» » দুর্গম পাহাড়

বর্ণাকার

তারা এক বাক্যে সবাই এতে সম্মতি দিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বললো, যদি তুমি মঙ্গল মতে পালিয়ে যেতে পারো তবে লোহিত সাগরের তীরে গিয়ে পৌঁছতে চেষ্টা করবে। সেখানে সৈন্যদের টহল বাহিনীর জাহাজ ও নৌকা পাবে। তুমি সেখানে পৌঁছতে পারলে আমাদের উপর যে বিপদ এসেছে তা ওদের জানাতে পারবে।’

সঙ্গীদের একজন বললো, ‘আমার বিশ্বাস, এ খবর সেখানে পৌঁছাতে পারলে আমাদের মুক্তির কোন না কোন উপায় আল্লাহ করে দেবেন। নিশ্চয়ই এ ডাকাতদের ধরার জন্য অভিযান চালাবে আমাদের বাহিনী।’

“কিন্তু আমরা এখানে আছি তারা জানলো কি করে?’

‘ঠিক আপনারা এখানে আছেন আমাদের জানা ছিল না। আমরা জানতাম, সুলতান আইয়ুবী লোহিত সাগরের উপকূল নিরাপদ রাখার জন্য টহল বাহিনীর ব্যবস্থা রেখেছেন। সেই ধারনা থেকেই তারা এমন কথা বলেছে বলে আমার মনে হয়।

কিন্তু এখানে এসে আমি আপনাদের পেয়ে গেলাম।’

‘তারপর? তারপর কিভাবে পালালে তুমি সেই কথা বলো।’

‘ডাকাতরা সস্পদ ও মেয়ে মানুষ পেয়ে আনন্দে মাতাল হয়ে গেল। মদ পান করতে করতে নেশায় বিভোর হয়ে ঢুলতে লাগলো ওরা। জায়গাটা এমন দুর্গম যে, খুব বেশী পাহারার কথা ওরা ভাবেনি। তাছাড়া আমরা বলতে গেলে সবাই ছিলাম আহত, আমাদের পক্ষ থেকে কোন বিপদের আশঙ্কাও তাদের ছিল না।

একে একে মশাল নিভতে লাগলো। আলো কমতে লাগলো। এক সময় গভীর অন্ধকারে ডুবে গেল আমাদের গুহার মুখ।

অনেক কষ্টে গুহামুখের ঢাকনা সরানো গেল। সরানো ঠিক নয়, গুহামুখের ফাঁক গলে একজন মানুষ বেরোনোর ছিদ্র তৈরী হলো। সেই ফাঁক গলে অনেক কষ্টে বেরিয়ে এলাম আমি। তারপর চুপিসারে ঢুলুঢুলু পাহারাদারদের দৃষ্টি এড়িয়ে সরে এলাম খাঁড়া টিলাগুলোর কাছে।

সেই নিরাপদ জায়গাটিতে যাওয়ার জন্য একটি মাত্র সুড়ং পথ আছে। পথটি প্রশস্ত। ঘোড়াও পার করা যায় সেই পথে। কিন্তু সেখানে পাহারা থাকায় ওই পথ মাড়ানোর সাহস পেলাম না।

টিলাগুলো অনেক উঁচু এবং খাঁড়া হলেও তাতে বুনো লতার ঝোঁপ ছিল। অন্ধকারে সেই বুনো লতা বেয়ে টিলা পেরোনোর সুযোগ হয়েছিল বলেই আমি এখানে পালিয়ে আসতে পেরেছি।

কিন্তু টিলা পেরোনোই সেখানে একমাত্র বিপদ ছিল না। অন্ধকারে সেখান থেকে বেরোনোর কোন পথ জানা ছিল না আমার। মরুভূমিতে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজতে গিয়ে হন্যে হয়ে গেলাম। ঘুরে ফিরে দেখা গেল বার বার একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি।

আমি প্রাণপণে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। কোরআনের যেসব আয়াত মুখস্ত ছিল পড়তে লাগলাম। আল্লাহর রহমতে শেষ রাতের একটু আগে টিলার-গোলক ধাঁধা থেকে বেরিয়ে এলাম।

