নবম পরিচ্ছেদ
নুরল এসলাম কারাগারে যাইবার পর, কোম্পানির টাকা আদায়ের নিমিত্ত কলিকাতা হইতে একজন কর্মচারী বেলগাঁও আসিলেন। ম্যানেজার সাহেব তাহাকে বলিলেন, “আসামীর সম্পত্তি যাহা ছিল, সে তাহা পূর্বেই ভগিনী ও স্ত্রীকে দান করিয়া গিয়াছে। সুতরাং তাহার নিকট টাকা আদায় অসম্ভব। এমন অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া যাহা হয়।” কিন্তু রতীশ বাবু পূর্বকথিত নবার নিকট শুনিয়া স্থানীয় রেজেস্টারী অফিসে খোঁজ করিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন—নুরল এসলাম দানপত্র রেজেস্টারী করিয়া দেন নাই। তিনি কলিকাতার কর্মচারীকে গোপনে বলিলেন, “আসামীর দানপত্র এ পর্যন্ত রেজেস্টারী হয় নাই, সুতরাং এখন সে সম্পত্তি আসামীর বলিয়া নালিশ করিতে পারেন।” কর্মচারী ম্যানেজার সাহেবের নিকট, আসামীর নামে সেই সূত্রে নালিশের প্রস্তাব করেন। উকিল সাহেব তাহা অবগত হইয়া রতনদিয়ায় পত্র লেখেন।
উকিল সাহেবের পত্র পাইয়া শয্যাশায়িনী আনোয়ারা বুকের ব্যাথা বুকে চাপিয়া উঠিয়া বসিল। সকলে মনে করিল, বউ সুস্থ হইয়া উঠিয়াছে।
আনোয়ারা সংক্ষেপে তাহার দাদিমাকে পত্র লিখিল,
“তোমরা সকলে আমার সালাম জানিবে। বাবাজান আমাদের বিপদে এখানে আসিয়া মাত্র দশটি টাকা দিয়া গিয়াছেন! এক্ষণে কোম্পানি আমাদের তালুক বিক্রয় করিয়া টাকা লইতে চেষ্টা করিতেছে। অতএব এই চিঠি পাওয়া মাত্র তুমি নিজ হইতে তিনশত, বাবাজান তিনশত, আমার পুঁজি টাকা চারি শত এবং কয়েকখানি শাড়ী ও তোমার প্রদত্ত আমার সমস্ত গহনা বিলম্ব না করিয়া পাঠাইবে। যদি ঐ সকল পাঠাইতে ইতস্তত বা বিলম্ব কর, তবে আমাকে আর জন্মের মত দেখিতে পাইবে না।” ইতি——
তোমার সোহাগের —
আনোয়ারা
স্নেহপরায়না বৃদ্ধা পৌত্রীর আত্মহত্যার আশঙ্কা করিয়া অগৌণে বস্ত্রালঙ্কার ও নগদ টাকা পাঠাইলেন। মাত্র ১০ টি টাকা মেয়েকে দিয়া আসিয়াছে শুনিয়া বৃদ্ধা পুত্রকে তিরস্কার করিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে তিনশত টাকা লইয়া তাহাও এই সঙ্গে পাঠাইলেন। আনোয়ারা যথাসময়ে টাকা, অলঙ্কার ও বস্ত্র পাইল।
