» » ফেরাউনের গুপ্তধন

বর্ণাকার

অনেক রাত। তারা এমন এক স্থানে এসে পৌঁছল যেখানে পানি আছে। ঘোড়াকে পানি পান করানো এবং একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য ঘোড়া থামালো রহিম। কারণ সে জানতো, এর পর বহুদূর পর্যন্ত আর পানি পাওয়া যাবে না। তাছাড়া তারা এতদূর চলে এসেছে যে, তার মনে হলো, এখন আর ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই।

আলিসা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসায় তার খোঁজে লোক বেরুবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সে যে পালিয়েছে এ কথা জানতে সময় লাগবে তাদের। তার ওপর পালিয়ে সে কোন দিকে এবং কার সাথে গেছে কারো জানা নেই। রাতের অন্ধকারে তারা যে এদিকেই এসেছে এ খবরও জানা থাকার কথা নয় অনুসন্ধানী দলের। এ সব বিবেচনা করেই সে আলিসাকে বললো, ‘আজ রাতের মত এসো আমরা এখানেই বিশ্রাম নেই। সকালে অন্ধকার থাকতেই আবার রওনা হয়ে যাবো।’

‘তুমি বায়তুল মুকাদাসের রাস্তা চেনো?” আলিসা রহিমকে প্রশ্ন করলো।

তারা আক্রা থেকে বের হওয়ার সময় কোথায় যাবে তার কোন সিদ্ধান্তই নেয়নি। তাদের তখন উদ্দেশ্য ছিল একটাই, যে কান মূল্যে নিরাপদে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়া।

অলিসা বায়তুল মুকাদাসের নাম করলে রহিম বললো, ‘বায়তুল মূকাদাসে কেন? আমি তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে তোমার পিছু ধাওয়া করার কারো সাহসই হবে না।’

‘কোথায় নিয়ে যাবে?” আলিসা জিজ্ঞেস করলো।

“মিশরের দিকে!’ রহিম উত্তর করলো।

“মিশর?’ আলিসা বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, “সে তো মুসলমানদের দেশ, তারা তো আমাদের জীবিত রাখবে না।’

“মুসলমানরা খুবই সদয় জাতি। তুমি গেলেই দেখতে পাবে।”

“না!” আলিসা চমকে উঠে বলল, “মুসলমানদের আমি ভীষণ ভয় করি। শিশুকাল থেকেই শুনে আসছি মুসলমানরা জঘন্য জাতি। আমাদের মায়েরা শিশুদের ঘুম পাড়ানোর সময় ভয় দেখায়, ঘুমোও বাবু ঘুমোও। সাবধান, গোল করো না, ওই যে মুসলমানরা আসছে। টের পেলে ওরা আমাদের জবাই করে ফেলবে।’ না, রহিম, আমি মিশর যাবো না। মুসলমানদের আমি দারুণভাবে ভয় এবং ঘৃণা করি।”

আসলেই সে খুব ভয় পাচ্ছিল। ভয়ে সে রহিমকে জড়িয়ে ধরল, যেন মুসলমানরা তাকে জবাই করার জন্য এসে গেছে।

“বায়তুল মুকাদ্দাস নিয়ে চলো। সেখানে সম্মানিত পাদ্রীকে সাক্ষী রেখে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব।”

আলিসা রহিমের বুকে মুখ ঘষছিল, মাথা তুলে বলল, “বায়তুল মুকাদাস কোন দিকে? আমার দিক সব উলটাপালট হয়ে গেছে। তুমি বায়তুল মুকাদাস যাচ্ছে তো?”

‘আমি মিশরের দিকে যাচ্ছি।” রহিম আবারো আগের কথাই বললো।

‘না, তুমি মিশর যাবে না।’ আলিসা জিদ ধরলো এবং কাঁদতে লাগলো।

‘কেন, তুমি মুসলমানদের খুব বেশী ভয় করো, তাদের ঘৃণা করো?”

“হ্যাঁ, খুব বেশী ঘূণা করি।”

“আর আমার সঙ্গে তোমার ভালবাসা?”

‘ওকথা বলছো কেন?”

“তুমি জানো তোমাকে আমি আমার জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসি!”

“যদি আমি বলি, আমি মুসলমান! তখন তুমি কি করবো?”

