» » বিষাক্ত ছোবল

বর্ণাকার

বুজার আমীর ইয়াজুদ্দিনকে সাদরে গ্রহণ করলো। ইয়াজুদ্দিন আদরের সাথে সুলতানের চিঠি পেশ করলো বুজার আমীরের নিকট। বুজার আমীর চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলেন। সুলতান আইয়ুবী লিখেছেন,

‘আমার প্রিয় ভাই! আমরা এক আল্লাহ, এক রাসূল এবং একই কুরআনের অনুসারী। অথচ আমরা একে অপর থেকে এমন দূরে সরে পড়েছি, যেন আমরা বিভিন্ন ফলের বাসিন্দা। এতে আমরা পরস্পর কমজোর হয়ে পড়েছি। এ অবস্থায় থাকলে জাতি হিসাবে কখনো আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। আমাদের এ অনৈক্যের সুযোগ নিচ্ছে খৃষ্টান ক্রুসেডাররা। তারা আমাদের খণ্ড-বিখণ্ড করে শিয়াল ও শকুনের মত কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের। কারণ তারা আমাদের ঈমানী চেতনাকে অসাড় ও নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। আমরা যে একে অপরের ভাই এবং একই নবীর উম্মত, যাদের নবী শিশাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন, সেই অনুভূতি আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

এ অবস্থা যতদিন থাকবে ততদিন জিল্পতি ও অপমান আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না। আমাদের মুক্তির পথ একটাই, এক দেহ এক প্রাণ হয়ে সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জু আঁকড়ে ধরা। যেভাবে খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং আঘাত হানছে, তাতে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে দেরী করি, তবে আমরা কেউ সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো না।

আমি আপনাকে এই ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছি। আসুন সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে আমরা এক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে যাই। আমাদের ঐক্যের ভিত্তি হবে কোরআন। কোন ব্যক্তি নয়, কোরআনই হবে আমাদের পরিচালিকা শক্তি। যার যার যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনুযায়ী আমরা ভূমিকা রাখবো এ জেহাদে।

আমি আপনার বর্তমান অবস্থা ভালভাবেই অনুধাবন করছি। আপনি আপনার ক্ষুদ্র এলাকায় নিজের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য জাতীয় শক্রদের কাছে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। আমি আপনাকে কুরআনের সেই আয়াত স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যেখানে বলা হয়েছে, অমুসলমান কখনো মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না। আল্লাহর এ সুস্পষ্ট ঘোষণা অগ্রাহ্য করে খৃস্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করলে তার ভয়াবহ পরিণতি গ্রাস করবে আমাদের।

তাই আপনার কাছে আমার পয়গাম হলে, প্রথমেই আপনি আপনার কেল্লাকে ইসলামী খেলাফতের অধীন করে দিন। খেলাফতের দাবী অনুযায়ী আমাদের আনুগত্য স্বীকার করে নিন। এর স্বীকৃতি স্বরূপ আপনার সামরিক শক্তি আমাদের সামরিক শক্তির সাথে একাত্ম ও মিলিত করে দিন। আমার এ প্রস্তাবে সম্মত হলে আপনি অবশ্যই আপনার কেল্লার অধিপতি থাকবেন। কিন্তু কেল্লার ওপর উড্ডীন থাকবে খেলাফতে ইসলামিয়ার পতাকা।

প্রিয় ভাই, যদি আমার এ শর্ত আপনার মনপুত না হয় তবে আপনার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করুন আমার বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করার জন্য। তবে এ প্রকৃতির সময় আমি আপনাকে অনুরোধ করবো হলব, মুশেল ও হারানের সম্মিলিত বাহিনীর শোচনীয় অবস্থা ও পলায়নের কথা স্মরণ রাখার জন্য। এতে আপনার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।

আমি দৃঢ় আশাবাদী, আমার পয়গাম অবশ্যই আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আমি আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের আশা পোষণ করি। কারণ আপনার সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। আমি যা কিছু বলছি, সবই ইসলামী খেলাফতের কল্যাণের কথা চিন্তা করে অর্পিত দায়িত্বের কারণেই বলছি। আল্লাহর বিধান অনুসারে আমি যেন জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারি সে জন্য আপনার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করে শেষ করছি।’

বুজার আমীর সুলতান আইয়ুবীর চিঠি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লেন এবং পড়া শেষ হলে ইয়াজুদ্দিনের দিকে তাকালেন।

‘জ্বী, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এ চিঠি আমি গভীর মনোযোগর সাথেই পড়েছি। এ সম্পর্কে আপনার আর কিছু বলার আছে?’