এদিকে আনোয়ারা উকিল সাহেবকে রতনদিয়ায় আসিতে সই-এর নিকট পত্র লিখিল। উকিল সাহেবও যথাসময়ে রতনদিয়ায় আসিলেন। দিনমানে তিনি দোস্তের সংসারের সিজিল মিছিল করিলেন। রাত্রিতে কোম্পানির দেনা শোধের কথা তুলিলেন। সরল ফুফু-আম্মা কহিলেন, “বাবা তুমি যাহা ভাল বুঝ তাহাই কর।” উকিল সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “টাকা ২/৩ হাজার নয়, আট হাজার! তালুক বিক্রয় ছাড়া উপায় দেখিতেছি না। আনোয়ারা ফুফু-শাশুড়ীর নিকট ঘরের ভিতরে বসিয়াছিল, সে ছোট করিয়া ফুফু-শাশুড়ীকে কহিল “তা কেন, আমার নিকট হাজার টাকা ও আমার এগার শত টাকার গহনা আছে। তাঁর (স্বামীর) পীড়ার সময় সই আমাকে একশত টাকা দিয়াছিল, তাহাও মজুদ আছে। এই সব দিয়া কোম্পানির টাকা মিটাইতে বলেন।”
ফুফু বউ-এর সমস্ত কথা উকিল সাহেবকে শুনাইলেন। উকিল সাহেব শুনিয়া বালিকার পতিপরায়ণতায় মনে মনে ধন্যবাদ দিলেন। মুখে কহিলেন, “আট হাজার টাকার দেনা এতে মিটিবে না।”
নুরল এসলাম কারাগারে যাইবার সময় আনোয়ারাকে পত্র লিখিয়াছিলেন, “অন্তিম অনুরোধ, শুধু শরিয়তের নহে, প্রাণের দোহাই দিয়া বলিতেছি, নরাধমকে পতি বলিয়া মনে রাখিবে।” আনোয়ারার সেই কথা এখন হৃদয়ে উজ্জ্বলভাবে জাগিয়া উঠিল এবং উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে পতির সম্পর্ক রক্ষা করা সে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্যকর্ম মনে করিল। তাই সে বিবাহের সময় স্বামীদত্ত যে নয়শত টাকার অলঙ্কার পাইয়াছিল, তাহাও এই ঋণ শোধার্থে দেওয়া কর্তব্য মনে করিয়া ফুফু-শাশুড়ীকে কহিল, “আপনারা যে আমাকে নয়শত টাকার গহনা দিয়াছিলেন, তাহাও পোটম্যানে তোলা আছে। ওগুলিও সয়া সাহেবকে দেওয়া যাক।” ফুফু সে কথাও উকিল সাহেবকে জানাইলেন। উকিল সাহেব মনে করিয়াছিলেন পূর্বে যে এগার শত টাকার গহনা দেওয়ার কথা হইল, তাহাই দোস্ত সাহেবের প্রদত্ত। এক্ষণে আরও নয়শত টাকার গহনার কথা শুনিয়া তিনি বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা ইতঃপূর্বে যে এগারশত টাকার অলঙ্কারের কথা বলিলেন তাহা কাহার”? ফুফু-আম্মা কহিলেন, “ওগুলি বউমার দাদিমা দিয়াছিলেন।” উকিল সাহেব শুনিয়া মনে মনে কহিলেন, “সতী, তুমিই ধন্য তুমিই পতিব্রতাদিগের আদর্শস্থানীয়া।”
উকিল সাহেব তখন হিন্দুদিগের বিশ্বামিত্র-প্রকৃতি পরিগ্রহ করিয়া পুনরায় কহিলেন, “নগদে ও গহনায় তিন হাজার এক শত হইতেছে, বাকি চারি হাজার নয়শত টাকা। তার উপায় কি?” আনোয়ারা তখন কাঁদিতে কাঁদিতে ফুফু আম্মাকে কহিল, “আমার হাতে এখন ৬০ টাকার অঙ্গুরী আছে। পরিধানে ৫/৬ শত টাকার শাড়ী আছে, ইহাও দেওয়া যাক।” ফুফু-আম্মা কহিলেন “বউ মা তুমি কাঁদিও না; শাড়ী দেওয়ার আবশ্যক নাই। ছেলের শোকে আমি পাগল হইয়াছি, তাই মনে ছিল না; আমাদের বিপদের কথা শুনিয়া রশিদা নিজ হাতে দুইশত