ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
ভূঞা সাহেব কার্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গিয়াছিলেন। সন্ধ্যার পর বাড়ি আসিলেন। জামাতাকে দেখিয়া আশির্বাদ করার পর কুশল-প্রশ্নাদি জিজ্ঞাসা করিলেন। রাত্রিতে যথাসময়ে সকলের আহার-ক্রিয়া সম্পন্ন হইল। ভূঞা সাহেবের কৃষাণ চাকরগুলি সকলেই তাঁহার প্রতিবাসী। এজন্য সকলেই রাত্রিতে বাড়ি যায়। কেবল পালাক্রমে প্রহরীরূপে একজন চাকর তাঁহার বাহির বাড়ির গোলাঘরে শয়ন করিলেন। ভূঞা সাহেব শয়ন ঘরে প্রবেশ করিয়া মেঝেতে সারি দেওয়া চৌদ্দটি তোড়া দেখিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এগুলিতে কি? কোথা হইতে আসিল?” স্ত্রী স্বামীর মুখের প্রতি তীব্র কটাক্ষ হানিয়া কহিল “খুলিয়া দেখ না?” ভূঞা সাহেব একটি তোড়া হাতড়াইয়া কহিলেন, “এ টাকা কে দিল?” স্ত্রী পুনরায় মর্মস্পর্শী কটাক্ষ নিক্ষেপে কহিল, “খোদায় দিয়াছে, জামাই আনিয়াছে।” ভূঞা সাহেব তাহার উত্তরে কিছু না বলিয়া পান চাহিয়া শয়ন খাটে উঠিলেন।
রাত্রি দ্বিপ্রহর। ভূঞা সাহেবের শয়ন-ঘরে বাতি জ্বলিতেছে। কৃপণের ঘরে এত রাত্রি পর্যন্ত আলো। প্রৌঢ়াতীত ভূঞা সাহেবের স্ত্রৈণ জীবনের আরাম দায়িনী, সুখ-সন্তোষ – বিধায়িনী, ধর্মসহচারী, কর্মবিধাতৃ, আজ্ঞাপ্রদায়িনী, প্রেমময়ী প্রাণাধিকা পত্নী গোলাপজান অতি সন্তর্পণে তোড়ার মুখ খুলিয়া টাকাগুলি মেঝেতে ঢালিতে লাগিল। এক দুই করিয়া পাঁচ তোড়া ঢালা হইল। এক গাদা টাকা! তদুপরি আরো দুই তোড়া ঢালিল। স্তূপাকার রজতমুদ্রার ধবল চাকচিক্য প্রদীপালোকে আরও উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। হায়রে রৌপ্য চাক্তি! সাধু বলেন, “তুমি হারামের হাড্ডি।” বহুদর্শী বলেন, “তুমি সর্বগুণিনাশিনী শয়তানের জননী। পৃথিবীর যাবতীয় অনিষ্টের মূলেই তুমি। কারুণ, নমরুদ, শাদ্দাদ, হামান ও ফেরাউন শ্রেণীর লোকের কার্যকলাপ ভাবিলে তোমাকে বাস্তবিক পিশাচের প্রসূতি বলিয়া মনে হয়; কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, তোমার এত দোষ, তুমি এত নীচ, তথাপি নরনারী তোমার মায়ায় এত মুগ্ধ। তোমার মোহুমদে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান তিরোহিত হয়। ধর্মবুদ্ধি সুদূরে পলায়ন করে। হায়! মানুষ যখন তোমার মোহনরূপে আত্মহারা হইয়া পড়ে, তখন অতি ভীষণ দুষ্কার্যও সুসঙ্গত মনে করে এবং পরিণাম চিন্তায় অন্ধ হইয়া তৎসম্পাদনে কৃতসঙ্কল হয়।’
রাশিকৃত রৌপ্যখণ্ড দীপালোকে ঝক্ ঝক্ করিতেছে। গোলাপজান একদৃষ্টে তৎপ্রতি চাহিয়া আছে। এত মুদ্রা এক সঙ্গে সে কখনও দেখে নাই, আজ দেখিয়া চক্ষু সার্থক করিতেছে! ইহা ছাড়া আরও এত টাকা পাশেই তোড়াবন্দী রহিয়াছে। সবগুলি টাকা সে নিজস্ব করিয়া লইয়া দেখিবার সঙ্কল্প করিতেছে। হায়! উদ্দাম-প্রবৃত্তি-প্ররোচনায় সে আর সাধের সঙ্কল চাপিয়া রাখিতে পারিল না। প্রকাশে পতিকে কহিল, “এ টাকাগুলি রাখা যায় না?” পতি চমকিয়া উঠিলেন, পরে কহিলেন, “তুমি বল কি? তোমার কথা ত, বুঝিতেছি না।” গোলাপজান এবার স্ত্রৈণ পতির মুখখানিতে ভুবন-ভুলান সম্মোহনবাণ নিক্ষেপ করিল, কামিনী কটাক্ষ দামিনীর প্রকৃতিসম্পন্ন। তাই কবি বলিয়াছেন—
