একাদশ পরিচ্ছেদ
আনোয়ারার শাড়ি বিক্রয়ের তিন দিন পর জেলা হইতে জনৈক নামজাদা পুলিশ ইনস্পেক্টার রতনদিয়ায় আসিয়া হঠাৎ নবাব আলীর বাড়ি ঘেরাও করিলেন। পাঠক, নবার আলী ওরফে নবার পরিচয় পূর্বেই পাইয়াছেন।
নবা বন্দরে যাইতে বাড়ির বাহির হইতেছিল। পুলিশ দেখিয়া তাহার অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠিল। জনৈক কনেস্টবল তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কি?”
নবা। হুজুর, কর্তা, আমার নাম—আমার না—ন—নবা। না, আমার নাম কর্তা মহাশয় নবাব আলী শ্যাক।
ইস্পেক্টারের ইঙ্গিতে কনেস্টবল নবাব আলীর হাত চাপিয়া ধরিল। নবার মুখ দিয়া তখন ধূলা উড়িতে লাগিল। সে মনে করিতে লাগিল, সমস্ত দুনিয়াটা বুঝি তাহার বিপদে ওলট-পালট খাইতেছে। সে এখন দিশাহারা, তথাপি বিলুপ্ত সাহসের কৃত্রিম ছায়া অবলম্বনে কনেস্টবলকে কহিল, ‘আপনে হুজুর কর্তা আমার হাত চাইপ্যা ধল্লেন কেন্? ছাড়েন, না ছাড়লে আমি এহনি এই দারোগা বাবুর কাছে নালিশ কইর্যা দিমু।”
ইন। (স্মিত মুখে) কি বলে নালিশ করবি?
নবা। হুজুর আমার বাপ-দাদা দুই পুরুষে কেউ চোর হয় নাই। আমিও চোর না। তবে কিছু ট্যাহা পইরা পাইছি, তা চান্ত’ এহনি বার করা দিতেছি।
ইনস্পেক্টার কহিলেন, “তবে বাড়ির ভিতর চল্।” কনেস্টবল নবার হাত ছাড়িয়া দিল, ইনস্পেক্টার তাহাকে সঙ্গে করিয়া সদলে নবার বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিলেন।
কনেস্টবল সঙ্গে গিয়া নবার টাকার বাক্স বাহিরে আনিল। সর্বসম্মুখে খোলা হইল, বাক্সে মাত্র ২০০ টাকা পাওয়া গেল। আর একটি ছোট রকমের টিনের বাক্স খোলা হইল, তাহা হইতে একখানি বেনারসী ও একখানি নীলাম্বরী শাড়ি আর ১৩ টি টাকা বাহির হইল। এই বাক্সটি নবা তাহার স্ত্রীকে ভালবাসিয়া খরিদ করিয়া দিয়াছিল। ইনস্পেক্টার নবাকে কহিলেন, “তোর বউ বেনারসী পরে, আর তুই বলিস আমি চোর না।” শাড়ী দেখিয়া নবার মাথা ঘুরিয়া গেল। কারণ সে এই শাড়ীর বিষয় কিছুই অবগত নয়। সে একটু সামলাইয়া কহিল, “হুজুর, আমি হাড়ীর কথা কিছুই জানি না। বউকে পুছিয়া দেহি কেমন কইরা এমন হাড়ী গরিবের বাড়ি আইল।” ইনস্পেক্টার আদেশ দিলেন। সে ঘরে গিয়া বউকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, তাহাদের মনিব-বউ তাহার স্ত্রীর নিকট দুইখানি শাড়ী বিক্রয় করিতে দিয়াছেন। বাস্তবিক তাহার স্ত্রী যে শাড়ী নিজে পরার জন্য মুনিব-বউয়ের নিকট হইতে টাকা দিয়া ক্ৰয় করিয়া আনিয়াছে, তাহা সে স্ত্রীর মুখে শুনিয়াও গোপন করিল।
ইন্। আচ্ছা, আর টাকা কোথায় রাখিয়াছিস বল।
নবা। আমি আর কোন হানে ট্যাহা রাখি নাই।
তখন ইনস্পেক্টারের আদেশে তাঁহার অনুচরগণ নবার বাড়িঘর তন্ন তন্ন করিয়া দেখিল, কিন্তু কিছু পাইল না, শেষে তাহার শয়নঘরের মেঝে খুড়িতে খুড়িতে এক পাতিল টাকা বাহির হইল। গুণিয়া দেখা গেল, সতর শত। ইনস্পেক্টার ক্রোধভরে নবাকে কহিলেন, “আট হাজারের মধ্যে ১,১৯৩ টাকা পাওয়া গেল। আর টাকা কোথায় আছে ভাল চাহিস ত খুলিয়া বল।”
নবা। হুজুর, এখন কাইট্যা ফেলালেও আর নবার ঘরে এক পয়সা পাইবেন না।
পুলিশ-অনুচারগণ নবার বাড়ি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া বাস্তবিকই আর কিছু পাইল না।
ইন্। তুই এত টাকা কোথা হইতে চুরি করিয়াছিস?
