অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
নুরল এসলাম অনেকদিন পাট-অফিসে চাকরি করিয়া পাটের কারবারে প্রভূত জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন, এ নিমিত্ত ব্যবসায়ে সত্বর লাভবান হইতে লাগিলেন। উকিল সাহেব লাভ দেখিয়া এককালে সাত হাজার টাকা দোস্তের কারবারে নিয়োগ করিলেন। তাহাতে নুরল এসলামের মূলধন ১৭/১৮ হাজার টাকা হইল। ব্যবসায়ে মূলধন যত বেশি হইবে, লাভও সেই অনুপাতে পড়িবে। ১৭/১৮ হাজার টাকা মূলধন লইয়া কলিকাতার বড় বড় মহাজনদিগের সহিত ঘনিষ্ঠতা ঘটাইয়া নুরল এসলাম লক্ষাধিক টাকার ব্যবসায় চালাইতে লাগিলেন। এতদ্দেশে পাট ব্যবসায়ের পূর্ণ উন্নতির সময় নুরল এসলাম এই ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছিলেন। সততায়, অভিজ্ঞতায় ও ব্যবসায়ের কল্যাণে তিনি ২/৩ বৎসরে স্বয়ং লক্ষপতি হইয়া উঠিলেন।
অদৃষ্ট প্রসন্ন হইলে সুখ-সন্তোষ উপযাচক হইয়া অদৃষ্টবানের দ্বারস্থ হয়। এই সময় নুরল এসলামের পত্নী অন্তঃসত্ত্বা হইলেন। অনন্তর সাত মাসের সময় সে স্বামীর আদেশ লইয়া মধুপুরে গেল।
আষাঢ়ে মাসে নূতন পাটের মরশুম আসিল। নুরল এসলাম বদ্ধপরিকর হইয়া ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইলেন। দেশের ভাল পাট জন্মিবার স্থানগুলি পূর্বেই নির্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছিলেন; যথাসময়ে ক্রেতা ও দালাল পাঠাইয়া তত্তাবৎ স্থানের পাট খরিদ করিয়া আনিলেন। শ্রাবণ মাসের প্রথম ভাগে সাতাইশ শত মণ পাট কলিকাতায় চালান দিলেন। বিক্ৰয়ান্তে আড়াই হাজার টাকা লাভ দাঁড়াইল। কলিকাতার মহাজন বেরামপুর আড়তে সমস্ত টাকার বরাত পাঠাইলেন। নুরল এসলাম টাকার জন্য বেরামপুর কর্মচারী না পাঠাইয়া, চারদাড়ী পাসি লইয়া স্বয়ং যাত্রা করিলেন। তাঁর ইচ্ছা, আসিবার সময় মধুপুরে স্ত্রীকে দেখিয়া আসিবেন। বেরামপুর হইতে মধুপুর দশ মাইল মাত্র পশ্চিমে।
নুরল এসলাম বেরামপুর আসিয়া বরাতি রোক্কা আড়তে দাখিল করিলেন। চব্বিশ হাজার চারিশত টাকার বরাতি ছিল। নুরল এসলাম নগদ চৌদ্দ হাজার টাকা ও অবশিষ্ট টাকার নোট লইলেন। চৌদ্দ হাজারে চৌদ্দ তোড়া টাকা হইল। নুরল এসলাম সন্ধ্যার পূর্বে টাকা লইয়া মধুপুরে আসিলেন। নৌকা ঘাটে লাগিলে তিনি অবতরণ করিয়া বাহির বাড়িতে কাহাকেও না দেখিয়া একছার বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। নুরল এসলামকে দেখিয়া দাসীর “সন্দেশ, সন্দেশ” রবে আনন্দ কোলাহল করিয়া উঠিল। একজন বয়স্কা দাসী “চাঁদ দেখুন” বলিয়া তখনই নুরল এসলামের আচকানের প্রান্ত ধরিয়া তাহাকে সূতিকাগৃহের সম্মুখে হাজির করিল। নুরল এসলাম দেখিলেন, শিশু সূতিকাগৃহ আলোকিত করিয়া শোভা পাইতেছে। দেখিয়া, নুরল এসলামের হৃদয় আনন্দে ভরিয়া গেল। তিনি অতঃপর অন্তঃপুরের সকলকে যথাযোগ্য আপ্যায়িত করিয়া বহির্বাটিতে আসিলেন। এই সময় পকেটে হাত দিয়া নোটের তোড়া দেখিয়া, দেওয়ানের দস্তখতি প্রাপ্তিস্বীকার রসিদ যাহা কলিকাতায় পাঠাইতে হইবে, তাহার কথা তাঁহার মনে পড়িল। তিনি পকেট খুঁজিয়া দেখিলেন রসিদ নাই। নৌকায় উঠিয়া বাক্স প্রভৃতি তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলেন, রসিদ আর পাওয়া গেল না। তখন মনে হইল বেরামপুরে দেওয়ান গদিতেই রসিদ ছাড়িয়া আসিয়াছেন। তিনি অবিলম্বে টাকার তোড়াগুলি বাড়ির উপর নামাইয়া রাখিয়া মাল্লাগণকে রসিদ আনিতে বেরামপুরে পাঠাইলেন।
যাইবার সময় নৌকার মাঝি কহিল, “হুজুর উজান পানি, আজ ফিরিয়া আসা যাইবে না। কাল এক প্রহরে আসিয়া পৌঁছিব।
নুরল এসলাম টাকার তোড়াগুলি তাঁহার শ্বশুরের শয়নঘরে হেফাজতে রাখিতে শাশুড়ীর নিকট দিলেন।