ষোড়শ পরিচ্ছেদ
এই সময় উকিল সাহেব, জেলার উপর বাসাবাড়িতে পুত্রের মুখে ক্ষীর দেওয়া উপলক্ষে দোস্তকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন এবং আনোয়ারাকে আনিবার জন্য পাল্কী-বেহারা প্রেরণ করিলেন।
নুরল স্ত্রীকে কহিলেন, সই-এর বাড়িতে যাইবে নাকি?
আনো। যদি অনুমতি পাই।
নুরল এসলাম ভগ্ন স্বরে স্ত্রীকে কহিলেন, “তোমার শরীরে কোন অলঙ্কার নাই, কি লইয়া ক্ষীরোৎসবে যাইবে?”
আনো। গলার স্বর ধরিয়া গেল যে! এরূপ দুঃখ প্রকাশ করিয়া কথা বলিতেছেন কেন?
নুরল। আমার দোষে তুমি তোমার গা-ভরা গহনা খালি করিয়াছ মনে হওয়ায় বুক ফাটিয়া যাইতেছে।
আনো। আপনি অকারণ দুঃখ করিতেছেন, আমি খালি গায়েই বেশ যাইতে পারিব। নুরল। সেখানে গহনা পরিয়া অনেক বড় বড় ঘরের বউ-ঝি আসিবে।
আনো। গহনা পরিয়া বেড়ান আমি মোটেই পছন্দ করি না।
নুরল। তথাপি আমার অনুরোধ, গবর্নমেন্টের দেওয়া হার, বালা, দাদিমার শেষ-দত্ত গহনা যাহা যেখানে সাজে পরিয়া যাও।
আনো। আমার অলঙ্কারাদি লইবার ইচ্ছা আদৌ নাই। পয়ন্ত দাদিমার সেরবরাদ্দ ওজনের অলঙ্কারের বোঝা আমি বহন করিতে কোন মতেই পারিব না।
নুরল। আচ্ছা, তবে হার ও বালা লইয়াই যাও, আর খোকার মুখ দেখার জন্য গুটি দুই তিন আকবরী মোহর লইয়া গেলে ভাল হয়।
আনোয়ারা অতঃপর স্বামীর আদেশ লইয়া উকিল সাহেবের বাসা-মোকামে রওয়ানা হইল।
এদিকে ক্ষীরদান মহোৎসবে উকিল সাহেবের অন্দরমহল কুলকামিনী কুলকলম্বরে কল- কলায়িত; বালক-বালিকাগণের ধাবন-কুর্দন-হর্ষক্রন্দন-কোলাহলে সুখ-তরঙ্গায়িত, পাচক- পাচিকাগণের পরস্পর দ্বন্দ্বে, পরস্পর রসালাপে, পরস্পর কর্ম-প্রতিযোগিতার উত্তেজনায় উচ্ছ্বসিত ও রবপূরিত হইয়া উঠিয়াছে। স্থানীয় জমিদার সাহেবের গৃহিনী, ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের পত্নী, স্কুল ইনস্পেক্টার সাহেবের বিবি, সেরেস্তাদার সাহেবের ভগিনী, দারোগা সাহেবের প্রথমা স্ত্রী, নাজির সাহেবের দুহিতা মৌলভী সাহেবের কাবিলা, মোক্তার সাহেবের বণিতা, শিক্ষক সাহেবের সহধর্মিনী প্রভৃতি গণ্যমান্য ভদ্রমহিলাগণের বেশ-ভূষার ঔজ্জ্বল্য ও নিক্কণে সেই ভাগ্যবান ব্যবহারজীবীর অন্তঃপুর আজ উদ্ভাসিত ও মুখরিত। আবার এই সকল ভদ্রমহিলা কেহ কুলাভিমানিনী, কেহ বড় চাকুরিয়ার ঘরণী বলিয়া গরবিনী, কোন ভামিনী আপাদবিলম্বী ঘনকৃষ্ণ চাঁচ-চিকুরাধিকারিণী বলিয়া অহঙ্কারিণী, কোন তরুণী বেশভূষায় মোহিনী সাজিয়া বাহুলতা অল্প দোলাইয়া দর্পভরে ধীরগামিনী; কোন সীমন্তিনী অতিমাত্রায় বিদুষা বলিয়া বঙ্কিমনয়নে অপরের উপরে কটাক্ষকারিণী। কেবল শিক্ষক-সহধর্মিণী বিলাস বিরাগিণী আত্মপ্রসাদভোগিনী বিনতা বিদূষী।
আনোয়ারা যথাসময়ে উকিল সাহেবের অন্তঃপুরে আসিয়া প্রবেশ করিল। হামিদা অগ্রগামিনী হইয়া পরমাদরে তাহাকে ঘরে তুলিয়া লইল। অনেক সুখ-দুঃখের কাহিনী মসীযোগে পত্রপৃষ্ঠে লেখনী-তুলিকায় চিত্রিত হইয়া আদান-প্রদান পর উভয়ের সন্দর্শন। কিয়ৎক্ষণ উভয়ে উভয়ের প্রতি চাহিয়া চাহিয়া সন্দর্শন-সুধা রস উপভোগ করিতে লাগিল। সঞ্জীবনী লতা তোলা ও শাড়ী বিক্রয় কাহিনী প্রভৃতি স্মরণ করিয়া হামিদা সইয়ের মুখের দিকে তাকাইয়া মনে মনে কহিল, ‘তুমি এমন কার্য করিয়াছ!’ জনৈক দাসী খোকাকে কোলে করিয়া উভয়ের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। আনোয়ারা সহর্ষে পরম স্নেহে ছেলে কোলে লইয়া তার মুখ চুম্বন করিল। শিশু অনিমেষে আনোয়ারার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। অতখানি সুন্দর মুখ দেখিয়া সে যেন মায়ের সুন্দর মুখও ভুলিয়া গেল।
