» » পরিণাম-পর্ব

বর্ণাকার

সপ্তম পরিচ্ছেদ

নুরল এসলাম জেলায় চালান হইবার সময় স্ত্রীকে যে পত্র লিখিয়া যান, তাহা যথাসময়ে আনোয়ারার হস্তগত হইল। ঐ সময়ে সে জোহরের নামাজ পড়িয়া নিজের দূরদৃষ্টের বিষয় চিন্তা করিতেছিল। স্বামীর হস্তাক্ষরযুক্ত পত্র দেখিয়া তাহার হৃদয়ে তুফান ছুটিল। সে কম্পিত হস্তে পত্রখানি চুম্বন করিয়া তাজিমের সহিত মাথায় রাখিল, তাহার পরে চক্ষে স্পর্শ করাইয়া বুকে ছোঁয়াইল, তৎপরে খুলিয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু হায়! পাঠান্তে—’খোদা, তুমি কি করিলে? এই বলিয়া জায়নামাজের উপরই অজ্ঞান হইয়া পড়িল।

সালেহা পূর্বে লেখাপড়া জানিত না। আনোয়ারার শিক্ষা-দীক্ষায় সে এখন কোরান শরিফ ও বাঙ্গালা পুস্তকাদি পড়িতে পারে। তাহার দেখাদেখি, পাড়ার আরও ৫/৬ মেয়ে আনোয়ারার কাছে পড়াশুনা করে। সালেহা পড়া বলিয়া লইতে এই সময় ঘরে আসিয়া দেখিল, আনোয়ারা জায়নামাজের উপর শুইয়া আছে। সালেহা প্রথমে ‘ভাবী’ বলিয়া ২/৩ বার ডাকিল, কোন উত্তর পাইল না; পরে জোরে গায়ে ধাক্কা দিল, তথাপি সাড়াশব্দ নাই; পরে এপাশ ওপাশ করিয়া দেখিল, যেদিকে কাৎ করে সেই দিকেই থাকে। এই অবস্থা দেখিয়া বালিকা সভয়ে চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “ফুফু-আম্মা, ভাবী মরিয়া গিয়াছে।” ফুফু-আম্মা শুনিয়া দৌড়িয়া আসিলেন। প্রতিবাসী অনেক স্ত্রীলোক আসিয়া জুটিল, আনোয়ারার কয়েকটি ছাত্রীও আসিল। ফুফু বউ-এর গায়ে হাত দিয়া দেখিলেন গা ঠাণ্ডা; নাকে হাত দিলেন, নিঃশ্বাস চলে না, মুখের ভিতর হাত দিয়া দেখিলেন দাঁতে দাঁতে দৃঢ়রূপে লাগিয়া গিয়াছে। ফুফু-আম্মাও তখন বৌ মরিয়া গিয়াছে বলিয়া হায়, হায়, করিতে লাগিলেন। উপস্থিত একজন প্রবীণা প্রতিবাসী স্ত্রীলোক কহিলেন, “আপনারা এত অস্থির হইবেন না, দাঁত লাগিয়াছে, মাথায় পানির ধারাণী দিউন।” তাঁহার কথামত কার্য চলিল, কিন্তু কি নিমিত্ত বৌ-এর এরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে; তাহা কেহই ঠিক করিতে পারিল না। পরে সেই প্রবীণা স্ত্রীলোকটি এদিক ওদিক চাহিয়া কহিলেন, “বিবি সাহেবার পাশে চিঠির মত ওখানা কি পড়িয়া রহিয়াছে?” কুসম নামে একটি বুদ্ধিমতী ছাত্রী চিঠিখানি তুলিয়া লইল এবং খুলিয়া মনে মনে পড়িতে লাগিল,—

“প্রাণাধিকে–

তুমি ফেরেশ্তাদিগের পূজনীয়। আমি নরাধম, তাই তোমাকে চিনিতে পারি নাই! পরন্তু লোকাপবাদে উন্মনা হইয়া তোমার পবিত্র হৃদয়ে যে ব্যথা দিয়াছি, সেই মহাপাপে আজ কারাগারে চলিলাম। সরকারি তহবিল হইতে আট হাজার টাকা কিরূপে খোয়া গিয়াছে কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। কোম্পানির আদেশে আমি দায়ী হইয়া ফৌজদারিতে সোর্পদ হইয়া জেলায় চলিলাম। হায়! তোমার স্বর্গীয় বিমল মূর্তি আর দেখিতে পাইলাম না, ইহাই দুঃখ রহিল। কারাগারে যাইয়া আর বেশি দিন বাঁচিবার আশা নাই। অন্তিম অনুরোধ, শুধু শরিয়তের নহে, ধর্মবিধি—প্রাণের দোহাই দিয়া বলিতেছি, নরাধমের জীবিতকাল পর্যন্ত তাহাকে পতি বলিয়া মনে রাখিও। ইতি–

তোমারই হতভাগ্য
নুরল এসলাম

পত্র পাঠ করিয়া কুলসম কহিল, “অজ্ঞানই হবারই কথা।” ফুফু-আম্মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “পত্রে কি লেখা আছে, মা?” কুলসম কারাগারে যাওয়ার কথা চাপা দিয়া কহিল, “দেওয়ান সাহেব সরকারি টাকা-পয়সার গোলমালে পড়িয়াছেন।” শুনিয়া ফুফু-আম্মা আরও উতলা হইলেন।

অনেক সেবা-শুশ্রূষার পর আনোয়ারার চৈতন্য হইল। সে জোর করিয়া উঠিয়া বসিতেই ‘উহ” বলিয়া আবার অজ্ঞান হইয়া পড়িল। পুনরায় সেবা-শুশ্রুষা চলিল। ধীরে ধীরে আনোয়ারা আবার চেতনা লাভ করিল। ফুফু-আম্মা হৃদয়ের ব্যাকুলভাব চাপিয়া বউকে প্রবোধ দিবার জন্য কহিলেন, “টাকা-পয়সার একটু গোলমাল হইয়াছে, তাহাতেই তুমি এত অস্থির হইয়াছ?” আনোয়ারা কহিল, “না, তিনি যে জেলে”—বলিয়াই আবার অজ্ঞান হইয়া পড়িল।

ফুফু-আম্মা কাঁদিতে লাগিলেন। আনোয়ারার বারংবার মূর্ছা ও ফুফুর কান্নাকাটিতে দিবা অবসান হইল, রাত্রি আসিল। অতিকষ্টে রাত্রিও প্রভাত হইল। আনোয়ারা বুকে গুরুতর বেদনা লইয়া শয্যায় উঠিয়া বসিল। ফুফু টোকা ওষুধের প্রলেপ তাহার বুকে দিয়া কহিলেন, “তুমি অত উতলা না হইয়া ছেলের রক্ষার জন্য মধুপুরে ও জেলার ঠিকানায় পত্র লিখ।”