সমুদ্র কোন দিকে এ ব্যাপারেও কোন ধারণা ছিল না। আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে অনুমানে একদিকে হাঁটতে লাগলাম। যত জোরে সম্ভব হাঁটছিলাম আমি। সকাল হওয়ার আগেই পাহাড় ছেড়ে বহু দূরে চলে এলাম।

সারাদিন আল্লাহকে স্মরণ করে পথ চলতে লাগলাম। পথে কোন বস্তি বা কাফেলার দেখা পেলাম না। পালাবার সময় পানির একটা ছোট মশক ও সামান্য কিছু খেজুর সঙ্গে আনতে পেরেছিলাম। এতেই আমি বেঁচে গেলাম।

খুব বেশী ক্লান্ত হওয়ায়, আর ছুটতে পারছিলাম না। দুপুরের একটু পর এক বালির টিলার পাশে পড়ে গেলাম। টিলার ছায়ায় আমার ঘুম এসে গেল। যখন সূর্য ডুবতে বসেছে তখন আমার চোখ খুললো।

অন্ধকার আকাশে ফুটে উঠলো তারা! তারারা আমার দিক ঠিক করে দিল। বুঝলাম আমি এতোক্ষণ ঠিক পথেই এগিয়েছি। আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে আবার হাঁটা ধরলাম।

অনেকক্ষণ চলার পর সমুদ্রের সুবাস ও স্নিগ্ধতা অনুভব করলাম। আমি যেদিক থেকে বাতাস আসছিল সেদিকেই যাচ্ছিলাম।

আমার গতি ছিল খুবই মন্থর। কিছু দূর যাওয়ার পর একটু জিরিয়ে নিতাম। আবার পথ চলতাম। এভাবে সারা রাত চলার পর প্রভাতের কাছাকাছি সাগর তীরে এসে পৌঁছলাম।

আমার শরীর একদম ভেঙ্গে পড়েছিলো। আমি সাগরের পারে এক গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসলাম। তারপর কখন ঘুমিয়েছি মনে নেই।

অনেক বেলায় একজন লোক আমাকে জাগালো। দেখি সূর্য অনেক উপরে উঠে গেছে। চোখ মেলে লোকটির দিকে তাকালাম। লোকটি একজন সৈনিক।

সাগর তীরে একটি বড় নৌকাও দেখতে পেলাম। সে বিশাল নৌকাটিও সৈন্য ভর্তি। আমি সৈনিকটির কাছে আমার করুণ অবস্থার কারণ তুলে ধরলাম।

আমার মর্মান্তিক কাহিনী শুনে তিনি আমাকে কিস্তিতে তুলে নিলেন। খাদ্য ও পানীয় দিয়ে বললেন, তৃপ্তি সহকারে আহার করো।’

তারাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। বলেছে, তোমার এ কাহিনী আমাদের কমাণ্ডোারকে শোনাতে হবে।’

‘আমাদের পথ দেখানোর জন্য তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।’ এ্যাডমিরাল হিশামুদ্দিন বললেন, ‘কিন্তু তোমার যা অবস্থা দেখছি তাতে এক্ষুণি তুমি আমাদের সাথে যেতে পারবে না। ক্লান্তি তোমাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।’

‘আমি এক্ষুণি আপনার সাথে যেতে প্রস্তুত।’ লোকটি বললো, ‘আমি কেমন করে এখানে আরাম করবো? আমার সাথীরা এখন ডাকাতদের হাতে বন্দী। মুসলমান মেয়েরা পড়ে আছে দস্যুর কবলে। এই যাত্রায় যদি আমার মৃত্যুও হয় তবুও আমি যেতে রাজি।’

হিশামুদ্দিন বললেন, ‘কিন্তু তুমি মরে গেলে আমাদের পথ দেখাবে কে?’

‘আল্লাহ যখন আমাকে এই পর্যন্ত এনেছেন তখন আপনাদের পথ দেখানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত মারবেন না। আমার উপর এখন সবচেয়ে বড় ফরজ হচ্ছে, মজলুম মেয়েদেরকে আগে জালিমদের হাত থেকে বাঁচানো। আমি এই কঠিন দায়িত্ব পালনে জীবন দিতেও প্রস্তুত।’

‘ডাকাতদের সংখ্যা কত হবে?’