নবা। হুজুর আমি চোর না। ট্যাহা পইরা পাইছি।
ইন্। কোথায় পেয়েছিস বল। ঠিক কথা বলিলে, তোকে ফাটকে দিব না।
নবা। হুজুর, বাপ মা, যদি গোলামকে বাঁচান, তবে সব খুইল্যা কই?
ইন্। বল, তোর কোন ভয় নাই।
নবা। যেদিন আমার মুনিবকে জেলায় ধ’রে লিয়া যায়, হেইদিন রাতে আমি সায়েবের পুষ্কন্নিতে মাছ মারতে গেছিলাম। পশ্চিমপারে জালি দিয়া মাছ মারতেছি; দেহি তিনজন মানুষ অফিসের ঘাট দিয়া নাইমে আইসে একজন পানিতে নাম্ল। তারপর কি যেন তুইলে উপরের দুইজনের মাথায় দিল, আর, নিজেও একটা নিল। তারপর তিনজনাই উপরে উঠে গ্যাল। আমি পানিতে মিইশ্যা থাইক্যা দেহলাম।
ইন্। তিনজন কে কে?
নবা। কাল্ছা আঁধারে চেনা গেল না।
ইন্। তুই তখন কি করলি?
নবা। তারা চইল্যা গ্যালে আমি আস্তে আস্তে পূর্বপারে যাইয়া দ্যাহি পানির কিনারে কি যেন উচা হ’য়া আছে। হাত দিয়া দ্যাহি ট্যাহার ছালা। আমি তাই মাতায় কইর্যা বাড়ি আনছি।
ইন্। এই তিনটি লোককে কি একেবারেই চিনিতে পারিস নাই?
নবা। হুজুর পরে পারচি।
ইন্। (সোৎসাহে) কে কে?
নবা। রতীশ বাবু আর দাগু মামু।
ইন্। তারা যে চুরি করিয়াছে কেমন করিয়া বুঝিলি?
নবা। আমি হেই দিন ভোরে বাড়ি হইতে আইসে সায়েবের পুষ্কন্নিতে মুখ ধুইতে গেছিলাম। দ্যাহি রতীশ বাবু আর দাগু মামু পুষ্কন্নিতে রাতে হেই জায়গায় খাড়া হ’য়া কি যেন বলা করা করতেছে। আর রতীশ বাবু ট্যাহার জায়গায় হাত ইশারা কইরা কি যেন দেহাইতেছে। ওগার উপর আমার ভারি শোবা হইল কিন্তু ভাবলাম আর একজন কে? ধরার জন্যি তাহে তাহে থাক্লাম।
এই পর্যন্ত বলিয়া নবা থামিয়া গেল।
ইন্। তাহারপর আর কোন খোঁজ করিতে পারিস নাই?
নবা। হুজুর, আমাকে ছ্যাইড়া দিবেন ত?
