একবিংশ পরিচ্ছেদ
অতঃপর দিখণ্ডিত লাশ ছালায় ভরিয়া কলসী সঙ্গে বাঁধিয়া স্রোতে ডুবাইয়া দেওয়া হইল। গোলাপজান আলো জ্বলিয়া বৈঠকখানার রক্তাদি ধৌত করিল। তখন রাত্রি দ্বি-প্রহর অতীত। স্বামী-স্ত্রী ঘরে আসিল। গোলাপজান ঘরে আসিয়া পুনরায় অবসন্নচিত্তে টাকার পার্শ্বে মেঝেতেই বসিয়া পড়িল। তাহার অন্তরাত্মায় ঘোর অশান্তির তুফান। ক্রমে সর্বাঙ্গ দিয়া ঘৰ্ম ছুটিল। সে নির্বাক হইয়া পরিশ্রান্ত কলেবরে ক্রমশঃ ঝিমাইতে ঝিমাইতে টাকার পার্শ্বে তন্দ্রাভিভূতা হইয়া পড়িল। ভূঞা সাহেব ম্রিয়মান হইয়া শয়নখাটে আশ্রয় লইলেন, কিন্তু পাপের বিভীষিকা তন্দ্রাবস্থায় উভয়কে অস্থির করিয়া তুলিল।
গোলাপজান তন্দ্রাবশে স্বপ্ন দেখিতে লাগিল, তাহার সম্মুখে বিশাল আগ্নেয় দেশ। তাহাতে সারি সারি অত্যুচ্চ আগ্নেয়গিরি অসংখ্য আগ্নেয় গহ্বর, অসংখ্য জ্বালাময় উৎস, স্থানে স্থানে আগ্নেয় নদী। পৃথিবীর অগ্নি অপেক্ষা যেন সহস্রগুণ তেজস্কর অগ্নি তাহাতে ধক্ ধক লক্ লক্ করিয়া জ্বলিতেছে এবং তাহার ভীম গর্জনে ভয়াবহ হুহুঙ্কারে সেই ভয়াবহ সর্বভূক্ দেশ কম্পিত হইতেছে। আবার পাপীদের অস্থিমর্জা পুড়িয়া পলকে পলকে ঝলকে ঝলকে তাহা হইতে অগ্নিময় ধূম্রপুঞ্জ মহাবেগে মহাগর্জনে ঊর্ধ্বগামী হইয়া সেই বহবায়তে অগ্নিরাজ্য সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছে। কোন স্থানে রক্ষিগণ অসংখ্য নর-নারীর হস্তপদ বন্ধন করিয়া জ্বালাময় অনলকুণ্ডে নিক্ষেপ করিতেছে; আর তাহাদের পঞ্জরাস্থিসমূহ উত্তপ্ত কটাক্ষে তপ্ত-তৈল ভর্জিত মৎস্যের ন্যায় পটপট চট পট রবে ফুটিয়া উঠিতেছে। কোন স্থানে নব- নবতিশিরা ফণিনী তীব্র হলাহল মুখে অসংখ্য নরনারীর বক্ষঃস্থল পুনঃ পুনঃ দংশন করিতেছে। আগ্নেয় রাজ্যের এই ভয়াবহ অবস্থা দর্শনে গোলাপজান থাকিয়া থাকিয়া আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিতে লাগিল। এই অবস্থায় সে আরও দেখিতে লাগিল, কোন স্থানে বিশ্বদাহী হুতাশন-তেজে শত শত মানব-মানবীর দেহ হইতে সফেন ক্লেদাদি নির্গত হইতেছে; আর তাহারা আর্তনাদ করিয়া বলিতেছে, কি ভীষণ যাতনা! কি নিদারুণ পিপাসা! উঃ বুক ফাটিয়া গেল। এই যন্ত্রণার উপর আবার তত্রত্য প্রহরীগণ, তাহাদের পিপাসা শান্তির ছলে উত্তপ্ত গলিত শবনির্যাস সেই হতভাগ্যদিগের মুখের মধ্যে ঢালিয়া দিতেছে। এই দৃশ্য দেখিয়া গোলাপজান আর স্থির থাকিতে পারিল না; চীৎকার করিয়া উঠিল। আবার সে দেখিতে লাগিল, কোন স্থানে ভীমদর্শন রক্ষীগণ শত শত লোকের চক্ষুমধ্যে অগ্নিময় ত্রিধার লৌহ শলাকা