সকালেও দেখা গেল বাড়ি যাওয়ার কোনও উদ্যোগ করছে না ফকির। পিয়াও তাড়া দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল নাঃ যতক্ষণ এই ডলফিনগুলোর সঙ্গে কাটাতে পারে ততই ওর ভাল।
খানিকটা বেলায় জল ফের বাড়তে শুরু করা পর্যন্ত দহটার মধ্যেই রয়ে গেল প্রাণীগুলো। তারপর আবার আধঘণ্টা যেতে না যেতেই উধাও হয়ে গেল–ঠিক আগের দিনের মতো। তফাত শুধু জোয়ার আসার সময়ের।
তা হলে, এখন যেটা জানা বাকি রয়ে গেল তা হল এখান থেকে বেরিয়ে এরা যায় কোথায়। ফকির হয়তো জানলেও জানতে পারে। নানারকম ইশারা আর অঙ্গভঙ্গি করে অবশেষে ফকিরকে ওর প্রশ্নটা বোঝাতে পারল পিয়া: এই নৌকো করে কি ডলফিনগুলোর পেছন পেছন যাওয়া যাবে? সাগ্রহে মাথা নাড়ল ফকির, সঙ্গে সঙ্গে নোঙর তুলে ফেলল।
দহটা ছেড়ে যখন বেরোল ওরা, তখনও জোয়ারের জল ঢুকছে। ফলে স্রোতের টানে নৌকোর গতিও বাড়ল খানিকটা। গর্জনতলা পেছনে ফেলে একটা মোহনায় এসে পৌঁছল ওরা। নৌকোর গলুইয়ে দাঁড়িয়ে পিয়া লক্ষ করল থইথই জোয়ারে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে চারপাশের দ্বীপগুলো।
দূরবিনে চোখ রেখে সামনে অনেকটা দূরে একবার জলের ওপর এক জোড়া পাখনা দেখতে পেল পিয়া। কিন্তু মোহনা পেরিয়ে যেতে যেতেই সেগুলির আর কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। তবে ফকিরকে দেখে মনে হল ও ঠিক জানে কোথায় যেতে হবে। নির্দ্বিধায় ডিঙির মুখ ঘুরিয়ে প্রথমে একটা বড় খাঁড়িতে পড়ল, সেখান থেকে আবার ঢুকল সরু একটা খালে। খানিক যাওয়ার পর হঠাৎ দাঁড় নামিয়ে ইশারা করল পাড়ের দিকে। দূরবিন সমেত মুখ ফিরিয়ে পিয়া দেখল তিনটে কুমির শুয়ে আছে কাদার ওপর। আগে চোখে পড়েনি কারণ এতক্ষণ ও শুধু জলের দিকেই মনোযোগ দিয়েছিল। ও আন্দাজ করল এদেরও হয়তো ফকির আগে এই জায়গায় দেখেছে। চোখের সামনেই শুয়ে ছিল তিনটে কুমির, কিন্তু কাদামাখা শরীরগুলো এমনভাবে চারপাশের সঙ্গে মিশেছিল যে প্রাণীগুলো কত বড় সেটাও ঠিক ভাল করে বোঝা যাচ্ছিল না। একটা কুমির আবার হাঁ করে ছিল। এত বড় রাক্ষুসে হাঁ, যে পিয়ার মনে হল দাঁড়ানো অবস্থায় গোটা একটা মানুষ তার মধ্যে ঢুকে যাবে–অন্তত ওর নিজের মাপের একটা লোক তো বটেই।
এই খালটা তুলনায় একটু সরু, ফলে এখন যদি ভাটার সময় হত, ওই কুমিরগুলোর খুব কাছ দিয়ে যেতে হত ওদের। কিন্তু জোয়ার থাকার ফলে অনেকটা দূরে আছে এখন প্রাণীগুলো পাড়ের বেশ খানিকটা ওপরের দিকে। নৌকোটা ওদের নজরে পড়েছে বলে মনে হল না, কিন্তু খানিক পরে দূরবিন ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে পিয়া লক্ষ করল মাত্র দুটো কুমির শুয়ে আছে এখন সেখানে। তিন নম্বরটা কখন পিছলে নেমে গেছে জলে। কাদার ওপর দিয়ে তার হেঁচড়ে নামার ফলে যে লম্বাটে গর্তটা তৈরি হয়েছে সেটা এর মধ্যেই ভরাট হয়ে যেতেও শুরু করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আর কোনও চিহ্ন রইল না দাগটার; পাড়ের পলি ফের যেমন কে তেমন–আগের মতোই মসৃণ, চকচকে।
