চতুর্থ পরিচ্ছেদ
নুরল এসলাম অফিসে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, খরিদ পাটের মূল্যের জন্য ১০/১২ জন বেপারী অফিস-বারান্দায় বসিয়া আছে। তিনি তাহাদিগকে টাকা দেওয়ার জন্য পকেট হইতে লোহার সিন্দুকের চাবি বাহির করিলেন। ঐ সঙ্গে একখানা পত্রও বাহির হইয়া পড়িল। পত্রখানি টেবিলের উপর রাখিয়া, নুরল এসলাম সিন্দুক খুলিতে ক্যাশ-কামরায় প্রবেশ করিলেন। সিন্দুকের ডালা তুলিয়া তন্মধ্যে দৃষ্টিপাতমাত্র তাঁহার অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠিল। তিনি শিরে অশনিসম্পাৎ বোধ করিলেন, চক্ষে অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। কারণ, সিন্দুকে ছয় পেটি টাকার মধ্যে দুই পেটি মাত্র আছে; চার পেটি টাকা নাই। প্রথমে মনে করিলেন তিনি ভুল দেখিতেছেন; এই জন্য রুমালে চক্ষু মুছিয়া পুনরায় সিন্দুকের তলায় দৃষ্টিপাত করিলেন, তখন ভুল নির্ভুল বলিয়া বুঝিলেন। সিন্দুকে চারি পেটি টাকা নাই দেখিয়া দৌড়াইয়া টেবিলের নিকট আসিলেন, ক্যাশ-বুক বাহির করিলেন, হিসাবের খাতা মিলাইয়া দেখেন, খরচ বাদে বারো হাজার টাকা তহবিলে আছে। প্রত্যেক পেটিতে দুই হাজার করিয়া টাকা থাকে, সুতরাং ১২ হাজার টাকা থাকিবার কথা; কিন্তু দুই পেটি মাত্র টাকা মজুদ আছে। চারি পেটিতে আট হাজার টাকাই নাই। সিন্দুকের চাবিও বরাবর তাঁহার নিকট। খুলিবার আগে সিন্দুকও বন্ধ পাইলেন। তবে এমন হইল কেন? টাকা কোথায় গেল? কিছু ঠিক করিতে না পারিয়া নুরল এসলাম ভাবিতে ভাবিতে অবসন্ন হইয়া চেয়ারে আসিয়া বসিয়া পড়িলেন। বেপারীগণ কহিল, “বাবু, অমন করিতেছেন কেন? আমাদিগকে টাকা দেন!” নুরল এসলাম অনেকক্ষণ কথা কহিলেন না। পরে ধীরভাবে কহিলেন, “বাপু সকল, একটু থাম।” এই বলিয়া তিনি মাথায় হাত দিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন।
এ জগতে ধর্মভীরু লোক পদে পদে পাপের ভয় করিয়া চলেন। অসম্ভব অচিন্ত্যরূপে তহবিল তছরুপাতে ধর্মভীরু নুরল এসলামের তখন মনে হইল, সতী সন্দেহ পাপে বুঝি এমন হইল। মনে করার সঙ্গে সঙ্গে কথাটি তাঁহার হৃদয়ের অন্তঃস্থল স্পর্শ করিল। এই সময় টেবিলের উপরিস্থিত সেই পত্রখানির প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। দেখিবামাত্র তিনি তাহা সমাদরে চুম্বন করিয়া পড়িতে লাগিলেন।
পাঠক, বুঝিয়াছেন কি, এ পত্র কাহার? ইহা আনোয়ারার সেই সঞ্জীবনী ব্রতের চিরবিদায় লিপি। নুরল এসলাম নীরোগ হওয়ার পর দাসী একদিন বিছানাপত্র রৌদ্রে দিবার সময় এই চিঠি খাটের নিচে পাইয়া নুরল এসলামের জামার পকেটে রাখিয়া দেয়, এ কথা পূর্বে বলা হইয়াছে। পত্র পাঠে নুরল এসলাম একান্ত বিকলচিত্ত হইয়া পড়িলেন। সতী- অনাদর পাপের ধারণা তাঁহার হৃদয়ে দৃঢ়রূপে বদ্ধমূল হইল। তিনি বুঝিলেন, নিশ্চয় সতীকে সন্দেহ করাতেই এই ভয়ানক সর্বনাশ উপস্থিত হইয়াছে। হায়, হায়, আমি কি ভীষণ দুষ্কার্য করিয়াছি! যে নারী নিজের প্রাণের বিনিময়ে, পতির প্রাণ রক্ষা করিতে পারে, সে যদি কলঙ্কিনী, তবে এ জগতে আর সতী কাহাকে বলিব? আমি মূঢ় পাপাত্মা, তাই সতীত্বের মর্মগ্রহণে অসমর্থ হইয়াছি। তাই সতীকে চিনিতে পারি নাই।”
