মেয়েটি বলে যেতে লাগলো, ‘রক্ত! রক্ত! রক্ত! চারিদিকে রক্তের সাগর বয়ে যাবে। পথেই মারা যাবে পবিত্র ঘরের দুশমনরা। আমি দেখতে পাচ্ছি তারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
থামলো মেয়েটি। তাকালো সুলতানের চোখের দিকে। বললো, ‘আল্লাহর হুজুরে সিজদায় পড়ে যে চোখ অশ্রু ঝরায়, আল্লাহর ফেরেশতারা সে অশ্রু মুক্তার মত কুড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সে অশ্রুর মতি কখনও নষ্ট করেন না। যদি নিয়ত পরিষ্কার থাকে তবে পথও সুগম ও সরল থাকে।’
সুলতান অনেক ভাবে তাকে পরীক্ষা করলেন। কিন্তু মেয়েটিকে তার আসল সত্ত্বায় কোনভাবেই ফিরিয়ে আনা গেল না। সে এমন সব কথা বলতে লাগলো যেন তার চোখে ভবিষ্যতের দৃশ্যগুলো ফুটে রয়েছে।
মেয়েটি আসলে মরুভূমিতেই তার আসল সত্ত্বা হারিয়ে ফেলেছিল। তার অবচেতন মনে খেলা করছিল তার কল্পনার বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাই সে বলে যাচ্ছিল প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে।
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘একে সেই বুজুর্গ লোকের আশ্রয়েই রেখে দাও। তবে এর ওপর সারাক্ষণ নজর রাখার ব্যবস্থা করবে।’
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মসজিদুল আকসায় আল্লাহর দরবারে যে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন ফেরেশতারা সে অশ্রু বিন্দু সত্যি সত্যি মুক্তার মত কুড়িয়ে নিয়েছিল, সেই অশ্রু যে আল্লাহপাক কবুল করে নিয়েছিলেন অচিরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। একে একে তার কাছে এমন সব সংবাদ আসতে লাগলো, আল্লাাহর গায়েবী মদদের নমুনা দেখে তিনি নিজেই তাজ্জব হয়ে গেলেন।
প্রথমেই তার কাছে খবর এলো, জার্মানীর সম্রাট ফ্রেডারিক মৃত্যুবরণ করেছেন। তার কয়েকদিন পর তিনি সংবাদ পেলেন, খৃষ্টানদের আরেক সম্রাট কাউণ্ট হেনরীও মৃত্যুবরণ করেছেন। এই সম্রাট ক্রুসেড বাহিনীর ঐক্যফ্রণ্টের শক্তিশালী সংগঠক ছিলেন। তিনি শপথ নিয়েছিলেন, বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুসলিম আধিপত্য থেকে মুক্ত না করে তিনি কোন নারী স্পর্শ করবেন না।
সম্রাট কাউণ্ট হেনরীর মৃত্যুর ঘটনা ক্রুসেড বাহিনী গোপন রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু একটি ঘটনা তা প্রকাশ করে দেয়। ঘটনাটি ছিল এরকম: সুলতান আইয়ুবীর নৌবাহিনীর কমাণ্ডোরা সমুদ্রে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। একদিন তারা ক্রুসেড বাহিনীর দুটি সামুদ্রিক জাহাজ দেখতে পেলো।
হাজাহ দুটো ছিল ফিলিস্তিন উপকূলের সামান্য দূরে। কমাণ্ডোরা বেপরোয়া আক্রমণ চালিয়ে জাহাজ দুটি আটক করে ফেলল। তারা জাহাজে অভিযান চালিযে পঞ্চাশজন ক্রুসেড নৌসেনাকে বন্দী করল।
এই জাহাজে তল্লাশী চালাতে গিয়ে কমাণ্ডোরা জাহাজে একটি দামী কোট আবিষ্কার করল। কোটের সাথে লাগানো ছিল হীরা ও জহরতের নানা রকম ইগনিশিয়া। দেখলেই মনে হয় এটা কোন সম্রাট বা রাজার পোশাক।
কামাণ্ডার জানতে চাইলো, ‘এই কোট কার?’
কিন্তু কোন ক্রুসেড বন্দী এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হ’ল না।
এই জাহাজেই ছিল একজন সম্ভ্রান্ত বন্দী। তাকে ক্রুসেডদের এই বাহিনীর কমাণ্ডার মনে হচ্ছিল। কিন্তু লোকটি নিজেই তা অস্বীকার করে বললো, ‘আমাদের কমাণ্ডার সম্রাট কাউণ্ড হেনরী।’
‘আর তুমি?’
‘আমি সম্রাট কাউণ্ট হেনরীর ভাতিজা।’ লোকটি জবাব দিল।
‘তাহলে উনি কোথায়?’