‘তখন আমি হাসবো!” আলিসা বললে, “তোমার রসিকতা আমার বড্ড ভাল লাগে।”

‘আমি হাসি ঠাট্টা করছি না, আলিসা।” রহিম শান্ত স্বরে ধীরে সুস্থে বললো, ‘আমি আসলেই একজন মুসলমান! তুমি আমার কঠিন ত্যাগের কথা চিন্তা করো, তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কি না করেছি! শুধু তোমায় ভালবাসাই আমাকে এ ত্যাগ আজো দিয়ে যাচ্ছি।”

’কেমন কুরবানী?’ আলিসা বললো, “তুমি তো আগে থেকেই গৃহহীন, ভাগ্য বিড়ম্বিত এক যুবক। আমাকে নিয়ে সংসার গড়ে তুলতে গিয়ে নতুন করে তুমি আবার কি ত্যাগ করলে?”

‘না, তা নয়। আলিসা!’ রহিম বললে, “আমি এখন গৃহহীন হয়েছি, তুমি বাড়ী থেকে পালিয়েছ, আমার সাথে বিয়ে করে নতুন ঘর সংসার করবে। কিন্তু আমার তো কোন ঠিকানা হবে না। আমি আমার কঠিন দায়িত্ব থেকে আজ পলাতক। আমি আমার সৈন্য বিভাগ থেকেও বিচ্ছিন্ন। আমি মিশরের গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার। আক্রা শহরে গোয়েন্দাগিরী করতে এসে তোমার ভালবাসায় অন্ধ হয়ে আমি আমার দায়িত্বকে কুরবানী দিয়েছি, আমার কর্তব্য কোরবানী করেছি। আমার চাকরী, পদোন্নতি, উন্নতি, অগ্ৰগতি সব কোরবানী করেছি।’

“তুমি আমাকে বড্ড ভয় দেখাচ্ছ!” আলিসা হেসে বললো, “রাখো এসব হেয়ালীপনা। এখন ঘুমিয়ে যাও, আমি তোমাকে জাগিয়ে দিব।’

‘আমি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছি না। আলিসা!” রহিম বললো, “আমার নাম রহিম হাংগুর, আইলিমুর নয়। আমি তোমাকে ধোঁকার মধ্যে রাখতে চাই না। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, তোমাকে আমি যেখানেই রাখি, সুখে শান্তিতে রাখবো। তোমার বাবার বাড়ির মতো সুখ শান্তি হয়ত আমি দিতে পারব না, কিন্তু তোমাকে কোন কষ্ট করতে দেবো না। তোমাত্র জীবন আমি সুখ শান্তিতে ভরে দেবো।”

“আমাকে কি ইসলাম গ্ৰহণ করতে হবে?’ আলিসা জিজ্ঞেস করলো।

‘তাতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে?’ রহিম বললো, যদি তোমার আপত্তি থাকে। তবে এমন কথা আমার মুখ থেকে কোনদিন তুমি শুনতে পাবে না। আলিসা, এখন এসব কথা থাক, আর সময় নষ্ট না করে শুয়ে পড়ো। আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। কথা বলার সময় অনেক পাবো আমরা।”

রহিম নিজে শুয়ে পড়লে আলিসাও শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর আলিসা রহিমের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেল। কিন্তু তার মোটেই ঘুম আসছিল না, নানা রকম দুশ্চিন্তা তখন কিলবিল করছিল তার মাথায়।

রহিমের ঘুম ভাঙ্গলো। চারদিক তখন ফর্সা হয়ে গেছে। সে আতংকে উঠে বসলো। তার এত বেশী ঘুমানো উচিত হয়নি। সে, চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকালো। সেখানে ঘোড়াও নেই, আলিসাও নেই। সে আবারও এদিক-ওদিক দেখলো। শেষে এক টিলার ওপর দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালো। মরুভূমির শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়লো না। সে কয়েকবার আলিসা আলিসা বলে ডাকল, কোনই সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। সে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল।

কি ঘটতে পারে ধারনা করতে গিয়ে সে কোন কুল কিনারা পেল না। একবার মনে হলো, কোন লোক কি তাদের পিছু ধাওয়া করে এসেছিল? সে আলিসাকে ঘুমন্ত অবস্থায় উঠিয়ে নিয়ে গেছে? কিন্তু তাই বা কি করে হয়! তাহলে তো রমিহকে জীবিত রাখার কথা নয়! নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করতো বা নারী অপহরণকারী হিসেবে তাকেও ধরে নিয়ে যেতো।

সে খুবই অবাক হলো, লোকেরা আলিসাকে এমন চুপিসারে কেমন করে উঠিয়ে গেল যে, সে একটুও-টের পেল না! হঠাৎ আরেকটি চিন্তা মাথায় ঢুকতেই সে একটু ভয় পেয়ে গেল। আলিসা নিজেই পালিয়ে যায়নি তো! সে মুসলমান, এ কথা শোনার পর আলিসার পক্ষে পালিয়ে যাওয়া কি খুবই অসম্ভব কোন ব্যাপার!