ইন্। হাঁ, হাঁ, তুমি যদি সব কথা সত্য করে খুলে বলিস, তবে তোকে বেকসুর খালাস দিব।
নবা। তবে কই হোনেন। আমরা ৩/৪ জন গরিব মানুষ পাট বাঁধাই করি। রতীশ বাবুর বাসার নিকট আমাগোর বাসা।
ইন। রতীশ বাবু কি পরিবার লইয়া থাকেন?
নবা। না, হুজুর, তিনি ক্যাবল বাসায় পাক কইরা খান।
ইন্। রাত্রে কোথায় থাকেন?
নবা। হুজুর, অনেক রাতে থানার পশ্চিমে বৈষ্টমী পাড়া যান।
ইন্। কোন্ বৈষ্ণবীর বাড়িতে থাকেন, জানিস?
নবা। জানি, নলিনী বৈষ্টমীর বাড়িতে থাহেন। আমরা সেই বৈষ্টমীকে নলিনী ঠাকরাণী বলি! ঠাকরাণী না বললে বৈষ্টমী বেজার হয়, বাবুও রাগ করেন।
ইন্। থাক, আসল কথা বল।
নবা। হুজুর, আমি এ্যাক দিন বেশি রাত জাইগ্যা বাসায় বইসে আছি, পাশে রতীশ বাবুর বাসায় তেনি, দাগু মামু আর ফরমান ৩ জন মানুষের কথা শুইনা কান খাড়া কলাম। দাগু মামু এই কইতাছে, বাবু, যে ছালা আলাদা বালুতে গাড়া হইচিল, তা আপনি আগে চালাকী কইরা তুইল্যা আনচেন। তার অংশ আমাকে না দিল আমি সব ফাঁসায়া দেব। রতীশ বাবু কইল, “না দাগু ভাই, আমি কালী ঠাকুরুণের দিব্যি কইরা কইতে পারি আমি তা আনি নাই।’ দাগু মামু তখন ফরমান ভাইকে কইলেন, ‘একাজ তবে তুমিই কর’চ? ‘ফরমান ভাইও তখন রাগের মুখে কইল, ‘আমাকে অত শয়তান মনে কইর না। চিনির বলদের মত বোঝা বওয়াইয়া মোটে পাঁচ গণ্ডা ট্যাহা দিতে চাও, খোদায় এ্যার বিচার করবো। রতীশ বাবু হাইসে কইলেন, ‘ নেও ফরমান, তুমি আর আপত্তি কইর না, এ্যাক ঘন্টায় এক কুড়ি, আর কত? ফরমান কইলেন—”বাবু, আপনারা যে ছালায় ছালায়। আমি যদি ফাঁসায়ে দিই? দাগু মামু কইল, ‘কয়া দিয়া আর কি ঘন্টা করবা? মোকদ্দমা ত’ মিট্যা গ্যাছে। তার জন্যি বড়বাবুর ফাটক হইচে। রতীশ বাবু কইলেন, ‘আমার মনে কয়—যে জলের ছালা চুরি করচে, হেই বালুতে আলাদা গাড়া ছালা নিছে।”
দূরদর্শী, শান্তশিষ্ট ইনস্পেক্টার নবাকে আর প্রশ্ন করা আবশ্যক বোধ করিলেন না। যাহা শুনিলেন, তাহাই যথেষ্ট মনে করিয়া লিপিবদ্ধ করিলেন। অনন্তর নবাকে সঙ্গে করিয়া সদলে বেলগাঁও উপস্থিত হইলেন। বেলা তখন ১১টা।
ইনস্পেক্টার সাহেব নলিনী, রতীশ, দাগু ও ফরমানকে স্থানীয় পুলিশের হেফাজতে পৃথক বন্দী করিয়া রাখিয়া স্নানাহারের জন্য ডাকবাংলায় উপস্থিত হইলেন।
আহারান্তে অপরাহ্ণে ২টায় ইনস্পেক্টার সাহেব জোহরের নামাজ পড়িয়া খানাতল্লাসী আরম্ভ করিলেন। অগ্রে নলিনী বৈষ্ণবীর বাড়ি দেখা হইল। তাহার ঘরে নূতন লোহার সিন্দুক ও নূতন মজবুত স্টীলট্রাঙ্ক। সিন্দুক ও বাক্সের চাবি নলিনীর নিকট চাওয়া হইল। নলিনী ঝাড়িয়া জবাব দিল, “চাবি নাই, কাল হারাইয়া গিয়াছে।” ইনস্পেক্টার কহিলেন, “শয়তানি ছাড়, চাবি দাও। “ নলিনী নির্ভয়ে উত্তর করিল, “বলছি চাবি হারাইয়া গিয়াছে, কোথা হইতে দিব?”