‘উনি গতকাল মারা গেছেন।’ জবাব দিল সম্রাট কাউণ্ট হেনরীর ভাতিজা।
‘এই কোট কি তবে তার?’
সম্রাট কাউণ্ট হেনরীর ভাতিজা স্বীকার করল, ‘হ্যাঁ, এটা আমার চাচার কোট।’
ক্রুসেড বাহিনী না চাইলেও এভাবেই সম্রাট কাউণ্ট হেনরীর মৃত্যুর খবর পেয়ে গেল কমাণ্ডোরা। তারা সঙ্গে সঙ্গে এ সংবাদ সুলতানকে দেয়ার জন্য কাসেদ পাঠিয়ে দিল।
কিভাবে সম্রাট কাউণ্ট হেনরীর মৃত্যু হয়েছে তা তদন্ত করতে গিয়ে সুলতানের বাহিনী দুটি ভিন্ন মতামত জানতে পারে। তার ভাতিজার কাছ থেকে প্রথমে জানা যায়, তিনি সাগরে ডুবে মারা গেছেন।
পরে সৈন্যদের সাথে আলাপ করে গোয়েন্দারা যে তথ্য পান তা হচ্ছে, তিনি নদীতে গোসল করতে নেমেছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে তাড়াতাড়ি জাহাজে তুলে আনা হয়। কিন্তু জাহাজে তুলে আনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি মারা যান।
সুলতান আইয়ুবী যাকে নিয়ে বেশী উৎকণ্ঠিত ও চিন্তিত ছিলেন তিনি ইংল্যাণ্ডের সম্রাট রিচার্ড। রিচার্ড খুব যুদ্ধবাজ সম্রাট ছিলেন। তিনি কালো রাজকুমার (Black prince) নামে খ্যাত ছিলেন। তাকে সিংহপ্রাণ সম্রাটও বলা হতো। তিনি খুব দুঃসাহসী এবং রণকুশলীও ছিলেন।
প্রকৃতি তাকে দিয়েছিল বিশাল শরীর। তার বাহু ছিল দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ। সে জন্য যুদ্ধের ময়দানে তিনি পেতেন অতিরিক্ত সুবিধা। তার তলোয়ার যখন শত্রুর গর্দানে গিয়ে পৌঁছাতো শত্রুর তলোয়ার তখনও তাঁর নাগালই পেতো না।
খৃষ্টান জগতের সকলের দৃষ্টি ছিল তাঁর উপর। তার সামরিক শক্তি যেমন বিশাল ছিল তেমনি তার নৌশক্তি ছিল বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দী।
সুলতান আইয়ুবীর শুধু তাকে নিয়েই ভয় ছিল। সুলতান আইয়ুবীর মনে পড়ল তার জাদরেল এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলুর কথা। কিন্তু তিনি নৌবাহিনী প্রধান ছিলেন না। সুলতান আইয়ুবীর নৌবাহিনী প্রধান ছিলেন এ্যাডমিরাল আব্দুল মুহসিন।
সুলতান আইয়ুবী যখন শুনতে পেরেন, সম্রাট রিচার্ড তার শক্তিশালী বিশাল নৌবহর নিয়ে ধেয়ে আসছেন, তখন তিনি তাঁর নৌবাহিনী প্রধান মুহসিনকে খবর পাঠালেন, সে যেন সম্রাট রিচার্ডের সম্মুখীন না হয়। তিনি তাকে পরামর্শ দিলেন তার নৌবহর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে।
এরপর এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলুকে কতগুলো যুদ্ধ জাহাজ ও কিছু দ্রুতগামী নৌকা নিয়ে আসকালান ডেকে পাঠালেন। তাকে বললেন, ‘শত্রুর জাহাজ ছুটে আসছে। কিন্তু সাবধান, তুমি তাদের সাথে সামনাসামনি লড়াই করতে যেয়ো না। তুমি শত্রুর জাহাজের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। যখনই তাদের কাউকে একা পাবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। সঙ্গে সামুদ্রিক কমাণ্ডো বাহিনী রাখবে। প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাবে দক্ষতার সাথে কিন্তু ওদের ফাঁদে পা দেবে না। শত্রুর কোন জাহাজ একা পেলে তাকে যখন আক্রমণ করবে তখন কোন দয়ামায়া দেখাবে না। আপাততঃ ওদের বন্দী করার চেষ্টা না করে জাহাজ ধ্বংস করে দিতে চেষ্টা করবে।’
এটা সেই সময়ের কথা যখন সুলতান আইয়ুবী নিদারুণ সমস্যায় জর্জরিত থাকার কারণে রাতের অধিকাংশ সময়ই ঘুমাতে পারতেন না। তিনি তার উপদেষ্টাদের বললেন, ‘আমাদের একটি উপকূলীয় শহর কোরবানী দিতে হবে, আর সে শহরটি হবে আক্রা। আমি শত্রুদের এমনভাবে প্রভাবিত করতে চাই যে, আমাদের যা কিছু আছে সব আক্রাতেই আছে। যদি আক্রা দখল করে নেয়া যায় তবে মুসলমানদের মেরুদণ্ডই ভেঙ্গে যাবে। তখন বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া কোন সমস্যাই হবে না।’
