পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
অতঃপর অনন্ত সুখ-শান্তির মধ্য দিয়া প্রেমশীল দম্পতির দিন যাইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে ছয়মাস অতীতের গর্ভে বিলীন হইল। তারপর আর এক দুর্ঘটনায় আনোয়ারার হৃদয় ভাঙ্গিয়া পড়িল। তাহার সংসার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অবলম্বন দাদিমার উদরাময় রোগে মৃত্যু হইল। বৃদ্ধার মৃত্যুর সময় আপন গাত্রালঙ্কার যাহা এতকাল সিন্দুকে পুরিয়া রাখিয়াছিলেন, তৎসমস্ত ও নগদ ১৫ শত টাকা এবং ১১টি আকবরী মোহর আনোয়ারাকে দিয়া গেলেন। আনোয়ারা দাদিমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পাঁচশত টাকা ব্যয় করিল।
নুরল এসলামের কারামুক্তির পর গবর্নমেন্ট জুট-কোম্পানির অপহৃত আট হাজার টাকা ম্যানেজার সাহেবকে বুঝাইয়া দিলেন। ম্যানেজার সাহেব পূর্বেই উকিল সাহেবের নিকট অপহৃত চারিহাজার টাকা বুঝিয়া পাইয়া নুরল এসলামকে অব্যাহতি দিয়াছিলেন। এক্ষণে তিনি তাঁহার মহান মহত্বের নিদর্শন-স্বরূপ গবর্ণমেন্ট হইতে প্রাপ্ত আট হাজার টাকা নুরল এসলামকে ফেরত দিলেন। নুরল এসলাম টাকাগুলি লইয়া স্ত্রীর নিকট দিয়া কহিলেন, “এই টাকা হইতে তোমার নগদ দেওয়া টাকা বুঝিয়া লও। অবশিষ্ট টাকা দোস্ত সাহেবকে দিতে হইবে। তিনি আমার জন্য যাহা করিয়াছেন, এ ভবে তাহার তুলনা নাই, তাঁহার ঋণ অপরিশোধ্য।” আনোয়ারা হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা, টাকা লইলাম; কিন্তু এ টাকা এক্ষণে আমি আর কাহাকেও দিব না। আমার একটা প্রার্থনা শুনিতে হইবে।” নুরল সোৎসাহে কহিলেন, “তোমার আদেশ-উপদেশ আমার শিরোধার্য” আনোয়ারা কহিল, “আদেশ- উপদেশ নয়, বাঁদীর আরজ,—আপনাকে আর আমি কোম্পানীর চাকরি করিতে দিব না। এই টাকা আর দাদিমার দত্ত হাজার টাকা লইয়া আপনি স্বাধীনভাবে ব্যবসা আরম্ভ করুন।” নুরল এসলাম স্ত্রীর বৈষয়িক যুক্তি-বুদ্ধির কথা শুনিয়া মনে মনে খোদতোয়ালাকে অশেষ ধন্যবাদ প্রদান করিলেন। প্রকাশ্যে কহিলেন, ‘আমি যে আশা চিরদিন হৃদয়ে পোষণ করিয়া আসিতেছি, তোমার কথাতে তাহা আজ ব্যক্ত হইল। আমি আর কোম্পানির চাকরি করিব না। স্বাধীনভাবে বেলগাঁয়-এ পাটের ব্যবসা অবলম্বন করিব
এই সময়ে একদিন নুরল এসলাম একটি ইসিওর পার্শ্বেল ডাকপিয়নের নিকট পাইলেন। খুলিয়া দেখিলেন, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট চোরের অনুসন্ধান করিয়া দেওয়ার জন্য তাঁহার স্ত্রীকে পুরস্কারস্বরূপ তিনশত টাকা মূল্যের এক ছড়া হার ও দুই শত টাকা মূল্যের একজোড়া বালা পাঠাইয়াছেন।
নুরল হাসিতে হাসিতে স্ত্রীকে বলিলেন, “ডিটেকটিভ মশাই, আপনার গোয়েন্দাগিরির পুরষ্কার নিন।” আনোয়ারা কিছু বুঝিতে না পারিয়া কহিল, “খুলিয়া বলুন না, ব্যাপারখানা কি?”
নুরল। আপনি শাড়ী বিক্রয় করিতে বসিয়া যে চুরির সন্ধান করিয়াছিলেন, সেইজন্য সরকার বাহাদুর খুশি হইয়া এইগুলি বক্সিস পাঠাইয়াছিলেন।
এই বলিয়া নুরল সাদরে স্ত্রীর কমনীয় কণ্ঠে হেমহার এবং হস্তে স্বর্ণবলয় পরাইয়া দিলেন। আনোয়ারা প্রফুল্ল মুখে স্বামীর পদচুম্বন করিয়া কহিল, “ইহা আপনার ব্যবসায়ের প্রাথমিক সুখলক্ষণ বলিয়া জানিবেন।’
অতঃপর ম্যানেজার সাহেব নুরল এসলামকে চাকরীতে হাজির হইতে ডাকিলেন। নুরল বিনীতভাবে ম্যানেজার সাহেবের নিকট আপাততঃ ছয় মাসের ছুটি লইয়া বেলগাঁও এ পাটের ব্যবসা খুলিয়া দিলেন।