ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
নুরল এসলাম তহবিল তছরুপাতের আসামী হইয়া হাজত-ঘরে প্রবেশ করিলেন। আমজাদ যথাসময়ে তাঁহার মুক্তির জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট দরখাস্ত করিলেন। তিনি উদীয়মান ক্ষমতাশালী গভর্নমেন্ট উকিল, অল্প সময়ের মধ্যে জেলার উপর পাকা বাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া করিয়া ফেলিয়াছেন। তথাপি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নুরল এসলামের জামিন মঞ্জুরে অনেক ওজর-আপত্তি করিলেন। কিন্তু আমজাদ নাছোড়বান্দা। তিনি অনেক সাধ্য-সাধনা করিয়া করিয়া দশ হাজার টাকার জামিন মঞ্জুর করাইয়া জেলখানার দ্বারে উপস্থিত হইলেন। নুরল এসলামকে আর চেনা যায় না, এই অল্প সময়ের মধ্যে তাঁহার মুখে কালির ছাপ পড়িয়াছে, চক্ষু বসিয়া গিয়াছে, শরীর কৃশ ও দুর্বল হইয়াছে, দেখিয়া আমজাদের চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। তিনি ক্লেশপূর্ণ স্বরে নুরল এসলামকে কহিলেন, ‘বাহির হইয়া আইস। তোমাকে জামিনে মুক্তি করিয়াছি।” নুরল এসলাম আমজাদকে দেখিয়া স্ত্রীলোকের ন্যায় ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। আমজাদ কহিলেন, “এখন আইস, কাঁদিয়া ফল কি?” আমজাদের চক্ষু দিয়াও অশ্রু গড়াইতে লাগিল। নুরল এসলাম কহিলেন, “আমি মুক্তি চাই না, এখানে বেশ আছি, তুমি আমার জন্য এত করিতেছ কেন?”
আমজাদ। তাহা পরে হইবে, এখন ত আইস। এই বলিয়া হাত ধরিয়া হাজত গৃহ হইতে তাঁহাকে টানিয়া বাহির করিলেন। তারপর গাড়িতে তুলিয়া বাসায় লইয়া আসিলেন। হামিদ ছুটিয়া আসিয়া পরদার অন্তরাল হতেই সয়াকে দেখিল। দেখিয়া সেও আঁচলে চোখ মুছিতে লাগিল।
অনেক সাধাসাধি করিয়া রাত্রিতে নুরল এসলামকে আহার করান হইল। আহারান্তে আমজাদ তাঁহাকে লইয়া বৈঠকখানায় যাইয়া বসিলেন।
আমজাদ। তহবিল তছরুপ কিরূপে হইল?
নুরল। পাপের ফলে।
আম। কি পাপ করিয়াছ?
নুরল। সতীকে অবজ্ঞা করিয়াছি। এই বলিয়া অবিরল ধারে অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কহিলেন, “সেই মহাপাপের প্রায়শ্চিত্তের নিমিত্ত জেলে যাইব স্থির করিয়াছি।”
আম। তাহাতে কতকটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় প্রকাশ পাইবে। আমার বিবেচনায়, প্রকৃত পাপীকে ধরিয়া শাস্তি দেওয়া এবং সতীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা শ্রেয়।
নুরল। মহাপাপী সাধারণ পাপীকে ধরিতে সমর্থ নয়।
আম। তবে কি করিবে?
নুরল। কারাগারে যাইব।
আমজাদ দেখিলেন সতী-অবজ্ঞায় তহবিল তছরুপ হইয়াছে মনে করিয়া বন্ধুর হৃদয় দীর্ণ বিদীর্ণ হইয়াছে; জীবনে ধিক্কার জন্মিয়াছে। ফলতঃ ঘটনা যাহাই হউক, ফল ভয়ানক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সুতরাং এখন তাহাকে রক্ষা করিতে হইলে কেবল নিজ চেষ্টায় সব করিতে হইবে। এইরূপ ভাবিয়া আমজাদ কহিলেন “স্থানীয় পুলিশ কোন তদন্ত করেন নাই?”
নুরল। আমার বাসাবাড়ি, সেকেন্ড ক্লার্ক রতীশ বাবুর ও অন্যান্য চাকরদিগের আড্ডা প্রভৃতি অনুসন্ধান করিয়া পুলিশ কিছু পায় নাই।
আম। রতীশ বাবু লোক কেমন?
নুরল। তিনি বেশ্যাসক্ত, বন্দরে তাহার এক রক্ষিতা আছে। উপার্জিত সমস্ত অর্থ তাহাকেই দেন। আমার ভয়ে উৎকোচ লইতে পারেন না বলিয়া তিনি আমার পরম শত্রু। দাগু প্রভৃতি চাকরেরাও এই কারণে আমার প্রতি বিদ্বেষপরায়ন।
শুনিয়া আমজাদ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। আবার কহিলেন, ক্যাশাদি কাহার জিম্মায় থাকিত?”
নুরল। আমার জিম্মায়। আম। চাবি?
নুরল। আমার নিকট।
আমজাদ কি যেন ভাবিয়া আর কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না।
পরদিন ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ লইয়া, ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও ইন্পেক্টার সঙ্গে করিয়া আমজাদ বেলগাঁও চলিয়া গেলেন। পুনরায় অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। জুট-অফিসের আমলা চাকরদিগের প্রত্যেকের বাসাবাড়ি, আড্ডা প্রভৃতি স্থান তন্ন তন্ন করিয়া দেখা হইল। অনেককে অনেক প্রকার প্রশ্ন করা হইল। এই কার্যেই দুই দিন গেল। তৃতীয় দিন অফিসের পুষ্করিণীতে জাল ফেলা হইল। ফলে কিছু মাছ পাওয়া গেল, আর কিছুই মিলিল না তৎপর পুষ্করিণীতে লোক নামাইয়া দিয়া দলামলা হইল হাঁড়ি-পাতিল কিছু উঠিল। সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেব আশাপূর্ণ অন্তরে তাহা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া দেখিলেম কিন্তু সব শূন্য। ঐ তিন দিন গুপ্তানুসন্ধানও চলিল, কিন্তু ফল কিছুই হইল না। পুলিশ হতাশ হইয়া পড়িলেন।