সুলতান আইয়ুবী তার মজলিশে শুরাকে আরো বললেন, ‘আমরা যদি শত্রুদের আক্রাতে এনে জড়ো করতে সক্ষম হই তবে শত্রুরা আক্রার দেয়ালের সাথে মাথা কুটে মরবে, অন্যদিকে নজর দেয়ারই সময় পাবে না।’
উপদেষ্টা পরিষদ তার এ প্রস্তাব সানন্দে অনুমোদন করল। সুলতান বিশ্বাস করতেন, মসজিদুল আকসা ও ফিলিস্তিনকে কেবল মুসলমানদের অশ্রুই বাঁচাতে পারে। মুমীনের অন্তর নিঙড়ানো অশ্রু আল্লাহ কখনও বৃথা যেতে দেন না। তাবে সে অশ্রু হতে হবে নিখাঁদ ও নির্ভেজাল। আর মুমীনকে সে অশ্রুর দাবী পূরণ করতে হবে।
মসজিদুল আকসায় অশ্রু বিসর্জন দিয়ে আসার পর তার অন্তরে প্রশান্তি নেমে এসেছিল। তিনি মনে করেন, আল্লাহর করণীয় আল্লাহ করবেন। আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের বুদ্ধি-বিবেক, সামর্থ ও চেষ্টাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।
তা মনে পড়ে গেল সেই মেয়েটির কথা, যে মেয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, আমি দেখলাম, শত্রুর জাহাজগুলো তোমার অশ্রুজলের সাগরে ডুবে যাচ্ছে। বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রাচীরের কাছেও তোমার দুশমনরা কেউ আসতে পারবে না।’
সুলতান ভাবছিলেন, সত্যি কি এমনটি ঘটতে পারে না! আমার প্রার্থনায় তো কোন খাঁদ ছিল না। তাহলে আল্লাহ কেন আমাদের বিজয় দেবেন না?
আল্লাহর প্রতি এমন নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার পরও সুলতান আইয়ুবীর মত খোদাভীরু লোক সম্রাট রিচার্ডের সামুদ্রিক নৌবহরের আগমনের খবরে বিচলিত হয়ে পড়লেন।
তিনি ভেবে পেলেন না, এত বড় বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা তিনি কিভাবে করবেন? নিজের অক্ষমতা টের পেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে তিনি বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলেন। বললেন, ‘আয় আল্লাহ, আমার যতটুকু সাধ্য ছিল আমি করেছি। আরো যদি কিছু করার থাকে সে বুদ্ধি তুমি আমার মাথায় ঢুকিয়ে দাও।’
সম্রাট রিচার্ড ইংল্যাণ্ড থেকে যাত্রা করে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করার কয়েকদিন পরের ঘটনা। এক রাতে এক ভয়াবহ তুফান তার নৌবহরকে ঘিরে ফেলল। ঝড়ে তার সমস্ত জাহাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তার নৌবহরে ছোট বড় পাঁচশ বিশটি জাহাজ ছিল।
তার মধ্যে অনেক গুলো ছিল বড় বড় যুদ্ধজাহাজ। এসব জাহাজ সৈন্য, ঘোড়া, অস্ত্র, রসদপত্র ও অন্যান্য মালপত্রে বোঝাই ছিল।
ঝড় এত প্রচণ্ড ছিল যে, সম্রাট রিচার্ডের জীবনও বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই তুফানের মধ্যে পড়ে জাহাজগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। ঝড় শেষ হওয়ার পরও কয়েকদিন লেগে গেল সেগুলো একত্র করতে।
অনেক অন্বেষণের পর জাহাজগুলো একত্রিত করে দেখা গেল পঁচিশটি বড় জাহাজের কোন হদিস নেই। ধারণা করা হ’ল, সেগুলোর সবই সমুদ্রে ডুবে গেছে।
এর মধ্যে ছিল দু’টি বিশালাকায় নামকরা জাহাজ। তাতে এত বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম ছিল, যা হারিয়ে সম্রাট নিজেই দিশেহারা হয়ে গেলেন। কারণ এতে ছিল তার আগুনতি ধন সম্পদ, অর্থ কড়ি ও প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র। এই ঝড় তার সবকিছুই ভূমধ্যসাগরে তলিয়ে দিল। এতে যে কেবল মূলবান সম্পদ ছিল তাই নয়, সম্রাটের বাগদত্তা স্ত্রী এবং তার এক বোনও ছিল সেই জাহাজে। ফলে জাহাজ দুটো হারিয়ে সম্রাট রিচার্ড অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন তো হলেনই সেই সাথে স্বজনও হারালেন। আর এই ক্ষতি তাকে প্রচণ্ড রকম বিমর্ষ করে তুললো।