“যে বিদ্যুচ্ছটা রমে আঁখি,
মরে নর তাহার পরশে।”
স্ত্রৈণ পতির মাথা ঘুরিয়া গেল। গোলাপজান শরসন্ধান সার্থক মনে করিয়া পুনরায় কহিল, “আমি টাকাগুলি নিজস্ব করিয়া রাখিতে চাই।” রৌপ্য-সুন্দরীর মোহিনী মায়ায় পতিও তখন অল্পে অল্পে অভিভূত হইয়া পড়িতেছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে কহিলেন, “জামাতা বিশ্বাস করিয়া যে টাকা দিয়াছে, তাহা তুমি কেমন করিয়া রাখিবে? “গোলাপজান কোপ-কটাক্ষে কহিল, “তুমি নামে মরদ, কিন্তু আসলে”— স্ত্রীর তীব্র বিদ্রুপে স্ত্ৰীগত প্ৰাণ পতির মনুষ্যত্ব দুর্বল হইয়া পাশবত্ব বাড়িয়া উঠিল। তখন তিনি মোহান্ধ হইয়া কহিলেন, “টাকা কি উপায়ে রাখিতে চাও?” গোলাপজান বাক্স হইতে এক সুবৃহৎ ছুড়ি বাহির করিয়া পাতিকে দেখাইল। পতির প্রাণ শিহরিয়া উঠিল। কিন্তু গোলাপজান অসঙ্কোচে ছুরির ধার পরীক্ষা করিতে লাগিল। ছুরির মুখে কিছু মরিচা ধরিয়াছিল। গোলাপজান খাটের নিচ হইতে একটা নূতন পাতিল বাহির করিয়া তৎপৃষ্ঠে সাবধানে মরিচা তুলিতে লাগিল। মৃৎপাত্রের হৃদয় চিরিয়া চিড় চিড় কিডু কিডু শব্দ উত্থিত হইতে লাগিল। সাবধান, অতি সাবধান! তথাপি মৃৎপাত্র যেন মর্মভেদী করুণ আর্তনাদে গোলাপজানকে বলিতে লাগিল, ওহে সুন্দরী, তুমি কুসুম-কোমল স্নেহ-দয়ারূপা পুণ্যের জননী, নারীর পূত নামে কলঙ্ককালিমা লেপন করিও না।” গোলাপজান তখন রৌপ্য চাক্তির লোভে আত্মহারা অভিভূতা; সুতরাং সে আর্তনাদের ভাবে তাহার পাষাণ-প্রাণ বিচলিত হইল না; কিন্তু বিচলিত হইল তাঁহার চিরানুগত পতির প্রাণ, আর অত্যধিক বিচলিত হইল পাশের সুতিকাগৃহের একটি নব- প্রসূতির অন্তরাত্মা; প্রসূতি, ছুরি ধার দেওয়ার বিকট শব্দে জাগ্রত হইয়া পৃথক শয্যায় নিদ্রাভিভূতা ধাত্রীকে নিঃশব্দে জাগাইল এবং অবিলম্বে অবস্থা জানিতে তাহাকে পিতার ঘরের দিকে পাঠাইয়া দিল। আনোয়ারার সূতিকাগৃহ দক্ষিণদ্বারী ঘরের সম্মুখে করিয়া দেওয়া হইয়াছিল।
এই সময় বিচলিত পতি, ভয়াতুর ভাষায় স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ছুরি দিয়া কি করিবে?” পিশাচী পতির পরিশুষ্ক মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “সাধে কি তোমায় না-মরদ বলিয়াছি, এতক্ষণ বুঝ নাই ছুরি দিয়া কি করিব? এই ছুরির সাহায্যে তোমাকে সবগুলি টাকা নিজস্বরূপে সিন্দুকে তুলিতে হইবে।” পতি কহিলেন, “সর্বনাশ! আমা দ্বারা কিছুতেই এক কার্য হইবে না।” স্ত্রী ক্রোধভরে কহিল, “হইবে যে না তাহা বুঝিয়াছি। আচ্ছা আমার সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হও।” পতি