হঠাৎ টুটুল একটা চিৎকার করে হাত তুলে কী একটা দেখাল সামনের দিকে। চট করে দূরবিন ঘুরিয়ে পিয়া একটা ডলফিনের লেজ এক ঝলক দেখতে পেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল সেটা জলের তলায়। কুমির দেখতে গিয়ে খামখা সময় নষ্ট করেছে বলে পিয়ার একটু রাগ হল নিজের ওপর। কিন্তু মিনিট খানেক পরেই আবার দেখা গেল একটা লেজ–জলের ওপরে একেবারে খাড়া যেন মাথার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডলফিনটা। তার পরেই আরও এক জোড়া লেজ দেখা গেল সেটার পাশে, একইরকম খাড়া হয়ে আছে জলের ওপরে। পিয়া চিনতে পারল, সেই মা আর ছানা ডলফিনটা–ওই দহের মধ্যে যাদের দেখেছিল। জল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজারো ছোট ছোট খাঁড়ির সৃষ্টি হয়েছে। চারপাশে, আশেপাশের দ্বীপগুলোতে ডাঙার মধ্যে বেশ খানিকটা করে ঢুকে গেছে সেগুলো। সেরকমই একটা খাঁড়িতে ঢুকে খাবার খুঁজছে ডলফিনগুলো। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে খুবই কম গভীরতা খাড়িটার, এমনকী ফকিরের নৌকোও ঢুকবে না সেখানে।
তবে ডলফিনগুলো ওখানে কী করছে চোখ বুজে সেটা বলে দিতে পারে পিয়া: এক দল মাছকে তাড়া করে নিয়ে ঢুকেছে ওরা ওই অগভীর জলে, আর মাছগুলো ওদের হাত থেকে পালাবার ব্যর্থ চেষ্টায় গিয়ে লুকিয়েছে কাদার মধ্যে। তারপর খরগোশ যেমন করে ক্ষেতের থেকে গাজর তুলে খায়, অনেকটা সেই ভাবে জলের নীচে কাদা থেকে মাছ তুলে তুলে খাচ্ছে ডলফিনগুলো।
ওর এত দিনের অভিজ্ঞতায় একবারই মাত্র এই দৃশ্যের ব্যতিক্রম দেখেছে পিয়া। ইরাবডিড নদীতে। সেখানে তখন একটা সার্ভের কাজ চলছিল। তারই মধ্যে খানিকটা সময় বের করে নিয়ে মান্দালয়ের উত্তরের এক গ্রামে দুই জেলের কাছে গিয়েছিল ওরা। ওরই চেনা আরেকজন সিটোলজিস্ট বলে দিয়েছিল এই জেলেদের কথা। বলেছিল, ওদের সঙ্গে গেলে এমন এক অভিজ্ঞতা হবে পিয়ার, নিজের চোখে দেখেও যা বিশ্বাস করা কঠিন।
সেই দুই জেলের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেল তারা আসলে বাবা আর ছেলে। বাবা মাঝবয়সি, আর ছেলের বয়স বড়জোর চোদ্দো কি পনেরো। দুপুর এগারোটা নাগাদ তাদের মাছধরা ডিঙিতে চড়ে বসল পিয়া আর ওর দোভাষী। মাপে সে ডিঙিটা মোটামুটি এই ফকিরের নৌকোরই সমান, কিন্তু কোনও ছই ছিল না সেটাতে। সেই এগারোটার সময়ই এত গরম সেখানে যে নদীর জল পর্যন্ত মনে হচ্ছিল ঝিম ধরে আছে, বিশেষ কোনও নড়াচড়া নজরে আসছে না। পিয়া আশ্বস্ত হল দেখে যে খুব একটা দুরে ওদের যেতে হবে না। পাড় থেকে নদীর ভেতরে মিটার বিশেক