» » মহাসমর

বর্ণাকার
🕮

আমি তার আরো কাছে সরে বসলাম। ক্রন্দনের সাথে সে যে প্রার্থনা করছিল আমি সে কথাও শুনতে পেলাম। সে তার গোনাখাতার জন্য মাফ চাচ্ছিল আর ক্রুসেড বাহিনীর পরাজয় ও ধ্বংসের প্রার্থনা জানাচ্ছিল।

সে তার এবাদতে এতই নিমগ্ন ছিল যে, তার অতি কাচে একজন বসে আছে সে চেতনাও তার ছিল না। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না, তাকে নিয়ে কি করবো।

এমন দ্বিধাদ্বন্ধের মাঝেই রাত কেটে গেল। সকালে ফজরের আজান হ’ল। নামাজের পর সুলতান বেরিয়ে যেতেই সেও বেরিয়ে পড়ল। তখন তার প্রতি আমার সন্দেহ আরো বেড়ে গেল।

আমি সব সময় তার উপর দৃষ্টি রাখছিলাম। লোকটি মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসার সময় কম্বলের নিচে তার পা দেখা যাচ্ছিল। মূহুর্তের জন্য তার হাতও দেখতে পেলাম আমি। সে তাড়াতাড়ি তা কম্বলে ঢেকে নিলে আমি টের পেলাম এ লোক পুরুষ নয়, মেয়ে মানুষ। তখন তার প্রতি আমার সন্দেহ আরো দৃঢ় হ’ল। আমি তার পিছু নিলাম।

‘হ্যাঁ! বন্ধু তুমি ঠিকই দেখেছো।’ আল আস বললো, ‘ও পুরুষ নয়, একজন নারী এবং খুবই সুন্দরী ও যুবতী। এই মেয়ে একজন বদকার ও পাপীষ্ঠ মেয়ে ছিল। সে দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করে আসছিল।’

‘সে খৃষ্টান মেয়ে?’

‘হ্যাঁ, খৃষ্টান ছিল।’ আল আস উত্তরে বললো, ‘এখন সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমি তাকে একজন মুসলমানের বাড়ীতে আশ্রয়ে রেখেছি। তাকে তুমি মহিলা দরবেশ বলতে পারো। সে দরবেশদের মত কথা বলে আর এবাদত বন্দেগী করে। সে তার পাপের জন্য অনুতপ্ত এবং প্রতি রাতেই সে জন্য মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে।’

‘আর তোমরা তার কথা বিশ্বাস করে তাকে আশ্রয় দিয়েছো?’ এহতেশাম বললো, ‘তোমরা রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করার সৈনিক। তোমরা এমন নারীর ছলনা কি করে বুঝবে?’

‘তাহলে তুমি আমার সাথে চলো।’ আল আস বললো, ‘তুমি নিজেই তাকে দেখো আর তার কথা শুনে মনের সন্দেহ দূর করো। আর যদি তোমার মনে হয় সে এখনও খারাপ মেয়ে রয়ে গেছে তবে সে কথা আমাকে বলো। এটা তোমার অভিজ্ঞতার বিষয়, তুমিই ভাল বুঝবে। আমি স্বীকার করছি, আমি তাকে বিশ্বাস করে আশ্রয় দিয়েছি। চলো, তুমি আমার সাথে।’

এহতেশাম আল আসের সাথে চলে গেল। তারা গিয়ে উঠল এক বুজুর্গ লোকের বাড়ীতে। এই বুজুর্গ লোকটি দীর্ঘদিন ধরেই বায়তুল মোকাদ্দাসে বাস করে আসছেন। আল আস ও এহতেশাম তার ঘরে গিয়ে বসলো।

এই লোক একজন জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নামাজ পড়াতে মসজিদে চলে গিয়েছিলেন, এখনও ফিরেননি।

এহতেশাম আল আসকে বললো, ‘মেয়েটিকে দেখার আগে আমি তোমার কাছে জানতে চাই, এ মেয়েকে তুমি কোথায় পেয়েছো? এ সম্পর্কে তুমি যা জানো সব আমাকে খুলে বলো।’

‘ঘটনাটি গত বছর গ্রীষ্মকালের।’ আল আস এহতেশামকে বললো, ‘আমি মিশর থেকে কিছু দূরে বর্ডারে কমাণ্ডোদের দলে ছিলাম। তখন বায়তুল মোকাদ্দাস জয় হয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনটা তো টিলা, জঙ্গল, পাহাড় ও মরুভূমিতেই কেটে গেছে। ওই অঞ্চলে আমাদের সে কাজের দায়িত্ব ছিল, যে কাজ এখনও কমাণ্ডোরা করে যাচ্ছে।

