আছে।

স্যামুয়েল ল্যাংহর্ণ ক্লিমেন্স-এর জন্ম ১৮৩৫ খৃস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর, আমেরিকার ফ্লোরিডা শহরে। ছোট বেলায় সকলে তাকে ডাকত “ক্ষুদে স্যাম” বা “স্যামি” বলে। নদীতীরবর্তী ছোট শহর হ্যানিবল্-এ তার শৈশব কেটেছে। নদী, নৌকো ও স্টিমার নিয়ে সে এক আশ্চর্য সুন্দর জগৎ। ছোট্ট স্যামির চোখে স্বপ্নের অঞ্জন। পরবর্তী কালে মার্ক টোয়েন লিখেছেন: “যখন সে দেখে বাষ্পীয় যানগুলি অনবরত যাতায়াত করছে অথচ একবারও সে তাতে চড়তে পারছে না, তখন একটি ছোট ছেলের মনের অবস্থা কি রকম হয় তা কল্পনাও করা যায় না।” সেই কল্পনা কিন্তু একদিন বাস্তবে রূপ নিল। ক্ষুদে স্যামের জীবনের অন্য অনেক দুঃসাহসিক ঘটনার মধ্যে সেও একটি। তাঁর বয়স তখন সবে ন’বছর। বেশ কতকগুলি যাত্রীবাহী স্টিমার হ্যানিবল-এ এসে ভিড়ল। স্যামিও চুপি চুপি তার একটি তে উঠে পড়ল। হামাগুড়ি দিয়ে সোজা হাজির হল ডেকে। স্টিমার ছাড়ার ঘণ্টা পড়ল। ঘাট ছেড়ে স্টিমার মাঝ নদীতে পড়ল। স্যামির স্টিমারে চড়ার স্বপ্ন সফল হল। হামাগুড়ি দিয়ে ডেকের তলা থেকে বেরিয়ে এসে প্রাণভরে দেখতে লাগল প্রকৃতির অপরূপ শোভা। মুষলধারে শুরু হল বৃষ্টি। হামাগুড়ি দিয়ে ফের ঢুকল ডেকের তলায়। কিন্তু পা-জোড়া বেরিয়ে রইল। একটি খালাসি দেখতে পেয়ে হিড়-হিড় করে তাকে টেনে বের করল। আর ঠিক পরের ঘাটেই স্টিমার থেকে নামিয়ে দিল। হ্যাঁ, মার্ক টোয়েনের “দি অ্যাডভেঞ্চার্স অব টম সইয়ার” বইয়ের বেশীর ভাগ পাঠকই যা অনুমান করেন সেটাই ঠিক—স্যাম ক্লিমেন্সই টম সইয়ার—একেবারে হুবহু এক।

ঘটনার বিপুল বৈচিত্র্যের যে নক্ষত্র-দীপ্তিতে মার্ক টোয়েনের জীবনের আকাশ ঝলমল করে, তারই প্রতিফলন আমরা দেখি তার সাহিত্য-কৃতিতে। Gilded Edge, The Adventures of Tom Sawyer, Huckleberry Fin, Life on the Mississipi, The Innocents Abroad, A Tramp Abroad, Roughing it প্রভৃতি বইয়ের পাতা ওল্টালে তার বিচিত্র রস ও রসিকতার অন্তরালে মার্ক টোয়েনের কটাক্ষ-রসায়িত হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি কোন চক্ষুষ্মান পাঠকেরই দৃষ্টিকে এড়িয়ে যেতে পারে না।

বিচিত্র মার্ক টোয়েনের জীবনের ইতিহাস। আট বছর ছাপাখানার শিক্ষানবীশ, চার বছর মিসিসিপি নদীতে স্টিমারের পাইলট, নেভাদার দুর্গম অঞ্চলে খনির সন্ধানে অক্লান্ত অভিযাত্রী, ভার্জিনিয়া সিটিতে সংবাদপত্রের প্রতিবেদক হিসাবে আর্থিক স্বচ্ছলতা ও প্রতিষ্ঠা লাভ, ক্যালিফোর্নিয়ার অভিজাত মহলে যাতায়াত ও সাহিত্য-রচনার পাথেয় সঞ্চয় চুয়াত্তর বছরের দীর্ঘ জীবন বৈচিত্র্যে ও সাফল্যে সমান সমুজ্জ্বল। চল্লিশ বছর ধরে তার সৃষ্টিশীল লেখনী থেকে অজস্র ধারায় ঝড়ে পড়েছে উপন্যাস, ছোট গল্প, ভ্রমণ-কাহিনী ও রম্যরচনার রসমধুর ফসল। লেখনীর মত তার রসনায়ও ছিল নিকষে কণক-দীপ্তির আশ্চর্য বিচ্ছুরণ সভাকক্ষে বক্তা হিসাবে যেমন ছিলেন জনপ্রিয়, তেমনি ছিলেন ভোজসভার বৈঠকী বাচন-ভঙ্গীতে পারঙ্গম। ছিলেন একাধারে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের সুহৃদ, অনেক রাজার সহচর, বিশ্বপর্যটক, খ্যাতিমান গল্পকার, প্রেমিক স্বামী ও স্নেহময় পিতা।