কিয়ৎক্ষণ পর হামিদা আগন্তুক ভদ্রমহিলাদিগের সহিত সই-এর পরিচয় করাইয়া দিল। আনোয়ারা বিনা-অলঙ্কারে তাহাদের মধ্যে তারকারাজি বেষ্টিত শশধরসন্নিভ শোভা পাইতে লাগিল। ভদ্রমহিলাগণ বাহ্যভাবে আনোয়ারার সহিত শিষ্টাচার প্রদর্শন করিলেন বটে; কিন্তু তাহার অসামান্য রূপলাবণ্য দর্শনে অনেকেই স্ত্রীস্বভাব-সুলভ হিংসার বশবর্তিনী লইয়া উঠিলেন। সন্ধ্যার পূর্বে আনোয়ারা বাসায় পৌঁছিয়াছিল, আলাপ-পরিচয়ে সন্ধ্যা আসিল। তখন আনোয়ারা ও অন্যান্য রমণীগণ মগরেবের নামাজ পড়িতে কক্ষান্তরে প্রবেশ করিলেন, কেবল ডেপুটি-পত্নী ও দারোগার স্ত্রী অন্তঃপুরে বাগানে যাইয়া দাঁড়াইলেন।
নামাজান্তে ভদ্রমহিলাগণ প্রায় সকলে এক দুই করিয়া হামিদার দক্ষিণদ্বারী শয়ন-ঘরের বড় ‘হলে’ আসিয়া সমবেত হইলেন।
ভদ্রমহিলাগণের প্রায় সকলেই তরুণী, কেবল জমিদার-গৃহিণী ও স্কুল ইনস্পেক্টার সাহেবের বিবি প্রৌঢ় বয়স্কা। জমিদার-গৃহিণী স্কুল ইস্পেক্টার সাহেবের বিবি ও ডেপুটি-পত্নী তিনখানি চেয়ারে উপবেশন করিলেন। অন্যান্য সকলে ফরাশের চৌকিতে স্থান লইলেন। গল্পগুজব আরম্ভ হইল। এই সময় শিক্ষক-সহধর্মিণী নামাজ শেষ করিয়া তথায় আসিলেন। হামিদা পাকের আয়োজনে ব্যস্ত। সে কার্যবশতঃ এই সময় ‘হলে’ প্রবেশ করিলে ডেপুটি- পত্নী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার সই কোথায়?’ এখনও নামাজে আছেন নাকি?’ শিক্ষক-সহধর্মিণী কহিলেন, “জ্বি হাঁ।’ হামিদা কার্যান্তরে গেল।
দারোগার স্ত্রী। মাগরেবের নামাজে এত সময় লাগে?
মোক্তার-বণিতা। কি জানি ভাই আমরাও নামাজ পড়ি; কিন্তু অমন লোক দেখানো নামাজ আমাদের পছন্দ হয় না।
ডেপুটি-পত্নী। নামাজ পড়া লোক দেখানো ছাড়া আর কি?
জমিদার-গৃহিণী। আপনি বলেন কি?
ডেপুটি-পত্নী। আমারত’ তাই মনে হয়। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ডবল এম-এ। তিনি বলেন, নামাজ রোজা মানুষের মনের মধ্যে। খোদার প্রতি মন ঠিক রাখারই কথা। তিনি আরও বলেন, হৃদয় পবিত্র করাই নামাজ রোজার উদ্দেশ্য, সুতরাং উচ্চশিক্ষা দ্বারা যাহাদের হৃদয় পবিত্র হইয়াছে, তাঁহাদের স্বতন্ত্র নামাজের প্রয়োজন কি?
জমিদার-গৃহিণী। আজকাল ছেলেপিলেগুলি ইংরেজি শিখিয়া একেবারে অধঃপাতে যাইতে বসিয়াছে।
স্কুল ইনস্পেক্টার বিবি। হ্যাঁ মা, কেমন যে দিনকাল পড়িয়াছে! নামাজে পড়িতে বলিলে বলেন,—ওসব তোমাদের একটা বোকামী। মনে মনে খোদার প্রতি ভক্তি থাকিলে ৫ বার পশ্চিমমুখী হওয়া ও ৩০ দিন রোজা করার আবশ্যক করে না।
সেরেস্তাদার ভগিনী। ভাই সাহেব ত’ আন্ডার গ্রাজুয়েট, তিনিও নামাজ রোজা সম্বন্ধে ঐ কথাই বলেন।
দারোগা-স্ত্রী। দারোগা সাহেব দুইবারে এন্ট্রাস পাস করিয়াছেন। তিনি বলেন, নামাজ- রোজা ইংরেজদের আইনের মত। অশিক্ষিত ছোটলোকগুলিকে দমন রাখার জন্য উহার দরকার।
এই সময় নামাজ শেষ করিয়া আনোয়ারা তথায় উপস্থিত হইল। সে নামাজ সম্বন্ধে এইরূপ উৎকট সমালোচনা শুনিয়া তথায় আর বসিল না, তওবা করিতে করিতে পাকশালের দিকে চালিয়া গেল।
ডিপুটি-পত্নী। দেখিলেন, আমাদের উকিল-বিবির সই কতদূর অহঙ্কারী, আমাদিগকে উপেক্ষা করিয়া চলিয়া গেলেন। আমি প্রথমে দেখিয়াই মনে করিয়াছি, রূপের অভিমানে ইনি ধরাকে সরা মনে করেন। গা-ভরা গহনা থাকিলে না জাতি কি হইত!
জমিদার-গৃহিণী। উনি বোধ হয় কোন প্রয়োজনবশতঃ চলিয়া গিয়াছেন।
দারোগা স্ত্রী। এতগুলি ভদ্রমহিলা অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেলেন; বলিয়া গেলেও ত কতকটা ভদ্রতা রক্ষা হত—তবুও ত কেরানীর বউ!
ডেপুটি-পত্নী। পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিতা জানানা, শিষ্টাচার-ভদ্রতার কি বুঝিবে?
দারোগা-স্ত্রী। বোধ হয় রূপ দেখিয়াই উকিল-বিবি উহার সহিত সই পাতিয়াছেন।
এইরূপে তাহারা মুচকি হাসির সহিত আনোয়ারার বিরুদ্ধে বিদ্রূপবান নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।
এদিকে আনোয়ারা পাকশালে উপস্থিত হইল। হামিদা কহিল, ‘সই, ডেপুটি সাহেবের স্ত্রী আমাকে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। তুমি কি নামাজ বাদ ‘হলে’ যাও নাই?
