পঞ্চম পরিচ্ছেদ
নুরল এসলাম জেলায় চালান হইবার পূর্বদিন বৈকালে, আমজাদ হোসেন সাহেব তাঁহার নির্জন লাইব্রেরি ঘরে বসিয়া একখানি মাসিক পত্রিকা পড়িতেছিলেন; এমন সময় হামিদা একখানি পত্রহস্তে মলিনমুখে তাঁহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। আমজাদ মুখ তুলিয়া পত্নীর মুখের দিকে চাহিয়া চমকিয়া উঠিলেন, কহিলেন, “একি! শরৎ-চন্দ্রমা রাহু-কবলিত যে?” হামিদা সে কথায় কান না দিয়া কহিল, “আমি আর তোমাকে ভালবাসিব না।”
আমজাদ। কেন গো, কি অপরাধ করিয়াছি?
এই সময়ে পাশের ঘরে খোকা কাঁদিয়া উঠিল। হামিদার একটি ছেলে হইয়াছে। হামিদা হাতের চিঠি স্বামীর সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছেলের উদ্দেশ্যে ছুটিল। আমাজদ পত্ৰ লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিলেন। পত্রের আরম্ভ এইরূপ লেখা ছিল :
“সই, আমার সঞ্জীবনী-লতা তোলার কথা তোমাকে লিখিয়াছি। ঐ ঘটনা হইতে আমাদের লোকাপবাদ ঘটিয়াছে এবং ঐ লোকপবাদ হইতে এ হতভাগিনীর কপাল ভাঙ্গিয়াছে।”
এই পর্যন্ত পড়া হইলে হামিদা খোকাকে কোলে করিয়া পুনরায় তথায় আসিল।
আম। তোমার সই দেখিতেছি ক্রমে সীতা দেবী হইয়া উঠিলেন।
আমি। সেইজন্যই ত বলিতেছি, আমি আর তোমাকে ভালবাসিব না। সই-এর সঞ্জীবনী-লতা তোলার কথা মনে হইলে, এখনও আমার গা কাঁটা দিয়া উঠে। স্বামীর জন্য অমনভাবে আত্মত্যাগের কথা কোথাও শুনি নাই। আবার তারই ফলে এখন এই কাণ্ড?
আম। কাণ্ড, বিষম কাণ্ড!
হামি। সয়া কি সইতে ত্যাগ করিয়াছেন?
আম। সয়া বোধ হয় ত্যাগ করেন নাই। সই-ই হয়ত অভিমানে হাদিস উল্টাইয়া দিয়া থাকিবেন।
হামিদা। সে কেমন কথা?
আম। হাদিস অনুসারে স্ত্রী, স্বামীকে ত্যাগ করিতে পারে না। কিন্তু লোকাপবাদে স্বামী সংশ্রব ত্যাগ করা তোমার সইয়ের পক্ষে বিচিত্র নহে।
হামি। যে স্বামীর জন্য প্রাণ দিতে পারে, সে কি স্বামীর সংশ্রব ত্যাগ করিতে পারে?