‘পাঁচশোর কিছু বেশী হবে।’ লোকটি উত্তর দিল।

হিশামুদ্দিন নৌবাহিনীর কমাণ্ডোারকে বললেন, ‘পাঁচশো সৈনিককে প্রস্তুত হতে বলো। তোমাদের সাথে এই অভিযানে আমিও যাবো।’

একে সঙ্গে নেয়ার দরকার নেই। এ লোক অচেনা পথে বিরতি নিয়ে ধীরে ধীরে এসেছে বলে আসতে বহু সময় নিয়ে ফেলেছে। আমার মনে হয় জায়গাটা আমি চিনে ফেলেছি। আমরা সন্ধ্যায় রওনা করলে মাঝ রাতের আগেই সেখানে পৌঁছে যেতে পারবো।’

কমাণ্ডোার বললো, ‘আমাদের সেনা প্রস্তুতি কেমন হবে? সবাই কি অশ্বারোহী হবে?’

‘না, আমার মনে হয় আমাদের সাথে একশ অশ্বারোহী নিলেই চলবে। বাকীরা হবে পদাতিক বাহিনী।’ হিশামুদ্দিন বললেন, ‘আমাদেরকে ওখানে কমাণ্ডোো আক্রমণ চালাতে হবে। সে জন্য ঠিকানা পর্যন্ত আমাদের নিরবতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করে যেতে হবে।’

‘তাহলে ঘোড়া কম নেয়াই ভাল। ঘোড়া যত বেশী হবে ততই শোরগোল ও শব্দ বেশী হবে।’ কমাণ্ডার সায় দিল।

‘আমি এই লোকের কাছ থেকে এখনই ঠিকানাটা আরো বিস্তারিতভাবে জেনে নিচ্ছি, তুমি সৈনিকদের তৈরী হতে বলো।’

‘কি ধরনের অস্ত্র সঙ্গে নেয়া দরকার বলে মনে করছেন আপনি?’

‘তীর তলোয়ার ছাড়াও ছোট মেনজানিক সঙ্গে নিতে হবে।’ হিশামুদ্দিন বললেন, ‘পেট্রোল হাঁড়ি এবং সলতেওয়ালা তীরও সঙ্গে নাও।’

‘না, আমি আপনাদের সঙ্গে যাবোই।’ লোকটি জেদের সুরে বললো।

‘ঠিক আছে, তুমি সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্রাম নাও। যাওয়ার সময় তোমাকে আমরা ডেকে নেবো।’

কমাণ্ডোার লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো হিশামুদ্দিন তাকে ডেকে বললেন, “আর সৈনিকদের বলে দিও, আমরা কোন ডাকাত দলের সাথে লড়াই করতে যাচ্ছি না। এরা সবাই খৃস্টান সেনা। একদল প্রশিক্ষিত খৃষ্টান সৈন্যের সাথে লড়াই হবে আমাদের।’

নৌবাহিনীর কমাণ্ডোার লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

দুর্গম পাহাড়ে ডাকাতদের সেই আস্তানা একটা সুরক্ষিত কেল্লার চেয়ে কম ছিল না। বরং তুলনামুলকভাবে কেল্লার চেয়েও সুরক্ষিত ও দৃঢ় ছিল।

সেখানে টিলার গোলাক ধাঁধা ছিল বর্ণনাতীত। রাস্তাগুলো এমন পেঁচানো যে, বাঁক ঘুরে একটু এগুলেই আবার বাঁক। টিলার পরে টিলা আর বাঁকের পরে বাক সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেয়। কোন পথ কোন দিকে গেছে বুঝা যায় না।

পথগুলো বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে আছে।

এই দুর্গম অঞ্চলে টিলার গোলক ধাঁধাঁর আড়ালে খৃষ্টানরা গোপন কামরা খোদাই করে বানিয়ে নিয়েছে তাদের ঘাঁটি। উট ও ঘোড়া রাখার জন্যও তারা গোপন জায়গা ঠিক করে নিয়েছিল।

হিশামুদ্দিনের পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা অতি সাবধানে মাঝরাতের আগেই সেখানে গিয়ে পৌঁছলো। খৃস্টানদের ধরা পড়ার ভয় মোটেই ছিল না। সে রকম ভয় থাকলে তার আশপাশে পাহারার ব্যবস্থা রাখতো।