অনেকের মতেই মার্ক টোয়েন আমেরিকার সাহিত্য-কুল-তিলক। “A man, a very great man, a national monument.” আমেরিকার নোবেল-পুরুস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন, “হাবেরি ফিন” থেকেই মার্কিন সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়েছে। তাঁর সাহিত্য-কীর্তির সমালোচনায় অগ্রসর হবার আগে জনৈক বিদগ্ধ সমালোচকের সতর্ক-বাণী অবশ্য স্মর্তব্য: “Twain is a dangerous man to write about. Unless you approach him With a sense of humour, you are lost. You cannot dissect a humorist upon a table. Your first stroke will kill him and make him a tragedian. You must come to Twain with a smile. That is his prerogative: that he can make you do so or fail. A great American critic wrote a study of Twain which was brilliant. The only trouble With it was he thought he was describing somebody else-himself, probably. The critie did not have a sense of humour, and his error was comparable to that of the tone-deaf critic who wrote on Beethoven God forbid that I should try to dissect Mark Twain. “ঈশ্বর দয়া করুন, সে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় যেন আমরাও না ব্রতী হই। তার পরিবর্তে মার্ক টোয়েনের প্রথম বিখ্যাত গল্প “কালাভেরাস জেলার কুখ্যাত লাফানে ব্যাঙ” থেকে শুরু করে “যে-মানুষ হ্যাড্‌ লিবুগ-এর চরিত্র হনন করেছিল” পর্যন্ত মোট তেতাল্লিশটি গল্পের পূর্ণাঙ্গ ভাষান্তর আমরা রসিক পাঠকদের সামনে উপস্থিত করলাম। এই সব গল্পের গুণাগুণ যার যার মনের নিকষ-পাষাণে ঘসে তারাই পরখ করে দেখুন। আমরা শুধু প্রসঙ্গত এইটুকুই বলতে পারি উল্লিখিত দুটি বিশ্ববিখ্যাত গল্প ছাড়াও “Cannibalism in the cars.” “Legend of Capitolive Venus.” “The Esquimau Maiden’s Romance” “The Death Disk.” “Was it Heaven or Hell.” ও “A Dog’s Tale”-এর মত গল্প কোন দেশের সাহিত্যের খুব বেশী লেখা হয় নি। একটি উদ্ধৃতি দিয়েই এ-প্রসঙ্গ শেষ করছি: “His stories are an important part of our literary heritage…Twain is our writer closest to folklore, our teller of fairy tales. The Jumping Frog story is a living American fairy tale acted out annually in Calaveras Country…Who are our short-story writers? Irving, Hawtharne, Poe. James, Melville, O. Henry, Bret Harte, Hemingway, Faulkner, Porter… Twain ranks high among them.

এবার মার্ক টোয়েন প্রসঙ্গের শেষ কথা—একটি মহৎ জীবনের অবসান মুহূর্তের কথা। তাঁর জীবনীকার আলবার্ট বিজেলো পাইন-এর জবানীতেই সে বিবরণ শোনা যাক … ১৯১০ খৃস্টাব্দের ২১শে এপ্রিল সকাল বেলা। তাঁর মন তখনও পর্যন্ত বেশ পরিষ্কার। বিছানায় শুয়ে নিজের বই থেকে খানিকটা পড়লেন। আমাকে বললেন দুটি অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি ফেলে দিতে। তাঁকে সান্ত্বনা দিলাম। তিনি আমার হাতটা চেপে ধরলেন। আমার প্রতি এই তাঁর শেষ কথা। … সারাটা বিকেল তন্দ্রায় ডুবে রইলেন; ক্রমে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলন; আর কখনও আমাদের দেখলেন না। সাড়ে ছ’টা নাগাদ ডাঃ কুইণ্টার্ড লক্ষ্য করলেন, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমেই মৃদু হয়ে আসছে। যন্ত্রণার চিহ্নমাত্র নেই। মাথাটা একপাশে হেলে পড়ল; একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস কাঁপতে কাঁপতে বাতাসে মিলিয়ে গেল— চুয়াত্তরটি ঘটনাবহুল বছর ধরে যে শ্বাস-প্রশ্বাস বইছিল তা চিরকালের মত থেমে গেল!

পরিশেষে বলি, মার্ক টোয়েনের অনুকরণীয় তথা অসরল বাক্য-ভঙ্গীকে বাংলায় ভাষান্তরিত করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি; কতটা সফল হয়েছি সে বিচার পাঠকের। ভাষান্তরের অনিবার্য ত্রুটি যেন গল্পকারকে স্পর্শ না করে, আমার শুধু এইটুকুই প্রার্থনা।

“মার্ক টোয়েন গল্পসমগ্র” প্রকাশ প্রসঙ্গে বন্ধুবর ডক্টর বিষ্ণু বসুর সহায়তার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি; কল্যাণীয়া ঈশিতার সহায়তার কথাও এখানে উল্লেখ্য।

—শ্রীম

৷৷ সুদৰ্শন ৷৷

৭৮/১২, আর. কে. চ্যাটার্জি রোড,

কলকাতা-৪২