ইয়াজুদ্দিন বললো, ‘আপনার এ দুর্গ তেমন মজবুত নয় আর আপনার সৈন্য সংখ্যাও অনেক কম। এই সামান্য সংখ্যক সৈন্যকে আপনি অযথা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন না, এটুকুই আমার অনুরোধ।’

বুজার আমীর চিঠির শর্ত মেনে নিয়ে আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন এবং সুলতান আইয়ুবীর নিকট জওয়াবী পত্র দিলেন। জওয়াবী চিঠিতে তিনি লিখলেন,

‘মুহতারাম মহানুভব সুলতান, এ দুর্দশাগ্রস্ত জাতিকে নিয়ে আপনি যেভাবে চিন্তা করছেন, তাতে আমি আশাবাদী, একদিন এ দুর্যোগের রাহুমুক্ত আমরা হবোই। আপনাকে আমি খোশ আমদেদ জানাচ্ছি। আপনি আসুন এবং এ কেল্লার দায়িত্ব বুঝে নিন। জাতির এ দুর্দিনে আপনার পাশে দাঁড়াতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।’

মুমবাজের আমীরও আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে অনুরূপ পত্র লিখলেন। ফখরুদ্দিন সে জওয়াবী চিঠি নিয়ে ফিরে এলেন কোহে সুলতানের ক্যাম্পে।

সুলতান আইয়ুবী নিজেই কেল্লা দু’টোতে গেলেন। কেল্লা দু’টোর সমস্ত সৈন্য এনে নিজের সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত করে দিলেন। নিজের সৈন্য বাহিনীর লোক নিয়োগ করলেন কেল্লা দু’টোতে। তারপর এ বিশাল বাহিনীর সৈন্যদের খাবার ও রসদপত্র মজুদ করার নির্দেশ দিলেন উভয় কেল্লায়।

কোহে সুলতানের সমস্ত রসদপত্র নিরাপদ স্থানে মজুদ করার পর পরবর্তী কাজে হাত দিলেন সুলতান। হলব শহরের একেবারে সন্নিকটে এজাজ দুর্গ নামে একটি মজবুত কেল্লা ছিল। সে দুর্গের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছিল হলবাসীদের। হলবের মতই এ কেয়ার নিয়ন্ত্রণভার ছিল আল মালেকুস সালেহের হাতে।

এ কেল্লা থেকে হলব বেশী দূরে ছিল না বলেই এ কেল্লার রক্ষক কোন রকম ঝুঁকি না নিয়ে শুরুতেই হলবের আমীর আল মালেকুস সালেহের আনুগত্য মেনে নিয়েছিল।

সুলতান আইয়ুবী হলব অবরোধ করার আগে এজাজ দুর্গটিও বিনা বাধায় দখল করে নিতে চাইলেন। এ আশায় তিনি তার এক সেনাপতি আল হেমায়েরীকে অনুরূপ চিঠি দিয়ে এজাজ দুর্গে পাঠিয়ে দিলেন।

এজাজের আমীর সুলতান আইয়ুবীর চিঠি পড়লেন। এ চিঠির ভাষাও আগের চিঠিগুলোর মতই ছিল। এজাজের আমীর চিঠিটি পড়ে আল হেমায়েরীর দিকে ছুঁড়ে মারল। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো, ‘তোমার সুলতান আল্লাহ ও রাসূলের দোহাই দিয়ে সারা দুনিয়ার বাদশাহ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাকে বললো, আগেও আপনি একবার হলব অবরোধ করেছিলেন। তাতে কতটুকু কি লাভ হয়েছিল সে হিসাব করে তিনি যেন এজাজ দুর্গ অবরোধ করতে আসেন।’

‘আপনি কি মুসলমানদের হাতেই মুসলমানদের রক্ত বন্যা বইয়ে দিতে চান?’ আল হেমায়েরী বললো, ‘আপনি কি চান, মুসলমান নিজেরাই পরম্পর যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যাক, আর খৃষ্টানরা আমাদের এ অবস্থা দেখে আনন্দ উৎসব করুক?’

‘না, আমি এটা চাইতে যাবো কেন, এটা তো চায় তোমার সুলতান। আমি খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে তিনি কি আমার আনুগত্য কবুল করে নেবেন? শোন, এটা ধর্মীয় জেহাদ নয়, এটা হচ্ছে দুই শাসকের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লড়াই। ক্ষমতা ও রাজনীতির মঞ্চে ধর্মকে টেনে এনে তোমার সুলতান ধর্মকেই অপবিত্র করছে। আমরা কি মুসলমান নই? আমরা কি আল্লাহ ও তার রাসূলকে বিশ্বাস করি না? তাহলে তিনি কেন আমাদের ওপর চড়াও হতে চাচ্ছেন? এতই যদি জেহাদ করার শখ তাহলে তিনি খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন না কেন? কারণ আমাদের মত তিনিও খৃষ্টানদের ভয় পান। তার যত বাহাদুরী সব তো ছোট ছোট মুসলিম শাসক ও আমীরদের সামনে। এখানে যদি কোন মুসলমানের এক ফোটা রক্তও ঝরে, তার জন্য দায়ী থাকবেন তোমার সুলতান। তিনি হয়তো শক্তি প্রদর্শন করে কিছু ছোটখাট জায়গীর ও জমিদারী দখল করতে পারবেন, কিন্তু আল্লাহর দরবারে তার সব দম্ভ ও জুলুমের হিসাব দিতে হবে। তোমার সুলতানকে বলো, এখানকার মুসলমানদের রক্ত ঝরানোর আগে তিনি যেন আল্লাহর পাকড়াওয়ের কথা একটু স্মরণ করে নেন!’ এজাজের আমীর রূঢ় কণ্ঠে জবাব দিল।

