রাতে এত গরম পড়েছিল যে মাঝখানে একবার উঠে গিয়ে কেবিনের দরজাটা খুলে দিল কানাই–যদি হাওয়া ঢোকে খানিকটা। তারপর দরজা খোলা রেখেই আবার গিয়ে শুল বাঙ্কের ওপর। পাল্লার ফাঁক দিয়ে বাইরের একটা ফালি চোখে পড়ছে। নরম জ্যোৎস্নায় গর্জনতলার গাছপালার হালকা ছায়া পড়েছে নদীর বুকে। রুপোলি জলের ওপর কালচে ছোপের মতো দেখাচ্ছে সেগুলোকে। কেবিনের ভেতরেও এসে পড়েছে এক চিলতে আলো। আগের দিন ছেড়ে রাখা কাদামাখা জামাকাপড়ের স্তূপটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে আলোতে।
ঘুম আসতে দেরি হচ্ছিল কানাইয়ের। আধো তন্দ্রায় চোখদুটো মাঝে মাঝে জড়িয়ে এলেও একটানা গভীর ঘুম কিছুতেই হল না। স্বপ্নের মধ্যে চমক লেগে বারবার তন্দ্রা ভেঙে যাচ্ছিল। ভোর চারটে পর্যন্ত এইভাবে চেষ্টা করে অবশেষে হাল ছেড়ে দিল কানাই। উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। লুঙ্গির কষিটা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে এল ডেকের ওপর। আশ্চর্য হয়ে দেখল হরেনও উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। পাশাপাশি রাখা দুটো আরাম-চেয়ারের একটায় বসে আছে। জড়ো করা দু’হাতের ওপর থুতনির ভর রেখে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। কানাইয়ের পায়ের আওয়াজে মাথা তুলল হরেন। ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারও ঘুম হল না?”
“নাঃ,” জবাব দিল কানাই। “আপনি কখন উঠলেন?”
“এই ঘণ্টাখানেক হবে।”
“ওদের নৌকোটা ফিরে আসছে কিনা তাই দেখছিলেন?”
গলার ভেতরে ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ করল হরেন। “হতেও পারে।”
“কিন্তু এখনও তো আলো ফোটেনি,” কানাই বলল। “এই রাতের বেলায় কি রাস্তা চিনে আসতে পারবে ওরা?”
“চাঁদটা দেখেছেন তো?” জিজ্ঞেস করল হরেন। “একেবারে জ্বলজ্বল করছে আজকে। আর এ জায়গার নদীনালা ফকির ওর হাতের তেলোর মতো চেনে। ফিরতে চাইলে ফিরতে ঠিকই পারত।”
হরেনের কথার ইঙ্গিতটা ঠিক ধরতে পারল না কানাই। “তার মানে?”
“হয়তো ও ফিরতে চায় না আজকে রাতে।” পূর্ণ দৃষ্টিতে কানাইয়ের চোখের দিকে তাকাল হরেন। ধীরে ধীরে হালকা একটা হাসি ছড়িয়ে গেল ওর মুখে। বলল, “কানাইবাবু, আপনি তো অনেক জায়গা ঘুরেছেন, অনেক কিছু দেখেছেন। ভালবাসায় পড়লে মানুষের যে কী হয় সে কি আপনি জানেন না?”
বুকের ওপর জোরালো একটা ঘুষির মতো তীব্রতায় কানাইকে ধাক্কা দিল প্রশ্নটা–তক্ষুনি কোনও জবাব খুঁজে পেল না বলে শুধু নয়, এই রকম একটা কথা হরেনের স্বভাবের সঙ্গে কিছুতেই যেন মিল খায় না, তাই কেমন যেন অদ্ভুত লাগল কানাইয়ের।
জিজ্ঞেস করল, “সত্যি সত্যি এরকম কিছু হয়েছে বলে মনে হয় আপনার?”
হরেন হাসল। “আপনি কি জেনেশুনে অন্ধ সাজার চেষ্টা করছেন কানাইবাবু? নাকি ফকিরের মতো একটা অশিক্ষিত মানুষও যে প্রেমে পড়তে পারে সেটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না?”
বিরক্ত হল কানাই। “এ কথা কেন বলছেন হরেনদা? আর এরকম কিছু আমি ভাবতেই বা যাব কেন?”
“ভাবলে আশ্চর্য হব না,” শান্ত গলায় বলল হরেন। “এরকম চিন্তা লোকের মনে আসতে আমি আগেও দেখেছি। সত্যি কথা বলতে কী, আপনার মেসোকেই দেখেছি।”
“মেসো? মানে নির্মল সারের কথা বলছেন আপনি?”
