» » পরিণাম-পর্ব

বর্ণাকার

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

শীতকাল। দিবাকর দক্ষিণায়নে দাঁড়াইয়া সহস্ররশ্মি-প্রভায় ভূবন আলোকিত করিয়াছে। রতনদিয়া গ্রামের একটি দ্বিতল অট্টালিকার নির্জন চত্বরে একজন যুবতী প্রাতঃস্নানান্তে সুমসৃণ কাষ্ঠাসনে উপবেশন করিয়া সোনার আলনায় চুল শুকাইতেছে; একটি শিশু তাহার সম্মুখে সৌধদ্বারে দাঁড়াইয়া তুর্কী অর্শ্বে আরোহণ নিমিত্ত বারংবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু অকৃতকার্য হইয়াও চেষ্টায় বিরত হইতেছে না, যুবতী একদৃষ্টে শিশুর অশ্বক্রীড়া দেখিতেছে। এই সময় একখানি পত্র হস্তে একজন যুবক নিচের সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতেই, যুবতীকে তদবস্থায় দেখিয়া থামিয়া গেলেন এবং ঈষৎ অন্তরালে থাকিয়া তাহাকে দেখিতে লাগিলেন। যুবতীর সুলম্বিত ঘনকৃষ্ণ কুন্তলরাশি সোনার আলনায় সুধীর প্রভাত সমীরণে ইতস্তত মৃদুমন্দ সঞ্চালিত হইতেছিল। মেঘের কোলে ক্ষণপ্রভার অপরূপ শোভা অনেকেই দর্শন করিয়াছেন, কিন্তু রামধনু কোলে স্থিরা সৌদামিনীর মোহন মাধুরী কি কেহ কখন দেখিয়াছেন? যুবক অতৃপ্ত নয়নে যুবতীর এই অদৃষ্টপূর্ব ভুবন ভুলান রূপলাবণ্য দেখিতে লাগিলেন; হঠাৎ যুবতীর দৃষ্টি যুবকের উপর পতিত হইবামাত্র যুবতী সলাজ-সঙ্কোচে হাসিমুখে মাথায় ঘোমটা টানিয়া আসন হইতে উত্থিত হইল এবং কহিল, “এখন না আসিলে কি চলিত না?” যুবক অগ্রসর হইয়া সাহাস্যে কহিলেন, “এত সত্বর খোকাকে সব ভালোবাসা বিলাইয়া দিয়াছ?” খোকা যুবকের কথার প্রতিধ্বনি করিয়া কহিল, “ছব বালা বিলাই দেছে।” যুবক-যুবতী হাসিতে লাগিলেন। শিশু তখন অশ্ব ত্যাগ করিয়া অফুটন্ত কুসুমাননে পিতার কোলে উঠিতে ক্ষুদ্র বাহু দুইটি বিস্তার করিল, যুবক কহিলেন, “এস বাবা, আজ আমারও ভালবাসা সবটুকু তোমাকে দান করিয়া ফেলি।” এই বলিয়া তিনি শিশুকে কোলে লইয়া মুখ চুম্বন করিলেন।

যুবতী। তোমার দান দেখিতেছি হযরত আবুবকরের দানের চেয়েও বড়; তিনি সর্বস্ব দান করিয়া একখানি কম্বল সম্বল রাখিয়াছিলেন; তুমি যে কিছুই রাখিতেছ না।

যুবক। তুমিও ত’ কিছুই রাখ নাই।

যুবতী। কে বলিল রাখি নাই? আমার বাকি জেন্দেগীর নিমিত্ত যাহা প্রয়োজন, সমস্ত মজুদ রাখিয়া বাকিটুকু বিলাইতেছি।

যুবক। মজুদের প্রয়োজন?

যুবতী। নারীজন্মের কর্তব্যহেতু ও পরলোকের সম্বলার্থে।

যুবতী। কর্তব্য কিছুই বাকি রাখিয়াছ কি?

যুবতী। সমস্তই বাকি, দাসীর ওয়াশীলের ঘর শূন্য! বাকি পর্বত প্রমাণ অন্তকালেও তাহার আদায় অসম্ভব।

যুবতীর চক্ষু ভক্তি প্রেমে অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল। যুবক খোকাকে কোলে রাখিয়াই ঘর হইতে একখানি কুরসী টানিয়া আনিয়া যুবতীর সম্মুখে রৌদ্রে বসিলেন এবং তাহাকে তাহার আসনে বসিতে আদর করিলেন। ইত্যবসরে খোকা পিতার হস্ত হইতে চিঠিখানা কাড়িয়া লইয়া আজরাইলের হাতে দিতে উদ্যত হইল।

যুবতী। খোকা যে একেবারে নষ্ট করিয়া ফেলিল দেখিতেছি, ওখানা চিঠি নাকি?