কিয়ৎক্ষণ পর নুরল এসলাম আবার চিন্তা করিতে লাগিলেন, “শুধু অনুতাপে এ মহাপাপের শাস্তি প্রচুর নহে। তাই বুঝি আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় এমন ভাবে তহবিল তছরুপাত হইয়াছে, অতএব আত্মরক্ষার আর চেষ্টা করিব না। পার্থিব নিরয়-নিবাসে লইয়াই সতী-অবজ্ঞা-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিব।
এই সময় নুরল এসলামের মানসিক অবস্থা ভীষণভাবে শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে। আত্মগ্লানির অনিবার্য হুতাশনে তাঁহার সুরম্য হৃদয়োপবন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে; এবং সেই দাবাগ্নির প্রবর্দ্ধিত বহিমুখশিখায় তাঁহার মুখমণ্ডল বিবর্ণ ও সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছে; আয়ত লোচন যুগল অস্বাভাবিকরূপে প্রদীপ্ত হইতেছে!
উপস্থিত বেপারিগণ নুরল এসলামের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আর কিছু বলিতে সাহস পাইল না।
অনন্তর নুরল এসলাম ক্যাশ-কোঠা বন্ধ করিয়া উত্তেজিতভাবে ম্যানেজার সাহেবের বাংলোয় উপস্থিত হইলেন। ম্যানেজার সাহেব তাঁহার মুখের চেহারা দেখিয়া বিস্মত ও ভীত হইলেন। তাড়াতাড়ি কহিলেন, “নুরল, খবর কি?” ম্যানেজার সাহেব নুরলকে অন্তরিক বিশ্বাস ও স্নেহ করিতেন, তাই ঐ ভাবে নাম ধরিয়া ডাকিতেন। নুরল এসলাম তহবিল তছরুপাতের কথা অসঙ্কোচ খুলিয়া বলিলেন। সাহেব, “বল কি?” বলিয়া দৌড়িয়া অফিস ঘরে আসিলেন। ক্যাশের সিন্দুক পুনরায় খোলা হইল, টাকা গণিয়া দেখা গেল, ক্যাশবুক মিলান হইল, শেষে আট হাজার টাকাই তহবিলে কম পড়িল। সাহেব নুরল এসলামকে কহিলেন, “এখন তোমার বক্তব্য কি আছে?” উপস্থিত রতীশবাবু বিনা জিজ্ঞাসায় কহিলেন, “চোরে লইলে সমস্ত টাকাই লইত।” সাহেব বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “তবে তোমরাই টাকা চুরি করিয়াছ।” রতীশ বাবুর মুখ কলিমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। তিনি কহিলেন, “হুজুর, চাবিত বড় বাবুর কাছেই থাকে। সাহেব কহিলেন, ‘হু।’ অনন্তর তিনি ক্যাশ-অফিসের প্রহরী ও অন্যান্য চাকর-বাকরদিগকে টাকা চুরি সম্বন্ধে নানারূপ প্রশ্ন, তৎসঙ্গে জেরা প্রভৃতি করিলেন, নানাপ্রকার শাস্তির ভয় প্রদর্শন করিলেন। অন্যান্য প্রকারে অনেক চেষ্টা হেকমত করিলেন, কিন্তু কোন ফল হইল না। অগত্যা বৈকালে তিনি কলিকাতা হেড অফিসে আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করিলেন। উত্তর আসিল অপরাধীকে ফৌজদারীতে দাও এবং তাহার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দ্বারা তহবিল পূরণ কর।
ম্যানেজার সাহেব নুরল এসলামকে যারপরনাই বিশ্বাস ও স্নেহ করিতেন। এজন্য তিনি তাহাকে নিজের বাংলোয় ডাকিয়া লইয়া কলিকাতার টেলিগ্রাম দেখাইলেন।
অনন্তর সাহেব নুরল এসলামকে কহিলেন, “তুমি টাকা লইয়া কি করিয়াছ?”