ও তাহার সোয়ামী একশত টাকা দিয়াছিল, সেই তিনশত টাকা আমার কাছে আছে। কাল ছেলেকে শাড়ীর বদলে তাহাই দেওয়া যাইবে।” এইবার উকিল সাহেবের পরীক্ষা শেষ হইল। তিনি কহিলেন, “আপনারা কান্নাকাটি করিবেন না, আপনাদের পাঁচশত টাকা আমার নিকট মজুদ আছে। দোস্ত সাহেবের ম্যানেজার সাহেব তাঁহার মোকদ্দমার সাহায্যের জন্য আমার হাতে দিয়াছিলেন, তাহাও এই দেনায় শোধ দিন।” এই বলিয়া তিনি পাঁচ কিত্তা নোট ফুফু-আম্মার হাতে দিলেন।
রাত্রি প্রভাতে ফুফু-আম্মা—
নিজের নিকট মজুদ – ৩০০
উকিল সাহেবের প্রদত্ত নোট – ৫০০
আনোয়ারার সয়ের প্রদত্ত – ১০০
আনোয়ারার পিত্রালয় হইতে আনীত – ১০০০
আনোয়ারার দাদিমার প্রদত্ত গহনা – ১১০০
আনোয়ারার স্বামী প্রদত্ত গহনা – ৯০০
আনোয়ারার আংটি – ৬০
মোট : ৩,৯৬০
মোট ঊনচল্লিশ শত ষাইট টাকা নগদে-গহনায় দেনা শোধের জন্য উকিল সাহেবের হাতে দিলেন। তিনি ঐ সকল লইয়া যথাসময়ে বাসায় আসিলেন।
উকিল সাহেব বাসায় পৌঁছিলে হামিদা কহিল, “এত টাকা ও গহনা কোথায় পাইলে?”
উকিল। পতির ঋণ-মুক্তির জন্য তোমার সই যথাসর্বস্ব আমার হাতে সঁপিয়া দিয়াছেন।
হামিদা। তাই ত’ দেখিতেছি, আমার প্রদত্ত আংটিটি পর্যন্ত দিয়াছে। ধন্য পতিব্রতা? এমন সতী সই হইয়া, নারী জন্ম সুন্দর ও সার্থক মনে হইতেছে।
উকিল। এতে সতীর উদ্দেশ্য সফল হইবে কিনা তাহাই ভাবিতেছি।
হামিদা। আর কত হইলে দেনা শোধ করিতে পারিবে?
উকিল। কমপক্ষে মোট সাড়ে চারিহাজার টাকা হইলে কথা বলা যায়।
হামিদা। তাহাই নাজাই কত?
উকিল। আর ৫৪০ হইলে সাড়ে চারিহাজার হয়।
হামিদা। তুমি ৩০০ দেও, আমি নিজ হইতে ২৪০ দেই।
উকিল। তোমার নিজ তহবিলে খুব টাকা জমিয়াছে নাকি?
হামিদা। জমিয়াছে বৈকি?
উকিল। কোথায় পাইলে?
হামিদা। আমি খোকার মুখে ক্ষীর দেওয়া উপলক্ষ ৩০০ টাকা জমাইয়াছি। তোমার অনুমতি হইলে তাহা হইতে দিতে চাই।
উকিল। তোমার হৃদয়ের মহত্ত্ব দেখিয়া সুখী হইলাম।
অতঃপর জুট ম্যানেজারের সহিত অনেক লেখালেখি হওয়ার পর তাঁহার বিশেষ অনুগ্রহে চারি হাজার টাকায় কোম্পানির টাকা শোধ সাব্যস্ত হইল। বন্ধুর তালুক ও বন্ধু- পত্নীর গাত্রালঙ্কার যাহাতে পরভোগ্য না হয়, তজ্জন্য উকিল সাহেব নিজ নামে হাজার টাকার হ্যান্ডনোট লিখিয়া দিয়া এবং বক্রী নাজাই নিজ হইতে দিয়া কোম্পানির রফার টাকার শোধ করিলেন। স্ত্রীকে হ্যান্ডনোটের কথা জানাইয়া কহিলেন, “অলঙ্কারগুলি সযত্নে তুলিয়া রাখ, সময়ে ফেরত দেওয়া যাইবে।” হামিদা আহ্লাদে গহনাগুলি নিজ বাক্সে পুরিল।