» » পরিণাম-পর্ব

বর্ণাকার

অষ্টম পরিচ্ছেদ

আনোয়ারা যেন কি ভাবিয়া আর সইকে পত্র লিখিল না। উপস্থিত বিপদের কথা উল্লেখ করিয়া মধুপুরে তাহার দাদিমাকে পত্র লিখিল। বৃদ্ধা হামিদার পিতাকে সঙ্গে দিয়া— আনোয়ারার পিতাকে টাকা কড়িসহ রতনদিয়ায় পাঠাইলেন।

নির্দিষ্ট দিনে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট-কোর্টে মোকদ্দমা উঠিল। বাদী ম্যানেজার সাহেবের কথা, আসামী চরিত্রবান বলিয়া প্রমাণিত হইলেন; কিন্তু উপস্থিত ঘটনায় তিনি যে নির্দোষ তাহা সাব্যস্ত হইল না। রতীশ বাবু ও দাগু সাক্ষ্য দিল “নুরল এসলাম দীর্ঘদিন পীড়িত থাকিয়া সর্বস্বান্ত হইয়াছিলেন; তারপর কার্যে পুনরায় উপস্থিত হন। ক্যাশ সিন্দুকের চাবি সর্বদা তাহার কাছে থাকিত।” দারওয়ান জগন্নাথ মিশ্র সাক্ষ্য দিল, “টাকা চুরির আগে বড়বাবু বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলিতেন আর থাকিয়া থাকিয়া রাম রাম বলিতেন।” তার কথায় আদালতের লোক হাসিয়া উঠিল। উকিল সাহেব দোস্তের দোষহীনতা প্রমাণের নিমিত্ত জ্বলন্ত ভাষায় বক্তৃতা করিলেন। ফলে, ম্যাজিস্ট্রেট নানাদিক্ বিবেচনা করিয়া নুরল এসলামের প্রতি ১৮ মাসের কারাদণ্ডের বিধান করিলেন। হুকুম শুনিয়া তালুকদার ও ভূঞা সাহেব পরিশুষ্ক মুখে ও উকিল সাহেব চক্ষু মুছিতে মুছিতে বাহিরে আসিলেন। বিচারের দিন তালুকদার ও ভূঞা সাহেব কোর্টে উপস্থিত ছিলেন।

সেদিন হামিদা অনাহারে কাটাইয়াছে। প্রাণের খোকাকে লইয়া তাহার হাসিখুশি সেদিন বন্ধ ছিল, তালুকদার সাহেব বিমর্ষ-চিত্তে অন্দরে প্রবেশ করিলে হামিদা ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবাজান, সয়া কি মুক্তি পাইয়াছেন?”

তালু। না মা, তাহার ১৮ মাসের জেল হইয়াছে।

হামিদার দম বন্ধ হইবার উপক্রম হইল।

তালু। মা, তুমি দেখছি আনোয়ারার মত হইলে।

হামিদা আরও অস্থিরচিত্তে কহিল, “বাবজান, তার কি হইয়াছে?”

তালু। রতনদিয়ায় আসিয়া শুনিলাম, দুলামিঞা হাজতে আসিবার দিনই তাহাকে চিঠি লিখিয়া আসিয়াছে—আমি জেলে চলিলাম, তখন তাকে লইয়াই কান্নাকাটি। রাত্রে ৪/৫ বার মূৰ্চ্ছা যায়। প্রাতে বুকে বেদনা ধরিয়া শয্যাগত হইয়াছে।

হামিদা। হায়! হায়! কি সর্বনাশ! এমন গজবও কি মানুষের উপর হয়।

তালু। মা, সকলই অদৃষ্টের ফল। তবে বিপদে ধৈর্য অবলম্বন করাই মনুষ্যত্ব।

হামিদা। বাবাজান, এমন বিপদেও কি ধৈর্য থাকে?

তালু। মা, কারবালার বিপদে হযরত হোসেন-পরিবার খোদাতায়ালার প্রতি আত্মসমৰ্পণ করিয়া ধৈর্যবলে মর-মহীতে অমর হইয়া গিয়াছেন

হামিদা পিতার উপদেশ কথঞ্চিৎ শান্ত হইয়া, তাহাদের আহারের আয়োজনে চলিয়া গেল।

পরদিন তালুকদার ও ভূঞা সাহেব রতনদিয়া হইয়া বাড়ি রওয়ানা হইলেন। ভূঞা সাহেব জামাতার সাহায্যের নিমিত্ত বাড়ি হইতে যে সাড়ে চারিশত টাকা লইয়া আসিয়াছিলেন তাহার মধ্য হইতে মাত্র ১০ টি টাকা আনোয়ারাকে দিয়া গেলেন।

তাঁহার বাড়ি পৌছিলে সংবাদ শুনিয়া বৃদ্ধা কাঁদিতে বসিলেন। এদিকে বুকের বেদনা বাড়িয়া আনোয়ারা একেবারে শয্যাশায়িনী হইল।