নবা। চাবি বুঝি রতীশ বাবুর কাছে আছে। আমি তার কোমরে অনেকবার বড় ছোড়াণী দেকচি।
তখনই রতীশ বাবুর নিকটে পুলিশ গেল। বাবু চাবি লুকাইতে সময় পাইলেন না; অগত্যা বাহির করিয়া দিলেন। চাবি দুইটি পাইয়া ইনস্পেক্টার নবার প্রতি খুশী হইলেন। অগ্রে লোহার সিন্দুক খোলা হইল। তন্মধ্যে নগদ দুই হাজার টাকা ও পাঁচ শত টাকার নোট পাওয়া গেল। স্টীলট্রাঙ্ক হইতে নগদ চারিশত টাকা এবং কুড়ি ভরি পাকা সোনা বাহির হইল। ইনস্পেক্টার নলিনীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর টাকা কোথায় রাখিয়াছ!” নলিনী নিরুত্তর। ইনস্পেক্টার অন্যান্য বেশ্যাদিগের নিকট প্রমাণ লইয়া জানিতে পারিলেন, এক বৎসর হইল রতীশ বাবু নলিনীকে তাঁর দেশ হইতে এখানে আনিয়া ঘর করিয়া দিয়াছেন। নলিনী রতীশ বাবুর প্রতিবেশী জনৈক তন্তুরায়ের বাল্যবিধবা কন্যা। প্রথম যখন এখানে আইসে তখন অবস্থা শোচনীয় ছিল। অল্পদিন হইল হঠাৎ স্বচ্ছল হইয়াছে।
ইনস্পেক্টারের আদেশে নলিনীকে হাতকড়া দিয়া থানার হাজতে পুরা হইল। রতীশ বাবুর বাসাবাড়ি খানাতল্লাসী করিয়া কিছুই পাওয়া গেল না। শেষে ফরমানকে ধরা হইল।
ফরমান আমাদের পূর্বকথিত গণেশের ন্যায় সজ্ঞান বাচাল; ছোটবেলায় সে গ্রাম্য স্কুলে লেখাপড়া শিখিয়াছিল; কিন্তু অদৃষ্ট মন্দ, তাই দাগু যাচনদারের সহকারিতা করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। সে ইন্স্পেক্টার সাহেবকে দেখিয়াই লম্ফ-লম্ফ দিয়া বলিতে লাগিল, “হুজুর বুঝি খোদ ধর্মরাজ! ধর্মমাহাত্ম্য দেখাইতে আসিয়াছেন! আমি বুঝিয়াছিলাম, এই হোমরা-চোমরা সাহেব-সুবা সব আসিয়া যখন খাট্টা খাইয়া গেল, তখন ইংরেজের মুলুকে ধর্ম নাই, কিন্তু হুজুরের দাড়ির ভিতর ধর্ম আছে বলিয়া মালুম হইতেছে!” ইনস্পেক্টার সাহেবের সুন্দর চাপদাড়ি ছিল। তাঁহার বয়সও ৩৫/৩৬ বৎসরের বেশি নয়। তিনি হাসিয়া কহিলেন, তোমাকে ভাল লোক বলিয়া বোধ হইতেছে; মিথ্যা কথা বলিও না, ঠিক করিয়া বল, তুমি কত টাকা চুরি করিয়াছ?