আনো। গিয়াছিলাম, কিন্তু যেখানে নামাজ-রোজা সম্বন্ধে মন্দ আলোচনা হয়, তথায় থাকা উচিত মনে করি নাই।
হামিদা। নামাজ-রোজা মন্দ আলোচনা! কে করিয়াছে?
আনো। আমি কেবল একজনের মুখে শুনিয়াই চলিয়া আসিয়াছি।
হামিদা। প্রতিবাদ করিয়া বুঝাইয়া দিলেই হইত?
আনো। বুঝাইতে গেলে বিরোধ বাঁধিতে পারে।
হামিদা। বিরোধের ভয়ে চলিয়া আসা ঠিক হয় নাই। কারণ, অন্ধকে কূপের দিকে যাইতে দেখিলে হাত ধরিয়া পথে দিতে হয়, পরন্তু ভদ্রমহিলাগণকে উপেক্ষা করিয়া আসায় লৌকিক ব্যবহারেও তুমি দোষি হইতেছ।
আনো। তা বুঝি, কিন্তু শুভ উৎসবে জেহাদ করিতে পারিব না।
হামিদা। তুমি বুঝি কেবল সয়ার প্রাণরক্ষায় যমের সহিত জেহাদ করিতে মজবুত, না?
আনো। সই, সে জেহাদ স্বতন্ত্র।
হামিদা। তা হোক, নামাজ-রোজার প্রতি যিনি অবজ্ঞা দেখাইয়াছেন, তাঁহাকে কিছু আক্কেল সেলামি দিতে হইবে। চল, তোমাকে জেহাদের মাঠে রাখিয়া আসি ।
এদিকে শিক্ষক সহধর্মিণী কথা প্রসঙ্গে ডেপুটি-পত্নীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার স্বামী কি নামাজ পড়েন না?”
ডেপুটি-পত্নী। তিনি উচ্চশিক্ষিত।
শিঃ সঃ। রোজাও করেন না?
ডেঃ পঃ। রোজা করেন।
শিঃ সঃ। উচ্চ শিক্ষিতের রোজার প্রয়োজন কি?
ডেপুটি-পত্নী একটু ফাঁপরে পড়িয়া রুক্ষমুখে কহিলেন, “রোজা বছরে একবার মাত্র করিতে হয়, আর সেই সময় ছোট বড় সকলেই রোজা রাখে।”
শিক্ষক-সহধর্মিণী হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। এই সময় আনোয়ারা ও হামিদা তথায় উপস্থিত হইল।
ডেপুটি-পত্নী শিক্ষক-সহধর্মিণীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার স্বামী কি কার্য করেন?” তখন ঘৃণা ও ক্রোধ তাঁহার গর্বিত মুখমণ্ডলকে ছাইয়া ফেলিয়াছে।
শিক্ষক-সহধর্মিণীও উত্তেজিত হইয়া উত্তর দানে উদ্যত; আনোয়ারা দেখিল, ডেপুটি- পত্নীর প্রশ্নের ভঙ্গিমায় বিবাদের সম্ভাবনা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, এজন্য সে শিক্ষক-সহধর্মিণীকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “কোন্ কথা হইতে এরূপ জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ হইয়াছে?”
শিঃ সঃ। নামাজ-রোজার কথা হইতে।
আনো। বড়ই আফছোছের কথা।
এই বলিয়া আনোয়ারা উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিল, “নামাজ-রোজা, বেশেহশতের চাবি, আপনারা তাই দিয়া দোজখের দ্বার খুলিতে উদ্যত হইয়াছেন, ইহা অপেক্ষা দুঃখের কথা আর কি হইতে পারে? আমাদের তিনি (স্বামী) নামাজ-রোজার প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, ‘মালি যেমন ফুলগাছে জড়িত লতাগুল্মের শিকড় তুলিতে বসিয়া, নির্বুদ্ধিতায় আসল গাছসুদ্ধ উপড়াইয়া ফেলে আজকাল নূতন শিক্ষাদীক্ষাপ্রাপ্ত অনেক যুবক-যুবতী নামাজ-রোজার মূলতত্ত্ব না জানিয়া, কুটতর্কে উহার আবশ্যকতাই অস্বীকার করিয়া ফেলেন। আমি নামাজ রোজা সম্বন্ধে ঐ সকল যুবক-যুবতীগণের মতামত ও নামাজ রোজার মূলতত্ত্ব জানিতে ইচ্ছা করায়, তিনি আমাকে যে সকল উপদেশ দিয়াছেন, তাহা আমার রোজানামচায় সংক্ষেপে লিখিয়া রাখিয়াছি। আমি তাঁহার মূল্যবান উপদেশ মনে রাখার জন্য প্রায় রোজনামচায় লিখিয়া রাখি। আমার মনে হইতেছে আপনারা কেহ কেহ নামাজ-রোজা সম্বন্ধে যে মতামত ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহার অনেক কথার মিমাংসা তাহাতে আছে।”
শিঃ সঃ। সে রোজনামাচা কি আপনি সঙ্গে আনিয়াছেন?
আনো। হ্যাঁ, তা সর্বদা আমার সঙ্গে থাকে।
শিঃ সঃ। দয়া করিয়া শুনাইলে সুখী হইতাম।
আনো। সকলের মতামত আবশ্যক।
মৌঃ-কবিলা। ধর্মের কথায় কাহার অমত?
