চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
এদিকে উকিল সাহেব নিজের পাল্কী করিয়া দোস্তকে বাড়ি পাঠাইলেন। পথিমধ্যে সাধ্বী পত্নীর অলৌকিক পতি ভক্তির ঘটনাবলী একে একে নুরল এসলামের হৃদয়ে জাগিয়া উঠিতে লাগিল, সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে অন্যায় প্রত্যাখ্যান নিত্তি অনুতাপের অগ্নি তাঁহাকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিল। নুরল এসলাম দহনজ্বালায় ক্রমে অস্থির হইয়া উঠিল। তখন চিরসহচর প্রেম, বন্ধুকে বিপন্ন দেখিয়া তাঁহার কানে কানে যেন কহিল, “চল, আমরা বাড়ি গিয়া এবার সতীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিব; তাহা হইলে অনুতাপের দাহিকাশক্তি হ্রাস হইয়া যাইবে।” নুরল এসলাম কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া অপরাহ্নে বাড়ি পৌঁছিলেন।
তাঁহাকে দেখিয়া বাড়ির সকলে আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিল। সরলা ফুফু-আম্মা ছেলের কাছে যাইয়া হর্ষ বিষাদের অশ্রু উপহার দিলেন; সোহাগে ছেলের মুখে হাত বুলাইতে লাগিলেন। সালেহা সোৎসুক দৃষ্টিতে ভ্রাতাকে দেখিতে লাগিল। দাস-দাসী ও প্রতিবাসী জনমন্ডলীর আনন্দের সীমা রহিল না। তাহাদের যেন কতকালের অভাব অভিযোগ নিমেষে পূরণ হইয়া গেল। কিন্তু যে জন এই মুক্তিমহানন্দের মূলীভূতা, সে এ সময়ে কোথায়? যে নুরল এসলামের বৈষয়িক চিন্তা দূরীকরণমানসে ত্রি-সহস্র মুদ্রার দেনমোহর দলিল অম্লানচিত্তে ছিন্ন করিয়া তাঁহার চরণে উৎসর্গ করিয়াছে, যাহার লোকাতীত সতীত্ব গুণে নুরল এসলাম দুরারোগ্র ব্যাধির করাল গ্রাস হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছেন, এ সময়ে সে কোথায়? যে জন পৈত্রিক-প্রাপ্ত নিজস্বধন সর্বস্ব দিয়া নুরল এসলামের বিষয় রক্ষা করিয়াছে, গাত্রালঙ্কার তাঁহাকে দায়মুক্ত ও পরিধান বস্ত্র বিক্রয়ে তাঁহাকে কারামুক্ত করিয়া আজ গৃহে আনিয়াছে, সেই সতীকূল-পাটরাণী এখন কোথায়?
নুরল এসলাম স্ত্রীর সাড়াশব্দ না পাইয়া শয়নঘরের দিকে, রন্ধনশালার দিকে পলকে পলকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন; কিন্তু হায়! নিষ্ফল দৃষ্টি। শেষে তিনি অধীরভাবে নিজে শয়নঘরে প্রবেশ করিলেন,—গৃহ শূন্য। চতুর্দিক দৃষ্টিপাত করিলেন, দেখিলেন, –গৃহে আছে সবই, কিন্তু কিছুই যেন নাই। আসবাবপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ঝক্ক করিতেছে, তথাপি গৃহ সৌন্দর্যহীন। আরও বিষাদের অন্ধকার যেন সেই শূন্য গৃহে জমাট বাঁধিয়া হা-হুতাশ করিতেছে। নুরল এসলাম সভয়ে প্রণয়ের আবেগে ডাকিলেন, “আনোয়ারা!” প্রতিধ্বনি কহিল, “কোথায় আনোয়ারা?” নুরল এসলামের হৃদয়ে তখন বিষাদ-নৈরাশ্যের ঝড় বহিতে লাগিল, স্ত্রীকে না দেখিয়া তিনি দশদিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন।