এজাজের আমীরের কথা শুনে সেনাপতি আল হেমায়েরী আস্তে করে বললো, ‘আমাদের সুলতান আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবেন সেটা তিনিই ঠিক করবেন। কিন্তু আপনি আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবেন সেটা কি ঠিক করেছেন? কোরআন যেখানে ইহুদী ও খৃস্টানদের বন্ধু না ভাবার নির্দেশ দিয়েছে, সেখানে আপনি ওদের বন্ধু বানিয়েছেন। এর কি জবাব দেবেন আপনি?

যেখানে খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে হাতে, সেখানে আপনি ওদের শত্রু না ভেবে বন্ধু ভাবেন কোন যুক্তিতে?’ আল হেমায়েরী জিজ্ঞেস করলো, ‘তবে কি আপনি কোরআনকে অগ্রাহ্য করতে চান? আপনি কি সত্যি মনে করেন, খৃষ্টানরা মুসলমানদের শত্রু নয়, বন্ধু?’

‘এখানে, এই সময়ে আমরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকেই আমাদের শত্রু হিসাবে দেখতে পাচ্ছি। খৃস্টান নয়, তিনিই আমাদের চ্যালেঞ্জ করেছেন।’ এজাজের আমীর বললো, ‘যিনি এই দুর্গ আমাদের থেকে জোর করে কেড়ে নিতে চান, তাকে শক্ত না ভেবে যারা আমাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের আমরা অযথা শত্রু ভাবতে যাবো কোন যুক্তিতে?’

আল হেমায়েরী ও এজাজের আমীরের মধ্যে এ রকম বাদানুবাদ আরো কিছুক্ষণ চললো। কিন্তু কিছুতেই এজাজের আমীরকে বুঝানো গেল না, সে জাতির কত বড় সর্বনাশ করছে। বরং সে দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল দরবার থেকে।

❀ ❀ ❀

আছিয়াত দুর্গ। খৃষ্টান অফিসার দেখা করলো গুমাস্তগীনের সাথে। কারিশমা এবং লিজাও তার সঙ্গে। গুমাস্তগীনের সাথে এ অফিসারের আগে থেকেই ভাল মতো পরিচয় ছিল। অফিসার ওমাস্তগীনকে বললো, ‘শুনতে পেলাম আপনি সুলতান আইয়ুবীকে খুন করার পরিবর্তে সাইফুদ্দিনের পিছনে লেগেছেন?’

‘আপনি কি শোনেননি, সাইফুদ্দিন কেমন কাপুরুষের মত যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়েছে! এমন আনাড়ি যোদ্ধার মত খেলে সে আমাদের সবার মুখেই চুনকালি মেখে দিয়েছে।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘তার কৃতিত্বের বর্ণনা এই মেয়ে দু’টির কাছ থেকে শুনে নিন। সে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীকে ময়দানে অসহায় ফেলে রেখে নিজে পালিয়ে গেছে। তার অপরাধ শুধু এটুকুই নয়, সে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, আমাদের বাহিনী দীর্ঘকাল আর যুদ্ধ করার মনোবলও জোগাড় করতে পারবে না। আমি বিচ্ছিন্ন সেনাদলকে একত্রিত করে সুলতান আইয়ুবীকে হলব থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবো। সাইফুদ্দিন বেঁচে থাকলে সে চাইবে না, তার পরিবর্তে আমি এ কৃতিত্ব অর্জন করি। সে তার কাপুরুষতা ঢাকার জন্য তলে তলে আমাকে পরাজিত করার চেষ্টা করবে। আর তা না হলে মনের আক্রোশ মিটানোর কথা বলে আরও একবার কমান্ডের জন্য জিদ ধরবে। আর এমনটি হলে আবারো আমাদের পরাজয়ের দুর্ভাগ্য বহন করতে হবে। তার চেয়ে বরং তাকে সরিয়ে দেয়াই ভালো।’

‘সাইফুদ্দিন এত প্রয়োজনীয় ব্যক্তি নয়, যেমন আপনি চিন্তা করছেন।’ খৃষ্টান অফিসার বললো, ‘তার সম্পর্কে আমি যা জানি তা আপনি জানেন না। আমি আপনার প্রত্যেক বন্ধু ও প্রত্যেক শত্রু সম্পর্কে আপনার চেয়ে বেশী জানি। এ কাজের জন্যই আপনাদের কাছে আমাদের উপদেষ্টা ও গোয়েন্দারা সারাক্ষণ মজুদ থাকে।

আমার কথাই ধরুন, আমি সুলতান আইয়ুবীর এলাকায় বহুরূপী সেজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কেন? শুধু আপনাদের টিকে থাকা ও রাজ্য বিস্তারে সহায়তার জন্য। ময়দানের যে অবস্থা আমার জানা আছে, তাতে আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, আপনি বা আপনার কোন বন্ধু আইয়ুবীকে হারাতে পারবেন না। তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে একমাত্র তাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই।

নুরুজিন জঙ্গী মারা গেছে, তাতে আপনারা এক আপদ থেকে মুক্ত হয়েছেন। নূরুদ্দিন জঙ্গী গেছে বলেই আজ আপনারা সাধারণ কেরাধিপতি থেকে এলাকার শাসক হয়ে বসতে পেরেছেন। আইয়ুবী যদি মারা যায়, তাহলে আপনারা রাজ্যকে বর্ধিত করার সুযোগ পাবেন। ছোট ছোট পরগণার শাসক থেকে হয়ে যাবেন দেশের বাদশাহ। এসব কি ভেবে দেখেছেন?’