জঃ গৃহিণী। আচ্ছা, আপনার স্বামীর উপদেশ আমাদিগকে পড়িয় শুনান দেখি।
আনোয়ারা ঘরে গিয়া ট্রাঙ্ক হইতে তাহার রোজনামচা লইয়া আসিল। শিক্ষক-সহধর্মিণী সূত্রপাতেই কহিলেন, “আপনি দেখিতেছি আমাদের ন্যায় অসার স্ত্রীলোকমাত্র নহেন।” আনোয়ারা সে কথার কোন উত্তর না করিয়া কিছু লজ্জিত—কিছু সঙ্কুচিতভাবে রোজনামচা দেখিয়া বলিতে লাগিল, “আমরা যদি আল্লাহ, ফেরেস্তা, কোরান, পয়গম্বর ও কেয়ামত বিশ্বাস করি অর্থাৎ ভক্তির সহিত খোদাতালার প্রতি ঈমান স্থির রাখি, তবে নামাজ রোজা সম্বন্ধে মনগড়া ভিন্নমত ব্যক্ত করা কাহারও উচিত নহে। আল্লাহ কোরান মজিদে আদেশ করিয়াছেন, ৫ অক্ত নামাজ ও ৩০ দিন রোজা নর-নারীর সকলেই পক্ষেই ফরজ। এ সম্বন্ধে আলেমের প্রতি যে আদেশ, জালেমের প্রতিও সেই আদেশ; এ সম্বন্ধে মোল্লা-মাওলানা, এম এ বি-এল, অলি-দরবেশ, পয়গম্বরের প্রতি যে আদেশ, বর্বরের প্রতিও সেই আদেশ; এ সম্বন্ধে শাহান্শা বাদশার প্রতি যে আদেশ, কড়ার কাঙ্গালের প্রতিও সেই আদেশ; এ সম্বন্ধে সালঙ্কারা নব-যুবতীর প্রতি যে আদেশ, ছিন্নবসনা ও বিগত-যৌবনা কাঙ্গালিনীর প্রতিও সেই আদেশ, একই বিধি ও একই নীতি। খোদাতায়ালার এই আদেশ নর-নারীর মঙ্গলের জন্য অকাট্য, চূড়ান্ত যুক্তি প্রমাণের উপর স্থাপিত। এই যুক্তি প্রমাণের সমালোচনা করিয়া রোজার মাহাত্ম্য ও উপকারিতা বুঝিয়া লওয়া মন্দ নয়। বরং তাহাতে নামাজ রোজার প্রতি আমাদের অধিকতর ভক্তি বিশ্বাস জন্মিবারই সম্ভাবনা। কিন্তু খোদাতায়ালার জ্ঞানের নিকট আমাদের জ্ঞান অপূর্ণ ও অকিঞ্চিৎকর। এই তুচ্ছ জ্ঞানের বড়াই করিয়া পূর্ণ জ্ঞানময়ের আদিষ্ট ও বিধান বিহিত নামাজ রোজা সম্বন্ধে ভিন্নমত ব্যক্ত করা এবং সেই মতের পোষকতা করিয়া নামাজ রোজা ত্যাগ করা বা অবজ্ঞা করা মানুষের কর্ম নহে। যাহারা নিজজ্ঞানে নামাজ রোজার উপকারিতা ও মাহাত্ম্য বুঝিতে অক্ষম, মহাজনগণের পথ ধরিয়া চলাই তাঁহাদের একান্ত কর্তব্য। হযরত রাসূলে (দঃ) মত তত্ত্বজ্ঞানী এ পর্যন্ত দুনিয়ায় কেহ আসেন নাই। হযরত আবুবকরের মত সত্যবাদী ও ঈমানদার, হযরত ওমরের মত ন্যায়পরায়ণ ধর্মবীর, হযরত ওসমানের মত বিনয়ী পরহেজগার, হযরত আলীর মত জ্ঞানী ও বিদ্বান, হযরত আবদুল কাদের জিলানীর মত সাধক এ পর্যন্ত সংসারে কেহ হন নাই; কিন্তু ইঁহারা সকলেই ভক্তির সহিত নামাজ রোজা করিতেন। বিবি আয়েশা, ফাতেমা, জোহরা, উম্মে কুলসুম, জোবেদা খাতুন প্রমুখ আদর্শ মাতৃগণ, নামাজ-রোজাকে প্রাণাপেক্ষাও অধিকতর ভালবাসিতেন।
“কেহ কেহ বলেন, নামাজ-রোজা মানুষের মনের মধ্যে! মনে মনে খোদার প্রতি ভক্তি থাকিলে, ৫ বার পশ্চিমমুখে ছেজদা করা, ৩০ দিন উপবাস করিবার দরকার কি? চাই মন একটু খেয়াল করিলে, তাঁহাদের এ কথা যে ভিত্তিশূন্য তাহা সহজেই বুঝা যায়। কারণ, কাহারও ঘরে যদি মহামূল্য রত্ন থাকে, আর তিনি যদি তাহার সদ্ব্যবহার না করিয়া, চিরকাল সিন্দুকে মাত্র তুলিয়া রাখেন, তবে সে রত্ন থাকিয়া লাভ কি? পরন্তু আমরা নিষ্পাপ, ইহা বলিয়া যদি তাঁহারা দাবী করিতে পারিতেন, তাহা হইলে তাঁহাদের এ কথা কতকটা সম্ভবপর বলিয়া মানিয়া লওয়া যাইত। কিন্তু তাঁহারা যে মায়ামোহে জড়িত প্রবৃত্তির বশীভূত; তাঁহারা যে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তাড়িত, ভোগ-বিলাসে, উন্মত্ত; এমতাবস্থায় নিষ্পাপ বলিয়া দাবী বলা তাঁহাদের পক্ষে একান্তই অসম্ভব। অতএব পাপক্ষয়ের জন্য মনে, মুখে ও কার্যের দ্বারা খোদার বন্দেগী অর্থাৎ নামাজ-রোজা না করিলে যে তাঁহাদের মুক্তির আশা নাই। যে স্ত্রীলোক বলে, আমি মনে মনে আমার স্বামীকে খুব ভালবাসী ও ভক্তি করি, কিন্তু বাহিরের কার্যের দ্বারা অর্থাৎ মিষ্ট সম্ভাষণ দ্বারা, সেবা-শুশ্রূষার দ্বারা, আদেশ-উপদেশ পালন দ্বারা তাহারা কিছুই করে না, এমতাবস্থায় তাহার কি স্বামীর প্রতি কর্তব্য পালন করা হয়? আর স্বামীই কি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হইতে পারেন? কখনই নয়? অতএব নামাজ-রোজা দ্বারা নিজের কর্তব্য পালন করিয়া জগৎ-স্বামীর মনন্তুষ্টি সম্পাদন করা নর-নারীর সকলের পক্ষেই একান্ত কর্তব্য।
