» » পরিণাম-পর্ব

বর্ণাকার

বিংশ পরিচ্ছেদ

শ্রাবণ মাস। বর্ষা পূর্ণযৌবনা। সর্বত্র পানি থৈ থৈ করিতেছে। ভূঞা সাহেবের বাড়ির পূর্বপার্শ্বের গলি দিয়া স্রোত পূর্ণবেগে দক্ষিণ দিকে ছুটিয়া চলিতেছে। সম্মুখে অমানিশীথিনী। জীব-কোলাহল মুখরিত মোদিনী সুষুপ্ত। রাত্রি নিঝুম। অনন্ত নীলাকাশের অগণিত প্রদীপ মিটি মিটি করিয়া জ্বলিতেছে, তথাপি নিবিড় অন্ধকার বিশ্বগ্রাস করিতে ছাড়ে নাই। ভূঞা সাহেবের বাড়ির উপরই যেন আজ তামসরাজের প্রকোপ বেশি। এই সময় গোলাপজান পতিকে সঙ্গে করিয়া ঘরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। অগ্রে বদ্ধপরিকর-বাসনা আততায়িনী পাপীয়সী;—হস্তে তীক্ষ্ণধার উজ্জ্বল অসি, পশ্চাতে কিঙ্করসম স্ত্রৈণ পতি;-হস্তে দড়ি, কলসী ও ছালা! যেন করাল কৃতান্তরূপিনী দানবীর পশ্চাতে মন্ত্রমুগ্ধদৈত্য।

পিশাচ-দম্পতি প্রাঙ্গণে পদার্পণ করিতেই আনোয়ারা সভয়ে সূতিকাগৃহের প্রদীপ নির্বাপণ করিয়া দিল। তখন সহসা ভীষণ অন্ধকার যেন গোলাপজানের গতিপথ রোধ করিয়া দণ্ডায়মান হইল। আবার সেই সূচীভেদ্য অন্ধকার ভেদ করিয়া বজ্রগম্ভীরে যেন শব্দ হইল— বিশ্বাসঘাতিনী, ডাকিনী, দস্যু-দুহিতে। সামান্য অর্থের লোভে, অহেতুকী হিংসার বসে, এ সময় কোথায় চলিয়াছিস? পাপীয়সী! ঐ দ্যাখ, তোর পাপানুষ্ঠান দর্শনে ঊর্ধ্বকাশে ফেরেশতাগণ স্তম্ভিত হইয়া রহিয়াছে। প্রকৃতি নীরব ও নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। এখনও নিরস্ত হও। এখনও পাপ আশা ত্যাগ কর। গোলাপজান ক্ষণকাল নিমিত্ত থমকিয়া দাঁড়াইল, মুহূর্তে আকাশপানে চাহিল, পরক্ষণে আবার সম্মুখদৃষ্টিতে দেখিতে পাইল, বাসনার বিচিত্র যবনিকা তাহার সম্মুখে প্রতিভাত। তখন সে ভবিষ্যৎ ভুলিয়া চিন্তা করিতে লাগিল, বিনা চেষ্টায় চৌদ্দ তোড়া টাকা ঘরে আসিয়াছে; সঙ্কল্প সিদ্ধির পর আবার চক্ষুঃশূল সতীন-কন্যাকে ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ করিয়া ভ্রাতার নিরাশায় আশাবারি সিঞ্চন করিতে পারিতেছি। পিত্রালয়ে যাইয়া, এ বাড়িতে বসিয়া তখন আদেশে তিরস্কারে সতীন কন্যার রূপের বাহার খর্ব করিতে পারিতেছি। অহো! এমন সুযোগে এত সুখ, এত সৌভাগ্য!

গোলাপজান প্রফুল্লচিত্তে পতি সঙ্গে বহির্বাটিতে উপস্থিত হইল। বহির্বাটিতে আসিয়া সে সাবধানে চতুর্দিকে দেখিয়া লইল। শেষে অনুচ্চভাবে স্বামীর সহিত অনেক বাদানুবাদ করিল। পরে স্থির হইল পতি মাথার দিক্ চাপিয়া ধরিবে, সে গলা কাটিবে। তখন ধীরে নিঃশব্দে দম্পত্তি বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল। গৃহ অন্ধকার। গ্রীষ্মাতিশয্যে জামাতা প্রদীপ নির্বাণ করিয়া শয়ন করিয়াছেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া গোলাপজান থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। তাহার হাতের অস্ত্র হঠাৎ মাটিতে পড়িয়া গেল। সে অবসন্ন-দেহে বসিয়া পড়িল।

পতি অস্ফুটস্বরে কহিলেন, “বসিলে কেন?”

স্ত্রী। আমার হাত-পা অবশ হইয়া আসিতেছে, বুকের মধ্যে ভয়ানক ব্যথা লাগিতেছে।

পতি। আমি ত’ প্রথমেই নিষেধ করিয়াছিলাম, দেখ আমারও গাঁ কাপিতেছে। আমি চলিলাম।

স্ত্রী। (অস্ফুটে) না, না, যাও কোথায়? এই উঠিতেছি। এই বলিয়া পাপিয়সী অদম্য বাসনাবলে দাঁড়াইয়া দৃঢ়মুষ্টিতে ছুরির বাঁট চাপিয়া ধরিল, পরে শয়ন-খাটের নিকট আসিয়া সম্মুখভাগ হাতড়াইয়া দেখিল কেহ নাই। শেষপ্রান্তে দেখিল, লোক আছে; পরীক্ষা করিয়া বুঝিল, গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত। তখন বিলম্বমাত্র না করিয়া একই সময়পতি মাথা ঠাসিয়া ধরিল, স্ত্রী সতীকন্যা-জামাতার গলা কাটিয়া দুই ভাগ করিল। হায় ভবের লীলা! হায় দুনিয়া!