প্রবিষ্ট করিয়া দিয়া পেটের ভিতর দিয়া বাহির করিয়া ফেলিতেছে। কোন স্থানে শত শত লোকের আপাদমস্তক আগুনের বিনামা প্রহারে জর্জরিত করিতেছে। জিহ্বা টানিয়া বাহির করিয়া জ্বলন্ত লৌহশলাকায় প্রবিদ্ধ করিতেছে। হৃৎপিণ্ড ছিঁড়িয়া লেলিহান কুকুরের মুখে ফেলিয়া দিতেছে। শেষে শতকোটি মণ ভারী আগ্নেয় প্রস্তর বুকে চাপা দিয়া চলিয়া যাইতেছে।
এই সকল ভয়াবহ নিদারুণ দৃশ্য দেখিয়া গোলাপজান একান্ত ভীত চিত্তে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “হায়! আমি কোথায়? আমি এখানে কেন?” তখন জনৈক ভীমদর্শন নরকপাল, তাহার সন্নিহিত হইয়া সক্রোধে কহিল, ‘পাপিয়সী! এইত’ তোর উপযুক্ত স্থান। তুই অবলা হইয়া আজ যে কার্য করিলি, এমন দুষ্কার্য দুনিয়ায় কেহ করে না। হায়! তোর মহাপাপে আজ খোদাতায়ালার আরশ পর্যন্ত কম্পিত হইয়াছে। তোর নারীজন্মে শতধিক্! বিশ্বাসঘাতিনী, পরানষ্টে, আত্ম-বিনাশিনী, ঐ দ্যাখ তোর চির বাসস্থান।” গোলাপজান সম্মুখে দৃষ্টিপাত করিয়া আরও শিহরিয়া উঠিল। সে দেখিল সর্বাপেক্ষা গভীরতমন গভীর এক প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড। ঊষ্ণতার আতিশয্যে তাহার অগ্নিনীলবর্ণ হইয়া গিয়াছে এবং লোলশিখা আকাশ স্পর্শ করিয়াছে। নরকপাল গোলাপজানের গলদেশে অগ্নিময় পাশ সংলগ্নকরত টানিয়া লইয়া সে ভীষণ অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিল। সে তখন উচ্চ চীৎকারে জাগিয়া উঠিল।
এই সময় ভূঞা সাহেবও তন্দ্রাবস্থায় ধীর উচ্চরবে বলিতেছিলেন, “হায় কি করিলাম, পাপী, পাপ ধনে, প্রাণে বিনষ্ট হইলাম। ডাকিনী, পিশাচী তোর রূপে পাপ! ডাকাতের মেয়ে, বিবাহ চাই না, দুরহ দুরহ! (শয়নখট্টায় পদপ্রহর।)
গোলাপজান জাগ্রত হইয়া ভাবিতে লাগিল, –আমি যেরূপ ভয়ানক খোয়াব দেখিলাম; উনিও বুঝি সেইরূপ দেখিয়া বকাবকি করিতেছেন। খুন করিলে লোকে বুঝি ঐরূপ খোয়াবই প্রথম প্রথম দেখিয়া থাকে। তা’ খোয়াব ত’ মিছা। খোয়াবে কতদিন আকাশে উঠিয়াছি, সাগরে ডুবিয়াছি, বাঘের মুখে পড়িয়াছে, আগুনে জ্বলিয়াছি, কিন্তু আজতক্ তার কোনটিই ফলে নাই, সব মিছা হইয়াছে। ফলে, খোয়াব দেখা কিছুই নয়। মনের বিকারে ওসব হয়। এইরূপ বিতর্ক করিয়া সে মনে মনে সাহস সঞ্চার করিতে লাগিল। ভূঞা সাহেব আবার বলিতে লাগিলেন, “ওঃ কি সাংঘাতিক দুষ্কার্য! হায়, এ মহাপাপের মুক্তি নাই! ঐ যে পুলিশ— ফাঁসি—দ্বীপান্তর।” গোলাপজান তখন স্বামীর শরীরে ঠেলা দিয়া কহিল, “কি গো, ভূতে পাইয়াছে নাকি?
ভূঞা। অ্যা অ্যা কি?
গোলাপ। এতক্ষণ কি বকিতেছিলে?