নুরল এসলাম যখন পাল্কী হইতে নামিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেন, তখন আনোয়ারা দক্ষিণদ্বারী ঘরে একটি ক্ষুদ্র জানালা পার্শ্বে অলক্ষিতে দাঁড়াইয়া স্বামীকে দেখিতেছিল। কারাক্লিষ্ট পতির মলিন মূর্তি দেখিয়া তাহার চক্ষু দিয়া দরবিগলিত ধারা বহিতে লাগিল। স্বামী যখন এখন এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করিয়া শূন্যমনে শয়নঘরে প্রবেশ করিলেন, তখন তাঁহার চরণসেবা করিতে সতী আর অগ্রসর হইতে পারিল না। নিজের ঘর, নিজের স্বামী, সমস্তই সম্মুখে, সমস্তই নিকটে; অথচ সে যেন বহু যোজন দূরে অবস্থিত। সংযমের কঠরতায় আজ সতীর বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।
নুরল এসলাম শয়নগৃহে প্রবেশের কিয়ৎকাল পরে দাসী তামাক সাজিয়া তথায় উপস্থিত হইল। দাসীকে দেখিয়া নুরল এসলামের হৃদয়ে আরও উদ্দামবেগে ঝড় বহিতে লাগিল। তাঁহার বুক ভাঙ্গিয়া যাওয়ার মত হইল। অজ্ঞাতে আবেগ-উচ্ছ্বাসে তাঁহার মুখ দিয়া হঠাৎ বাহির হইল “আনোয়ারা!” দাসী মনে করিল, আমাকেই বুঝি জিজ্ঞাসা করিলেন, তাই সে কহিল, “তিনি দক্ষিণদ্বারী ঘরে বসিয়া কাঁদিতেছেন।” দাসীর কথায় নুরল এসলাম হঠাৎ মৃতদেহে প্রাণ পাইলেন। স্ত্রীর অস্তিত্ব পরিজ্ঞাতে তাঁহার তাপ দগ্ধ হৃদয়ের জ্বালা মন্দীভূত হইয়া আসিল। তিনি দাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ফুফু-আম্মা কোথায়?”
দাসী! তিনি রান্নাঘরে গিয়াছেন।
নুরল অতি মাত্রায় ব্যগ্রভাবে দক্ষিণদ্বারা ঘরে প্রবেশ করিলেন! আনোয়ারা স্বামীকে দেখিয়া দাঁড়াইয়া থর্ থর্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল। নুরল তাহার দিকে অগ্রসর হইতেই আনোয়ারা বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “দাসী অস্পৃশ্যা।” গুরুতর অপরাধের নিদারুন অনুতাপ- চিহ্ন নুরলের মুখমণ্ডলে নিমিষের মধ্যে প্রকাশিত হইয়া পড়িল। তিনি করুণ স্বরে কহিলেন, “সতী পাপীর অস্পৃশ্যই বটে।”
আনো। আপনি চির পুণ্যবান—দাসী পরাহৃতা-অপবাদ কলঙ্কিনী, তাই আপনার ন্যায় পবিত্র মহাত্মার পক্ষে অস্পৃশ্যা।