এই ব্যথাতুর মন নিয়েই সম্রাট রিচার্ড তার বহর নিয়ে সাইপ্রাস দ্বীপে এসে পৌঁছলেন এবং জাহাজগুলোকে এখানে নোঙর করার হুকুম দিলেন। এখানে এসে তিনি জানতে পারলেন, ঝড়ের কবলে পড়ে তার নৌবহরের যে জাহাজগুলো হারিয়ে গিয়েছিল তার তিন চারটি সাইপ্রাসের কূলে চলে আসতে পেরেছিল এবং সেগুলো এখনও এখানেই নোঙর করা আছে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, যে জাহাজে তার যুবতী বোন জিয়ান ও বাগদত্তা রানী বিরাঙ্গারিয়া ছিল সে জাহাজটিও রক্ষা পেয়েছে এবং তারাও বেঁচে আছে।
এদের দু’জনের ব্যাপারেই তিনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, তারা ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছে। তাদের বেঁচে থাকার খবরে তিনি পঁচিশটি বড় বড় জাহাজ হারানোর বেদনা ভুলে গেলেন। তার মুখে অনেক দিন পর আবার হাসি দেখা গেল। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না, তার জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক এক দুঃসংবাদ। যখন জানতে পারলেন তখন তার সেই হাসি আবার বিষাদে রূপ নিল এবং তিনি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন।
তিনি জানতে পারলেন, তার রাণী ও বোনকে বহনকারী জাহাজসহ চারটি জাহাজই নিরাপদে কূলে এসে ভিড়তে পেরেছিল। কিন্তু তখনই দেখা দিল নতুন সমস্যা।
সাইপ্রাসের সম্রাট আইজাক কূলে ভিড়া জাহাজের সমস্ত মালপত্র উঠিয়ে নিলেন এবং জাহাজের সকল যাত্রীকে ধরে নিয়ে বন্দী করলেন। এই বন্দীদের মধ্যে ছিলেন রিচার্ডের রাণী ও বোন।
আইয়ুবীকে শায়েস্তা করতে এসে পথে অন্য কারো পেছনে শক্তি ক্ষয় করতে প্রস্তুত ছিলেন না সম্রাট রিচার্ড। কিন্তু বাধ্য হয়ে রিচার্ডকে আইজাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হ’ল। যুদ্ধে আইজাক পরাজিত ও বন্দী হলেন। বন্দী আইজাককে এনে রাখা হ’ল এক তাঁবুতে।
গভীর রাত। আইজাক বন্দী হয়ে আছেন তার নিজের দেশে। তাঁবুতে শুয়েও তার ঘুম এলো না। তিনি অপমান ও মর্ম যাতনায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন। তখনই তার মনে হ’ল, আমি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি না কেন? এটা আমার নিজের দেশ। এর পথঘাট সবই আমার চেনা। দেশের মানুষ আমার প্রজা। একবার এই তাঁবু থেকে পালাতে পারলে রিচার্ডের সৈন্যদের সাধ্য হবে না আমাকে ধরার। আমাকে আশ্রয় দেবে এ দেশের প্রতিটি নাগরিক। তা হলে আর বসে আছি কেন? তাঁবুর পাহারাদার দু’জন ঘুম তাড়াবার জন্য তাঁবুর এক পাশে বসে গল্প করছিল। যেদিকে কোন পাহারা ছিল না সম্রাট আইজাক সেদিকের তাঁবুর নিচ দিয়ে গড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর খুব সন্তর্পণে একটু একটু করে সরে যেতে লাগলেন তাঁবুর কাছ থেকে। এক সময় রিচার্ডের সৈন্যদের দৃষ্টির বাইরে চলে এলেন তিনি, পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন এক দ্বীপে।
রাণী এবং রাজকুমারীকে বন্দী করায় এমনিতেই সম্রাট রিচার্ড আইজাকের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। আইজাকের পলায়ন তার আত্মসম্মানে ঘা দিল, তিনি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন।
তিনি তার বিশাল বাহিনীকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, আইজাককে পাকড়াও না করে এক পাও তিনি সামনে এগুবেন না আর।