এ সময় কথা বলে উঠলো কারিশমা, ‘আর আইয়ুবীর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আপনারা চিরদিনের জন্য যুদ্ধের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে পারেন। আইয়ুবী বেঁচে থাকলে আপনাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে হবে ভয় ও শংকার মধ্যে। একদিনের জন্যও সে আপনাদের শান্তি ও স্বস্তিতে ঘুমোত দেবে না।’

গুমাস্তগীন শুনছিল ওদের কথা। খৃষ্টান অফিসারটিই আবার কথা বলে উঠলো, “আমি ত্রিপলী যাচ্ছি। আপনারা যে উট, ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র হারিয়েছেন সে ক্ষতি জলদি পূরণ করার জন্য আমি আমাদের নেতৃবৃন্দকে বলবো। আশা করি যুদ্ধের অন্ত্রপাতি ও ঘোড়া আমরা শীঘ্রই পাঠিয়ে দিতে পারবো। আমি আপনাকে বলতে চাই, আপনি কিছুতেই সাহস হারাবেন না। আপনার ওপর আমাদের নেতৃবৃন্দের যথেষ্ট সু-ধারনা ও আস্থা রয়েছে। তারা এখন মনে করছেন, সুলতান আইয়ুবীকে একমাত্র আপনিই দুনিয়া থেকে সরাতে পারবেন। আর আপনি যদি সত্যি তা পারেন, তবে আপনাকে এত বেশী সাহায্য দেয়া হবে যে, আপনার শাসন ক্ষমতা সাইফুদ্দিন এবং আল মালেকুস সালেহের চাইতেও শক্তিশালী ও ব্যাপক হবে। চাই কি, মুসলমানদের কাছে সুলতান আইয়ুবী যে মর্যাদা ও সম্মান পাচ্ছে, সেই সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবেন আপনি।’

গুমাস্তগীন ছিল যেমন বিলাসপ্রিয় ও ক্ষমতালোভী, তেমনি সুযোগ সন্ধানী। ক্ষমতার লোভ গুমাস্তগীনের ওপর এমনভাবে চেপে বসেছিল যে, তার স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধিও গ্রাস করে নিয়েছিল। খৃষ্টান অফিসারের কথা শুনে তার মগজে একবারও এ চিন্তা জাগেনি যে, এই খৃষ্টান অফিসার যা বলছে, তা গুমাস্তগীনের কল্যাণের জন্য নয়, বরং খৃষ্টানদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই বলছে। সে সেই সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করছে, যারা দুনিয়া থেকে ইসলাম ও মুসলমানের নাম নিশানা মুছে দিতে চায়। সে যা কিছু বলছে ও করছে, সবই তার আপন জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই।

এ খৃষ্টান অফিসারটি ছিল ভয়ংকর দুষ্কৃতকারী এবং অতিশয় দক্ষ ও চালাক ক্রুসেডার। কেমন করে সুলতান আইয়ুবীর ঝড়ের গতি থামাবে, এ নিয়ে সে ছিল খুব পেরেশান ও বিচলিত।

প্রত্যেক রণক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে খৃষ্টান ক্রুসেডাররা এখন একটা কথাই শুধু ভাবছিল, সুলতান আইয়ুবীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। আর এ কাজটি সারতে হবে কোন মুসলমানকে দিয়েই।

তারা ভাল করেই জানতো, মুসলমান শাসকদের পরস্পরের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছেদ, তাতে সুলতান আইয়ুবীর পর এমন আর কেউ নেই যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে পারে। বরং আইয়ুবীর সাথে যুদ্ধ শেষ হলে শুরু হবে যুদ্ধের নতুন পর্যায়। এক মুসলিম শাসক নিজের আধিপত্য বিস্তারের লোভে ঝাঁপিয়ে পড়বে অন্য শাসকের ওপর। তখন খৃষ্টানদের কাজ হবে সংঘাতরত উভয় শক্তিকে অস্ত্র ও রসদ সম্ভার দিয়ে সহায়তা করা এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক সাহস ও উৎসাহ যুগিয়ে যাওয়া। এতে করে তারা পরস্পর যুদ্ধ করে নিঃশেষ হয়ে যাবে। মুসলিম নিধনের যে স্বপ্ন তাদের অন্তরে অনুক্ষণ জ্বলছে, সে স্বপ্ন সফল করে দেবে মুসলমানরাই।

