» » পরিণাম-পর্ব

বর্ণাকার

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

উকিল সাহেব বন্ধুকে সঙ্গে করিয়া বাসায় আসিলেন। হামিদা উল্লাসে আত্মহারা হইয়া পড়িল। তখনই রতনদিয়া ও মধুপুরে তার করা হইল।

আনোয়ারা যেরূপ নিজের সর্বস্ব দিয়া কোম্পানির দাবির টাকা শোধ করিয়াছে; যেরূপ শাড়ী বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়া চোরের সন্ধান করিয়াছে; নুরল এসলাম বাসায় আসিয়া উকিল সাহেবের নিকট তাহার সমস্ত অবগত হইলেন।

রাত্রিতে আহারান্তে উকিল সাহেব নুরল এসলামকে পরিহাস করিয়া কহিলেন, “দোস্ত, বাড়ি যাইয়া আবার সই-এর মনে ব্যথা দিবে না কি?” নুরল কহিলেন, “ব্যথা? বাড়ি যাইয়া তাহাকে মুখ দেখাইব কিরূপে তাহাই ভাবিতেছি।” হামিদা আড়ালে থাকিয়া অস্ফুটস্বরে কহিল, “ভাবিয়া কি করিবে? পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাহিতে হইবে। ছি, ছি, পুরুষগুলো কি, হালকা, লোকপবাদে এহেন সাধ্বী সতী পত্নীর প্রতি সন্দেহ!”

এদিকে তারের সংবাদে নুরল এসলামের বাড়িতে আনন্দের রোল পড়িয়া গেল। গৃহস্বামীর কারামুক্তিতে সকলেই সহর্ষে নিশ্বাস ত্যাগ করিল; আনোয়ারা রাত্রিতে ঘরে আসিয়া এশার নামাজ অন্তে খোদাতায়ালার শোকর গোজারীর জন্য দুই রেকাত নফল নামাজ পড়িল। শেষে ঊর্ধ্বহস্তে মোনাজাত করিতে লাগিল, ‘দয়াময়! তোমার অপরিসীম অনুগ্রহে আজ দাসীর নারী জন্ম ধন্য হইল। প্রভো! যেদিন আমি পতিরমুখে প্রথম কোরান শরীফ ও মোনাজাত শুনিয়াছিলাম, সেইদিন এইরূপ আনন্দলাভ করিয়াছিলাম; যেদিন প্রিয়তমের প্রাণরক্ষা হইবে মনে করিয়া নিজ প্রাণদান-সঙ্কল্পে সঞ্জীবনী লতা তুলিতে গিয়াছিলাম; সেইদিন যেরূপ সুখী হইয়াছিলাম, আজ প্রভো সেইরূপ”–বলিতে বলিতে সতীর চক্ষু দিয়া আনন্দের অশ্রুধারা বিগলিত হইতে লাগিল। সে অপরিসীম আনন্দে আত্মবিস্মৃত হইয়া ভাবিতে লাগিল, “স্বামী বাড়ি আসিলে তাঁহাকে কিভাবে সম্ভাষণ করিব? আগে কোন কথাটি বলিয়া তাঁহার মনস্তুষ্টি বিধান করিব? হায়! কারাক্লেশে না জানি তাঁহার শরীর কত কৃশ, কত মলিন হইয়া গিয়াছে? কি কি ভাল খাদ্য প্ৰস্তুত করিয়া তাঁহাকে খাওয়াইব? কেমন করিয়া তাঁহার শরীর সুস্থ করিব?” সতী আবার ভাবিতে লাগিল, “আচ্ছা, এবারো যদি তিনি আমার সহিত মন খুলিয়া কথা না বলেন, তবে কি করিব? কেন? আমি কি তাঁহার ধর্মপত্নী নহি, কোন্ অপরাধে তিনি আমার প্রতি বাম হইবেন?” সহসা নবার বৌ-এর ঘৃণিত কথা তাহার স্মৃতিপটে উদিত হইল। সতী তখন শিহরিয়া উঠিল। তাহার পতি পরায়নতা-সুলভ সুকল্পনা নিমিষে অন্তর্হিত হইল। তাহার মনে হইল, ‘অহো! আমি যে পরাপহৃতা, আমি যে লোকপবাদে কলঙ্কিনী,—আমার দোসেই ত স্বামীর কারাবাস! অতএব আমার ন্যায় হতভাগিনী কি স্বামী-সহবাস সুখের আশা করিতে পারে? হায়! এখন আমার কর্তব্য কি? খোদা তুমি এই মন্দভাগিনীর কর্তব্য বুঝাইয়া দাও! তুচ্ছ ভোগ-বাসনায় স্বামী সহবাসে তাঁহার চির-পবিত্র জীবন চির কন্টকময় করিব? ধিক্ দুনিয়া। শতধিক্ কামনা!”