সেনাপতি হিশামুদ্দিন অশ্বারোহী বাহিনীকে অনেক দূরে রাখলেন; যেন ঘোড়ার ডাক শত্রুদের কানে না যায়।

পদাতিক বাহিনীর কমাণ্ডোার কয়েকজন সৈন্য সঙ্গে নিয়ে টিলার এক গলির মধ্যে ঢুকে গেল। তারা ঘুরে ফিরে অনেক দূর অগ্রসর হওয়ার পর ঘোড়ার হালকা শব্দ তাদের কানে এলো। তিনি থেমে গেলেন এবং এক উঁচু টিলার ওপর গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

তিনি ছিলেন খুবই কুশলী গেরিলা কমাণ্ডোার। সন্তর্পনে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার কৌশল জানা ছিল তার। তিনি টিলার উপরে গিয়ে চারদিক নিরীক্ষণ করলেন।

টিলার উপরে বেশ চওড়া জায়গা। কোন দিক থেকে ঘোড়ার শব্দ এলো বুঝতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন তিনি। ফলে সেখান থেকে নেমে এলেন।

আবার চড়লেন গিয়ে অন্য টিলার উপরে। সেখান থেকে তিনি মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। শুনতে পেলেন মানুষের হুড়োহুড়ির শব্দ। কিন্তু নিচে কাউকে দেখতে পেলেন না।

সেখান থেকে নেমে তিনি এক গলিতে প্রবেশ করলেন। গলি পথে কিছু দূর এগুতেই তিনি কাছে কোথাও কারো কণ্ঠস্বর শুনলেন।

তিনি সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, শব্দ শুনেই আবার থেমে গেলেন। তিনি সৈন্যদের ইশারা করলেন। সৈন্যরা আরো সতর্ক হয়ে অত্র তাক করে সন্তর্পণে তার পিছনে চলতে লাগলো।

সামনেই একটা মোড়। দুই ব্যক্তি কথা বলতে বলতে মোড় ঘুরলো। তাদের কথা বলার ভঙ্গিতে বুঝা যাচ্ছে তারা দু’জনই মদে মাতাল। সৈন্যরা অন্ধকারে গা ঢাকা দিল।

যখন তারা সৈন্যদের কাছাকাছি হলো তখন তাদের বুকের পাশে তলোয়ার ঠেকিয়ে দুই সৈনিক বললো, ‘খামোশ, কোন কথা বলবে না।’

লোক দুটো ভড়কে গিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো তাদের দিকে। কমাণ্ডোার তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যদি একটু শব্দ করে। তবে মারা যাবে।’

নেশা ছুটে গেল দুই ডাকাতের। পরিস্থিতি বুঝতে অসুবিধা হলো না তাদের। কারণ তারা সাধারণ ডাকাত নয়, সামরিক বাহিনীর ট্রেনিং পাওয়া সৈনিক। তারা দুজনই চুপ মেরে গেল।

কমাণ্ডোার তাদেরকে সেখান থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। জায়গাটা গলিপথ থেকে সামান্যই দূরে। কমাণ্ডোার বললেন, ‘কোন চালাকি নয়, যা জানতে চাই ঠিক ঠিক জবাব দিতে হবে। কোন রকম ভুল ধরা পড়লে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করবো না। এবার বলো তোমরা কারা? এখানে কি করছো? কয়জন আছো? কোথায় তোমাদের মূল আস্তানা?’

মাতাল দু’জন প্রাণের মায়ায় সব প্রশ্নের সঠিক জবাব দিল। তাদের সাথীরা কোথায় আছে, কতজন আছে, তাদের সাথে কি কি অস্ত্র আছে সব বলে দিল।

কমাণ্ডোার বললো, “ঠিক আছে, তোমাদের কথা সত্য কিনা পরখ করবো, আমাদেরকে তোমাদের আস্তানায় নিয়ে চলো।’

ডাকাত দু’জন তাদেরকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল সেখানে, যেখানে তাদের সাথীরা আনন্দ ফুর্তি করছিল। কমাণ্ডোার নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখলেন তাদের।