আর সফলভাবে যদি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে এরপর ক্রুসেডারদের সামনে আর বড় রকমের কোন বাঁধাই থাকবে না। তখন তারা ধীরে ধীরে সমস্ত আরব দেশগুলোর ওপর স্বচ্ছন্দে নিজেদের শাসন ক্ষমতা জারী করতে পারবে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তো তারা এতদিন ধরে মুসলিম আমীর ও শাসকদের মস্তিষ্ক ধোলাই করে আসছে। তাদের মগজে জাগিয়েহে ধন-সম্পদের লোভ এবং বাদশাহী বা গদির মোহ। এ এমন এক নেশা বার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই তাদের।

গুমাস্তগীনের সাথে কথা বলছিল, আর এ পরিকল্পনার কথা স্মরণ করছিল খৃষ্টান অফিসার ও গোয়েন্দারা। গুমাস্তগীন বললো, ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে শেখ মান্নান তো নিরাশ হয়ে গেছে। সে আরও চারজন ফেদাইন খুনী পাঠিয়েছে কিন্তু তারা যে সফল হবে এমন কোন আশা নেই তার।’

‘এতগুলো হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর শেষ মান্নানের নিরাশ হওয়া ছাড়া আর কি করার আছে!’ খৃষ্টান অফিসারটি বললো, ‘কিন্ত কেন তারা ব্যর্থ হয়েছে শেষ মান্নান না জানলেও আমি জানি। তার এতগুলো আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার কারণ হচ্ছে, ফেদাইন গুঘাতকরা তাকে খুন করতে যেতে গাজায় দম দিয়ে। নেশার ঘোরে ওরা বুদ্ধি গুলিয়ে ফেলত। এসব নেশাখোররা কোনদিন তাকে হত্যা করতে পারবে না। তাকে হত্যা করতে পারবে সেই লোক, যে সুস্থ মস্তিকে চিন্তা করতে পারবে।’

কারিশমা আরেকটু আগ বাড়িয়ে বললো, ‘কেবল সুস্থ মস্তিষ্কের হলেই চলবে না, আইয়ুবীকে হত্যার কঠিন সংকল্প থাকতে হবে তার। তাকে মনে রাখতে হবে, আইয়ুবী কেবল তার ব্যক্তিগত শত্রু নয়, জাতিরও শত্রু! সে এক জঘন্য খুনী। তার খায়েশ মিটাতে গিয়ে অসংখ্য মুসলমান আত্মাহুতি দিয়েছে। এই আবেগ থাকলেই কেবল তাকে হত্যা করা সম্ভব।’

‘আপনি হয়ত মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে ততটা জ্ঞাত নন।’ বললো খৃষ্টান অফিসার, ‘সুলতান আইয়ুবীকে যারাই খুনের পরিকল্পনা নিয়ে যায়, তাদের উপর নেশার ঘোর চেপে থাকে। যখন তাদের সামনে কোন বাঁধা আসে তখনই তাদের নেশার ঘোর কেটে যায়। তখন আক্রমণকারী তার জান বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করে। এদের পরিবর্তে যদি আপনি হিংসার আবেগে ক্ষিপ্ত করে তাদের মনে ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে হত্যার জন্য পাঠান, তবে সে অবশ্যই হত্যা করতে সক্ষম হবে।’

‘শেখ মান্নান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে হত্যার জন্য চারজন কমাণ্ডো পাঠিয়ে দিয়েছে।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘তারা কতদূর কি করতে পারে আগে দেখি। যদি তারা ব্যর্থ হয় তবে আমি নিজেই তাকে খুন করার জন্য যাবো। শেখ মান্নান আমাকেও চারজন কমাণ্ডো দিয়েছে। তবে তারা ফেদাইন দলের কেউ নয়, আইবীরই চার জানবাজ কমাণ্ডো। এদেরকে আমার কাছে দিয়ে বলেছে, এদের তৈরী করে সাইফুদ্দিনকে আগে হত্যা করো। কারণ এই কমান্ডো চারজন সাইফুদ্দিনকে শত্রু জানে। ফলে তারা তাকে হত্যা করে আনন্দ বোধ করবে। আমি তাদেরকে এ সুযোগ করে দেবো। সাইফুদ্দিনকে মৃত্যুর জালে ফেলানো আমার দায়িত্ব। তার অযোগ্যতা এবং আমাদের অপদস্ত করার শান্তি হিসাবে এটাই তার পাওনা।’

‘তার চেয়ে এদেরকে সুলতান আইয়ুবীর নিধনে প্রকৃত করা হোক না কেন?’ খৃস্টান অফিসারটি বললো, “এদেরকে নেশায় আচ্ছন্ন না করে এদের মনে ঘৃণার আক্রোশ জাগিয়ে তুলতে পারলে এরা সহজেই আইয়ুবীকে হত্যা করতে পারবে।’

‘কিন্তু কিভাবে তাদের মনে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণা জন্মানো সব? এরা তো আইয়ুবীরই লোক! শুনেছি, তার কমাণ্ডোরা তাকে অসম্ভব ভক্তি শ্রদ্ধা করে! বললো গুমাস্তগীন।