রিচার্ডের বাহিনী আইজাকের খোঁজে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ছুটে গেল দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। দিন পেরিয়ে যেতে লাগলো। আইজাকের কোন সন্ধান পাচ্ছেন না সম্রাট রিচার্ড।
সপ্তাহ পার হয়ে গেল। পার হ’ল দশদিন। দুই সপ্তাহ অতিক্রম করার পরও তার কোন খোঁজ না পেয়ে সম্রাট রিচার্ড চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন, আমি কি ক্ষোভের বশে এখানে সময় নষ্ট করছি? তিনি সৈন্যদের বললেন, ‘তোমাদের আর পাঁচ দিন সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে আইজাককে আমার সামনে হাজির করতে না পারলে তোমাদের ভাগ্যে কি ঘটবে আমি বলতে পারি না।’
আজ সম্রাট রিচার্ডের বেঁধে দেয়া সময়ের শেষ দিন। সৈনিকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। ব্যর্ততার অপমান ও ক্ষোভে কালো হয়ে গেল সম্রাটের চেহারা। তিনি নিজের তাঁবুর মধ্যে গিয়ে সেই যে ঢুকলেন আর বের হলেন না।
রিচার্ডের সৈন্যরা সাগর তীরের প্রতিটি গ্রাম ও দ্বীপ তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। কিন্তু ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই পেলো না তারা। তবু হাল ছাড়লো না, একবার যেখানে খুঁজে গিয়েছিল সেখানেই আবার নতুন করে খুঁজতে লাগলো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। একদল সৈনিক এক দ্বীপে তাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসছিল, তাদের সামনে পড়ে গেল একদল জেলে। এই জেলেদের একজনের ওপর আটকে গেল এক সৈনিকের চোখ। লোকটি জেলেদের বেশে থাকলেও অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জেলেদের পোশাক পাল্টে এ লোককে ভদ্রলোকদের পোশাক পরিয়ে দিলে সে কোন অভিজাত বংশের সর্দার হতে পারবে।
জেলেদের দলটিকে আটকালো সৈন্যরা। জানতে চাইলো তারা এদিকে সম্রাট আইজাককে দেখেছে কি না? তারা অস্বীকার করল। কিন্তু সন্দেহ গেল না সেই সৈনিকের। সে ওই লোককে বন্দী করে নিয়ে এলো সম্রাট রিচার্ডের সামনে। পাহারাদাররা তাকে দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললো, ‘ইনিই তো সম্রাট আইজাক।’
সম্রাট রিচার্ড যখন ফিলিস্তিনের উপকূলে এসে পৌঁছলেন ততক্ষণে ক্রুসেডদের সম্মিলিত বাহিনী আক্রা শহর অবরোধ করে নিয়েছে। এই অবরোধকারী বাহিনীর প্রথমেই ছিলেন গে অব লুজিয়ানের সেনাদল, যাকে রাণী সাবিলা সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে আর কখনও যুদ্ধ করবে না এই শর্তে মুক্ত করে নিয়েছিলেন।
এরপর তাদের সাথে এসে যুক্ত হলেন ফ্রান্সের সম্রাট ফিলিপস অগাষ্টাস ও তার বাহিনী। এই দুই শক্তি মিলে আক্রার অবরোধকে দৃঢ়তর করে তুলল। এ সময় শহরের মধ্যে মুসলমান সৈন্যের সংখ্যা ছিল মাত্র দশ হাজার আর তাদের কাছে এক বছর চলার মত খাদ্যশস্য মজুত ছিল।
এই সর্বাত্মক অবরোধের সূচনা ঘটে ১১৮৯ সালের ১৩ আগষ্ট। আক্রা ছিল খুবই সমৃদ্ধ শহর। রাজা বাদশাহদের থাকার মত আলীশান মহলগুলো ছিল সাগর তীরে। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এ শহরকে আকর্ষণীয় পর্যটক কেন্দ্রে পরিণত করে নিয়েছিল। এ শহরের তিন দিকেই ছিল খোলা সমুদ্র, মাত্র একদিকে ছিল শহরের শক্ত প্রতিরক্ষা প্রাচীর।
বলতে গেলে সমুদ্রের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের সবটাই ঘেরাও করে নিয়েছিল খৃষ্টান বাহিনীর নৌবহর। স্থলবাহিনী খৃষ্টান সদস্যরা আস্তানা গেড়েছিল শহর রক্ষা প্রাচীরের বাইরে, নিরাপদ দূরত্বে। এভাবে জল ও স্থল পথের সমস্ত রাস্তা ক্রুসেড বাহিনী বন্ধ করে দিয়ে ভাবলো, এবার সিংহকে খাঁচায় আটকানো গেছে।
