দশম পরিচ্ছেদ
জুট কোম্পানির টাকা শোধের পর, একদিন রাত্রিতে শয়ন করিয়া ফুফু-আম্মা আনোয়ারাকে কহিলেন, “বউ মা, এখন উপায় কি?” আনোয়ারা শোক নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “কিসের উপায়ের কথা বলিতেছেন, আম্মাজান?” ফুফু কহিলেন, “টাকা পয়সা সব গেল, আশ্বিন মাস না আসিলে তালুকের খাজনাপত্র পাওয়া যাইবে না। খুসীর কাপড় নাই। সে তাহার জন্য বায়না ধরিয়াছে। কাল বাদে হাট, তাহারই বা উপায় কি? আনোয়ারা পুনরায় দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “সব যাইয়া যদি,—” আর বলিতে পারিল না। তাহার বাকরোধ হইয়া আসিল। চোখের পানিতে তাহার বুক ভাসিয়া যাইতে লাগিল।
রাত্রি প্রভাত হইলে আনোয়ারা ফজরের নামজ পড়িয়া ট্রাঙ্ক হইতে নিজের একখানি এক ধোপের লালপেড়ে ধুতি খুসীকে ডাকিয়া পড়িতে দিল। খুসী কাপড় পাইয়া সন্তুষ্ট হইয়া বউ- বিবিকে আশীর্বাদ করিতে লাগিল।
বিকাল বেলায় নবাব বৌ এই বাড়িতে বেড়াইতে আসিল। এই নবার বউই প্রথমে সালেহার নিকট আনোয়ারার লোকপবাদের কথা বলিয়া যায়। এজন্য আনোয়ারা তাহাকে দেখিয়া প্রথমে শিহরিয়া উঠিল, শেষে আত্মসম্বরণ করিয়া তাহাকে ডাকিয়া ঘরে লইল। নবার বৌ ঘরে আসিলে আনোয়ারা পোটম্যান খুলিয়া একখানি রেশমের উপর পদ্মফুল তোলা নিলাম্বরী শাড়ি বাহির করিয়া তাহার হাতে দিয়া কহিল, তোমার সোয়ামীকে দিয়া শাড়ীখানা বিক্রয় করিয়া দিবে?”
নবার বৌ সহৃদয়তা জানাইয়া কহিল, “আপনারা বড়লোক, হাড়ী বেচবেন ক্যান?”
আনো। আমাদের টাকা পয়সার খুব টানাটানি হইয়াছে।
নবার বৌ। এ্যার দাম কত?
আনো। নয় টাকা; এখন সাত টাকা হইলেই দিব।
নবার বৌ। পোটম্যানের দিকে চাহিয়া কহিল, “ঐ যে হোনার ল্যাগান জ্বতিছে ওহান কি হাড়ি?”
আনো। হ্যাঁ, ওর দাম বেশি।
নবার বৌ। কত?
আনো। পনরকুড়ি টাকা।
নবার বৌ। ওহান বেচবেন না?
আনো। খরিদ্দার পাইলে বিক্রয় করিব।
নবার বৌ। দাম কত চান?
আনো। এখন অর্ধেক দামে দিব!
নবার বৌ। খুইল্যা দেহান ত?
আনোয়ারা শাড়ী খুলিয়া দেখাইল। কিছু দিন ব্যবহার হইলেও বিচিত্র বেনারসী শাড়ী দেখিয়া নবার বৌ-এর চোখ ঝলসিয়া গেল। সে শাড়ীর জন্য উন্মত্তা হইয়া উঠিল। কিন্তু সন্ধ্যা উপস্থিত হওয়ায় কহিল, “আজ থাক, কাইল লইয়া যামু।” নবার বৌ চলিয়া গেল।
রাত্রিতে নবা বেলগাঁও হইতে বাড়ি আসিল। নবার বৌ পূর্বেই তাহাকে শাড়ির ফরমাস গিয়াছিল। বাড়ি আসিবামাত্র বউ নবাকে কহিল, “আমার ছাড়ী কই?”
নবা কহিল, “রতীশ বাবু কলকাতা থাইকা আইলেই হাড়ী পাইবা। “
নবার বৌ মুখ ভার করিয়া রাত্রিতে অনেকক্ষণ কথাবার্তা কহিল না। নবা অনেক সাধ্য- সাধনা করিলে বৌ শেষে অভিমানের নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “আচ্ছা, আমাকে বুঝি বিশ্বাস পাও না? ছোরানী দুড্যা আমার কাছে দেওনা ক্যান?” নবপ্রেমে আত্মহারা নবা তখন বউ-এর আচলে চাবি দুইটা বাঁধিয়া দিয়া কহিল, “এই নাও ছোরানী। হুঁশিয়ার হয়া রাখবা।” প্রাতে নবা বন্দরে গেল। নবার বাক্স খুলিয়া শাড়ির অর্ধেক মূল্য সাড়ে সাতকুড়ির স্থলে আটকুড়ি আর সাত টাকা লইয়া শাড়ী কিনিতে চলিল।
আনোয়ারা তখন কোরান পাঠ করিতেছিল।
নবার বৌ টাকাগুলি তাহার পায়ের কাছে ঢালিয়া দিয়া কহিল, “হাড়ী দুইহান দ্যান।”
আনোয়ারা টাকা দেখিয়া চমকিত হইয়া উঠিল। কোরান পাঠ বন্ধ করিয়া কহিল, “তোমরা গরিব মানুষ, এত টাকা কোথায় পাইলে?
নবার বৌ মিশিরঞ্জিত দন্ত বিকশিত করিয়া কহিল, “খোদার দিছে।”
আনো। তা ত’ সত্যি; কিন্তু খোদা কেমন করিয়া দিল?
নবার বৌ ইতস্তত করিতে লাগিল। আনোয়ারা ভরসা দিয়া কহিল, “আমার কাছে বলিতে ভয় কি?” নবার বৌ তথাপি ইতস্তত করিতে লাগিল। আনোয়ারা তখন কহিল, “তুমি টাকার কথা না বলিলে আমি তোমাকে শাড়ী দিব না।” নবার বৌ শাড়ীর জন্য পাগল! সে এদিক্ ওদিক চাহিয়া কহিল, “বাড়ি আলা এক ছালা ট্যাহা পৈরে পাইছে।”
আনো। কোথায় পাইয়াছে?
নবার বৌ। সাহেবের পুষ্কন্নিতে রাতে মাছ মারতে যারা।
আনোয়ারা শুনিয়া অনেকক্ষণ কি যেন চিন্তা করিল। পরে দশ টাকা ফেরত দিয়া শাড়ীর কথিত মূল্য ১৫৭ টাকা রাখিয়া শাড়ী দুইখানি নবার বউ-এর হাতে দিল। সে মহানন্দে শাড়ি লইয়া প্রস্থান করিল।