এতক্ষণ পর এই প্রথম মুখ খুললো লিজা। বললো, ‘দুনিয়াতে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। যদি আপনারা চান এ দায়িত্ব আমরা নিতে পারি। ওদের কমাণ্ডারের নাম আন নাসের। আমি ওদের এই কমাণ্ডারকে তৈরী করার দায়িত্ব নেবো। বাকী তিনজনকে সামলাবে কারিশমা।’

গুমাস্তগীনের দিকে তাকিয়ে খৃস্টান অফিসার সামান্য হাসলো। এরপর কারিশমা ও লিজার দিকে ইঙ্গিত করে বললো, ‘এদের আপনি চেনেন না, এরা লোক তৈরীর ক্ষেত্রে ওস্তাদ কারিগর।’

খৃষ্টান অফিসার লিজার দিকে তাকিয়ে বললো, “বেশ, তুমি আন নাসেরকে তৈরী করো। আর অন্যান্যদের দায়িত্ব কারিশমার ওপরই ছেড়ে দাও। মানুষকে বশ করার যাদু সে ভালই জানে। তার সাথীদেরকে সে একাই সামলাতে পারবে।

কারিশমা মুচকি হাসলো শুধু, মুখে কিছু বললো না।

গুমাস্তগীন বললো, ‘কিন্তু কিভাবে তোমরা এটা করবে?’

‘সে ব্যবস্থা আমি করছি।’ বললো খৃষ্টান অফিসার। সে কারিশমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আন নাসের এখন কোথায়?’

‘ওরা ফেদাইন প্রহরীদের হেফাজতে আছে।’

‘তাকে এখানে নিয়ে এসো।’ অফিসার বললো, “আন নাসেরকে এখন থেকে পৃথক কামরায় রাখবে, আর তার সাথীদের রাখবে অন্য কামরায়।’ তারপর লিজাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আর তুমি খুব সাবধানে থাকবে। শেখ মান্নানের লালসার চোখ পড়েছে তোমার ওপর। সে সহজে তোমাকে ছাড়বে না। সে তোমার জন্য এতটা উতলা হয়ে পড়েছে যে, তোমার জন্য আমাকে পর্যন্ত চোখ রাঙানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে।’

গুমাস্তগীন অবাক হয়ে বললো, “কি বললে! একটা মেয়ের জন্য সে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে?’

অফিসার বললো, ‘তার কথা আর বলবেন না। আমাকে ধমক দিতেও বাঁধেনি তার। সে আমাকে এই বলে শাসিয়েছে, মেয়েটাকে আমার কাছে সঁপে দাও নইলে তুমি মেহমান থেকে কয়েদীতে পরিণত হবে। সে আমাকে খুন করার হুমকিও দিয়েছিল। আমি ধৈর্য না ধরলে এতক্ষণে খুনাখুনি কাণ্ড ঘটে যেতো। ‘আমি চিন্তা করে দেখবো’ বলে ওদের নিয়ে এসেছি।’

‘তাহলে এখন আর ওদের এখানে আনার দরকার নেই।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘আমি চার কমান্ডোকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাই। আপনিও এই দুই মেয়েকে নিয়ে একসাথে চলুন এখান থেকে বের হই। আমি এবং আপনি দু’জন এক সাথে থাকলে সে হয়তো বেশী বাড়াবাড়ি করার সাহস পাবে না।’

❀ ❀ ❀

গুমাস্তগীনের কামরা থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। আন নাসের ও তার তিন সঙ্গীকে ডেকে আনা হলো খৃষ্টানদের জন্য নির্ধারিত কেল্লার বিশেষ এলাকায়। এখানে ক্রুসেডারদের মেহমান রাখার জন্য বিশেষ কামরার ব্যবস্থা আছে।

আন নাসেরকে পৃথক কামরা দেয়া হলো। কিন্তু বেঁকে বসলো আন নাসের। সে বললো, ‘আমি আমার সাথীদের সাথে একত্রে থাকতে চাই। যদি আমরা বন্দী হয়ে থাকি তবে আমাদের কয়েদখানায় পাঠিয়ে দাও। আর যদি বন্দী না হই তাহলে আমাদের একত্রে থাকতে দাও।’

এ কথা শুনে খৃষ্টান অফিসার একটু অবাক হলো। সে চাচ্ছিল, কারিশমা ও লিজা আজ থেকেই তাদের মিশন শুরু করে দিক। কিন্তু এদের আলাদা করা না গেলে তো মিশন শুরু করা সব নয়! সে আন নাসেরকে বললো, ‘একি বলছো তুমি! তুমি এদের কমাণ্ডার! আমি তোমাদের পৃথক হওয়ার কথা বলছি না, যখন ইচ্ছা তুমি ওদের কাছে যেতে পারবে, ওরা তোমার কাছে আসতে পারবে। আমি তো শুধু তোমাকে তোমার মর্যাদা অনুযায়ী থাকতে বলছি। কমাণ্ডার ও সৈনিকদের মর্যাদা তো আর এক নয়, তাহলে তুমি আপত্তি করছো কেন?’

