» » পরিণাম-পর্ব

বর্ণাকার

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বৈশাখ মাস শেষ হইতে আর বেশিদিন বাকি নাই। শনিবার, মাধ্যাহ্নিক রবি পশ্চিম গগনে হেলিয়া পড়িয়াছে। গ্রীষ্মের নিদারুণ অত্যাচারে সর্বংসহা পৃথিবী শাঁ শাঁ খাঁ খাঁ করিতেছে। জীবকুল যেন রোজ কেয়ামত স্মরণ করিয়া সভয়ে নীরব হইয়াছে। যে যাহার আবাসে পড়িয়া ঝিমাইতেছে। কেবল ২/৪ টি অপান্ত বালক এদিকে ওদিক ছুটাছুটি করিতেছে। আর আমাদের বড়বাবু ও ছোটবাবু অবিশ্রান্তভাবে মসী-লেখনীর সদ্ব্যবহার করিয়া কেরানী- জীবনের দুর্ভাগ্যের পরিচয় প্রদান করিতেছেন। বড়বাবুর চিত্ত নিদারুণ ঘটনাবশে বিভ্রান্ত, তথাপি তিনি কর্তব্যকার্যে যথাসাধ্য মনোযোগী। তাঁহার ছিদ্রান্বেষণে রত ছোটবাবুও কার্য করিতেছেন, আর থাকিয়া থাকিয়া জানালা-পথে বড়বাবুর কার্য দেখিতেছেন।

বেলা ২টার পর বড়বাবু নুরল এসলাম চিত্তের প্রসন্নতার জন্য মসজিদে নামাজ পড়িতে গেলেন। একঘন্টা পর তথা হইতে ফিরিয়া আসিয়া পুনরায় অফিসের সেদিনের অবশিষ্ট কার্য শেষ করিলেন। অনন্তর ৪ টার সময় সাহেবের নিকট বিদায় লইয়া তিনি বাড়ি রওয়ানা হইলেন। কিন্তু হায়! বাড়ি-মুখে গমনোদ্যত তাঁহার প্রফুল্লচিত্ত ও উৎসাহী হস্ত-পদ আজ অবশ হইয়া আসিতে লাগিল। তিনি বিষাদের বোঝা বুকে করিয়া চিন্তাকুলচিত্তে সমস্ত পথ অতিবাহিত করিলেন।

তিনি বাড়ির নিকটবর্তী হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, হায়! আমি এখন কেমন করিয়া সেই পতিপ্রাণার সম্মুখে উপস্থিত হইব। এই কলুশিত অন্তর লইয়া তাহার সম্মুখে কেমন করিয়া দাঁড়াইব—হাসিয়া কথা কহিব? আমার হৃদয়ে যে কি দাবানল জ্বলিতেছে, সে-ত’ তাহার কিছুই জানে না; হায়, সে যখন হাসিয়া আসিয়া আমার হাত ধরিবে, আদর করিয়া কথা কহিবে, তখন আমি কি বলিয়া উত্তর দিব? কিরূপেই বা সরিয়া দাঁড়াইব? কেমন করিয়া তাহাকে উপেক্ষা করিব? হায়! সে যে আমা বই আর কিছুই জানে না! আমাকে সে যে প্রাণের চেয়েও ভালবাসে—সে যে আমার জন্য হাসিতে হাসিতে জীবন দানে উদ্যত। অহো! তাহার ভালবাসায় আমার আর অধিকার নাই। আমি আর সে পুণ্যবতীকে স্পর্শ করিবার যোগ্য নহি। ঘৃণিত সন্দেহের ছায়া লইয়া সে সতী-রত্নকে ছলনা করিতে পারিবে না। এইসব চিন্তা করিতে করিতে তিনি বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলেন।