“আজ্ঞে। সেই যে রাতের বেলায় আমার নৌকোয় উনি আর আমি মরিচঝাঁপিতে গিয়ে উঠেছিলাম, সে কথা জানেন তো? আপনি কি ভেবেছেন শুধু ঝড়ের টানেই ওখানে গিয়ে ঠেকেছিলাম আমরা? তা নয়।”
“তার মানে?”
“কুসুম আর আমি যে একই গাঁয়ের লোক সে কথা তো আপনি জানেন কানাইবাবু। আমার থেকে প্রায় বছর ছয় সাতের ছোট ছিল কুসুম। যখন আমার বিয়ে হয়, ও তখন একেবারে ছেলেমানুষ। আমার বয়স তখন ছিল চোদ্দো। আমাদের বিয়ে-শাদির সব কিছু তো বাড়ির বড়রাই ঠিক করে, আর এ ব্যাপারে আমার নিজের কোনও মতামতও ছিল না। তো, কুসুমের বাবাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। মাঝে মধ্যেই ওদের ডিঙিতে টুকটাক কাজ করতে যেতাম। যেবার ওর বাবাকে বাঘে ধরল তখনও আমি ছিলাম ওখানে। কুসুমের সঙ্গে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে চোখের সামনে দেখেছিলাম পুরো ঘটনাটা। সেই থেকেই কেমন যেন মনে হত ওর আর ওর মায়ের দেখাশোনা করাটা আমারই দায়িত্ব। অবশ্য খুব বিশেষ কিছু যে করতে পারতাম তাও নয়। আমার তখন কতই বা বয়েস? মেরেকেটে কুড়ি। নিজের একটা সংসার আছে, বৌ বাচ্চা আছে। এদিকে কুসুমের মা তখন দিলীপের কাছে কাজের খোঁজ করছে। আমাকে বলেছিল সে কথা। আমি তো শুনেই বুঝেছি ব্যাপার সুবিধের নয়। নানাভাবে সাবধান করার চেষ্টা করলাম। কী কাজ দিলীপ দিতে পারে সেটাও বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার কথা শুনলে তো। কতটুকুই বা খবর রাখত বেচারি এই দুনিয়াটার? এইসব ব্যাপার-স্যাপার ওর কল্পনারও বাইরে ছিল। তারপর চলে যখন গেল শেষ পর্যন্ত, আমার তখন আরও বেশি করে মনে হত লাগল কুসুমের দেখাশোনা আমাকেই করতে হবে। সেজন্যেই ওকে লুসিবাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম আমি–আপনার মাসির কাছে। সেখানেও যখন দেখলাম দিলীপের নাগাল পৌঁছেছে, তখন আমি ওকে লুসিবাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেলাম। একেবারে ভাটির দেশের বাইরে যাতে চলে যেতে পারে সে ব্যবস্থা করে দিলাম। তবে আমি তো আমার মতো করে ভেবেছিলাম ভেবেছিলাম কুসুমকে আমি আড়াল করে রাখছি, দূরে সরিয়ে রাখছি সব বিপদ আপদ থেকে; আসলে কিন্তু কুসুমের মনের জোর ছিল আমার থেকে অনেক বেশি। আমার কেন, কারওর পাহারাদারিরই কোনও দরকার ছিল না ওর। মাকে খুঁজতে যাওয়ার জন্য যেদিন ওকে ক্যানিং স্টেশনে নিয়ে গেলাম সেই দিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম সেটা। ট্রেনে তুলে দেওয়ার আগে হঠাৎ আমার মনে হল আর হয়তো জীবনে কোনওদিন ওর সঙ্গে দেখা হবে না। ওকে যেতে বারণ করলাম আমি। বার বার করে বললাম ফিরে আসতে আমার সঙ্গে। সত্যি কথা বলব–আমার কেমন ভয় করছিল। একা একটা মেয়ে অজানা অচেনা জায়গায় কোথায় ঘুরে ঘুরে বেড়াবে, কখন কী বিপদ হবে কে বলতে পারে। অনেক করে মানা করলাম। এমনকী বললাম আমার বউ-বাচ্চাকে ছেড়ে দেব, ওকে বিয়ে করে একসঙ্গে থাকব। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওর মন যা চেয়েছে সে ও করবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। করলও তাই শেষ পর্যন্ত। এখনও ওকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার সময়কার ছবিটা আমার চোখে ভাসে। ফ্রক পরা, চুলগুলো তখনও ছোট ছোট বড় মেয়েমানুষ নয়, একটা বাচ্চার মতো চেহারা। ট্রেনটা চলে গেল, কিন্তু সে ছবিটা রয়ে গেল আমার মনের মধ্যে।