সুলতান আইয়ুবী তার তৎপরতার দ্বারা প্রমাণ করছিলেন, তিনি শহরেই আছেন, কিন্তু মূলত তিনি শহরে ছিলেন না। ক্রুসেড বাহিনী সুলতান আইয়ুবীকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলতে পেরেছে ভেবে খুবই আনন্দিত ছিল। শিকারী যেমন হিংস্র প্রাণীকে খাঁচায় আটকাতে পারলে নিরাপদ বোধ করে তেমনি নিশ্চিন্ততা নিয়ে তারা চারদিক থেকে শহর ঘেরাও করে বসে ছিল। আজই সুলতানকে হাতের মুঠোয় পেতে হবে এমন কোন তাড়াহুড়ো ছিল না তাদের মধ্যে। তারা ভাবছিল, কিছুদিন যাক খাদ্য ও রসদের ঘাটতি দেখা দিক মুসলিম শিবিরে। না খেতে পেরে শুকিযে মরুক। তারপর এক সময় তারা আত্মসমর্পন করবেই।
এ ধরনের ভাবনার কারণেই তারা শহর আক্রমণ করার কোন গরজ অনুভব করল না। বরং তারা মনে করল, শহরের দিকে চোখ রেখে অলসভাবে সময় পার করে দিতে পারলেই একদিন বিজয় এসে চুমু খাবে তাদের পায়ে।
সুলতান আইয়ুবী তখন শহরের বাইরে এক নিরাপদ ও গোপন জায়গায় বসে লক্ষ্য করছিলেন শত্রুদের গতিবিধি। তিনি তার কর্ম তৎপরতার দ্বারা শত্রু বাহিনীকে আক্রার দিকে টেনে আনতে পেরেছেন, এটাকে তার প্রথম বিজয় বলে গণ্য করলেন। এবার তিনি তার আসল খেলা শুরু করলেন।
ক্রুসেড বাহিনী যখন অবরোধকে গুছিয়ে নিয়ে সুস্থির হয়ে বসলো তখন তিনি তার কমাণ্ডো বাহিনীকে বললেন, ‘হ্যা, এবার তোমরা কাজে নামতে পারো।’
একদিন রাত। অবরোধকারী সৈন্যরা রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ মধ্য রাতে হৈ চৈ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল তাদের। ওরা তাকিয়ে দেখলো শহরের ফটক তেমনি বন্ধ আছে। সৈন্য নড়াচড়ার কোন লক্ষণ নেই শহরের ভেতর। স্থলভাগের অবরোধকারীদের পেছন দিকের কিছু তাঁবু জ্বলছে। ওইসব তাঁবুতে তাদের খাদ্যসামগ্রী ও সরঞ্জামাদি রাখা ছিল। আশে পাশে তারা কোন মুসলমান সৈন্যও দেখতে পেলো না।
তবে গে অব লজিয়ান ও সম্রাট অগাষ্টাসের বুঝতে বাকী রইলো না, সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডো বাহিনী তাদের পেছন থেকে আক্রমণ করেছিল। তাদের টার্গেট ছিল রসদভাণ্ডার, তাই তারা সৈন্যবাহিনীর ওপর আঘাত হানেনি।
পরদিন তারা পাহারা আরো জোরদার করল। বিশেষ করে পেছন দিকের সুরক্ষার দিকে মনযোগ দিল বেশী।
সেই রাতেই আবার হামলা হ’ল। তবে এবার হামলা আরো জোরালো। হামলা হ’ল এক পাশে এবং ঝড়ের বেগে এসে ঝড়ের বেগে হারিয়ে গেল কমাণ্ডো বাহিনী। তছনছ করে দিয়ে গেল অনেক তাঁবু।
পরের রাত। ক্রুসেড বাহিনীর পাহারাদাররা দুই ভাগ হয়ে এক ভাগ তাকিয়েছিল শহরের দিকে অন্য ভাগ তাদের পেছনটা দেখছিল। হঠাৎ মাঝরাতে ক্যাম্পের ডান পাশে তারা দেখতে পেলো মুহূর্তে কতগুলো মশার জ্বলে উঠেছে এবং বাঁধা দেয়ার আগেই তারা অতর্কিত ঢুকে পড়েছে ক্যাম্পের ভেতর। আজও তারা ঝড়ের বেগে একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
তবে যাওয়ার আগে অনেক কয়টা তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেল। সামনে যাকে পেলো হত্যা করে গেল। ক্যাম্পের আগুনে ছুটাছুটি করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মরলো কয়েকজন। আহত হ’ল বেশ কিছু সৈন্য।
ওরা বুঝলো, সুলতান আইয়ুবী ভেতরে থাকলেও তার কিছু কমাণ্ডো সৈন্য বাইরে রয়ে গেছে। হয়তো তারা শহরে প্রবেশ করতে চায়। শহরে ঢুকার রাস্তা বের করার জন্যই বার বার হামলা করছে।
সম্রাট অগাষ্টাস বললেন, ‘গে অব লুজিয়ান, ওদের শহরে ঢুকার মত একটা রাস্তা বের করে দাও, দেখে কমাণ্ডো আক্রমণ বন্ধ হয়ে গেছে।’
পরের রাতে তারা শহরের ফটক বরাবর অংশটা এমনভাবে হালকা করে দিল, যাতে সুলতানের দলছুট কমাণ্ডোরা শহরের ফটক পর্যন্ত অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে। কিন্তু তারা তখনও বুঝতে পারেনি, সুলতান আইয়ুবী শহরের ভেতরে নয়, বাইরে আছেন।