নুরল। এরূপ কথা না বলিয়া আমাকে বধ করুন।
সাহেব। তবে টাকা কে চুরি করিয়াছে?
নুরল। বলিতে পারি না।
সাহেব। কাহাকেও সন্দেহ কর কি না?
নুরল। সন্দেহ করিয়া কি করিব? চাবি ত আমার কাছেই ছিল।
সাহেব আশ্চর্যভাবে নুরল এসলামের মুখের দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, জ্বলন্ত সত্যতা ও সরলতার মধ্যে দিয়া এক অব্যক্ত যন্ত্রণার ভাব আসিয়া তাঁহার আনন্দিত মুখমণ্ডল পরিম্লান করিয়া ফেলিয়াছে।
সাহেব। শুনিতেছি, তোমার স্ত্রী ঘটিত মোকদ্দমার পর তুমি নাকি বড়ই উন্মনা হইয়াছ? কাজ-কর্মে ভুল-ভ্রান্তি করিতেছ, সুতরাং এমনও হইতে পারে, ক্যাশ বন্ধ করিয়া অসাবধানে চাবি স্থানান্তরে রাখিয়াছিলে, সেই সময় অন্যে চাবি দিয়া সিন্দুক খুলিয়া টাকা চুরি করিয়াছে।
নুরল। কিছুই বুঝিতেছি না।
সাহেব। রতীশ, দাগু প্রভৃতি তোমার বিরুদ্ধে হিংসা পোষে?
নুরল। বিশেষরূপে না জানিয়া তাদের প্রতি কিরূপে সন্দেহ করিব?
সাহেব মনে মনে তাঁহার সাধুতায় আরও সন্তুষ্ট হইলেন। প্রকাশ্যে কহিলেন “তবে তুমি এখন টাকার উপায় কি করিবে?”
নুরল। আপনি আমায় ফৌজদারীতে সোর্পদ করিয়া অতঃপর যাহা ভাল বোধ হয় করুন।
সাহেব। তোমাকে যদি ফৌজদারীতে না দেই?
নুরল। কর্তৃপক্ষের আদেশ লঙ্ঘনের জন্য ও টাকার জন্য আপনাকে দায়ী হইতে হইবে।
সাহেব। সেইজন্য বলিতেছি টাকা সংগ্রহের উপায় দেখ।
নুরল। হুজুর, টাকা কোথায় পাইব? ছয় মাস কাতর থাকিয়া সর্বস্বান্ত হইয়াছি।
সাহেব। তোমার না তালুক আছে?
নুরল। তালুকে আমার কোন স্বত্ব নাই।
সাহেব। সে কি কথা?
নুরল। স্ত্রী ও ভগিনীদিগকে হেবা করিয়া দিয়াছি।
সাহেব। নবীন বয়সে এরূপ করিয়াছ কেন?
নুরল। কাতর থাকাকালে মৃত্যু আশঙ্কা করিয়া।
সাহেব। সমস্ত সম্পত্তি হেবা করিয়াছ?