কহিলেন, “আমি তাহাও পারিব না। তোমাকে এই ভীষণ কার্য করিতে নিষেধ করিতেছি। এ দুষ্কার্য অপ্রকাশ থাকিবে না। এই খুনের বদলে আমাদের উভয়কে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে।” স্ত্রী বুক ফুলাইয়া কহিল, “আমি জাফর বিশ্বাসের কন্যা। আমার কথামত কাজ করিলে, ভূতেও জানিতে পারিবে না, তোমার গায়ে কাঁটার আঁচড়ও লাগিবে না।” পতি কহিলেন, “মেয়েটি চিরকালের মত দুঃখিনী হইবে।” স্ত্রী কহিল, “ মেয়ে ত’ ভারী সুখে আছে! তার যত পুঁজিপাটা ছিল, কোন রাজার মেয়েরও অত থাকে না। মেয়ে সর্বস্ব সোয়ামীর পায়ে দিয়াও তাহার মন পায় নাই। এই ত’ ছেলে হওয়ার পূর্বে নাকি জামাই তাহাকে ত্যাগ করিয়াছিল। আরও শুনিলাম, তোমার কুলিন জামাই সাহেব টাকা চুরি করিয়া জেল খাটিয়া আসিল। বেহায়া মেয়ে আবার তাহাকেই রক্ষা করিবার জন্য নিজের টাকা-গহনা তার দাদিমার সব পুঁজিপাটা দিল। উপরন্ত তুমিও অনটন সংসার হইতে ৩০০, ৪০০ টাকা দিলে। আবার মেয়ের দাদি মরার পর দাদির এতগুলি সোনা-রুপার গহনা নগদ টাকা-পয়সা দুষ্ট জামাই মেয়েকে ফুসলাইয়া বাড়িতে পার করিয়াছে। বাঁচিয়া থাকিলে এইরূপে আস্তে আস্তে তোমার গৃহস্থালী উজার করিবে। এই গুণের জামাই-মেয়ের জন্য তোমার মায়া ধরিয়াছে, তোমাকে আর বলিব কি?” কৃপণ পতি মনে মনে ভাবিয়া দেখিলেন, স্ত্রী যে সকল কথা বলিল, তাহার একটি কথাও মিথ্যা নয়। চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে তাহার পাশবত্ব পূর্ণমাত্রায় বৃদ্ধি পাইল; মনুষ্যত্ব অধিকতর দুর্বল হইয়া পড়িল। স্ত্রী দেখিল, পতির মন খুবই নরম হইয়া আসিয়াছে। সে আবার বলিতে লাগিল, আজ যদি ফয়েজ উল্লার (আজিম উল্লার পুত্র) সহিত মেয়ের বিবাহ হইত, তবে মেয়ের ও তাহার দাদিমার হাজার হাজার টাকার গহনা ও নগদ টাকা-পয়সা রতনদিয়ায় যাইত না; সমস্তই শেষে তোমার হাতে পড়িত। ফয়েজের পিতা যত টাকা নগদ দিতে চাহিয়াছিল তাহাও তোমার হাতে থাকিত। তাছাড়া, ভাই হামেশা টাকা-পয়সা দিয়া তোমার উপকার করিত, কিন্তু এই জামাইয়ের গুণে তোমার সব আশাতেই ছাই পড়িয়াছে।” এই পতির দুর্বল মনুষ্যত্বটুকু একেবারে লোপ পাইল। স্ত্রী পতির মনের ভাব বুঝিয়া আনন্দিত হইয়া কহিল, “আমি মনে করিয়াছি এই রাত্রেই এই আপদটাকে শেষ করিয়া টাকাগুলি সিন্দুকে তুলিব। ফয়েজ উল্লার বউ মরিয়াছে, তোমার বিধবা মেয়েকে তাহার সহিত বিবাহ দিয়া আমাদের চির আশা পূর্ণ করিব। মেয়েও সুখে থাকিবে, তুমিও এই টাকায় চিরকাল সুখে শুইয়া বসিয়াই কাটাতে পারিবে। এখন বুঝিয়া দেখ, আমি কেমন ফন্দি ঠাওরাইয়াছি।” এইবার পতি কহিলেন, “তুমি যাহা করিবে তাহার সাথী আছি।”
এদিকে ধাত্রী নব-প্রসূতির উপদেশে প্রসূতির পিতার ঘরের বারান্দায় উঠিয়া জানালা পথে সমস্ত দেখিল, সমস্ত শুনিল; অতঃপর ঘরে পুনঃ প্রবেশ করিয়া প্রসূতিকে সমস্ত কহিল। শুনিয়া প্রসূতি হতবুদ্ধি হইয়া কাঁপিতে লাগিল।