ফর। হুজুর, ভাল লোক কি চুরি করে? তা’ যদি হয় তবে হুজুরকেও চোর বলা যায়। ইনস্পেক্টার সাহেব পুলিশ প্রভুদিগের ন্যায় অগ্নিশর্মা না হইয়া কার্যোদ্ধারের নিমিত্ত কহিলেন, “টাকার লোভে ভাল লোকও চোর হয়।”
ফর। তা হুজুরদিগের জেয়াদা।
ইন্। তবে তুমি টাকা চুরি কর নাই?
ফর। এক পয়সাও না।
ইন্। তবে কোম্পানির এত টাকা কে চুরি করিয়াছে?
ফর। হুজুর, দাগু বেটাকে ধরুন। বেটা দুপুর রাতে আমাকে ঘুম হইতে উঠাইয়া টাকার বোঝা বহাইয়া ৭/৮ দিন পরে মোটে কুড়িটি টাকা দিয়াছে। হুজুর, ভিজা ছালার টাকা— বালুচরে বহিয়া নিয়া আমার মাথার বেদনা ধরিয়াছিল, এখনও সারে নাই! হুজুর আমি যেন দাগু বেটার চিনির বলদ।
ইন্। তুমি যদি চুরির সব কাণ্ডকারখানা খুলিয়া বল, তবে তোমাকে আর চালান দিব না।
ফর। হুজুর, সেই কাণ্ডকারখানা আপনি শুনিলে তাজ্জব হইবেন। আমি সত্য ছাড়া এক বিন্দুও মিথ্যা বলিব না। আহা! হুজুর যদি হোমরা-চোমরাদিকের আগে আসিতেন, তবে বড়বাবুর ফাটক হইত না। হুজুর, তাঁর মত ভাল লোক এদেশে নাই। আমার মনে হলে তাঁর জন্য কান্না আসে!
ইন্। কে কে টাকা চুরি করিয়াছে?
ফর। রতীশ বাবু আর দাগু।
ইন্। কেমন করিয়া চুরি করিল?
ফর। হুজুর, প্রথমে টের পাই নাই। শেষে আস্তে আস্তে সব মালুম হইয়াছে।
ইন্। খুলিয়া বল।
ফর। যেদিন দুষ্টেরা টাকা চুরি করে, সেই দিন শনিবার ছিল। বড় বাবুর মন আগে থাকিতেই কি কারণে যেন খারাপ হইয়াছিল। কাজ কাম উদাসভাবে করিতেন, ভুল-ভ্রান্তি খুবই হইত।
ইন্। কি কাজে ভুল করিতেন?
ফর। তাই ত’ বলিতেছি, শুনেন না?
ইন্। (হাসিয়া) আচ্ছা বল।
ফর। উব্দা করে দোয়াতে কলম দিতেন।
ইন্। থাক আসল কথা বল।
ফর। বড়বাবুর ভুলের কথা বলি নাই; এখন আসল!
ইন্। (মৃদুহাস্যে) তবে তাড়াতাড়ি বল।
ফর। একদিন বাবু আমাকে বলিলেন, –’ফরমান বাবাজি, এক বদনা পানি আন ত’।’ আমি পানি আনিয়া দিলাম। বাবু চোখ বুজিয়া ফুরসী টানিতে শুরু করিলেন। অনেকক্ষণ টানিয়া টানিয়া কহিলেন, “ফরমান কি পানি দিলে হে, ধুঁয়া ত’ বাহির হয় না?’ আমি বললাম—”বাবু, পানি দিয়া কি ধোঁয়া বাহির হয়? তখন বাবুর চৈতন্য হইল। কহিলেন, ‘আরে না, পানি নয়, আগুন দাও।’
ইন্। তুমি মদ খাও নাকি?
ফর। তওবা, তওবা। আপনার বুঝি অভ্যাস আছে?
ইনস্পেক্টার সাহেব রাগ করিয়া কহিলেন, “বাচলামী রাগ, কেমন করিয়া কে কত টাকা চুরি করিয়াছে তাই বল।”
ফর। ভাবিয়াছিলাম আপনি বুঝি সক্রেটিস, তা এখন টের পাইলাম আপনি বাবা শা- ফরিদের দাদা।
ইন্। (ফরমানের দিক চাহিয়া) তুমি ওসকল নাম কিরূপে জান?