বাড়ির দাসী নুরল এসলামকে বৈঠকখানায় বিষণ্নচিত্তে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আনোয়ারাকে যাইয়া সংবাদ দিল। শুনিয়া আনোয়ারা উৎকণ্ঠিতা হইল। ফুফু-আম্মা দাসী দ্বারা ডাকাইয়া তাহাকে বাড়ির মধ্যে আনাইলেন। নুরল এসলাম বাড়ির মধ্যে আসিলে ফুফু আম্মা সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, অসুখ করিয়াছে কি?” নুরল ‘জি’ বলিয়া শয়ন ঘরে প্রবেশ করিলেন। আনোয়ারা ফুফু-আম্মার অসাক্ষাতে ছুটিয়া ঘরে গেল। কিন্তু স্বামীর বিবর্ণ মুখ ও ভীষণ ভাবান্তর দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া পড়িল। শেষে জিজ্ঞাসা করিল, “অমন হইয়াছেন কেন? মুখে যে কালির ছাপ পড়িয়াছে; কি অসুখ করিয়াছে?” নুরল এসলাম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন; কোন উত্তর করিলেন না।

অন্যান্য দিন আনোয়ারা নিকটে যাইবামাত্র স্বামী তাঁহাকে প্রেম-সম্ভাষণে সাংসারিক নানাবিধ প্রশ্ন করিতে করিতে অস্থির করিয়া তোলেন। আনোয়ারা উত্তর দিতে দিতে তাহার গায়ের পোশাক নিজ হস্তে খুলিয়া লয়, ব্যজনে শ্রান্তি দূর করে, অজুর জন্যে পানি দিয়া, নানাবিধ উপাদেয় নাস্তায় টেবিল পূর্ণ করে। নামাজ শেষ হইলে ‘এটা খান, ওটা খান’ বলিয়া নানাবিধ আব্দার করিতে থাকে।

কিন্তু হায়! আনোয়ারা আজ স্বামীর প্রেমময় আদর-সম্ভাষণ কিছুই পাইল না। নিরাশায় পতিপ্রাণার হৃদয় দীর্ণ-বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। রাত্রিতেও নুরল এসলাম স্ত্রীর সহিত বিশেষ কোন বাক্যালাপ করিলেন না। কেবল থাকিয়া থাকিয়া হাহুতাশ দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সহিত রাত্রি অতিবাহিত করিলেন। আনোয়ারা অশ্রু মুছিতে মুছিতে প্রাতে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। কিছুক্ষণ পর সালেহা আনোয়ারার নিকট উপস্থিত হইল। সে কহিল, “ভাবী, আপনার মুখ মলিন কেন?” আনোয়ারা মনের বেদনা চাপিয়া, বাহিরে প্রফুল্লতা দেখাইবার চেষ্টা করিল। কহিল, “কই বুবু, মুখ মলিন হইবে কেন?” শারীরিক অসুখের ভানে অনাহারে আনোয়ারার দিন গেল, বৈকালে সালেহা তাহার চুল বাঁধিয়া দিতে চাহিল, সে অস্বীকার করিল। রাত্রি আসিল, আনোয়ারা অনাহারেই ঘরে গেল। যথাসময়ে এশার নামাজ পড়িয়া স্বামীর পদপ্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইল। নুরল এসলাম নীরব। আনোয়ারা কহিল, “আপনি এত বিমনা হইয়াছেন কেন? দাসীর অজ্ঞানে বা অজ্ঞাতে কোন দোষ হইয়া থাকিলে পায়ে পড়িয়া ক্ষমা চাহিতেছি। কাল হইতে আমার কিভাবে দিন যাইতেছে, একবার ভাবিয়া দেখুন। আপনার মলিন মুখ দেখিয়া কলিজা যে জ্বলিয়া খাক হইতেছে, দয়া করিয়া বলুন কি হইয়াছে। আমি আর সহ্য করিতে পারিতেছি না।” এই বলিয়া সে স্বামীর প্রতি করুণনেত্রে চাহিয়া তাঁহার পা ধরিতে উদ্যত হইল। সেই একান্ত-নির্ভরপূর্ণ দৃষ্টিতে নুরল এসলামের মর্ম ছিন্ন হইয়া গেল। তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় পা সরাইয়া লইয়া আর্তস্বরে কহিলেন, “আমাকে স্পর্শ করিও না।” আনোয়ারা ভক্তির আবেগ-উত্তেজনায় কহিল, “কেন স্পর্শ করিব না? খোদার বন্দেগীর পর এই চরণযুগলই দাসী তাহার জীবন-ব্রতের সার সম্বল করিয়াছে। যদি অপরাধিনী হই, অন্য শাস্তি বিধান করুন, তথাপি চরণসেবায় বঞ্চিত করিবেন না।” এই বলিয়া আনোয়ারা স্বামীর পদপ্রান্তে লুটাইয়া পড়িল। নুরল করুণ কণ্ঠে কহিলেন, “তুমি বুঝিতেছ না আমার হৃদয়ে কি দারুণ অগ্নি জ্বলিতেছে।” স্বামীর কথা শুনিয়া সতীর প্রেম- প্রবণ হৃদয় আরও অস্থির হইয়া উঠিল। সে কহিল, “আপনার সুখ-শান্তি আপনার দুঃখ- অশান্তির সমভাগিনী হইব, আপনার রোগ-শোক বুক পাতিয়া লইব বলিয়াই ত এ জীবন ও- চরণে বিকাইয়াছি।”