নুরল। আমি ভ্রান্ত কল্পনার বশীভূত হইয়া তোমা হেন সতীরত্নকে অবজ্ঞা করিয়া যথেষ্ট মর্মযাতনা পাইয়াছি। সন্দেহের চক্ষে দেখিয়া তোমার হৃদয়েও অনেক ব্যথা দিয়াছি, কিন্তু প্রিয়তমে—আমার প্রতি চিরদিনই তোমার ভালবাসার সীমা নাই। আমি না বুঝিয়া তোমর পবিত্র সরলতাপূর্ণ হৃদয়ের সহিত বড়ই দুর্বব্যহার করিয়াছি। প্রিয়ে! যে প্রেমপূর্ণ সরলতা প্রকাশে নুরলকে কিনিয়াছ, সেই সরলতা পূর্ণ ভালবাসা দানে দয়া করিয়া আজ আমার সেই অপরাধ ক্ষমা করিবে কি? আমি নরাধম! তোমা হেন সতীর উপর সন্দেহ করিয়া যেরূপ পাপ করিয়াছি কিছুতেই তাহার প্রায়শ্চিত্ত হইতে পারে না। নিরপরাধ কুটিলবোধবিহীনা সাধ্বী সতীর কোমল প্রাণে যে ব্যথা দিয়াছি, ইহজন্মে আমার হৃদয় হইতে তাহা অপনীত হইবে না। এ অকিঞ্চিৎকর পাপ জীবনের সহিত সে নিদারুণ অনুতাপের সম্বন্ধ চিরদিনই থাকিবে, আজ আমি তোমার নিকট ক্ষমার ভিখারী।
বলিতে বলিতে নুরল এসলাম সাশ্রুনয়নে আনোয়ারার হাত ধরিলেন। হৃদয়ের অসীম যাতনায় ও শোকোচ্ছ্বাসে নিতান্ত কাতর হইয়া অশ্রুজলে প্রিয়তমার পবিত্র হস্ত প্লাবিত করিতে লাগিলেন। আনোয়ারা অতি যত্নে স্বামীকে প্রকৃতিস্থ করিয়া তাহার চরণে পড়িল এবং কোকিল কন্ঠে গভীর প্রেমের আবেগে কহিল, “আপনাকে ক্ষমা? আপনার দুর্বাক্য যাহার কর্ণে মধু বর্ষণ করে, যে আপনার চরণের ভিখারিণী,—তাহার নিকট ক্ষমা?—কিন্তু নাথ! আপনি যে ভ্রমে আমাকে চরিত্রহীনা বলিয়া মনে স্থান দিয়াছেন, আজ দাসী সে কলঙ্ক মোচনে মুক্তকণ্ঠে তাহার প্রতিবাদ করিবে।”
নুরল। জীবিতেশ্বরী! আমার মন ভ্রান্ত হইয়াছিল বটে কিন্তু অজ্ঞানান্ধকারে দিগ-ভ্রান্ত হইয়া, আমার হৃদয় সন্দেহমার্গে পরিভ্রমণ করিয়াছিল সত্য; কিন্তু চিত্ত অনুতাপে দগ্ধ হইতেছে। প্রাণেশ্বরী! তুমি ভিন্ন আমার এ জগতে আর কেহ নাই; আমি তোমার পবিত্র সংসর্গে এ কলুষিত দেহ পবিত্র করিব। অজ্ঞানান্ধ নুরলের যত কিছু পাপ হওয়া সম্ভব, প্রাণেশ্বরী! সে সকল পাপেই সে মহাপাপী। যদি সে সকল অজ্ঞানকৃত পাপের আর প্রায়শ্চিত্ত না থাকে; তবে তোমার সাক্ষাতেই জীবন ত্যাগ করিয়া এ পাপ-পঙ্কিল দেহ বিসর্জন দিব।
আনো। প্রাণেশ্বর, ইচ্ছাপূর্বক আপনি আমাকে মনকষ্ট দেন নাই, এজন্য আপনাকে দোষী হইতে হইবে না। অদৃষ্টের দোষে নিজে দুঃখ পাইলাম, আপনাকেও যথেষ্ট দুঃখ দিলাম। প্রিয়তম, স্বামিন! অভিন্নহৃদয় প্রাণেশ। আপনি পবিত্র, প্রেমময়! আপনার প্রেমের কণিকা লাভের জন্যও আমি ভিখারিণী! আপনি আমার জীবনের একমাত্র ধ্রুবতারা, আপনার হৃদয়ে আমার স্থান নাই জানিয়াও এ শূন্য হৃদয়ে প্রিয়তম লাভের শেষ আশা পোষণ করিত জীবিত রহিয়াছি; কিন্তু আপনি ভাল করিতেছেন না, এই হতভাগিনীর সহবাসে থাকিয়া আপনি