“সামান্য যুক্তিমূলে যাহা বলা হইল তাহার সূক্ষ্মতত্ত্ব এইরূপ—আমাদিগের মন ও হৃদয়ের সহিত শরীরের আশ্চর্য সম্বন্ধ। মনে চিন্তা প্রবেশ করিলে দেহ অবসন্ন ও দুর্বল হইয়া পড়ে; আবার আনন্দে হৃদয়-মন উভয় প্রফুল্ল হয়, সঙ্গে সঙ্গে শরীরও সুস্থ হইয়া উঠে। ইষ্টজন বিয়োগ বা অত্যানন্দে অশ্রু বিগলিত হয়; ফলতঃ ভিতরে ভাবান্তর ঘটিলে বাহিরে তাহা প্রকাশ না হইয়া যায় না। আবার বাহিরের অবস্থান্তরে ভিতরের ভাবান্তর অনিবার্য। আমাদের নামাজের প্রক্রিয়া সমূহ অর্থাৎ ওজু, কেরাম, সূরা পাঠ প্রভৃতি কার্য খোদাভক্তির বাহ্য অবস্থান্তর। যাঁহারা বলেন, মনে মনে খোদাভক্তি থাকিলে বাহিরে আর কিছু করিবার আবশ্যক নাই, এখানেই তাঁহাদের কথার অযৌক্তিকতা ধরা পড়ে। তবে যে অবস্থায় খোদাভক্তিতে বাহিরের ভাব একেবারে বিলুপ্তি হয়, সে অবস্থা বড়ই কঠিন। তাহাকে ‘মারেফাতের’ অবস্থা বলে। খয়বরের যুদ্ধে হযরত আলীর পাদমূলে-প্রবিদ্ধ তীর তাঁহার নামাজের সময় টানিয়া বাহির করা হইয়াছিল; কিন্তু তিনি সেই তীর বাহির করা টের পান নাই, নামাজের সমাধি অবস্থায় ঐরূপ ঘটে।
‘হৃদয়-মন পবিত্র করাই নামাজ-রোজার উদ্দেশ্য; সুতরাং সুশিক্ষা দ্বারা যাঁহাদের তাহা হইয়াছে, স্বতন্ত্র নামাজ-রোজা করা তাঁহাদের প্রয়োজন কি? এমন উৎকট ভ্রমাত্মক কথাও ২/৪ জন শিক্ষিতাভিমানী প্রকাশ করিয়া থাকেন। যাঁহারা এমন কথা বলেন, আমার ভয় হয়, বলিবার সময় তাঁহাদের রসনা বুঝি জড়তাপ্রাপ্ত হইয়া যায়। হাজার শিক্ষা লাভ করুন, তদ্বারা হৃদয় পবিত্র হইয়াছে একথা অপূর্ণ মানব বলিতে পারে না। হযরত মুহাম্মদের (দঃ) মত চরিত্রবান লোক জগতে আর কে আছে? কিন্তু তিনিও নামাজ-রোজা ত্যাগ করেন নাই।
“কেহ কেহ বলেন, নামাজের অর্থ খোদার বন্দেগী। সুতরাং তাহার আবার সময় অসময় কি? নির্দিষ্ট ৫ বারই বা নামাজ পড়িতে হইবে কেন? যতবার ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা খোদার বন্দেগী করায় কি দোষ আছে? যাহারা এমন কথা বলেন, নামাজ পড়া বা খোদার নাম লওয়া দূরে থাক, তাঁহাদের সংসার-যাত্রা নির্বাহ করাইত’ কঠিন ব্যাপার। কারণ, দুনিয়ার প্রত্যেক কার্যই যে নির্দিষ্ট সময়ের মুখাপেক্ষী; তাহা কাহাকেও বুঝাইবার আবশ্যক করে না। সময় মত কাৰ্য না করিলে তাহা সুসম্পন্ন হয় না বলিয়াই সময় অমূল্য! যদি মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে কার্য না করিত, তাহা হইলে দুনিয়া অচল হইয়া সৃষ্টি বিপর্যয় ঘটিবার আশঙ্কা হইত। যাহা হউক, নামাজের নির্ধারিত সময়টি অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ির মত; অর্থাৎ যে ঘড়ি যেমন নিদ্রিত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ে জাগাইয়া দেয়, নামাজের নির্ধারিত সময়টি তেমনি সংসারমত্ত মানবকে খোদাতায়ালার গুণগানে প্রলুব্ধ করে।
“আর এক কথা, খোদাতায়ালার সুমহান অনুগ্রহে আমরা পরম সুখে সংসারে কালযাপন করিতেছি, এ-নিমিত্ত তাঁহার নিকট অহোরাত্রি মধ্যে ৫ বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের পক্ষে নিতান্তই উচিত। আবার পাঁচ অক্তের যে সময় নির্ধারিত হইয়াছে, সহজ খেয়ালেই বুঝা যায়, তাহা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পক্ষে উপযুক্ত সময় বটে। দয়াময়ের অনুগ্রহে নির্বিঘ্নে সুখদ শয়নে রাত্রি যাপন করিয়া, প্রাতে তাঁহার গুণগান করা, কি সুন্দর সময়! নামাজের অন্যান্য অক্তগুলি, তাঁহার স্তবস্তুতির পক্ষে এইরূপ প্রশস্ত।”
“প্রিয়তমে, এ সম্বন্ধে আরো জানিয়া রাখ, পাঁচ এই সংখ্যাটি আমাদের শাস্ত্রকর্তারা শ্রেষ্ঠ ও পুণ্যার্থকবাচক বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। কারণ, দুনিয়া সৃষ্টির বহুকাল পূর্বেই আল্লাহতায়ালা নিজ নূরে হযরত রাসূলকে সৃষ্টি করিয়া, গোপনে রাখিয়াছিলেন। সেই সময় হজরত রছুল খোদাতালাকে পাঁচবার ছেজদা করেন। পাঁচ অক্ত নামাজের ইহাই মূল।”
“খোদাতায়ালার নূরে, হযরত রাসূল, আলী, ফাতেমা, হাসান, হোসেন এই পাঁচজন পয়দা হন।”
‘আল্লা, মোহাম্মদ, আদম, এসলাম, এন্ছান—ঈমান, শরীয়ত, মারেফত, নুছুত, মালাকুত প্রভৃতি ধর্মাভাবপূর্ণ-পদগুলি আরবী পাঁচ পাঁচ অক্ষরে লিখিত হয়।
“কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, জাকাত— এই পাঁচটি বিষয় আমাদের ধর্মের মূল! ইহাও পাঁচ প্রকার।“