খৃষ্টানদের এ পরিকল্পনা সফল হ’ল না, কেউ ঢুকলো না শহরে। ঢুকার কথাও নয়। এভাবেই প্রতি রাতে, কখনও দু’একদিন বিরতি দিয়ে অবরোধকারী বাহিনীর ওপর মুসলমানদের আক্রমণ চলতেই থাকল। তখন ওরা বুঝলো, সুলতান আসলে শহরের ভেতরে নেই তিনি বাইরেই আছেন এবং এসব হামলা তিনিই পরিচালনা করছেন।
এ কয়দিনের হামলায় ক্রুসেড বাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়ে গেল। তারাও প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিল এবং প্রতিরোধ করতে শুরুও করল। এতো মুসলামনদেরও কয়েকজন কমাণ্ডো শহীদ হয়ে গেলেন।
সুলতান আইয়ুবীর সবচে বড় অসুবিধা ছিল, তাঁর সৈন্য সংখ্যা নিতান্তই কম। তারপরও আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনি মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তিনি মনে মনে আশা করলেন, অবরোধ দীর্ঘদিন ধরে চললে ক্রুসেডদের শক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাবে। তিনি কমাণ্ডো আাক্রমণের মাধ্যমে যতটা না তাদের ক্ষতি করছিলেন তারচে বড় টার্গেট ছিল তার, দুশমনের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া। তিনি একটু একটু করে তাদের শক্তি নিঃশেষ করতে চাচ্ছিলেন। এতে করে খৃষ্টান সৈন্যদের মনে ভীতিটা একটা রোগের মতই ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
সুলতান আইয়ুবী হিসাব করে দেখলেন, আঘাত হানার জন্য আর অপেক্ষা করলে ক্রুসেড বাহিনী নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের উদ্যোগ নিতে পারে।
১১৮৯ সালের ৪ অক্টোবর। দিন গিয়ে রাত এলো। সুলতান আইয়ুবী তার সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ক্রুসেড বাহিনীর উপর প্রবল আক্রমণ চালালেন। ক্রুসেড বাহিনীও সতর্ক এবং প্রস্তুত ছিল। শুরু হ’ল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এক রাতেই নিহত হ’ল ক্রুসেড বাহিনীর নয় হাজার সৈন্য।
কিন্তু তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ। মাত্র নয় হাজার সৈন্য শেষ হওয়ায় তাদের তেমন কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হ’ল না। আক্রা শহর তাদের দখলে আসবে এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হ’ল না তাদের মধ্যে। বরং তাড়াতাড়ি যুদ্ধ লেগে যাওয়ায় খুশীই হ’ল তারা। এভাবে লড়াই শুরু না হলে মোকাবেলা হতো কি করে? আর মোকাবেলা না হলে কি করে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে?
ক্রুসেড বাহিনী বীর বিক্রমে আইয়ুবীর জানবাজদের হামলা প্রতিহত করে চললো। কিন্তু সাহস করে তারা কেল্লা বা শহর আক্রমণ করতে গেল না। কারণ তারা যতবারই শহরের প্রাচীরের দিকে এগুতে চেষ্টা করেছে ততবারই মেনজানিকের অগ্নিগোলা ও তীরের বৃষ্টি তাদের ছেকে ধরেছে। বিজয় যেখানে নিশ্চিত সেখানে ধৈর্যহারা হয়ে অযথা নিজেদের আরো কিছু সৈন্য ক্ষয় করার কোন মানে হয় না। এই ব্যাপারে সম্রাট অগাষ্টাস ও গে অব লজিয়ান দু’জনই একমত।
রাত শেষে ভোর হ’ল। ক্রুসেড বাহিনী ময়দানে দিকে তাকিয়ে দেখলো তাদের হাজার হাজার সৈন্য পড়ে আছে ময়দানে কিন্তু আইয়ুবীর বাহিনীর কোন ছায়াও নেই আশেপাশে।
সম্রাট অগাষ্টাস বললেন, ‘না, এভাবে মার খাওয়ার কোন মানে হয় না। শহর আক্রমণ করতে হবে। শহরের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই লুকোচুরি খেলা থামাবে না আইয়ুবী।’