আম। তা যাক; পত্রের ভাবে বুঝিতেছি উভয়ের মধ্যে খুব একটা মন-ভাঙ্গাভাঙ্গি হইয়াছে; আমি ভাবিতেছি দোস্ত এখন উদ্ভ্রান্ত চিত্তে ভুল-ভ্রান্তি করিয়া সরকারি কার্যে কোন বিভ্রাট না ঘটান। হাজার হাজার টাকা তাঁহার হাতে আমদানি-রপ্তানি হয়।
এই সময় আমজাদের বালক-ভৃত্য আসিয়া কহিল, “হুজুর সদর বাড়িতে পিয়ন দাঁড়াইয়া।”
আম। চিঠি-পত্র থাকে’ত লইয়া আইস।
ভৃত্য। মনিঅর্ডার অনেক টাকার, আর লাল চিঠি একখানা।
আমজাদ শুনিয়া বাহির বাটিতে আসিলেন। পিয়ন সেলাম করিয়া একখানি ৫০০ টাকার টেলিগ্রাম মনিঅর্ডার ফরম ও একখানি লাল চিঠি আমজাদের হাতে দিল। তিনি ফরম সহি করিয়া টাকা লইলেন। লাল চিঠিখানা সেইখানেই খুলিয়া পড়িলেন। তাহাতে লেখা আছে,
“আমাদের আট হাজার টাকার তহবিল তছরুপের জন্য কোম্পানির আদেশানুসারে নুরল এসলামকে ফৌজদারীতে সোর্পদ করা হইল। সে আত্মরক্ষায় রাজী নহে। শুনিয়াছি, আপনি তাহার অকৃত্রিম বন্ধু। ওখান হইতে তাহার রক্ষার জন্য যাহা করিতে হয় করিবেন। মোকদ্দমার সাহায্য বাবদ আমি নিজ হইতে তাহাকে ৫০০ টাকা দিলাম। আশা করি, মনিঅর্ডার ও চিঠির কথা আর কাহাকেও বলিবেন না।
সি. ডব্লিউ. স্মিথ,
জুট ম্যানেজার, বেলগাঁও
বালক-ভৃত্য টাকাগুলি তোড়া করিয়া বাড়ির মধ্যে লইয়া চলিল। আমজাদ লাল চিঠি
হাতে করিয়া স্ত্রীকে যাইয়া কহিলেন, “হামি, যে কথা সেই কাজ। তোমার সয়া ত জেলে চলিলেন।”
হামি। ওমা! সে কি কথা?
আম। এই দেখ না, তাঁহার ম্যানেজার সাহেব ‘তার’ করিয়াছেন।
হামি। কি লিখিয়াছেন?
আম। আট হাজার টাকার তহবিল তছরুপাতে নুরলকে ফৌজদারীতে সোপর্দ করা হইয়াছে।
হামি। তহবিল তছরুপ হইল কিরূপে?
আম। কিছুই বুঝিতেছি না।
হামি। ও টাকা কিসের?
আম। ইংরেজ জাতির মহত্ত্বের নমুনা। ম্যানেজার সাহেব স্বয়ং বাদী হইয়াও আসামীর সাহায্যের জন্য ৫০০ টাকা পাঠাইয়াছেন।
হামি। (কাঁদ কাঁদ মুখে) তুমি সয়াকে বাঁচাও।
আম। তিনি যদি সত্যই টাকা চুরি করিয়া থাকেন, তবে বাঁচাইব কিরূপে?
হামি। সই একদিন আমাকে বলিয়াছিল, ফেরেশতাদিগের স্বভাব বদ হইতে পারে, তথাপি তোমার সয়ার চরিত্র মন্দ হইতে পারে না।
আম। আমি ত তাহাকে দেব চরিত্র বলিয়াই জানি। তবে তিনি যুবক, যুবকের মতিগতি কখন কিরূপ হইয়া দাঁড়ায় বলা যায় না।
হামি। (ভ্রূকুটি করিয়া) তুমি বুঝি এখন বুড়া হইয়াছ, না?
আম। বাকি বড় বেশি নাই।
হামি। দরবেশী কথা রাখ; আমার সয়াকে রক্ষা করিবে কি না তাহাই বল।
আম। সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিব।
হামি। শুনয়াছি, বড় বড় সঙ্গীন মোকদ্দমায় বড় বড় আসামীকে রক্ষা করিয়াছ। তোমার পায়ে পড়ি, যেরূপে পার আমার সয়াকে বাঁচাইবে। আমি ভাবিয়া অস্থির হইতেছি, এ সংবাদ পাইয়া সই আত্মঘাতিনী না হয়।
আম। তিনি যদি সংশ্রব ত্যাগ করিয়া থাকেন, তবে আর মরিবেন কার জন্য?
হামি। পতিব্রতার হৃদয় বুঝিতে এখনও তোমার ঢের বাকি।
নুরল এসলামের আসন্ন বিপদে আমজাদ হোসেন একান্ত দুঃখিত ও উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছেন। তিনি স্ত্রীর কথার কোন উত্তর না করিয়া বিষণ্নচিত্তে চিন্তা করিতে লাগিলেন।