তিনি বিস্মিত হলেন আস্তানার অবস্থা দেখে। এমন নির্মম ও নির্দয় মরুভূমি, যেখানে এলে জাহান্নামের দুঃসহ চিত্রের কথা মনে হয় সেই দুর্গম পাহাড়ের আড়ালে জান্নাতের মত আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করে নিয়েছে খৃস্টানরা। যেখানে পিপাসায় ছটফট করে মারা যাওয়ার ভয়ে কোন মানুষ পা রাখে না, সেখানে ওরা মদের আসর সাজিয়ে বসেছে।

মাতাল ডাকাতরা এদিক ওদিক এলোমেলোভাবে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। কেউ কেউ দল বেঁধে বসে বসে গান গাচ্ছে। একজন গাচ্ছে আর অন্যরা তাল দিচ্ছে তার সাথে।

মাঝখানে মাঠের মধ্যে জাজিম বিছানো। সেই জাজিমের ওপর নাচছে এক মেয়ে। মশাল জ্বলছে, আর সেই মশালের আলোয় তাকে দেখাচ্ছে অপূর্ব রূপবতী। যেন কোন পরী নাচছে।

‘অনেকে ভেতরে আছে।’ খৃস্টান বন্দীরা কমাণ্ডোারকে বললো, ‘তারা এখন মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে।’

‘বাহ, খুব মৌজে আছো তো! এ রকম আসর কি প্রতি রাতেই হয়?’

‘না, বড় কোন কাফেলা লুট করা গেলে সেই আনন্দ আমরা উপভোগ করি এভাবে উল্লাস করে। এবার কাফেলাটা বেশী বড় ছিল, তাই সবার তিন দিন উৎসব করার ঘোষণা দিয়েছেন।’

‘তোমাদের সংখ্যা ছয়শো বলেছিলে, কথাটা কি ঠিক?’

‘হ্যাঁ, প্রায় ছয়শো।’ তারা উত্তর দিল।

মদে মাতাল এক নাইট বেহুশ হয়ে পড়েছিল নর্তকীর জাজিমের ওপর। কমাণ্ডোার দূর থেকে ময়দানের দৃশ্য যতদূর সম্ভব দেখে নিলেন। মশালের আলো মধ্য মাঠে থাকায় সবটা দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। যা দেখতে পাচ্ছিলেন না, সে অভাব তিনি পুষিয়ে নিলেন খৃস্টান কয়েদী দুজনের কাছ থেকে প্রশ্ন করে।

তিনি কয়েদী দু’জনকে সঙ্গে নিলেন এবং সেখান থেকে নেমে এলেন। একজন কয়েদী ও কয়েকজন সৈন্য সঙ্গে নিয়ে তিনি দেখা করলেন সেনাপতি হিশামুদ্দিনের সাথে। বাকীদের ওখানেই সন্তর্পন অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি সেনাপতি হিশামুদ্দিনকে সবকিছু জানিয়ে জানতে চাইলেন এখন কি করবেন।

হিশামুদ্দিন বললেন, ‘চলো। আগে আমি অবস্থাটা দেখি। তারপর অভিযান চালাবো।’

কমাণ্ডোারের সাথে হিশামুদ্দিন সেখানে গেলেন যেখানে দাঁড়িয়ে কমাণ্ডোার ময়দানের দৃশ্য দেখেছিল। মশালের আলোয় তিনি তাকালেন মাঠের দিকে। দেখতে পেলেন ময়দান বলতে গেলে ফাঁকা। মাঠে এখানে ওখানে মাতালরা পড়ে আছে।

তিনি শুধু একজনকেই পেলেন যে তখনো জেগে আছে এবং বসে বসে মদ পান করছে।

তিনি কমাণ্ডোারকে অভিযান শুরু করার হুকুম দিলেন। বললেন, ‘খৃস্টান ডাকাতরা এখন ঘুমিয়ে আছে। তাদের হত্যা না করে বন্দী করবে। শুধুমাত্র যারা মোকাবেলা করতে আসবে তাদেরই হত্যা করবে।’

কমাণ্ডোার এতে আপত্তি তুলে বললো, ‘আপনি এদের বাঁচার যোগ্য মনে করেন? এরা শুধু লুটেরা নয়, খুনী। হত্যার বদলে হত্যা ওদের পাওনা হয়ে গেছে। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই, চরম প্রতিশোধ।