ফর। আপনি কি আমাকে চাষা মনে করেন?
ইন্। (হাস্য করিয়া) না, না, তুমি বিশিষ্ট ভদ্ৰলোক।
ফর। তবে শুনেন,—সেই শনিবার দুপুরের পর বড় বাবু অফিস-ঘর হইতে মসজিদে নামাজ পড়িতে গেলেন। দাগু বেটা আমাকে কহিলেন, ‘ফরমান, তুমি মসজিদের পথ আগুলিয়া দাঁড়াইয়া থাক; বড়বাবু মসজিদ হইতে বাহির হইলেই আমাদিগকে সংবাদ দিবে। রতীশ বাবু কহিল, ‘প্রিয় ফরমান, তুমি জান বড়বাবু নিজে দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার তামাক খান, কিন্তু আমাদের ভাগ্যে ২/১ বারও ঘটে না। তা’ এই অবসরে প্রাণভরে তামাক খাই, তুমি খুব সাবধানে বড়বাবুর আসার পথের দিকে চাহিয়া থাক।’ হুজুর রতীশ বাবু ও দাগু বেটার কল্যাণে দু’পয়সা উপরি পাই, তারা না দিলে উপায় নাই তাই তাদের কথামত কাজে প্রবিত্ত হইলাম। হুজুর, যদি জানতেম বড়বাবু ভুলে টেবিলের উপর ক্যাস বাক্সের চাবি রাখিয়া নামাজ পড়িতে গিয়াছেন, আর শালারা সেই অবসরে সিন্দুক খুলিয়া ছালা-বোঝাই টাকা পুষ্করিণীতে ডুবাইয়াছে তাহা হইলে কি আমি তাদের কথায় ভুলি? এমন বিশ্বাসঘাতক কাজের কথা আমি জন্মেও শুনি নাই, দেখা ত’ দূরের কথা।
ইন্। ঐরূপভাবে যে চুরি হইয়াছে, তুমি কত দিন পরে কেমন করিয়া জানিলে?
ফর। বড়বাবুর জেল হওয়ার পর চোরদের মুখেই শুনিয়াছি।
ইন্। তোমরা পুষ্করিণী হইতে টাকা কবে তুলিয়া বালুচরে রাখিয়াছিলে?
ফর। যেদিন বড়বাবু জেলায় চালান হইয়া যান সেই রাত্রিতে।
ইন্। তোমাকে কত টাকা দিয়াছিল?
ফর। মাত্র কুরি টাকা।
ইন্! তোমাকে ত’ খুব ঠকাইয়াছে?
ফর। হুজুর, না ঠকাইলে ফরমান মিয়ার কাছে এত খবর পাইতেন কিনা, সন্দেহের কথা বলিয়া মনে করুন।
ইনস্পেক্টার সাহেব অতঃপর দাগুকে ধরিয়া কহিলেন, ‘কোম্পানির টাকা চুরি করিয়া কোথায় রাখিয়াছ?’
দাগু। আমি কেন টাকা চুরি করিব?
ইস্পেক্টার সাহেবের হুকুমে তাহার অনুচরেরা দাশুর থাকিবার স্থান খুঁজিতে আরম্ভ করিল, কিন্তু কিছুই পাইল না।
ইন্। তোমার বাড়ি কোথায়?
দাগু। দুধের গ্রাম।
ইন্। গ্রামের নাম?
দাগু। আজ্ঞে হ্যাঁ।
ইন্। এখান হইতে কত দূর?
