» » পরিণাম-পর্ব

বর্ণাকার

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

আব্বাস আলীদিগের কারাগারে যাইবার কিছুদিন পর, একদিন রাত্রি ১১ টার সময় স্থানীয় সাবরেজিস্ট্রার সাহেবের বাসায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া, নুরল এসলাম নিজের বাসায় যাইতেছিলেন। পূর্বে বলা হইয়াছে, রতীশবাবুর বাসা, বন্দরের উপর রাস্তার ধারে। নুরল এসলাম ঐ বাসার নিকটে আসিলে শুনিতে পাইলেন ৩/৪ জন লোক তথায় বসিয়া গল্প করিতেছে। একজন লোক কহিল, “রতীশবাবু, আজকাল পাওয়া-থোওয়া কেমন?”

রতীশ। নেড়ে দাদা কাজে আসা অবধি পাওয়া-থোওয়া চুলোয় গেছে।

প্রথমে ব্যক্তি। রতীশবাবু, আপনি যাই বলুন, আপনাদের বড়বাবু লোকটি বড় মন্দ নয়। আজকালকার বাজারে অমন খাঁটি লোক পাওয়া কঠিন। বেচারার কথা মিষ্ট, ব্যবহার উত্তম, চরিত্র দেবতার ন্যায়।

রতীশ। (গরম মেজাজে বলিলেন) তুমি বুঝি বড়বাবুর ঘোড়ার ঘাসী? নইলে অসতী স্ত্রীলোক লইয়া ঘর-সংসার করিতে যে ঘৃণা বোধ করে না, তুমি তাহারই গুণগান করিতে বসিয়াছ?

দ্বিতীয় ব্যক্তি। আপনি বলেন কি? বড়বাবুর স্ত্রীর সতীপনায় গুণ্ডাগণের হাত হইতে এদেশ রক্ষা পাইয়াছে।

তৃতীয় ব্যক্তি। আমরাও শুনিয়াছি, মোকদ্দমার ঘটনা শুনিয়া জজ সাহেবও তাঁহার সতীত্বের প্রশংসা করিয়াছেন।

রতীশ। আব্বাস আলীর মত গুণ্ডার হাতে যে স্ত্রীলোক একবার পড়িয়াছে, তাহার যে সতীত্ব আছে, তাহা তুমি শপথ করিয়া বলিলেও বিশ্বাস করি না। স্বয়ং সীতাদেবী হইলেও না।

নুরল এসলামের খানাবাড়ির প্রজা নবাব আলী ওরফে নবা নামক একটি লোক তথায় উপস্থিত ছিল। সে বলিল, “মুনিবের বিবি বলিয়া বলিতে ভয় হয়, কিন্তু ছোটবাবু যাই বলেন, আমারও ত তাহাই মনে হয়।” নুরল এসলাম ঘরের পাশে দাঁড়াইয়া সব শুনিলেন। রতীশবাবুর শেষ উক্তি নুরল এসলামের কর্ণ ভেদ করিয়া সবেগে এবং সজোরে তীরের ন্যায় তাঁহার হৃদয়ের অন্তস্থলে প্রবিদ্ধ হইল। তিনি দম বন্ধ করিয়া বাসায় আসিলেন। হায়! বিনা মেঘে অশনিপাত হইল। নুরল এসলাম শয্যায় পড়িরা হা-হুতাশ করিতে লাগিলেন। তিনি বলিতে লাগিলেন, “হায়, কি শুনিলাম! ক্ষয়কাশে মৃত্যু হইলেও ত ভাল ছিল! তাহা হইলে এমন ঘৃণিত কথা আর শুনিতে হইত না।

অপরিসীম যাতনায় তাঁহার হৃদয় নিষ্পেষিত হইতে লাগিল। শয্যা কন্টক অপেক্ষাও তীক্ষ্ণবিদ্ধ হইয়া উঠিল। তিনি সারারাত্রি অনিদ্রায় কাটাইলেন। প্রাতে শান্তিলাভ-বাসনায় ধীরে ধীরে মসজিদে নামাজ পড়িতে গেলেন। নামাজ অন্তে ঊর্ধ্ব-করযোড়ে বলিতে লাগিলেন, “দয়াময়! যদি রোগে রক্ষা করিলে তবে দুর্ভোগ কেন? হৃদয়ে যে দাবানল জ্বলিতেছে; প্রভো! আর ত সহে না, তুমি অসহায়ের গতি, বিপন্নের বন্ধু, দুর্বলের বল, তুমি সর্বশান্তির আধার, অতএব দাসের হৃদয়ে শান্তি দান কর, কর্তব্য নির্ণয়ে বুদ্ধি দাও!”

নুরল এসলাম এইরূপ নানাবিধ বিলাপের সহিত মোনাজাত শেষ করিয়া হাত নামাইলেন। তাঁহার হৃদয়-যাতনার অনেক উপশম হইল। তিনি বাসায় আসিয়া যথাসময়ে অফিসের কার্যে ব্রতী হইলেন, কিন্তু মন কি আর অফিসের কার্যে স্থির হয়! অল্প সময় মধ্যে তাঁহার মনের আবার ভাবান্তর জন্মিল; থাকিয়া থাকিয়া পত্নীর সতীত্ব-নাশ সন্দেহের অপবিত্র ছায়াপাতে তাঁহার পবিত্র হৃদয় কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, হায়! আমার ন্যায় অসুখী, আমার ন্যায় অভাগা বুঝি দুনিয়ায় আর নাই? ফলতঃ এইরূপ দুর্ভাবনার দিনারুণ নিষ্পেষণে তাঁহার চিত্ত-বৈকল্য ঘটিয়া উঠিল এবং তাহা হইতে উন্মনা ভাব জন্মিল। উন্মনা ভাব হইতে ক্রমশঃ তাঁহার স্মৃতিশক্তির বিপর্যয় ঘটিতে লাগিল। সরকারি কার্যাদিতে ভূলভ্রান্তি, হিসাবপত্রে কাটকুট আরম্ভ হইল। তিনি মনে স্থিরতা-সম্পাদন জন্য মসজিদে যাইয়া পাঁচ অক্ত নামাজ পড়িতে আরম্ভ করিলেন।