ভূঞা। কৈ? কি? না, না।
গোলাজপান ঘৃণার ভাবে কহিল, “তুমি পুরুষ হইয়াছিলে কেন?” অতঃপর এইরূপে রাত্রি প্রভাত হইল।
ভূঞা সাহেব গ্রামের প্রধান ও পঞ্চায়েত। প্রাতঃকালে কার্যোপলক্ষ্যে অনেক লোক ক্রমে তাঁহার বাড়িতে সমাগত হইতে লাগিল। চৌকিদার ট্যাক্স আদায়ের সাড়া দেওয়ার হুকুম লইতে আসিল। ভূঞা সাহেব দারুণ অশান্তি-উৎকণ্ঠ হৃদয়ে চাপিয়া বাহির বাড়িতে আসিলেন। এই সময় গ্রামান্তর হইতে কতিপয় ভদ্রলোক প্রয়োজন বিশেষে নৌকাপথে তথায় উপস্থিত হইলেন। কথা প্রসঙ্গে তাঁহারা কহিলেন, “আমরা আসিবার সময় আপনাদের গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে একটা লাশ দেখিয়া আসিলাম। একটি আমগাছের শিকড়ে আটকাইয়া আছে এবং ছালার ভিতর হইতে পা দেখা যাইতেছে। অদ্য মরিয়াছে বলিয়া বোধ হইল। থানায় সংবাদ দেওয়া উচিত।” শুনিয়া ভূঞা সাহেবের মুখ দিয়া ধুলা উড়িতে লাগিল। উপস্থিত গ্রামবাসীরা লাশ দেখিতে চৌকিাদারসহ নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইল।
কিয়ৎকাল পর ছালায় ভরা সেই লাশ আনিয়া ভূঞা সাহেবের বাহির বাড়িতে নামান হইল। খুলিয়া দেখা গেল, গোলাপজানের প্রাণাধিক পুত্র বাদশা। গোলাপজান যখন অন্তঃপুর হইতে শুনিল, কে যেন বাদশাকে খুন করিয়াছে; তখন সে কিয়ৎক্ষণ বজ্রাহত ব্যক্তির ন্যায় নির্বাক ও নিস্পন্দ হইয়া রহিল। তাহার পর হঠাৎ দ্রুতবেগে উন্মত্তার মত বহির্বাটিতে আসিয়া মৃত পুত্রের নিকট মূর্ছিতা হইয়া পড়িল। ভূঞা সাহেব কাষ্ঠ পুত্তলিকার ন্যায় নিশ্চেষ্টভাবে স্বস্থানে বসিয়া রহিলেন। শবের চতুর্দিকে সমবেত লোক সকল নীরব ও স্তম্ভিত। অনেকক্ষণ পর-ধীরে সভয়ে জনতা মধ্য হইতে শব্দ হইল, “ওহ্! কি ভয়ানক খুন! কি নিদারুণ হত্যা! নিদারুণ হত্যা! হায়! এমন সর্বনাশ কে করিল?” এমন সময় গোলাপজান চৈতন্য লাভ করিয়া উন্মত্তভাবে বলিয়া উঠিল, “সর্বনেশে জামাই আমার ছেলে খুন করিয়া পলাইয়াছে। এই সময় নুরল এসলাম অগ্রসর হইয়া কহিলেন, “মাগো, আমি পলায়ন করি নাই, আপনার পুত্রও হত্যা করি নাই! টাকাই বুঝি এ কার্য করিয়াছে।” গোলাপজান ভীষণ বিকট কটাক্ষে নুরল এসলামের দিকে চাহিয়া কহিল, “ও ভরানেশে, তুই এখনও বাঁচিয়া আসিছ? আর না, আমার সে ছুরি কৈ? তাই দিয়া তোকে এখনি ছেলের সাথী করিতেছি।”—এই বলিয়া পুত্রনাশিনী ক্ষিপ্ত রাক্ষসীর ন্যায় উন্মুক্তবেশে ছুরি আনিতে অন্দরে দিকে ছুটিল। তাহার গতিরোধে কেহই সাহসী হইল না। আলুলায়িত উন্মাদিনীর সর্বসংহারিণী মূর্তি দেখিয়া দাসীগণ অন্তঃপুরে চীৎকার করিয়া উঠিল! আনোয়ারা সূতিকাগৃহে থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল! পিশাচী ছুরির জন্য ঘরে উঠিতেই হামিদার পিতা পশ্চাদ্দিক হইতে যাইয়া ঝাপটিয়া ধরিয়া তাহার হাত বাঁধিয়া ফেলিলেন।