দাগু। দুই মাইল।
ইনস্পেক্টার সাহেব ঘরি দেখিয়া দাশুকে কহিলেন, “চল তোমার বাড়িতে যাইব।’ দাগুর মুখ শুকাইল। অনুচরেরা দাগুকে বাঁধিয়া লইয়া ইনস্পেক্টার সাহেবের পশ্চাদগামী হইল।
দাশুর বাড়ি তন্ন তন্ন করিয়া দেখা হইল, কোথাও কিছু পাওয়া গেল না; ইনস্পেক্টার সাহেব হতাশ হইয়া ফিরিতে উদ্যত হইলেন। ফরমান সঙ্গে গিয়াছিল, সে ইনস্পেক্টার সাহেবকে কহিল, “হুজুর, একটা জায়গা দেখা বাকি আছে, আমি গল্পে শুনিয়াছি, সেয়ানা চোরেরা চুরির মাল চুলার নিচে রাখে।’ ফরমানের কথা ইনস্পেক্টার সাহেবের মনে ধরিল। তিনি দাগুর রান্না ঘরের চুলা খুঁড়িতে অনুচরগণকে আদেশ করিলেন। আদেশানুসারে কার্য চলিল। চুলার অনেক নিচে মুখবন্ধ একটি তামার ডেকচি পাওয়া গেল। ভুলিয়া দেখা গেল পুরা দুই হাজার টাকাই পাত্রে রাহিয়াছে! ইনস্পেক্টার সাহেব উল্লসিত হইয়া কহিলেন, “ফরমান, তুমি বাঁচিয়া গেলে।“
ফরমান। আপনার মুখে ধান-দূর্বা।
অতঃপর ইস্পেক্টার সাহেব অনুমান করিলেন বালুচরে পৃথক পোতা যে এক ছালা টাকার জন্য রতীশ বাবু কালী ঠাকুরুণের শপথ করিয়াছেন,–নবা বলিয়াছে সে টাকা রতীশ বাবুই চোরের উপর বাটপারী করিয়া আত্মসাৎ করিয়াছেন। কারণ, ম্যানেজার সাহেব বলিয়াছেন, চারি ছালা টাকা খোয়া গিয়াছে, প্রত্যেক ছালায় দুই হাজার করিয়া টাকা ছিল। সুতরাং রতীশ বাবু এক ছালা টাকা লইলে তাঁহার রক্ষিতার ঘর হইতে নগদ মোট দুই হাজার নয়শত এবং বাকি সোনার ভরি ২৫ টাকা ধরিলে ২০ ভরি স্বর্ণের মূল্য ৫০০ টাকা অর্থাৎ মোট তিন হাজার দুইশত টাকা! অবশিষ্ট টাকা পাওয়া অসম্ভব। কারণ প্রমাণে নলিনীর যে অবস্থা জানা গেল, তাহাতে এক ছালা টাকা বাদে সে নিজে এক হাজার দুইশত টাকা জমাইতে পারে নাই। এখন দেখা যাইতেছে, মোট আট হাজারের মধ্যে আটশত টাকা নাই। এই টাকা হয় রতীশ না হয় নলিনীর নিকট আছে।
রতীশ বাবু যখন অবশিষ্ট টাকার কথা মোটেই স্বীকার করিলেন না, তখন ইনস্পেক্টার সাহেব স্থানীয় পোস্ট অফিসে উপস্থিত হইয়া মাস্টার বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানকার পাট অফিসে কেরানী রতীশ বাবু ২/১ সপ্তাহের মধ্যে সেভিংস ব্যাঙ্কে কোন টাকা জমা দিয়াছেন কি না? অথবা মনিঅর্ডারে কোথাও পাঠাইয়াছেন কি না?” পোস্ট মাস্টার বাবু খাতাপত্র দেখিয়া কহিলেন, ‘হ্যাঁ, চারিশত টাকার মনিঅর্ডার করিয়াছিলেন এবং চারিশত টাকা ব্যাংকে জমা দিয়াছেন।”
ইন্। কোথায় মনিঅর্ডার করিয়াছে?