‘মৃত্যুর পরে অজু, গোসল, কাফন, জানাজা, কবর ইহাও পাঁচটি। আমাদের চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয় পাঁচ, আব, আতস, খাক্, বাত প্রভৃতি পাঁচ। ফলতঃ দুনিয়ার সৃষ্টিস্থিতিলয়ের পক্ষে যাহা প্রধান, তাহা এই ৫ সংখ্যাযুক্ত। সুতরাং জগতের সর্বোত্তম বিষয় খোদাতালার বন্দেগী পঞ্চবার হওয়া স্বাভাবিক ও সুসঙ্গত হইয়াছে।”
“কেহ কেহ বলেন, খোদাতায়ালার প্রতি একাগ্রচিত্ত হওয়াই নামাজের উদ্দেশ্য বটে; কিন্তু কেয়ামে আহকামে সে উদ্দেশ্যই নষ্ট হইয়া যায়। যাঁহারা এমন কথা বলেন, তাঁহারা কেয়ামে আহকামের মাহাত্ম্য বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই। বাদশার দরবারে যে প্রজা অবনত মস্তকে, করযোড়ে, বিনীতভাবে উপস্থিত হয়, তাহার প্রতি বাদশার যেরূপ সুনজর ও দয়ার দৃষ্টি পড়ে, অবিনয়ী, উদ্ধত বা জড়স্বভাব প্রজার প্রতি সেরূপ নজর পড়ে না। পরন্তু দুনিয়ার বাদশার প্রকৃতি বিশ্ব-বাদশার প্রকৃতির প্রতিচ্ছায়া মাত্র। সুতরাং তাঁহার দরবারে হাজির হইবার সময় অর্থাৎ নামাজের সময় আমাদিগকে কতদূর বিনীত হওয়া উচিত, তাহা খেয়ালের বিষয়; কিন্তু অপূর্ণ মানব পূর্ণ পরাৎপরের সন্নিধানে কিরূপভাবে বিনীত হওয়া উচিত, তাহা নির্ধারণ করিতে পারে কি? তাই স্বর্গীয় দূত জিব্রাইল আসিয়া, বিশ্বপতির নিকট কিরূপ বিনয় ও দীনতাভাব প্রকাশ করিতে হইবে, হযরত মুহাম্মদকে হাতে ধরিয়া তাহা শিক্ষা দিয়া যান। হযরতের অনুগামী দাস আমরা, সেই মহাপুরুষ হইতেই নামাজের কেয়াম অর্থাৎ বিনয়-নীতি-রত্ন লাভ করিয়াছি। নামাজের সময় দুই পা কিছু দূরে রাখিয়া কেবলামুখে দণ্ডায়মান হইয়া পার্শ্ববর্তী জনকে খোদার নামে সহমিলনে আহ্বান করা, স্বহস্তে কর্ণস্পর্শ করিয়া সেই হস্ত বক্ষ বা নাভিমূলে স্থাপন করা; একভাবে প্রণতস্থানের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া আল্লার নামে জাতিবাক্য উচ্চারণ করা, পরে ঊর্ধ্ব শরীরাধসহ মস্তক অবনত করিয়া পুনরায় উত্থান, পরে সষ্টাঙ্গ-প্রণত হইয়া আবার উত্থান আবার পতন, শেষে জানু পাতিয়া উপবেশন প্রভৃতি ক্রিয়া দ্বারা যেরূপ বিনয়ভাব প্রকাশ করা হয়, তদ্রূপ আর কোন অবস্থায় হইতে পারে না। প্রায় আট হাজার বৎসর গত হইল, হযরত আদমবংশ দুনিয়ায় আসিয়াছে; এ সুদীর্ঘকাল মধ্যে কত জাতি কত প্রকারের উন্নতির উচ্চতম সোপানে আরোহণ করিয়াছে। কিন্তু মুসলমান ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কোন জাতি ধর্মনুষ্ঠান ব্যাপারে খোদার সম্মুখে এমন চুড়ান্ত বিনয় ও দীনতার উচ্চতম নিদর্শন দেখাইতে সমর্থ হন নাই। খোদার প্রতি এই বিনয় ও দীনভাবই এসলামের অনুপম মহত্ত্ব এবং একেশ্বরবাদের পাদপিঠ।”
এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা নীরব হইল। তাহার রোজনামজার লিখিত উপদেশ শুনিয়া উপস্থিত রমণী মণ্ডলী তাজ্জববোধ করিতে লাগিলেন। যাঁহারা নামাজ-রোজা সম্বন্ধে বিরুদ্ধ কথা বলিয়াছেন, তাঁহারা লজ্জায় মস্তক অবনত করিলেন। শিক্ষক-সহধর্মিণী আনোয়ারাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আপনার ন্যায় ভগিনীরত্ন পাইয়া আজ আমরা বাস্তবিকই গৌরবান্বিত ও সুখী হইলাম। আপনার মুখে ধর্ম কাহিনী শ্রবণ করিয়া শুনিবার ইচ্ছা আরও বাড়িয়া উঠিয়াছে। অতএব নামাজ-রোজার উপকারিতা ও মাধুর্য সম্বন্ধে আমাদিগকে আরও কিছু উপদেশ দান করিয়া কৃতার্থ করুন।”
আনোয়ারা বিনীতভাবে কহিল, “আমি মূঢ়মতি অবলা, নামাজ-রোজার মহদ্দেশ্য ও উপকারিতা আপনাদিগকে বুঝাইবার শক্তি আমার নাই; তবে তিনি এতদ্সম্বন্ধে দাসিকে যে সকল উপদেশ দিয়াছেন এবং আমি রোজনামচায় যাহা লিখিয়া রাখিয়াছি, তাহা আরও কিছু আপনাদিগকে শুনাইতেছি। তিনি (স্বামী) বলেন, “আমাদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য আমাদিগকে সর্বদা বহির্জগতে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়, এজন্য আমাদিগের অনেক সময় নামাজ-রোজা কাজা হইয়া যায়, কিন্তু তোমাদের সে সকল অসুবিধা নাই। নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত (এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা জিভ কাটিল) তোমরা নিশ্চিন্তে নামাজ-রোজা করিতে পার। আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি, তাঁহার কথা সম্পূর্ণ সত্য। খোদার প্রতি ভক্তি থাকিলে নামাজ-রোজা করা আমাদের পক্ষেই সুবিধাজনক। তিনি বলেন, নামাজ-রোজা আমাদের