আলিসা যেখানেই যাক বা তাকে কেউ উঠিয়েই নিয়ে যাক, রহিম এই ভেবে অস্থির হয়ে উঠলো যে, সে এখন কোথায় যাবে? আক্রা ফিরে যাওয়া ভীষণ বিপজ্জনক। কায়রো ফিরে যাওয়া আরো বিপজ্জনক। কারণ সে তার ফরজ দায়িত্ব পালন করেনি। তাছাড়া কমান্ডার ইমারনকেও সে কিছু বলে আসেনি। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সে সিদ্ধান্ত নিল, সে আক্রাও নয় কায়রোও নয়, সোজা ক্রাকে চলে যাবে। সেখানে গিয়ে বলবে, তাকে মুসলমান ও গোয়েন্দা বলে চিনে ফেলেছিল বলে কাউকে কিছু না বলেই সে পালিয়ে এসেছে। অবস্থা এমনই প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল যে, রেজাউল বা ইমরান কাউকে সে কোন সংবাদও দিতে পারেনি। তার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়ে গিয়েছিল।

অনেক ভেবে দেখল, এটাই সবচেয়ে ভালো কৈফিয়ত। কারণ কেউ এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করবে না, কেউ বলবে না, তোমার কথার যথার্থতা প্ৰমাণ করো, সাক্ষী পেশ করো।

রহিম পানি পান করে পায়ে হেঁটেই ক্রাকের দিকে যাত্রা করলো। আলিসার অনুপস্থিতিতে সে খুবই মর্মাহত ও বেদনাবোধ করছিল। তার আফসোস হচ্ছিল এই ভেবে, জীবনে আলিসার কোন খবর কি আর পাবো না। এই বিশাল মরুভূমিতে সে কেমন করে কোথায় হারিয়ে গেল!

সে অতি কষ্টে পায়ে হেঁটে মাইল তিনেক পথ মাত্র অতিক্রম করেছে। হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেল পেছনে। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে সে পেছনে তাকিয়ে দেখল, ধুলি ঝড় তুলেই তার দিকে ছুটে আসছে ঘোড়া।

সে এদিক-ওদিক দেখলো, কোথাও লুকানোর জায়গা নেই। সে জানতো না, এই আরোহী করা। আরোহীদের নিয়ে চিন্তার চেয়ে তার নিজেকে নিয়েই বেশী চিন্তা হলো। কি পরিচয় দেবে সে তার নিজের এই মরুভূমিতে বাহনহীন অবস্থায় সে কি করছে? সে কি খৃস্টান, না মুসলিম? খৃস্টান হলে সে ক্রাকের দিকে যাচ্ছে কেন? মুসলিম হলে খৃষ্টান অধূষিত মরু অঞ্চলে কি করছে সে?

সে ঘোড়ার রাস্তা থেকে একটু সরে গিয়ে হাঁটতে লাগলো। ঘোড়া নিকটবর্তী হলো। এবার সে ওদের চিনতে পারলো, ওরা ক্রাকের ক্রুসেড বাহিনীর সদস্য।

অশ্বারোহী বাহিনী মুহুর্তে তাকে ঘিরে ফেলল। সে নিরস্ত্ৰ, অসহায়। পালানোর কোন সুযোগই পেল না সে। আরোহীদের দিকে তাকালো সে। তাদের মধ্যে একজনকে সে চিনতে পারলো। এই সে সামরিক অফিসার, আলিসা যার বাগদত্তা। সে রহিমকে বললো, আমারও ধারণা ছিল যে, তুমি খৃস্টান নও।

তাকে ধরে ফেলা হলো। সে কোন রকম বাঁধাই দিল না তাদের। তারা তার হাত পিঠের দিকে শক্ত করে বেঁধে এক আরোহীর পেছনে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিল। ঘোড়া আক্রার দিকে চললো!

ঘটনাটি সেই সময়ের, যখন ইমরান রহিমের সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখলে সে সেখানে নেই। বণিকের চাকর ইমরানকে বলল তাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

ইমরান খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। রহিম গেল কোথায়? কোন সমস্যা দেখা দিলে প্রথমে তো রহিমের তার কাছেই আসার কথা! কিন্তু সে কেন তার কাছে এলো না?

এসব চিন্তা করতে করতে গির্জায় ফিরে এলো। এক অজানা আশংকায় দুরু দুরু করতে লাগল তার বুক।

(সমাপ্ত)