অতঃপর যুবতী নিমিষে কর্তব্য নিরূপণ করিয়া লইল। কর্তব্য নির্ণয়ের সহিত তাহার কমনীয় মূর্তি সংযমের কঠোরতায় উদ্দীপ্ত হইতে লাগিল, যেন দ্বাদশ সূর্য কিরণে শতদল হাসিয়া উঠিল। সতীর মনের ভাব আর কেহ বুঝিল না, তাহার আকৃতির প্রতিও কেহ লক্ষ্য করিল না। কেবল নৈশ প্রকৃতি যেন যে স্বর্গাদপি গরীয়সী মূর্তি নীরিক্ষণ করিয়া নীরবে স্তম্ভিত হইয়া রহিল। প্রকৃত যেন গৃহস্তগৃহে অমন অগ্রতপা, জ্যোতির্ময়ী যোগিনীমূর্তি আর কোথাও দেখে নাই। তাই সে সভয় দেখিতে লাগিল,—এ মূর্তি মৃত-সঞ্জীবনীব্রতের মূর্তি নহে। তাহাতেও ইহাতে অনেক প্রভেদ- অনেক অন্তর। সে মূর্তি মৃতের শান্তিময় সমাধির উপর স্থাপিত ছিল, আর এ মূর্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দাহনশীল, জীবন-জ্বালাময় সংযমের পাদপিঠে প্রতিষ্ঠিত। সে মূর্তি চাঁদের অমিয় কিরণে হাসিত আর এ মূর্তি প্রখর রবিকরে উদ্ভাসিত। তাহার কামনা ছিল,—পতির রোগমুক্তি, সঞ্জীবণীব্রত তাহার আরম্ভ, প্রাণদানে পর্যবসিত! আর ইহার সাধনা—পতির লোকাপবাদ মোচন, সহবাস ত্যাগ আরম্ভ, চির কঠোর সংযমে সমাপ্ত।

সতী আজ সংসারের যাবতীয় সুখ সার্থ বিসর্জন দিয়া নীরবে যোগ-সাধনায় নিজের কর্তব্য সুদৃঢ় করিয়া লইল।

প্রাতঃকালে আনোয়ারা স্বামীর শয়ন-ঘর সজ্জিত করিতে আরম্ভ করিল। নুরল এসলাম কারাগারে যাইবার পর, আনোয়ারা আর সে ঘরে প্রবেশ করে নাই। দক্ষিণদ্বারী ঘরে ফুফু- আম্মার সহিত কালযাপন করিয়াছে। সে আজ স্বামীর ঘরে প্রবেশ করিয়া প্রথমে স্বামীকে প্রাণাধিক প্রিয় সোনার জেকরা কোরান শরীফটি বাহির করিয়া ভক্তির সহিত চুম্বন করিল; পরে নিজ অঞ্চলে ঝাড়িয়া-মুছিয়া যথাস্থানে রাখিয়া দিল। তাজমহলের ফটোখানিও ঐরূপে পরিষ্কার করিল। স্বামীর পরম আদরের পরম সাধের লাইব্রেরীর পুস্তকগুলি আলমারীসহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া রাখিল। গদী, তোষক, খাট, টেবিল, চেয়ার, দর্পণ, চিরুণী প্রভৃতি আসবাবপত্র পরিপাটিরূপে মার্জিত করিয়া যথাস্থানে স্থাপন করিল। ব্যবহারাভাবে পতির রৌপ্যফুরসী হুকা ও পাদুকা-যুগলে যে ময়লা ধরিয়াছিল, আনোয়ারা যত্নের সহিত তাহা পরিষ্কার করিয়া রাখিল। ফলতঃ স্বামী বাড়ি আসিয়া ঘর-দ্বার অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন দেখিয়া বিরক্ত না হয়, এ নিমিত্ত সে সারাদিন তাহার সুশৃঙ্খলাবিধানে ব্যাপৃত রহিল।