উপসংহার
মিলাদের দিন আনোয়ারা রজতাসন পাইয়াছে। মিলাদ শরিফ সুচারুরূপে সম্পন্ন হওয়ায়, সে পরদিন স্নানান্তে দ্বিতল বাসগৃহের সেই নির্জন চত্বরে পরমানন্দে সেই রুপার খাটে বসিয়া সোনার আলনায় পূর্ববৎ চুল শুকাইতেছে। এমন সময় নুরল এসলাম তথায় আসিয়া কহিলেন, “রুপার খাটে ত’ বসিয়াছ, এখন তোমার স্বপ্নের কথাটি শুনা যাক।” আনোয়ারা সহাস্যে কহিল, “যদি নাছোড় হও তবে শুন।” নুরল একখানি আসন টানিয়া স্ত্রীর সম্মুখে বসিলেন।
আনোয়ারা বলিতে লাগিল, “অনেক দিনের কথা, ভালরূপে মনে নাই, তবে যাহা মনে আছে তাহাই বলিতেছি। স্বপ্নে দেখিয়াছিলাম, আমি যেন একটি ক্ষুদ্র নদীরতীরে বসিয়া আছি। নদীর পরপারে নীলাকাশে চাঁদ উঠিয়া ক্রমে যেন আমার দিকে অগ্রসর হইতেছে। আমি কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া একদৃষ্টে তাহাই দেখিতেছি, সহসা অদূরে বুলবুলের প্রাণ মাতানো সঙ্গীতের ন্যায় এক সুমধুর রব আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। স্থিরচিত্তে শুনিয়া বুঝিলাম কে যেন অদৃশ্যে থাকিয়া কোরআন পাঠ করিতেছে। শেষে সেই স্বরে আবার এক বিশ্বপ্রেমভরা মোনাজাত শুনিতে পাইলাম। আমার মনে হইল, ইতিপূর্বে ওরূপ ভক্তিভাবপূৰ্ণ মোনাজাত ও কোরআন পাঠ কোথাও কখনও শুনি নাই। তাই আত্মহারা হইয়া শুনিতে লাগিলাম।”
স্ত্রীর স্বপ্নের কথা শুনিয়া নৌকার সেই কোরআন পাঠ ও মোনাজাতের কথা নুরল এসলামের স্মৃতিপথারূঢ় হইল। তিনি সহাস্যে কহিলেন, “ কোরান পাঠ ও মোনাজাত যত সুন্দর না হউক, তোমার বর্ণনাটি কিন্তু পরম সুন্দর! উহা লিখিয়া রাখিবার যোগ্য
আনো। তুমি যদি ঠাট্টা কর, তবে স্বপ্নের কথা আর বলব না।
নুরল। না, না, ঠাট্টা নয়, সত্য কথাই বলিতেছি।
নুরল প্রশান্ত সরল মুখে এই কথা কহিলেন। আনোয়ারা তখন বলিতে লাগিল, “কিয়ৎকাল পর আবার স্বপ্নাবেশেই দেখিলাম, একজন সুন্দর যুবক করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া আছে। আমি তাঁহাকে দেখিবামাত্র লজ্জিত হইয়া উঠিয়া যেন পলায়ন করিলাম। অল্পকাল পরে দেখিলাম, কে যেন আমার হাত-পা বাঁধিয়া দুর্গন্ধময় কূপে নিক্ষেপের চেষ্টা করিতেছে; এই সময় আবার আকাশের গায়ে মেঘ সাজিল, ঝড়-তুফানে ক্রমে প্রলয়কাণ্ড ঘটাইয়া তুলিল। মেঘের গর্জনে বিজুলির চমকে জীবজন্তু সব অস্থির হইয়া উঠিল। সর্বত্র দাউ দাউ করিয়া আগুন জ্বলিতে লাগিল। আমি ভয়ে চীৎকার করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে আবার সব থামিয়া গেল। শেষে দেখিলাম, এই,–’ এই বলিয়া আনোয়ারা থামিয়া গেল।
নুরল। এই কি?
আনো। (ভ্রূকুটি সহকারে) আরও ভাবিয়া বলিতে হইবে?
নুরল। এমন স্বপ্ন কি আর ইশারা করিয়া বলিলে চলে?