আর সুখী হইতে পারিবেন না, লোকাপবাদে আপনার কর্মময় জীবনে চিরঅশান্তি আসিয়া হৃদয়তন্ত্রী ছিন্ন ছিন্ন করিয়া দিবে। অতএব দাসীর প্রার্থনা, আপনি পুনরায় বিবাহ করিয়া বংশরক্ষা ও সংসারধর্ম পালন করুন। আপনার সুখের জন্যই আমার জীবন, আপনার সুখে আমার সুখ। এই নিমিত্ত গতরাত্রিতে আমি সঙ্কল্প স্থির করিয়াছি, লোকপবাদ মোচনের জন্য আপনার সহবাস-সুখ বিসর্জন দিব। অতএব দাসীর এই দৃঢ়ব্রত আর ভঙ্গ করিবেন না। দাসীর শেষ প্রার্থনা, খোদা তায়ালার অনুগ্রহে আপনি বিবাহ করিয়া চির সুখী হউন, কিন্তু দাসীকে চরণ-ছাড়া করিবেন না। দাসী যেন দাসীবৃত্তি অবলম্বনে আপনার পুণ্যধামে থাকিয়া প্রত্যয় আপনার পবিত্র সুন্দর মুখশ্রী সন্দর্শন করিয়া—জীবিতকাল অতিবাহিত করিতে পারে। আমি কলঙ্কিনী হইলেও আপনার দাসী।
সতীর অশ্রুপূর্ণ নিষ্কাম প্রেমপূর্ণ বাক্যগুলি মিছরির ছুরির ন্যায় নুরল এসলামের হৃদয় দীর্ণ-বিদীর্ণ করিয়া ফেলিল। তিনি অভিমান-ব্যাকুলচিত্তে কহিলেন, “অনুতাপের দাবানলে ভষ্মীভূত হইয়াছি, আর দগ্ধ করিও না।”
আনো। আপনি অকারণ অনুতাপ করিবেন না। যাহা বলিলাম ভাবিয়া দেখুন তাহাই আপনার পক্ষে শ্ৰেয়ঃ।
নুরল। আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি—জগতের শিক্ষার্থে যাহার স্ত্রী তোমার ন্যায় ব্রতী তাহার জীবন ধন্য। তোমার মত স্ত্রী যার ঘরে তার মর্ত্যেই স্বর্গ।
কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া পরে গুরুগম্ভীর স্বরে আবার কহিলেন, “আমি আর অধিক বলিতে চাই না প্রিয়তমে, তুমি শত কলঙ্কে কলঙ্কিনী হইলেও আজ তাহা পবিত্র বিশ্বাস- তুলিকাতে মুছিয়া ফেলিলাম, তুমি রমণীরত্ন! তোমাকে আমি ক্লেশ দিয়াছি। সংসার যায়, যাউক;–লোকসমাজে অপমানিত হই, হইব,—হৃদয় অশান্তি-শ্মশান হয়, হউক;—অদ্য আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি—আনোয়ারা! তুমি আমার পরম ধার্মিকা সতী-সাধ্বী পত্নী। ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশতী হইয়া আর তোমায় কষ্ট দিব না। তুমি আমার অজ্ঞানকৃত অনাদর ভুলিয়া যাও এবং তোমার সঙ্কল্প পরিত্যাগ কর; নচেৎ এখনই তোমার সম্মুখে আত্মঘাত হইয়া সর্বদুঃখের অবসান করিব।” প্রেমাভিমানের কঠোরতায় নুরল এসলামের হৃদয় চিরিয়া, কথাটি বিদ্যুদ্বেগে সতীর প্রেমময় হৃদয়ের অন্তস্তলে প্রবেশ করিল। তখন সে আর স্থির থাকিতে পারিল না। পতি-হত্যা মহাপাপজনিত আশঙ্কায় তাহার কঠোর সঙ্কল্প তিরোহিত হইল। সে তৎক্ষণাৎ পতির চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করিল।