আমি ওদের লাশগুলো এখানে এমনভাবে ফেলে রেখে যেতে চাই, যাতে মরু শিয়ালগুলো অনেক দিন ধরে তৃপ্তির ভোজ দিতে পারে। যাতে তাদের লাশগুলো পচে গলে অন্য কোথাও দুর্গন্ধ ছড়াতে না পারে।’

‘না, আমিও তাদের বাঁচার যোগ্য মনে করি না। কিন্তু ঘুমন্ত ও মাতালদের আমি খুন করার অনুমতিও দিতে পারি না। কেন তারা মরছে এটা না জেনেই মারা যাক, তা চাই না আমি।’

“আপনি কি এদের বাঁচিয়ে রেখে খৃস্টানদের সাথে কোন সুবিধা আদায় করতে চান? বন্দী বিনিময় করতে চান?’

‘না!’ হিশামুদ্দিন বললেন, ‘আমি তাও চাই না। তোমার মত আমিও ওদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাই। কিন্তু, সেই প্রতিশোধ আমি নেবো ওদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে।

ওরা মুসলমানদের সাথে যেমন ব্যবহার করে তেমন ব্যবহার করার শিক্ষা আমরা পাইনি। নইলে আমারও আবেগ বলছে, ওদের হত্যা করে। কিন্তু বিবেক তাতে সায় দিচ্ছে না।’

তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তুমি জানো না, আমার অন্তরে কি মর্মজ্বালা ধিকিধিকি জ্বলছে। আমি জানি মুসলমান কয়েদীদের ওপর ওরা কেমন প্রতিশোধ নেয়। তাদের রক্তের প্রতিশোধ আমিও নিতে চাই।’

‘আমিও জানি খৃস্টানদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা কত ভয়ংকর।’

‘না, তুমি সব জানো না। তুমি কি জানো খৃস্টান সম্রাট আরনাত মুসলিম বন্দীদের আক্রাতে নিয়ে গিয়ে কি নির্মম আচরণ করেছিল? এটা আজ থেকে সাত বছর আগের কথা, কিন্তু আমার মনে হয় গতকালের ঘটনা।

যুদ্ধ বন্দীদের হত্যা করা আন্তর্জাতিকভাবেই আইনতঃ নিষেধ! কিন্তু আরনাত সমস্ত মুসলিম কয়েদীদের সারাদিন না খাইয়ে তাদেরকে দিয়ে অমানুষিক কঠিন পরিশ্রম করায়। তারপর দিন শেষে সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা নেই, বিচার আচারের বালাই নেই, ওদের মগজে আছে শুধু আক্রোশ ও হিংস্রতা। এ ঘটনা আমি সারা জীবনেও ভুলতে পরবো না।

‘আজ তার প্রতিশোধ নিন।’

‘হ্যাঁ, আজ আমি তার প্রতিশোধ নেবো। কিন্তু একজনের অন্যায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে নয় অথবা কাপুরুষের মত তাদেরকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে নয়। এদের যেটুকু অপরাধ তার শাস্তি আমি কড়ায় গণ্ডোায় শোধ করে দেবো।’

হিশামুদ্দিনের সৈন্যরা ময়দানে প্রবেশ করলো। তাঁরা খৃষ্টানদের মশালের আলোতে নিভে যাওয়া মশালগুলো ধরিয়ে নিল।

সৈন্যরা ঘুমন্ত ডাকাতদের বন্দী করতে গেলে নেশার ঘোরে তারা সৈন্যদের গালিগালাজ করতে লাগলো। কিন্তু তাদের প্রতিরোধ করার কোন ক্ষমতা ছিল না।

কেউ কেউ তাদের প্রতিরোধ করতে চাইল। অভিযানে আসা সৈন্যরা তলোয়ারের আঘাতে তাদের হত্যা করে জবাব দিল প্রতিরোধের।

এই হট্টগোলে যারা ঘুমিয়ে ছিল তারাও শোরগোল করে জেগে উঠলো। ঘুমের ঘোর কাটলে বুঝতে পারলো ব্যাপার কি ঘটছে।