“তার প্রায় বছর আষ্টেক কেটে যাওয়ার পর ঘটল মরিচঝাঁপির ঘটনা। নানারকম গুজব কানে আসত তখন। শুনতে পেলাম রিফিউজিরা এসে উঠেছে ওখানে। দখল করে বসেছে দ্বীপটা। কানাঘুষোয় শুনলাম আমাদের কুসুমও নাকি আছে ওই রিফিউজিদের সঙ্গে। বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে আবার ভাটির দেশে। সঙ্গে একটা বাচ্চা। ও কোথায় আছে সেটা খুঁজে বের করলাম আমি। ডিঙিতে করে ওর ঘরের পাশ দিয়ে কয়েকবার যাতায়াত করলাম, কিন্তু কিছুতেই সাহস করে গিয়ে দেখা করে উঠতে পারলাম না। যেদিন আপনার মেসোকে নিয়ে কুমিরমারি গেলাম, সেদিন ওর কথাই আমি ভাবছিলাম সর্বক্ষণ। কত কাছ থেকে এসে ঘুরে যাচ্ছি, বার বার সে কথাই মনে হচ্ছিল আমার। তারপর ফেরার পথে সেই ঝড় উঠল, বনবিবির আশীর্বাদের মতো।
“সেইদিন থেকে আমি ঘুরে ফিরে বারবার যেতে লাগলাম মরিচঝাঁপিতে। আপনার মেসোকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার অছিলায় চলে যেতাম, উনিও যেতেন বারবার, আমার অছিলায়। একটা জিনিস খেয়াল করলাম–আমি যেমন সবসময় কুসুমের কথা ভাবতাম, উনিও সেরকম ওর কথা না ভেবে থাকতে পারতেন না। আমার মতো ওনারও যেন রক্তের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল কুসুম। ওর নাম শুনলেই চঞ্চল হয়ে উঠতেন উনি, হাঁটাচলা বদলে যেত, মুখে যেন কথার খই ফুটত। খুব কথা বলতে ভালবাসতেন আপনার মেসো। আর আমার আবার মুখে বেশি কথা আসত না। আমি বুঝতে পারতাম এটা-ওটা নানারকমের গল্প-কাহিনি বলে ওকে বশ করার চেষ্টা করছেন উনি। আমার সেদিক থেকে দেওয়ার কিছুই ছিল না–শুধু চোখের দেখাটুকু ছাড়া। শেষ পর্যন্ত কিন্তু দু’জনের মধ্যে থেকে আমাকেই বেছে নিল কুসুম।
“হামলার আগের রাত্তিরে, বুঝলেন কানাইবাবু, আপনার মেসো যখন ওনার শেষ কথাগুলো লিখছিলেন ওই খাতাটায়, কুসুম আমাকে বলল, সারকে আরেকটু সময় দাও; চলো আমরা বাইরে যাই। ও আমাকে নিয়ে গেল আমার নৌকোয়। সেখানেই প্রমাণ দিল ওর ভালবাসার একটা পুরুষ মানুষ যা চাইতে পারে, সব চাহিদা পূরণ করে দিল ও। নদীতে ভরা জোয়ার তখন। ঢেউয়ের মুখে অল্প দোল খাচ্ছিল’ বাদাবনের আড়ালে লুকিয়ে রাখা আমার ডিঙি। আমরা গিয়ে উঠলাম তার ওপর, আমার গামছা দিয়ে ওর গোড়ালি থেকে মুছিয়ে দিলাম কাদা। আমার পা দুটো কুসুম ওর দু’হাতের মধ্যে নিয়ে ভাল করে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল। তারপর যেন একটা বাঁধ ভেঙে গেল। জলের মতো গলে গিয়ে মিশে গেল আমাদের শরীরদুটো–নদী যেমন সাগরে গিয়ে মেশে, সেরকম। মুখ ফুটে কেউ কাউকেই বলিনি কিছুই, বলার কিছু ছিলও না। সব কথাই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল আমাদের শরীরের ওমে। কথা কিছু ছিল না, শুধু মিশে যাওয়া ছিল–মিঠে জল আর লোনা জলের মতো। আর ছিল জোয়ার-ভাটার ঢেউয়ের মতো ওঠাপড়া। আর কিচ্ছু না।”