ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
ওয়ারিশসূত্রে অতঃপর আনোয়ারা সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হইল। পিতার জোতের মূল্য বিশ হাজার ও অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য পাঁচ হাজার, মোট পঁচিশ হাজার টাকার সম্পত্তি পাইয়া আনোয়ারা তাহা তাহার স্বামীর চরণে উৎসর্গ করিল।
হত্যাকাণ্ডের গোলযোগে নুরল এসলামের পাটের ব্যবসায়ের অনেকটা ক্ষতি হইয়াছিল। তথাপি আশ্বিনের শেষে হিসাবান্তে ষোল হাজার টাকা লাভ দাঁড়াইল। পর বৎসর তিনি মরসুমের প্রথমেই কারবার আরও বিস্তৃত করিয়া লইলেন। লাভও আশানুরূপ হইতে লাগিল। এইরূপে নুরল ইসলাম বাণিজ্য প্রাসাদাৎ অল্প সময় মধ্যে ধনকুবের হইয়া উঠিলেন। অর্থাগমের সহিত তাঁহার পৈতৃক ভদ্রাসন দ্বিতল-সৌধরাজিতের শোভিত হইল। নুরল এসলামের অর্থ সাহায্যে ও স্বজাতিপ্রিয়তায় গ্রামের দুঃস্থ লোকগণের সুখ-সন্তোষ বৃদ্ধি হইতে লাগিল। তিনি দরিদ্র লোকের শিক্ষার জন্য স্বগ্রামে অবৈতনিক মাইনর স্কুল খুলিয়া দিলেন।
পূর্বে বলা হইয়াছে, আলতাফ হোসেন সাহেব পুত্রের জন্য যথাসর্বস্ব হারাইয়া সপরিবারে ভগিনীর আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। বহু পোষ্য লইয়া আসিয়াছিলেন, সুতরাং খরচ বাড়িয়া যাওয়ায় ভগিনীর তালুকটুকু অল্প অল্প করিয়া ঋণে আবদ্ধ করতঃ পোষ্যগণের গ্রাসাচ্ছাদন নির্বাহ করিতে লাগিলেন। ক্রমে ভগ্নীর দুরবস্থা চরমে উঠিল। মাতার সহিত বিবাদ করিয়া সালেহা কিছুদিন নুরল এসলামের বাড়িতে ছিল; কিন্তু অভিমানিনী মাতা কন্যাকে শাসন করিয়া পরে বাড়িতে লইয়া যান। এখন তাঁহাদের কখন অর্ধহারে কখন বা অনাহারে দিন যাইতে লাগিল। সালেহা সময় সময় বিশুষ্ক মুখে চুপে চুপে আনোয়ারার নিকট যায়। আনোয়ারা তাহাকে আদর করিয়া নানাবিধ সুখাদ্য পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া দেয়। কাছে বসাইয়া নানাবিধ সুখ-দুঃখের কথা বলে। সালেহার মায়ের খাওয়া-পরার কথা জিজ্ঞাসা করে, সরলা সালেহা মাতার অনাহার ও বস্ত্রকষ্টের কথা সব খুলিয়া বলে।
একদিন আনোয়ারা স্বামীকে কহিল, “আম্মাজানদিগের দিন চলে না, আল্লার ফজলে এখন তোমার স্বচ্ছল অবস্থা, এ সময় তাঁহাদিগকে সাহায্য না করা বড়ই অন্যায় হইতেছে।”
সন্তান হওয়ার পর, আনোয়ারা স্বামীকে তুমি বলিয়া সম্বোধন করিতে আরম্ভ করিয়াছে।
নুরল। তুমি কিভাবে সাহায্য করিতে বল?
আনো। তাঁহাকে পুনরায় এই সংসারে আনিতে চাই।
নুরল। তিনি মানিনীর মেয়ে; আসিবেন বলিয়া বোধ হয় না।
আনো। সংসারের সর্বস্ব তাঁহার হাতে ছাড়িয়া দিলে বোধ হয় আসিতে পারেন।
নুরল। তুমি তাহাতে রাজি আছ?
আনো। একশ বার, হাজার হইলেও তিনি আমাদের পূজনীয়া। তাঁহার অন্নবস্ত্রে কষ্টের কথা শুনিয়া আমার বরদাস্ত হইতেছে না। আমি তাহার হাতে সংসার ছাড়িয়া দিয়া সৰ্বদা তাঁহার খেদমত করিব।
নুরল। আমি তোমার প্রস্তাবে সুখী ও সম্মত হইলাম।
অতঃপর আনোয়ারা একদিন রাত্রিকালে খোকাকে কোলে লইয়া একজন দাসী সঙ্গে সালেহাদিগের আঙ্গিনায় উপস্থিত হইল; সালেহার মা আনোয়ারাকে দেখিয়া বিস্ময়ে অভিভূত হইলেন। কারণ, আনোয়ারা একজন রাজরাণীতুল্য। আর রাজরাণী না হইলেও ভিন্ন স্থানে পদার্পণ তাহার পক্ষে অসম্ভব। সালেহা আনোয়ারাকে দেখিয়া অতীব আনন্দিত হইল। তাড়াতাড়ি খোকাকে কোলে লইয়া সোহাগ করিতে লাগিল। আনোয়ারার নিরভিমান সারল্যে সালেহা-জননীর বিজাতীয় কৌলিন্যাভিমান খর্ব হইয়া আসিতে লাগিল। আনোয়ারা শাশুড়ীর পদচুম্বন করিয়া কহিল, “আম্মাজান, আমার খোকাকে দোয়া করুন।” উন্নতশিরা ফনিণী যেমন ঔষধের গন্ধে নতমস্তক ও দুর্বল হইয়া পড়ে, আনোয়ারার অনুপম শিষ্টাচারে সালেহা- জননীর অন্তর সেইরূপ কোমল হইয়া আসিল। সালেহা তাহার মায়ের কোলে ছেলে দিল, মা সাগ্রহে ছেলেকে চুম্বন করিয়া আশীর্বাদ করিলেন। আনোয়ারা কহিল, “আম্মাজান, খোকা আপনাকে লইতে আসিয়াছে, আপনি আপনার বাড়িতে চলুন।” অগ্নির উত্তাপে যেমন লৌহ দ্রবীভূত হয় এবার সালেহার মা সেইরূপ বিগলিত হইলেন। তিনি ভগ্নকন্ঠে গদ্গদ্ভাবে কহিলেন, “খোকার বাপ আমায় পৃথক করিয়া দিয়াছে।” আনোয়ারা দুঃখের স্বরে কহিল, “আম্মাজান, অমন কথা বলিবেন না। সংসার জুড়িয়াই এমন কিছু হয়; আপনি বাঁদীকে ফিরাইয়া দিবেন না।” অনুতাপে তখন সালেহা জননীর বিগলিত হৃদয় দগ্ধ হইতেছিল। তিনি কি যেন ভাবিয়া কহিলেন, “আগামীকল্য খোকা আসিলেই আমি যাইব।”
পরদিন পুনরায় আনোয়ারা পুত্র কোলে করিয়া আসিয়া সালেহাসহ তাহার মাতাকে বাড়িতে লইয়া গেল। অতঃপর আনোয়ারার স্বর্গীয় ব্যবহারে তাহার সৎ-শাশুড়ী আপন মায়ের অধিক হইয়া উঠিলেন। সুখ-শান্তিতে নুরল এসলামের সংসার আনন্দময় হইয়া উঠিল।