পোস্ট। বাড়িতে তাঁহার পিতার নিকট।
রতীশ বাবুর সহিত পোস্ট মাস্টারের জানাশুনা ছিল। ইন্স্পেক্টার সাহেব রতীশ বাবুর পিতার নাম জানিয়া তখনি তার, করিলেন, “চারিশত টাকার মনিঅর্ডার পাঠাইয়াছি, এ পর্যন্ত প্রাপ্তি সংবাদ রসিদ না পাইয়া চিন্তিত আছি।” ইতি –
রতীশচন্দ্র—বেলগাঁও।
উত্তর আসিল, টাকা পাইয়াছি।
ইনস্পেক্টার সাহেব তখন আপন আনুমানিক কার্যের সত্যতা দেখিয়া খোদাতায়ালাকে অশেষ ধন্যবাদ করিলেন।
এইরূপে চুরি আস্কারা করিয়া ইনস্পেক্টার সাহেব ডাকবাংলায় চলিয়া গেলেন।
তিনি ডাকবাংলায় উপস্থিত হইলেন, জুট-ম্যানেজার সাহেবও তথায় আসিলেন।
ম্যানে। কল্পনার অতীত এমন জটিল চুরি আপনি কিরূপে আস্কারা করিলেন? আপনি সত্বর সুপারিন্টেণ্ডেন্ট হইবেন।
ইন্। ইহাতে আমার কৃতিত্ব কিছুই নাই।
ম্যানে। তবে কাহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে এমন ডাকাতি ধরা পড়িল?
ইন্। আপনারা যে নির্দোষ ব্যক্তিকে জেলে দিয়াছেন, তাঁহার সহধর্মিণীর সন্ধানে। ম্যানেজার সাহেব লজ্জিত ও দুঃখিত হইলেন। পরে কহিলেন, “তিনি অসূর্যস্পশ্যা, কিরূপে এমন সন্ধান করিয়াছেন?”
ইন্। আপনাদের তহবিল তছরূপের টাকা শোধের জন্য সতী গাত্রালঙ্কার প্রভৃতি বিক্রয় করতঃ শেষে উদরান্নের জন্য পরিধেয় শাড়ী বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, সেই সূত্রে
চোরের সন্ধান হয়।
ম্যানে। আমি নুরল এসলামের স্ত্রীর প্রতি-ভক্তিতে ক্রমশঃই বিস্ময় বিমুগ্ধ হইতেছি। পীড়িত পতির প্রাণরক্ষাই এই লোকাতীত ঘটনা! আবার এই এক আশ্চর্য ব্যাপার! খুলিয়া বলুন।
ইন্। আমাদের উকিল সাহেবকে আপনি জানেন। তাঁহার নিকট আপনার মহত্ত্বের ভূয়সী প্রশংসা শুনিয়াছি। তাহার স্ত্রী আপনাদের নুরল এসলাম সাহেবের স্ত্রীর সখী। নুরল এসলাম সাহেবের স্ত্রী, তাঁহার সখীকে পত্র লিখেন, “আমাদের খানাবাড়ীর প্রজা নবাব আলী শেখের স্ত্রী আমার নিকট হইতে ১৫৭ টাকা দিয়া দুইখানা শাড়ি কিনিয়া লইয়াছে। তাহার স্বামী দিন মজুরী করিয়া খায় সুতরাং এত টাকা সে কোথায় পাইল—জিজ্ঞাসা করায় ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, ‘আমার সোয়ামী কিছু টাকা কুড়াইয়া পাইয়াছে।’ সবিশেষ জিজ্ঞাসায় অবগত হইলাম, নবাব আলী বেলগাঁও জুট ম্যানেজার সাহেবের পুষ্করিণীতে রাত্রিতে মাছ ধরিতে যাইয়া একছালা টাকা পাইয়াছে। আমার বিশ্বাস, যে টাকার নিমিত্ত তোমার সয়া” – এই পর্যন্ত লিখিয়া পতিপ্রাণা আর কিছু লিখিতে পারেন নাই। আমি উকিল সাহেবের নিকট এই চিঠি দেখিয়াছি। তিনি এই চিঠি লইয়া ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখাইয়া সব খুলিয়া বলেন; ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে তদন্তের জন্য পাঠাইয়াছেন।
ম্যানেজার সাহেব শুনিয়া সহর্ষে বলিয়া উঠিলেন, “জগতে সতী-মহাত্ম্যের তুলনা নাই।”