ইহ-পরকালের সার- সম্বল; যে সকল স্ত্রী-পুরুষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ রীতিমত পড়েন, পাপের প্রতি তাঁহাদের ঘৃণা ও ভয় থাকে। সুতরাং তাঁহারা প্রকৃত সুখ-শান্তির অধিকারী হন। আবার মৃত্যুর পর যখন অন্ধকার কবরে গমন করেন, তখন নামাজ সে অন্ধকারে তাঁহাদের আলোকস্বরূপ হয়। হযরত রাসুল বলিয়াছেন, “নামাজ ধর্মের শোভন স্তম্ভ। যে স্ত্রী-পুরুষ এমন নামাজকে ত্যাগ করিয়াছে, তাহারা ধর্মকে ধ্বংস করিয়াছে।” তিনি আরও বলিয়াছেন, নামাজ গৃহদ্বার সম্মুখে প্রবাহিত স্রোতস্বিনীর ন্যায়। তুমি প্রত্যহ পাঁচবার সেই নদীতে অবগাহন কর, দেখিবে তোমার দেহের পাপ-দেহের ময়লা ধৌত হইয়া গিয়াছে।” এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা কহিল, “নামাজের আর একটি অবস্থা আছে তাহা বড়ই কঠিন। আমি তাহার মুখে শুনিয়া লিখিয়া রাখিয়াছি, ভালরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।” ডেপুটি-পত্নী কহিলেন, “যত কঠিন হউক না কেন আপনি বলুন; আমরা কি এতই অশিক্ষিতা যে তাহার কিছুই বুঝিতে পারিব না?” আনোয়ারা তখন রোজনামচার পাতা উল্টাইয়া বলিতে লাগিলেন, “প্ৰকৃত নামাজী দুনিয়ার খেয়াল ভুলিয়া মিনতি ও দীনতা লইয়া নামাজে প্রবৃত্ত হন। ইহাতে খোদাতায়ালার সহিত তাঁহার এক দুশ্ছেদ্য স্মরণসম্বন্ধ স্থাপিত হইয়া যায়। বিবি আয়েশা বলিয়াছেন, “নামাজের সময় উপস্থিত হইলে, হযরত আমাকে, আমি হযরতকে চিনিতে পারিতাম না। খোদাতায়ালার ভয় সম্মানে আমাদের চেহারা বদলাইয়া যাইত।’ নামাজের সময় হযরত ইব্রাহিম ও হযরত রাসুলের পাক দেহমধ্যে এক প্রকার শন্ শন্ শব্দ উত্থিত হইত। জগতে অদ্বিতীয় বীর হযরত আলী নামাজের সময় থর থর করিয়া কাঁপিতেন। খোদাতায়ালাকে সাক্ষাৎ জানিয়া তাঁহার সম্মুখীন হইতে প্রকৃত নামাজীর দেলের অবস্থা এইরূপ হইয়া থাকে। সংসারের মায়া-মোহের মলিনতা হৃদয় হইতে সহজে উঠে না, নামাজের এই অবস্থার পর, তাহা পরিষ্কার ভাবে উঠিয়া যায়। তখন তিনি দর্পণের ন্যায় স্বচ্ছচিত্ত হইয়া নিজেকে ভুলিয়া নিরঞ্জন দর্শনলাভে তাহাকে অবিশ্রান্তভাবে ডাকিতে থাকেন। আমটি যখন গাছে ধীরে ধীরে পাকিয়া উঠে, তখন তাহা যেমন স্বভাবত রসপূর্ণ হয়, তেমনই খোদাতায়ালাকে ডাকিতে ডাকিতে নামাজীর মনে এক প্রকার অমৃত রসভাবের সঞ্চার হয়। এই রসভাবের নাম প্রেম। দুনিয়ায় এই প্রেমের তুলনা নাই। জ্ঞানবলে এ প্রেমের লাভ হয় না। ঈগল পক্ষীর ন্যায় উড়িতে যাইয়া কচ্ছপ যেমন পাহাড়ে পড়িয়া চুরমার হইয়াছিল, এই স্বর্গীয় প্রেমের নিকট জ্ঞানের গর্ব সেইরূপ খর্ব হইয়া যায়। জ্ঞান বিরোধের সৃষ্টি কর্তা, প্রেম মিলনের নেতা। জ্ঞান বাইবেল-কোরানে বিরোধ বাধাইয়া তোলে, প্রেম মাতব্বরী করিয়া সকলের কলহ পানি করিয়া দেয়। বস্তুত প্রেম সংসারে সমস্ত বিপরীতের সমন্বয়বিধাতা। ইহার নিকট সব সমান কোন কিছুরই ভেদাভেদ নেই। প্রেম পূর্ণরূপে নির্মল, পূর্ণরূপে পবিত্র, পরিপূর্ণরূপে সরল।
‘নামাজী দিন দিন নামাজরূপ হাপরে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস-বাসনা ভস্মসাৎ করিয়া তবে এ হেন প্রেমরত্ব লাভ করিতে ক্ষমতা লাভ করেন। এই অমূল্য রত্ন লাভের প্রথমাবস্থায় নামাজীর মন দিনরাত প্রেমময় খোদাতায়ালার ধ্যানে ডুবিয়া থাকে, অন্য কোন দিকে তাঁর মন যায় না। কেবল ধ্যানই তিনি সুখকর বলিয়া বোধ করেন। এই অবস্থায় তাঁহার ধ্যানের উপর ধ্যেয় পদার্থ ক্রমশঃ জাগিয়া উঠে অর্থাৎ যে খোদাকে স্মরণ করা হয়, সেই খোদাই তখন নামাজীর হৃদয় সম্পূর্ণ অধিকার করিয়া বসেন। সেখানে তখন অন্য কিছুরই প্রবেশ স্থান থাকেন না। প্রেমের প্রাবল্যে প্রেমিক এইরূপে আপনাকে বিস্মৃতি-সাগরে ডুবাইয়া দেন। তাঁহার দৈহিক অনুভূতি অন্তর্হিত হয়। বিশ্ব-সংসারে অন্য সমস্ত পদার্থ তাঁহার অস্তিত্বের বাহিরে চলিয়া যায়। তখন যাঁহার জন্য এত সাধনা, এত ধ্যানধারণা, এত উপবাস অনিদ্রা, সেই প্রেমাধার খোদা, প্রেমিকের দর্শন-পথে প্রকট মূর্তিতে আসিয়া উপস্থিত হন। প্রেমিক তখন বিশ্বময় এক খোদা ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পান না। তখন তিনি সহর্ষে বলিয়া উঠেন, অহো! কি সৌভাগ্য! অহো কি আনন্দ! খোদা, তুমি ছাড়া যে আর কিছুই নাই, কিছুই দেখিতেছি না। কি শান্তি! কি সুখ!
এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা ভদ্রমহিলাগণের মুখের দিকে তাকাইয়া লজ্জিত হইল। সে দেখিল, তাঁহারা তাহার মুখের প্রতি নির্বাক নিস্পন্দ নয়নে চাহিয়া আছেন। তাঁহাদের সকলেরই জজবার ভাব উপস্থিত।
এই সময় হামিদা আসিয়া কহিল, “গরিবের নিমক-পানি তৈয়ার।”
ডেপুটি-পত্নী ধ্যান ভাঙ্গিয়া কহিলেন, “আমরা শরাবন তহুরা পানে আত্মহারা!”
এই সময় ডেপুটি-পত্নী হঠাৎ চেয়ার হইতে উঠিয়া সসম্মানে আনোয়ারার হস্ত ধারণ করিলেন এবং বিনীতভাবে কহিলেন, “আপনার সম্মুখে এতক্ষণ চেয়ারে বসিয়া ছিলাম, বেয়াদবী মাফ করিবেন।” আনোয়ারা লজ্জিতভাবে কহিল, “আমি সামান্যা নারী, আমাকে ওরূপ কথা বলিয়া আপনি লজ্জা দিবেন না।” জমিদার গৃহিণী হাসিয়া কহিলেন, “মা, আমাদের অসার বাসরে লজ্জা ব্যতীত এমন কোন সার সম্পদ নাই—যাহা দিয়া তোমার এই অমূল্য উপদেশ দানের প্রতিদান করি।”
ডেপুটি-পত্নী। তাহা, যাহাই হোক, এক্ষণে আপনি রোজার সম্বন্ধে কিছু উপদেশ দিয়া আমাদিগকে সুখী করুণ।
আনো। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, রোজার এত মাহাত্ম্য কেন? তিনি বলিলেন, মাসের নামেই রোজার মাহাত্ম্য প্রকাশ পাইতেছে। রমজান শব্দের অর্থ দগ্ধ হওয়া অর্থাৎ মানুষের পাপরাশি এই মাসে দগ্ধ হইয়া যায়। চাতক চাতকী যেমন বৈশাখের নূতন মেঘের পানি-পানাশায় আকাশ পানে চাহিয়া থাকে, খোদাভক্ত মুসলমান নর-নারী সেইরূপ রমজান মাসের আশায় চাঁদের তারিখ গণিতে থাকেন। হযরত রাসুলও রমজান মাসকে নিজস্ব মাস বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। আমি তাঁহাকে বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, উপবাসে পাপ নাশ হয় কিরূপে? তিনি তখন হাদীস হইতে একটি দৃষ্টান্ত দিলেন। দৃষ্টান্তটি এইঃ
“আল্লাহতায়ালা নফছ-আম্মারকে সৃষ্টি করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, তুমি কে? আমি কে? সে অসঙ্কোচে উত্তর দিয়াছিল,–-‘আমি আমি’ ‘তুমি তুমি’! তখন তাহাকে দোজখে নিক্ষেপ করা হয়। বহুদিন পর তাহাকে দোজখ হইতে তুলিয়া পুনরায় প্রশ্ন করা হয় তুমি কে? আমি কে? তখনও সে এইরূপ উত্তর দান করে। শেষে তাহাকে ক্রমান্বয়ে ক্রমাধিক ক্লেশজনক সাতটি দোজখে রাখা হয়, কিন্তু সে কিছুতেই খোদাতায়ালাকে সৃষ্টিকর্তা বলিয়া স্বীকার করে না। পরিশেষে তাহাকে অনাহার-ক্লেশের দোজখে আবদ্ধ করা হয়; তখন সে ক্রমশঃ হীনবল হইয়া বিনীতভাবে বলে, হে সর্বশক্তিমান খোদা। তুমি সৃষ্টিকর্তা, তুমি রক্ষাকর্তা, তুমি পালনকর্তা। আমি তোমারই সৃষ্ট নগণ্য কীটাণুকীট। ইহা হইতে আমরা বুঝিতে পারি, প্রবৃত্তি দমনের যত প্রাকার উপায় আছে, তন্মধ্যে উপবাস যেমন, এমন আর একটিও নহে। এই প্রবৃত্তি দমনকারী ব্রতের নাম-রোজা। মানুষ প্রবৃত্তিবশে অদম্য পশু, নামাজ তাহাদের লাগাম, রোজা চাবুকস্বরূপ।
এক্ষণে, আমি আপনাদিগকে শেষ একটি কথা বলিতেছি, মনে রাখিবেন—আমরা অবলা, দুনিয়ায় আমাদের যদি সুখ-শান্তি থাকে, তবে তাহা নামাজ-রোজা ও পতিভক্তির মধ্যে নিহিত রহিয়াছে। আপনাদের দোওয়ায় আমি নামাজের প্রত্যক্ষ ফল লাভ করিয়াছি।
এই সময় হামিদা পুনরায় আসিয়া কহিল, “আমার এই সই আপনাদিগকে যাদু করিয়াছে নাকি?”
ডেপুটি-পত্নী। তাহারও উপরে।
দারোগা-স্ত্রী। যাদু অস্থায়ী, কিন্তু আপনার সইয়ের যাদুপনা আমাদের দেলে বসিয়া গেল।
অতঃপর সকলে উঠিয়া আহারার্থে গমন করিলেন। রাত্রিতে শয়নকালে ডেপুটি-পত্নী তাঁহার দাসীকে কহিলেন, “সূর্যোদয়ের পূর্বে আমাকে জাগাইয়া দিও ফজরের নামাজ পড়িতে হইবে।”