আনো। আমি দো-মহলা দালানে রুপার কুর্সিতে বসিয়া সোনার আলনায় চুল গুকাইতেছি। আর পূর্বে যে যুবককে দেখিয়া লজ্জায় পালাইতেছিলাম, তিনি আমাকে যেন কি বলিতেছেন।
এই পর্যন্ত বলিতেই আনোয়ারার রক্তিমাভ মুখমণ্ডল তাহার সুখতরঙ্গায়িত হৃদয়ের ভাব ফুটিয়া উঠিল। নুরল এসলাম পুনরায় হাসিয়া কহিলেন, “যুবক তোমাকে কি বলিয়াছেন!” আনোয়ারা বিলোল কটাক্ষে কহিলো, “অত দিনের কথা মনে নাই।”
নুরল। আমি বলিতে পারি। আনো। বল দেখি?
নুরল। যুবক বলিয়াছিলেন,–
প্রেমময়ী প্রেমের ছলে,
রোখো দাসে চরণ তলে।
আনোয়ারা আসন হইতে উঠিয়া নুরল এসলামের মুখ চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “তোমার পায়ে পড়ি, অমন মনগড়া কথা বলিলে আমি আর তোমাকে কোন কথাই বলিব না।” নুরল স্ত্রীকে বাহুবাশে বেষ্টন করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা আমি আর কিছু বলিব না। তোমার মনগড়া স্বপ্নের কথাই শুনা যাউক!”
আনো। আমার মাথার কছম, মনগড়া কথা নয়, এমন সফল স্বপ্ন কেহ কখন দেখে না। সেইদিন রুপার খাটের কথায় স্বপ্নের কথা মনে হওয়ায় খেয়াল করিয়া দেখিতেছি, স্বপ্ন আমার ষোল আনা রকমে ফলিয়াছে।
নুরল। এত বড় স্বপ্নের কথা এত দিন আমাকে বল নাই কেন?
আনো। তোমার ঐকদম শরিফের গুণে উহা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছিলাম।
নুরল। (হাসিয়া) আমি ত’ তোমার স্বপ্ন সফলতার কিছু দেখিতেছি না।
আনো। আরও চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিব?
নুরল। তাহাই হউক।
আনোয়ারা। তবে শুন। যে রাত্রিতে স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম, তাহার পরদিন ভোরবেলাতে খিড়কীর দ্বারো ওজু করিতে যাইয়া সত্যই নৌকার উপর কোরআন পাঠ ও মোনাজাত শুনিলাম; তারপর দেখিলাম সত্যই সেই স্বপ্নদৃষ্ট যুবক পেট কাট ছৈ-এর মধ্যে দাঁড়াইয়া বেগানা কুলবালার দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া আছে।
এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া মুখ চাপিয়া হাসিতে লাগিল।
নুরল এসলাম মৃদু হাস্যে কহিলেন, “তারপর?”
আনো। কিছুদিন পরে বাবাজান দুর্গন্ধকূপে নিক্ষেশের ন্যায় নীচবংশে আমার বিবাহের প্রস্তাব করিলেন। বিবাহের লগ্নদিনে সত্যই ঝড়-তুফান হইল, বাজ পড়িয়া আমাদের গোশালায় আগুন লাগিল। স্বপ্নের শেষ ফল এই দেখ, রুপার খাটে বসিয়া সোনার আনায় চুল শুকাইতেছি, আর সেই দু–”
নুরল। (হাসিয়া) আচ্ছা, নৌকার উপরে সেই দুষ্ট যুবককে দেখিয়া সেই সাধ্বী কুলবালার মনে কিছু উদয় হইয়াছিল না?
আনো। (স্মিতমুখে) কি আর মনে হইবে? দেখিয়া তাজ্জব হইয়াছিল।
নুরল। আর কিছু নয়?
আনোয়ারা ফাঁপরে পড়িয়া স্বামীর মুখে প্রেম-তীব্র কটাক্ষ হানিল।
নুরল। সত্য কথা না বলিলে ছাড়িব না। মেয়ে লোকে পুরুষের দোষই বেশি দেখে।
আনোয়ারা চুল গোছাইয়া পলায়নে উদ্যত হইল; নুরল ধা করিয়া তাহাকে বক্ষে চাপিয়া ধরিলেন।
আনো। ছাড়—সই আড়ি পাতিয়া দেখিবে!
নুরল। তিনি ওজিফা পড়িতেছেন।
আনো। খোকা আসিবে।
নুরল। সে মরিয়মকে (উকিল সাহেবের কন্যার নাম) সঙ্গে করিয়া বাগানে খেলা করিতেছে।
আনো। উভয়ের ভাব দেখিয়া সই আমাকে এক কথা বলিয়াছে।
নুরল! এ-কথা সেকথা থাক; মনের কথাটি আগে হোক।
আনো। আচ্ছা, চোখে দেখা আর ভাবা কি এক?