প্রজ্বলিত হুতাশনর উপর সুশীতল সলিল পতিত হইলে তাহা যেমন আরও দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠে, আনোয়ারার প্রেমপূর্ণ সুমধুর বাক্যে নুরল এসলামের অন্তরের জ্বালা সেইরূপ বাড়িয়া উঠিল। তিনি যন্ত্রণাতিশয্যে দুই হস্তে বুক চাপিয়া ধরিয়া ভগ্ন-কণ্ঠে কহিলেন, “আমাকে আর কিছু বলিও না। আমাকে একাকী থাকিতে দাও।” এবার স্বামীর উক্তি শত বজ্রঘাত অপেক্ষাও সতীর কোমল হৃদয়ে আঘাত করিল। সে বুক চাপিয়া ধরিয়া অবসন্ন দেহে মাটিতে বসিয়া পড়িল।

অনেকক্ষণ পরে বালিকা উঠিয়া দাঁড়াইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। ‘হায়! কি হইল,’ ভাবিয়া তাহার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

নুরল এসলাম স্ত্রীকে উপেক্ষার ভাব দেখাইলেন বটে, কিন্তু দুশ্চিন্তার তুষানলে তিনিও ভস্মীভূত হইতে লাগিলেন। তিনি ভাবিতে লাগিলেন ‘একদিকে সাধ্বীসতী, অপরদিকে লোকাপবাদ; কোটি ত্যাজ্য? কোটি উপেক্ষণীয়? সরলা অবলা—অন্ধকার রাত্রি—সত্যই কি পাপিষ্ঠেরা তাহার ধর্মনাশ করিতে পারিয়াছে?’ স্মরণমাত্র তাহার শরীর শিহরিয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে চিত্তের ভাবান্তর ঘটিল। তিনি আবার ভাবিতে লাগিলেন, “যে ব্যক্তি জীবনদানসংকল্পে আমার জীবন রক্ষা করিয়াছেন, যাহার মত প্রেমময়ী, পতিপ্রাণা সতী দুনিয়ায় আছে বলিয়া জানি না, যাহার প্রতি কার্যে পতিহিতৈষিতার পরিচয় পাইতেছি, যাহার প্রতি নিঃশ্বাসে সতীত্বের তেজ ও সৌরভ অনুভব করিতেছি, পাপিষ্ঠেরা কি তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে। সতী-অঙ্গ কি কখনও কলঙ্কিত হইতে পারে? শুধু কতিপয় নীচাশয় ব্যক্তির অলীক কথায় বিশ্বাস করিয়া পতিপরায়ণা সতী রমণীকে ত্যাগ করিব? অহো কি নিষ্ঠুরতা! কি নীচাশয়তা!! ধর্মবিক্রয়ে কর্ম রক্ষা, দীন ছাড়িয়া দুনিয়া, না না, আমার দ্বারা তাহা হইবে না, শত কোটি অপমানের বোঝা অম্লানচিত্তে বহন করিব, তথাপি আমার সহধর্মিনীকে ত্যাগ করিব না’–এইরূপ দুশ্চিন্তার তিনি ক্ষণকাল শান্তি-সুখ অনুভব করিতে লাগিলেন—কিন্তু