‘আমাদের কাছে কোন উঁচু-নিচু ভেদাভেদ নেই।’ আন নাসের বললো, ‘আমাদের সুলতানও তার সৈন্যদের সাথে থাকেন। আমি তাঁর তুলনায় কিছুই না, সামান্য এক কমাণ্ডার মাত্র। আমি তাদের থেকে আলাদা হলেই বরং অস্বস্তি বোধ করবো। নিজের মধ্যে কখন গর্ব ও অহংকার এসে যায় এই ভয়ে আমার ঘুম হবে না। এক অন্যায় ও পাপ বোধে জর্জরিত হবো শুধু।’

‘আমরা তোমাকে সম্মান করতে চাই, তোমার উপযুক্ত মূল্য দিতে চাই। এটাই আমাদের রীতি।’ খৃষ্টান অফিসার বললো, ‘তোমাদের ওখানে গিয়ে তুমি যা ইচ্ছা করো, তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু যতক্ষণ আমাদের এখানে আছো ততক্ষণ তোমার প্রতি আমাদের যে শ্রদ্ধাবোধ আছে তা বজায় রাখার জন্য আমাদের সহায়তা করবে, আমাদের রীতিকে শ্রদ্ধা করবে, এটুকু সৌজন্যও কি আমি তোমাদের কাছে আশা করতে পারি না।’

এ কথার কি জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিল না আন নাসের। ওরা তো ওদের রীতি অনুযায়ী তাকে সম্মান দেখাতে চাইতেই পারে! এ ব্যাপারে তাদের আহত করা কি তার উচিত হবে। আবার অবছিল, এটা তো কোন ষড়যন্ত্রের অংশ নয়? দ্বিধা কম্পিত কণ্ঠে আন নাসের বললো, ‘আমাদের কমাণ্ডো বাহিনীর কমাণ্ডার তার সৈন্যদের সাথে একত্রে থেকেই জীবন কাটায়। এক সাথেই তারা জীবিত থাকে আর মরতে হলেও একত্রেই তারা মৃত্যু বরণ করে। যেদিন আমরা কমান্ডো বাহিনীতে নাম লিখিয়েছি, সেদিন থেকেই মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেছি আমরা। আমরা বেঁচে আছি সেই আকাঙ্খিত মৃত্যুর প্রত্যাশায়।’ আন নাসের বললো, ‘মৃত্যু পথের যাত্রী হিসাবে আমরা কখনও একে অপর থেকে দূরে থাকতে চাই না।

তা ছাড়া, আমরা যদি আপনার এখানে মেহমান হিসাবে আসতাম, তবু না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু আমরা তো এখানে এসেছি কয়েদী হিসাবে। আপনি ভাল করেই জানেন, আমরা আপনাদের দুশমন। আর দুশমনকে কেউ কখনো মেহমানের মত আদর আপ্যায়ন করে না।’

আন্ নাসের ওদের আরো বললো, ‘আমরা জানি, আমরা আপনাদের বন্দী! আর বন্দীদের ভাগ্য তো শুধু একটাই হতে পারে, ক্রমাগত শাস্তি ভোগ করা এবং একের পর এক বিপদ মুসীবত ও কষ্ট সহ্য করে যাওয়া। আমরা এসব কষ্ট ও যন্ত্রণা মিলিতভাবেই বরণ করে নিতে চাই। আমরা একই মঞ্জিলের মুসাফির। বাঁচলে আমরা এক সাথেই বাঁচতে চাই, মরলেও একই সাথে জীবন কুরবানী করতে চাই।’

আন নাসেরের এ বক্তব্যের পর আর কথা চলে না। খৃষ্টান অফিসার হাল ছেড়ে দিল। শুমাস্তগীনকে জানানো হলো আন নাসেরের বক্তব্য। শুনে গুমাস্তগীন বললো, ‘চলো তো, ওদের দেখে আসি!’

সে রাতেই গুমাস্তগীন খৃষ্টান অফিসারের সাথে ওদের কাছে এলো। আন নাসেরের বক্তব্যের জবাবে বললো, ‘তবে কি তোমরা আমার কাছ থেকে পালানোর চেষ্টা করবে?’

আন নাসের হেসে বললো, ‘আমরা মুক্ত হতে তো অবশ্যই চেষ্টা করবো। এটাই তো আমাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। আমরা যোদ্ধা! বীরের মত মরতে পারলেও আমরা খুশী। আমাদেরকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে না দিলে বীরের মত মরতে দাও, আর যদি তা না করে বন্দী করে রাখতে চাও, তবে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখো। আমাদের সঙ্গে কোন প্রতারণা করবে না। প্রতারণা আমরা একদম পছন্দ করি না। আমি আবারও বলছি, আমরা রণাঙ্গণের সৈনিক। আমরা সাইফুদ্দিন ও গুমাস্তগীনের মত গাদ্দার ও ঈমান বিক্রেতা নই।’

‘খামোশ!’ রাগে গর্জন করে উঠল গুমাস্তগীন, “আমি হারানের স্বাধীন শাসক আমীর গুমাস্তগীন! তুমি আমাকে গাদ্দার ও ঈমান বিক্রেতা বললে!’