নুরল। সে বিচার পরে হইবে।
আনো। তুমি ত’ বলিয়াছিলে আমার একটি কথা স্মরণ হইতেছে।
নুরল। তাই আগে শুনিতে চাও?
আনো। হ্যাঁ।
নুরল। তুমি ফিরানীতে মধুপুরে গিয়া একমাস নফল রোজা করিয়াছিলে কেন? আনোয়ারা খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল।
নুরল। হাসিতেছ কেন?
আনো। তুমি নজুম হইলে কবে?
নুরল। নজ্জম হইলাম কেমন করিয়া?
আনো। পেটের কথা টানিয়া বাহির করিতে জান।
নুরল। কোন্ কথা?
আনো। যে কথা এতক্ষণ চাপিয়া আসিতেছিলাম, তোমার প্রশ্নের উত্তরেই তাহা বলিতে হইতেছ।
নুরল। বেশ, তবে বল।
আনো। আচ্ছা, তবে শুন,–সেই প্রথম দিন তোমাকে নৌকার উপরে দেখিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশকালে অস্ফুটস্বরে হৃদয়ের সহিত বলিয়াছিলাম, মা, তোমার কথা যেন সত্যে পরিণত হয়। আমি একমাস নফল রোজা করিব। ফল লাভ করিয়া ফিরানীতে মধুপুর গিয়া সেই মানত শোধ করিয়াছি।
নুরল। (মৃদুহাস্যে) কি ফল লাভ করিয়াছিলে?
আনোয়ারা প্রেমকোপে চোখ রাঙাইয়া চুপ করিয়া রহিল।
নুরল। আচ্ছা, মা তোমাকে কি কথা বলিয়াছিলেন?
আনো। মা বলিয়াছিলেন, শেষ রাত্রিতে স্বপ্ন বিফল হয় না। আমি শেষ রাত্রে ঐ খোয়াব দেখিয়াছিলাম।
নুরল। আর একটি কথা, তুমি অন্তঃপুরে যাইয়া সেদিন অত কাতর হইয়াছিলে কেন? আনো। কেন যে কাতর হইয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না—তবে সেদিন মায়ের (বিমাতার) অকারণ তিরস্কারে মন যেন একেবারে ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। সেই তিরস্কারে দারুণ যাতনায়, ঘৃণা আসিয়া ব্যথিত করিল, রাত্রিতে অনাহারে থাকিলাম এবং শেষ রাত্রিতে ঐরূপ স্বপ্ন দেখিলাম। ভোরে আবার তোমার উজ্জ্বল মুখচ্ছবি দেখিয়া স্বপ্ন সফলতায় মনের আনন্দের সঞ্চার হইল; কিন্তু পরক্ষণে আবার সই-এর মুখে চোরের ঘরে বিবাহের সংবাদ পাইয়া, সংসার আমার পক্ষে জ্বলন্ত শ্মশানসদৃশ হইয়া উঠিল। মন আবার নিরাশ সমুদ্রে ডুবিয়া গেল। দুঃখে হতাশায় প্রাণ ব্যাকুল হইয়া পড়িল। ফলে, এরূপ হর্ষ-বিষাদের অবিরাম ঘাত-প্রতিঘাতে মনের যে শোচনীয় অবস্থা হইল, তুমি সে সময় চিকিৎসা না করিলে, ঐ অবস্থায়ই আমার মৃত্যু ঘটিত। অতএব, আমি যে কেন কাতর হইয়াছিলাম তাহা মনে ভাবিয়া দেখ।
নুরল। তাহা ত’ দেখিয়াছি; কিন্তু লক্ষ টাকার জান বাঁচাইয়া তাহার পুরস্কার ত’ পাই নাই।
আনো। কেন? যাহা যত্ন করিয়া রক্ষা করিয়াছ, তাহা সমস্তই তোমাকে ধরিয়া দেওয়া হইয়াছে।
নুরল। সে ত মূলধন; কিছু উপরি লাভ কই?
আনোয়ারা কি যেন মনে করিয়া “আজ দিব” বলিয়া উৎফুল্ল হইয়া উঠিল।
“তবে এখনই দাও” বলিয়া নুরল সোৎসাহে মস্তক অবনত করিলেন। আনোয়ারা বিদ্যুদ্বেগে নিজে উত্তোলন করিয়া “তবে এই নাও” বলিয়া হাসিতে হাসিতে সাদরে স্বামীর মুখ-চুম্বন করিয়া মধুর উপরি লাভ প্রদান করিল।