নুরল। সমস্তই।
সাহেব। ডেপুটি গণেশবাহন বাবুর নিকট শুনিয়াছি, তোমার স্ত্রী নাকি তাঁহাদের সীতা- সাবিত্রীর মত সতী। তিনি কি তোমার এ বিপদে তাঁহার সম্পত্তি দিয়া রক্ষা করিবেন না?
নুরল। করিলেও দানের বস্তু প্রতিগ্রহণ করিব না।
সাহেব। তবে কি করিবে?
নুরল। জেলে যাইব।
সাহেব। জেলে যেতে এত সাধ কেন?
নুরল। জেলে না গেলে আমার পাপের প্রায়শ্চিত হইবে না! আমি মহাপাপী।
নুরল এসলাম কাঁদিয়া ফেলিলেন।
সাহেব। টাকাও চুরি কর নাই, তবে কি পাপ করিয়াছ?
নুরল এসলাম পকেট হইতে আনোয়ারার সেই পত্র বাহির করিয়া সাহেবের হাতে দিলেন এবং কহিলেন, “লোকপবাদে—এমন স্ত্রীকে ভীষণভাবে অবজ্ঞা করিয়াছি।” সাহেব জনৈক পুণ্যশীল পাদ্রী সাহেবের পুত্র। নিজেও পরম সাধু। অদৃষ্ট-ফলে পাট-অফিসের ম্যানেজার হইয়াছেন। সুন্দর বাঙ্গালা জানেন। তিনি অগ্রাহের সহিত পত্রখানি পড়িতে লাগিলেন। পাঠ করিয়া সহজে ধন্য ধন্য করিয়া উঠিলেন এবং কহিলেন, “আমাদের কথা দূরে থাক তোমাদের মধ্যেও অমন মেয়ে পাওয়া কঠিন। তুমি নবীন যুবক, সংসার চিন না; তাই অমন রত্ন লাভ করিয়াও পায়ে ঠেলিয়াছ। লোকাপবাদ ত দূরের কথা তোমার স্ত্রীর সতীত্বগৌরবে নারীজাতির মুখোজ্জ্বল হইবে। তাঁহাকে অবজ্ঞা করিয়া গুরুতর অন্যায় করিয়াছ।” এই বলিয়া সদাশয় ম্যানেজার সাহেব নিজ রুমাল দিয়া নুরল এসলামের অশ্রু মুছাইয়া দিলেন। তারপর কহিলেন, “আমি সামান্য নয়শত টাকা বেতনে চাকুরি করি। ছেলের পড়ার খরচের জন্য মাসে ৫০০ শত টাকা বিলাতে পাঠাইতে হয়। অবশিষ্ট চারিশত টাকায় আমরা উভয়ে দুঃখে-কষ্টে সংসার চালাই; সুতরাং তোমাকে এই বিপদে বেশি কিছু সাহায্য করিতে পারিলাম না। এই পাঁচ কিতা নোট তোমাকে দিলাম, অবশিষ্ট সাড়ে সাত হাজার টাকা-সংগ্রহ করিয়া তহবিল পূরণ কর। কলঙ্কের হাত হইতে রক্ষা পাইবে, আর তোমার চাকুরি যাহাতে বজায় থাকে আমি তাহা করিব।
নুরল। তহবিল পূরণ করা আমার অসাধ্য। বাঁচিবার চেষ্টাও আর করিব না। সুতরাং অনর্থক আপনার টাকা লইয়া আমি কি করিব?
সাহেব অনন্যোপায়ে বাধ্য হইয়া তখন থানায় সংবাদ দিলেন। দারোগা আসিলেন। মৌরসীভাবে তদন্ত চলিল, কিন্তু চুরির আস্কারা হইল না। নুরল এসলাম তহবিল তছরুপাতের আসামী হইয়া জেলায় চালান হইলেন। যাইবার সময় তিনি একখানা পত্র লিখিয়া স্ত্রীকে দেওয়ার জন্য একটি বিশ্বস্ত লোকের হাতে দিয়া গেলেন।