যুবক। হ্যাঁ, ঐ চিঠির কথাই ত তোমাকে বলিতে আসিয়াছি।

যুবতী। বল না।

যুবক। বড় খুকীরা মসজিদ-মিলাদে আসিবে। কল্য স্টীমার-ঘাটে পাল্কী বেহারা রাখিতে বলিয়াছে, ছুটি পাইলে ডেপুটি সাহেবও আসিবেন।

যুবতী। শুনিয়া সুখী হইলাম। এখন স্ব-পতি ছোট খুখি আসিলেই আমার আশা পূর্ণ হয়।

যুবক। ছোট খুকি বোধ হয় আসিতে পারিবে না। তাহার স্বামী জ্বরে কাতর হইয়া বাড়ি আসিয়াছেন।

যুবতী। তিনি না এবার বি.এ. পরীক্ষা দিবেন? তবে বুঝি পরীক্ষা দেওয়া ঘটে না।

যুবক। তাই ত বোধ হইতেছে।

যুবতী। পরীক্ষা না দিতে পারুন—খোদার ফজলে সত্বর তিনি আরোগ্য লাভ করিলে হয়। যেমন মেয়ে তেমনি জামাইটি হইয়াছে। মামুজান বাছিয়া বাছিয়া সৎপাত্রে ভাগ্নী দুইটি সম্প্রদান করিয়াছিলেন। জামাই দুইটি যেন সাক্ষাৎ ফেরেশ্তা।

যুবক। ননদদের সতীন হইতে সাধ যায় নাকি?

যুবতী। (সহাস্যে) দুই ননদ দুইখানে,—যাইয়া সতীন হওয়া কঠিন; বরং তুমি সম্মত হইলে, তাহাদিগকে এখানে আনিয়া সতীন করিয়া লইতে পারি।

যুবক। তুমি এ ত মুখরা দুষ্ট হইলে কবে?

যুবতী। এত দুষ্টামির কথা নয়। ঢিলটি ছুঁড়িল পাটকেলটি খাইতে হয়।

যুবক। রক্ষা কর আর পাটকেল-টাটকেল ছুঁড়িও না। একটু অবজ্ঞার ঢিলা দিয়া জেলের

গুতানি খাইয়া আসিয়াছি।

যুবতী। থাক, তোমার মিলাদের আয়োজন কতদূর?

যুবক। উদোরপিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে নাকি?

যুবতী। সে কি কথা?

যুবক। মিলাদ আমার না তোমার?

যুবতী। যারই হোক, আয়োজন কতদূর?

যুবক। এত’ শুধু মিলাদ নয়, রাজসূয় উৎসব; এ উৎসবের বিধিবন্দোবস্ত করা ক্ষুদ্র মাথায় কুলাইতেছে না।

যুবতী। মাথা খাটাইয়া ফর্দ করিয়াছ। এখন তদৃষ্টে বন্দোবস্ত করা বেশি কঠিন কি!

যুবক। এত মওলানা, মৌলবী সাহেবানের আনা-নেওয়া, দেশসুদ্ধ লোকের আহারাদির বন্দোবস্ত করা কি সহজ ব্যাপার?

যুবতী। আমার দাদিমা বলিয়াছিলেন, দাদা মিঞা মক্কা শরীফ যাইবার পূর্বে এক মণ হরিদ্রার আয়োজনে গরিব ভোজনের মহোৎসব সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়াছিলেন। এ ব্যাপারে হদ্দ ১০/১২ সের হরিদ্রা ব্যয় হইবে, এর বন্দোবস্তে অক্ষম হইতেছ? দাদিমার মুখে আরও শুনিয়াছি, ঈমানের সহিত কার্যে প্রবৃত্ত হইলে, দয়াময় আল্লাহতালা নিশ্চয় লোকের মকছেদ পুরা করিয়া থাকেন। আমি জানি সৎকার্যে খোদা সহায়।

যুবক। তোমাদের দাদি-নাতিনীর কথা অভ্রান্ত ও শিরোধার্য; দয়াময় খোদা এ পর্যন্ত আমার সব মনোবাসনা পূর্ণ করিয়াছেন, তবে সে বাসনা ভিন্নরূপ।

যুবতী। ভিন্নরূপ কিরূপ?

যুবক। প্রথমে তোমাকে পাইবার বাসনা। দ্বিতীয় স্বাধীন-ব্যসায়ে জীবিকা-নির্বাহ করা, তৃতীয় তোমার চুল শুকানোর নিমিত্ত সোনার আলনা ও চাঁদীর কুর্সি প্রস্তত করিয়া দেওয়া।

যুবতী। চাঁদীর কুর্সি ত পাই নাই?

যুবক। ফরমাইশ দিয়াছি।

যুবতী। কবে পাইব?

যুবক। মিলাদের দিন।

যুবক। চাঁদীর কুসির কথায় আমার একটি স্বপ্নের কথা মনে পড়িল।

যুবক। শুনিতে পাই না?

যুবক। মিলাদের দিন।

যুবতী। যেদিন রুপার কুর্সিতে বসিব সেইদিন বলিব।

যুবক। আমারও একটি কথা স্মরণ হইল।

যুবতী। (অধরে হাসি লইয়া) বলিবে না?

যুবক। (স্মিতমুখে) সেদিন তুমি স্বপ্নের কথা বলিবে সেদিন আমার কথাও শুনিতে পাইবে।

এই সময় খোকা পিতার কোলে থাকিয়া ‘মা যাই, মা যাই’ বলিয়া আবদার ধরিল। যুবতী চুল গোছাইয়া পুত্র কোলে লইল। যুবক পুত্রকে চুম্বনে পরিতুষ্ট করিয়া আগমনপথে প্রত্যাগমন করিলেন।