হায়! এই সুখ-শান্তি অধিকক্ষণ হৃদয়ে স্থায়ী হইল না। রতীশের ঘৃণিত উক্তি আবার পিশাচমূর্তিতে আবির্ভূত হইয়া স্ত্রীর সম্বন্ধে অনুকূল সাধু মত সকল চৈত্রানিল-তড়িত তুলার ন্যায় উড়াইয়া দিল। তিনি শূন্যহৃদয়ে আবার ভাবিতে লাগিলেন, “লোকাপবাদ অমূলক হইলেও সামান্য নহে। হায়! আমি কেমন করিয়া লোকের মুখ বন্ধ করিব? রাজদ্বারে, সমাজে, সভাস্থলে লোক যখন আমাকে অপহৃতা স্ত্রীর স্বামী বলিয়া ভ্রূকুটি উপেক্ষা করিবে, হায়! তখন আমি কোথায় লুকাইব? হায়! খোদা আমি জীবন্তে হত হইলাম।” এইরূপ মর্মান্তদ বিলাপ-পরিতাপের ও এইরূপ মরণ-যন্ত্রণাধিক চিন্তা তরঙ্গের মধ্যে দিয়া নুরল এসলামের রাত্রি প্রভাত হইল। এইসময় গ্রামীণ মসজিদ হইতে প্রভাতিক মধুর আযানধ্বনি দিগন্ত মুখরিত করিয়া তুলিল। নুরল এসলাম মনের শান্তি নিমিত্ত নামাজ পড়িতে মসজিদে চলিয়া গেলেন এবং বাড়ি না আসিয়া নামাজ অন্তে তথা হইতেই বেলগাঁও কার্যস্থলে গমন করিলেন। এদিকে আনোয়ারা অশ্রুপূর্ণনেত্রে রন্ধন-প্রাঙ্গণে আসিয়া উপস্থিত হইল। পূৰ্ব দিনের ন্যায় কিছুক্ষণ পর সালেহা তথায় আসিল। সে আনোয়ারার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “ভাবী, কাল আপনার মুখ ভার দেখিয়াছি, আজ আবার আপনি কাঁদিতেছেন। নিশ্চয় ভাইজান আপনাকে তিরস্কার করিয়াছেন।” আনোয়ারা চোখের পানি মুছিয়া কহিল, “বুবু, তিনি তিরস্কার করিলে পুরস্কার ভাবিয়া মাথায় লইতাম।” সালেহা কহিল, “তবে কি হইয়াছে?”

আনো। তিনি বাড়ি আসা অবধি আমার সহিত কথা বলিতেছেন না। তাঁহার মুখের ভাবে অন্তরের নিঃশ্বাসে বোঝা যায়, কি যেন অব্যক্ত দারুণ দুঃখে তিনি নিস্পেষিত হইয়াছেন।

সরলা সালেহা কহিল, “ভাবী এক কথায় শুনিয়াছি”–কথাটি বলিয়াই বালিকা চাপিয়া গেল। আনোয়ারার শরীর কন্টকিত হইয়া উঠিল। সে কহিল, “কি কথা বুবু?” সালেহা ফাঁপড়ে পড়িয়া ইতস্তত করিতে লাগিল। আনোয়ারা শুনিবার জন্য নাছোড় হইয়া পড়িল। সালেহা অগত্যা কহিল, “কাল নবার বউ আমাদের এখানে আসিয়াছিল; সে একটা খারাপ মিথ্যা কথা কহিল, আমি শুনিয়া তাহাকে তখনই তাড়াইয়া দিয়াছি। “