যাওয়ার পরেই বয়স্ক লোকটি একটা লাঠি বের করে সেটা দিয়ে নৌকোর গায়ে বাড়ি মারতে লাগল। মিনিট কয়েকের মধ্যে একটা মসৃণ চকচকে পাখনা দেখা গেল জলের ওপরে। একটু পরে আরও কয়েকটা পাখনা ভেসে উঠল আশেপাশে। কমবয়সি জেলেটি তখন মাছ ধরার জালটা নিয়ে সেটার ধারে ধারে বাঁধা ধাতুর টুকরোগুলোতে ঝম ঝম করে আওয়াজ করতে শুরু করল। সেই শব্দ শুনে দল ছেড়ে বেরিয়ে এল দুটো ডলফিন। বাকিরা যে জায়গায় ছিল সেখানেই রয়ে গেল, আর এই জোড়াটা এগিয়ে এল নৌকোর খুব কাছে। ডিঙির মুখের কয়েক মিটার দূরে এসে হঠাৎ গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল ডলফিন দুটো, যেন একটা আরেকটার লেজ ধরার চেষ্টা করছে। দোভাষীর মাধ্যমে জেলেরা বোঝাল যে এক দল মাছকে ঘিরে ধরে নৌকোর দিকে নিয়ে আসছে ডলফিন দুটো।
বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে দেখতে লাগল জেলে দু’জন। একটু পরে কমবয়সি জেলেটি উঠে দাঁড়াল। মুখ দিয়ে গুবগুব একটা আওয়াজ করে মাথার ওপর দু’-এক পাক ঘুরিয়ে নিয়ে জালটা ছুঁড়ে দিল জলে। ডলফিন দুটো যেখানে বৃত্তাকারে পাক খাচ্ছিল, ঠিক তার কেন্দ্রে গিয়ে পড়ল জালটা। জাল ডুবতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বুজকুড়ি উঠতে লাগল জলে। দু-একটা ছোট ছোট রুপোলি মাছ লাফিয়ে উঠল, আর ডলফিনগুলো আরও দ্রুত সাঁতরাতে লাগল, ক্রমশ ছোট করে আনতে লাগল পাক খাওয়ার বৃত্তটা। দলের বাকি ডলফিনগুলোও এবার যোগ দিল ওই দুটোর সঙ্গে, তিরবেগে ঘুরতে থাকল জালের চারদিকে, লেজের বাড়ি মারতে লাগল জলে ছড়িয়ে পড়া মাছগুলোকে জালের কাছাকাছি তাড়িয়ে আনার জন্য।
দুই জেলে এবার টেনে তুলল জালটা, সঙ্গে সঙ্গে খাবি খাওয়া কিলবিলে একটা রুপোলি পিণ্ড যেন ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল নৌকোর ওপর। মনে হচ্ছিল যেন একটা পিনাটা ফাটানো হয়েছে, আর প্রচুর ঝিলমিলে কাগজ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ডলফিনগুলোও এর মধ্যে তাদের ভোজ শুরু করে দিয়েছে। জালটা যখন জলে ডুবছিল তার চাপে বহু মাছ গিয়ে গেঁথে গিয়েছিল নদীর নীচের নরম মাটিতে। সেই জলের তলার ফসল তুলে এখন খাচ্ছে ওরা। মহা উৎসাহে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই মাছগুলির ওপর, মাথা নিচু করে লেজ শূন্যে তুলে শিকার ধরছে; আর জলের ওপরে মনে হচ্ছে তাদের কিলবিলে লেজের একটা ছোট জঙ্গল তৈরি হয়েছে।
একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল পিয়া এই দৃশ্য দেখে। মানুষ এবং বন্যপ্রাণীদের পরস্পরনির্ভরশীলতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু আছে? ভেবে পেল না ও। কত যে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে এই জলজীবনে তার কোনও সীমা পরিসীমা নেই।