‘তাহলে আর দেরী করে লাভ কি? আসুন এখনই হামলা করে বসি। এতগুলো সৈন্য এক সাথে এগিয়ে গেলে শহরের পতন ঘটাতে আমাদের এক ঘণ্টার বেশী লাগবে না।’ বললেন গে অব লুজিয়ান।
ক্রুসেড বাহিনী তাদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে হামলা করল শহরের ওপর। কিন্তু তারপরও তাদের সৈন্যরা প্রাচীরে কাছে ভিড়তে পারলো না। কারণ মুসলমান সৈন্যরা তাদের উপর মুষলধারে তীর বর্ষণ করতে লাগলো।
এই তীরে জাল ভেদ করে জীবন নিয়ে শহরের পাঁচিলে কাছে পৌঁছা সম্ভব নয় কোন মানুষের পক্ষে। এই ছাড়া মুসলমান সৈন্যরা পেট্রোল ভর্তি হাড়ি নিক্ষেপ করল খৃষ্টানদের দিকে, যার লেলিহান শিখা টপকে প্রাচীরের কাছে পৌঁছা সম্ভব ছিলনা তাদের পক্ষে।
ফলে ছয় লাখ সৈন্যের যে বিশাল বাহিনী পঙ্গপালের মত ছুটছিল শহরের দিকে তারা আরো কয়েক হাজার সাথীকে ময়দানে ফেলে রেখে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হ’ল। সম্রাট অগাস্টাস ও গে অব লুজিয়ান উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকার্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন।
সম্রাট অগাষ্টাস বললেন, ‘আইয়ুবীকে আর ছাড় দেয়ার কোন উপায় নেই। সে আমাদের বহু সৈন্যকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিয়েছে। সুযোগ দিলে সে এভাবে একটু একটু করে আমাদের খেয়ে ফেলবে। অতএব শহরে আমাদের ঢুকতেই হবে। কিভাবে শহরে প্রবেশ করা যায় সে বুদ্ধি বের করো।’
অনেক গবেষণার পর এক অফিসার একটি বুদ্ধি আবিষ্কার করল। সে তার চিন্তা পেশ করল বৈঠকে। সবাই একমত হ’ল তার প্রস্তাবে। শুরু হ’ল সে প্রস্তাব বাস্তবায়নের মহা তোড়জোড়।
ক্রুসেড বাহিনী প্রাচীর টপকানোর যে নতুন উপায় উদ্ভাবন করেছে তা সফল করার জন্য তারা কয়েক দিনের পরিশ্রমে একটি বড় গম্বুজওয়ালা কাঠের ঘর তৈরী করল। এই ঘরের নিছে অনেকগুলো কাঠের চাকা লাগানো হ’ল। সে ঘরটি এত বড়ছিল যে তাকে কয়েকশ সৈন্য এক সাথে থাকতে পারে। ঘরের গম্বুজটি অনেক উঁচু। ওখান থেকে সহজেই প্রাচীরের ওপর লাফিয়ে নামা যাবে। একদিন ভোরে একদল খৃষ্টান সৈন্য ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। তারা ঘরে ঢুকতেই অন্য আরেকদল সৈনিক ঘরটি শহরের পাঁচিলের দিকে ঠেলতে শুরু করল। শহরের প্রতিরক্ষা বাহিনী অবাক হয়ে দেখলো এই অদ্ভুত কাণ্ড। তারা ঘরের দিকে তাক করে তীর ছুঁড়তে শুরু করল।
তীর সব কাঠে বিদ্ধ হচ্ছিল, সে জন্য সৈনিকদের তাতে কোন ক্ষতি হ’ল না। তখন সেই ঘর তাক করে মুসলমানরা মেঞ্জানিক কামান দাগতে শুরু করল। ঘরটি প্রাচীরের আরো কাছে চলে এলো। এ সময় এক মুসলিম সেনা কমাণ্ডার বললো, ‘না, এভাবে হবে না।’ এই কমাণ্ডার ঘরের দিকে পেট্রোল হাড়ি নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিল।
সে দেয়ালের কাছাকাছি চলে আসা ঘরটির দিকে তাক করে মেনজানিক দিয়ে পেট্রোল হাড়ি ছুঁড়ে মারলো। হাড়িটি ঘরের গায়ে লেগে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। পেট্রোল ছড়িয়ে পড়ল ঘরের কাঠের দেয়ালে। ঘরের ভেতর থেকে কয়েকশো সৈন্য তীর ছুঁড়তে লাগলো পাঁচিলের দিকে। সেই তীরের জবাবে তীর ছুঁড়ছিল মুজাহিদরাও। সেই কমাণ্ডার এক মুজাহিদকে বললো, ‘অগ্নিতীর ছুঁড়ে মারো।’
এক মুজাহিদ দ্রুত ঘরের দিকে অগ্নিতীর ছুঁড়ে মারলো। জ্বলন্ত তীরটি কাঠের ঘরের দেয়াল স্পর্শ করতেই সেখানে দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। মুহূর্তে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। একে তো কাঠের ঘর তার ওপর সেই কাঠ পেট্রোল ভেজা। ফলে দেখতে দেখতে ঘরটি হারিয়ে গেল বিশাল অগ্নিকুণ্ডের ভেতর। কয়েক মিনিটের মধ্যে সমস্ত সৈন্যসহ ঘরটি পুড়ে ছাই হয়ে গেল।