পূর্বেই বলিয়াছি, নবাব আলী ওরফে নবা নুরল এসলামের খানা-বাড়ির প্রজা। সে বেলগাঁও বন্দরে গাঁট বাঁধাই-এর কর্ম করে। রতীশ বাবুর বাসার সন্নিকটে তাহার রাত্রি যাপনের আড্ডা! প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর বহু টাকা ব্যয় করিয়া নবাব আলী কথিত স্ত্রীর পানিগ্রহণ করিয়াছে। স্ত্রী ভরা যৌবনা এবং রূপসী। নবা তাহার চরণে আত্মপ্রাণ উৎসর্গ করিয়াছে। বৃদ্ধা মাতার বর্তমানেও স্ত্রীই তাহার সংসারের সর্বময় কর্ত্রী। সেদিন রাত্রিতে রতীশ বাবুর বাসায় যে সকল লোক নুরল এসলামের সম্বন্ধে কথাবার্তা বলে, তাহার মধ্যে নবা ছিল, এবং সে রতীশ বাবুর মতের পোষকতা করিয়া কথা বলিয়াছিল। পাঠক, একথা পূর্বেই অবগত হইয়াছেন।

আনোয়ারা সালেহাকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “বুবু, আমাকে যদি কথা খুলিয়া না বল, তবে আমি এখনই গলায় ফাঁস লাগাইব।” সরলা সালেহা ভয় পাইয়া তখন কহিল, “নবাব বউ চুপে চুপে আমাকে বলিল, তার সোয়ামী তার নিকট বলিয়াছে, বন্দরে সকলে গাওয়া পেটা করে,–কোম্পানির বড়বাবু অসতী স্ত্রী লইয়া ঘর-সংসার করে।” তীব্র আশীবিষ দংশনে দৃষ্ট ব্যক্তি যেমন দেখিতে দেখিতে মুহূর্তে ঢলিয়া পড়ে, আনোয়ারা সালেহার মুখের কথা শেষ হইতে না হইতে সেইরূপ রন্ধন আঙ্গিনায় আবসন্ন হইয়া পড়িল। সালেহা অপ্ৰস্তুত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ফুফু-আম্মা ‘কি হইয়াছে’ বলিয়া নিকটে আসিলেন। আসিয়া দেখেন, বউয়ের মুখশ্রী বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে, টানিয়া টানিয়া নিঃশ্বাস ফেলিতেছে; ফুফু-আম্মা দুইদিন যাবত দেখিতেছেন, বউ অনাহারে রহিয়াছে, সর্বদা চোখের পানি ফেলিতেছে; ছেলের মুখও বিষদমাখা। ঘরে বুঝি কোন অকুশল ঘটিয়াছে, এইরূপ মনে করিয়া তিনি সালেহাকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না, কেবল দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। দাসী ফুফু-আম্মার আদেশে আনোয়ারাকে বাতাস করিতে লাগিল। সালেহা তাহার চোখে-মুখে পানি দিল। অনেকক্ষণ পরে আনোয়ারা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল। অতঃপর ধীরে ধীরে আক্ষেপ করিয়া বলিতে লাগিল, “খোদা তুমি না দয়াময়? তুমি না সুখ-শান্তির জনক? তবে তোমার এ বিধান কেন? অন্তর্যামীন প্রভো! দাসীর যাতনা চরমে উঠিয়াছে, আর সহিতে পারিতেছি না। মঙ্গলময়! এখন মৃত্যুই দাসীর পক্ষে শ্রেয়ঃ! অতএব প্রার্থনা, আর জীবিত রাখিয়া দন্ধিয়া মারিও না, এককালে মৃত্যুপথে শান্তিদান কর। দুনিয়া আর চাই না।

সালেহা ও ফুফু-আম্মার যত্ন, চেষ্টা এবং প্রবোধ বাক্যে আনোয়ারা দিনমানে কথঞ্চিৎ সুস্থ হইল এবং সইকে দুঃখের কথা জানাইয়া জেলার ঠিকানায় পত্র লিখিল।