‘আমি আপনাকে আরও একবার গাদ্দার এবং ঈমান বিক্রেতা বলছি।’ আন নাসের বললো, ‘আপনি অবশ্যই বিশ্বাসঘাতক, মুসলিম জাতির কলঙ্ক এবং ইসলামের দুশমন।’

চতুর গুমাস্তগীন এরই মধ্যে সামলে নিয়েছে নিজেকে। রাগ সামলে সে বলে উঠল, ‘কিন্তু এখন আমি বেঈমানও নই, বিশ্বাসঘাতকও নই।’ গুমাস্তগীন আন নাসেরকে নরম সুরে বললো, “দেখো না, তুর্কমানে যুদ্ধ চলছে, আর আমি এখানে বসে আছি। যদি আমি তোমাদের শত্রুই হতাম তবে আমি অবশ্যই এখন ময়দানে থাকতাম। যদি তোমাদের দুশমন ভাবতাম, তবে তোমাদেরকে এমনভাবে মুক্ত রাখতাম না। আমি সাইফুদ্দিন ও আল মালেকুস সালেহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছি। ওদের সাথে এখন আমার কোন সম্পর্ক নেই। তুমি ঠিকই বলেছো, একদিন গুমাস্তগীন বিশ্বাসঘাতকই ছিল, কিন্তু সে গুমাস্তগীন মরে গেছে। এখন যে তোমাদের সাথে কথা বলছে, সে এক আলাদা গুমাস্তগীন। ভুল তো মানুষই করে! ভুলের কি কোন প্রায়শ্চিত্য নেই। আমি আমার ভুলের কাফফারা দিতে চাই। এ জন্যই তোমাদেরকে সম্মান ও শান্তিতে এই দুর্গ থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাই। আল্লাহ বান্দার জন্য তওবার দুয়ার খুলে রেখেছেন। তোমরা কি বলতে চাও আমার জন্য সে দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে। আমি তা বিশ্বাস করি না। আল্লাহ যে দুয়ার খুলে রেখেছেন, তা তোমরা বন্ধ করতে পারো না। আমার সাথে চলো। ফেদাইনদের খপ্পর থেকে আগে তোমাদের বের করে নেই, তারপর তোমাদের সম্মানের সাথে বিদায়ের ব্যবস্থা করবো। তুমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এক কমাণ্ডো! সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বুকে যে মহানুভবতা, দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা আছে, ততটুকু না হোক, সেই চেতনা ও আবেগেই তো তোমাদের হৃদয়ও পূর্ণ থাকার কথা!’

গুমাস্তগীন তার দীর্ঘ ও আবেগপূর্ণ বক্তব্য শেষ করলো। আন নাসের বললো, ‘কিন্তু কিছুতেই আমি আমার সঙ্গীদের থেকে পৃথক থাকবো না। আপনি যা বললেন, এই যদি হয় আপনার হৃদয়ের প্রতিধ্বনি; তবে আমাদের একত্রে থাকার এ সামান্য আবেদনটুকু আর অগ্রাহ্য করবেন না।’

‘না, তা করবো কেন?’ গুমাস্তগীন বললো, ‘যেভাবে থাকতে তুমি পছন্দ করবে, সেভাবেই থাকবে তুমি। তোমাকে আলাদা কামরায় থাকতে হবে না, তুমি তোমার সঙ্গীদের সাথেই থাকো।’

তার সাথীরা একটি আরামদায়ক খোলামেলা কামরায় তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কামরাটি ছিল সুন্দর ও সুসজ্জিত। সেখানে নরম খাটের ওপর নরম ও মোটা বিছানা পাতা ছিল। তাদের সেবায় নিয়োজিত ছিল একাধিক খাদেম। তারা চাকরকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই কামরা এত সুসজ্জিত কেন? এখানে কারা থাকে?’

চাকর বললো, “এটা কেল্লার খৃস্টানদের জন্য নির্ধারিত অংশ। সাধারণত এখানে খৃষ্টান ও তাদের মেহমানরা থাকে। কামরাটি সুসজ্জিত এ জন্য যে, এখানে শুধু সেইসব মেহমানরাই থাকে, যারা উচ্চ মর্যাদার ও সম্মানিত লোক।’

তিন কমাণ্ডো লক্ষ্য করে দেখলো, তাদের ব্যবহার কয়েদীদের সাথে ব্যবহারের মত নয়।

কমান্ডোরা খুবই ক্লান্ত ছিল। খাওয়ার পর এমন আরামপ্রিয় বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম এসে জড়িয়ে ধরলো তাদের। শুয়ে শুয়ে তারা ভাবছিল আন নাসেরের কথা। কিন্তু কখন যে ঘুম এসে ওদের কাবু করলো, টের পেলো না কেউ। গভীর দ্ৰিায় নিমগ্ন হয়ে পড়লো তিন কমাণ্ডো।

❀ ❀ ❀