অবশেষে আমার ফিরে যাওয়ার আদেশ হ’ল। আমাকে একটি দলের কমাণ্ডারের দায়িত্ব দেয়া হ’ল এবং সবাইকে নিয়ে ফিরে যেতে বলা হ’ল। আমার সঙ্গে ছিল ষোল জন কমাণ্ডো সৈন্য। আমরা রওনা হলাম এবং প্রত্যেকেই যার যার মত গল্প করতে করতে পথ চলছিলাম।

আমারা একটি পাহাড় অতিক্রম করছিলাম। পাহাড়ের এক স্থানে একটি টিলা স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে ছিল। আশপাশের অন্যান্য টিলাগুলোও ছিলো ভয়ংকর ধরনের। মনে হচ্ছিল আমরা এক অদ্ভুত এলাকায় প্রবেশ করেছি।

আমার এক কমাণ্ডো তামাশা করে বললো, ‘মনে হচ্ছে আমরা জ্বীন ভূতের রাজ্যে এসে পড়েছি। এমন জায়গায় হয়তো সুন্দরী পতিতাদের প্রেতাত্মারা বাস করে।’ আমি তার কথা শুনে একটু হাসলাম এবং টিলার সেই গোলক ধাঁধা পার হতে গেলাম। টিলাটি দেখে আমার তেমন ভয় লাগেনি। কারণ আমি জীবনে এর চেয়েও ভয়ংকর জায়গায় রাত কাটিয়েছি। আমার এমন জায়গায় রাত কাটিয়েছি যেখানে মানুষের কংকাল ও হাড়হাড্ডি চারদিকে ছড়ানো ছিল।

কিন্তু আমারা যখন টিলার গোলক ধাঁধাঁর মধ্যে প্রবেশ করলাম তখন রীতিমত আতংকিত হয়ে উঠলাম। আমি জীবনে প্রথমবারের মত অনুভব করলাম ভয় কি জিনিস। আমার সমস্ত সৈন্যরা কালেমা পড়তে লাগলো।

আমরা দেখলাম, সামনে এক টিলার ছায়ায় এক নারী বসে আছে। তার সামনে আরেক নারী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তারা উভয়েই সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। তাদের গায়ের রং রৌদ্র তাপে ও ধূলোবালিতে ধুসর বা বাদামী রং ধারণ করেছিল।

দুটি মেয়েই যুবতী। তাদের ঠোঁট ধূলোবালিতে ও পিপাসায় শুকিয়ে ফেটে গিয়েছিল। তাদের মুখ খোলা ও মাথার চুল ছড়িয়ে আছে। এমন ভয়ংকর অবস্থায়ও মনে  হ’ল, মেয়ে দুটি অপূর্ব সুন্দরী।

এমটা হতেই পারে না যে, এরা মানুষ। এটা কোন রাস্তাও নয় যে, কোন কাফেলা এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় ডাকাতের দল তাদের লুট করে এনেছে। নিশ্চয়ই এরা নিজেরাই পালিয়ে এসে এখানে লুকিয়ে আছে। কিন্তু কোন মানুষ এমন কর্ম করবে না। তাহলে এরা কারা? ভূত? নাকি জ্বিন?

ভয়ে আমার সর্ব অঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি ভীত সৈন্যদের সাহস দিতে গিয়ে নিজেই এমন শংকিত হয়ে পড়লাম যে, আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হ’ল না। আমাদের সবার পা তখন এক জায়গায় অনড় হয়ে আছে। কেউ আমার পা নাড়াতে সাহস পাচ্ছিলাম না।

তাদের দেখামাত্র যে কথাটা আমার প্রথম মনে হ’ল তা হচ্ছে, এরা মানুষ নয়, কোন পাপী ও পতিতা নারীদের প্রেতাত্মা। আমরা মনে মনে আশা করছিলাম, ওরা এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যাক, যাতে আমাদের চলার রাস্তা ফাঁকা হয় এবং আমরা আবার চলা শুরু করতে পারি।

কিন্তু তারা যে অবস্থায় ছিল ঠিক সেই অবস্থাতেই রয়ে গেল। বসা মেয়েটা আমাদের দিকে বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে রইল। আমার এক সাথী ফিসফিস করে বললো, ‘চলো পিছনে ফিরে যাই’। অন্য একজন সায় দিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, তাই চলো, কিন্তু ওদের পিছন করো না। তাহলে ছুটে এসে আমাদের ঘাড় মটকে দিতে পারে।

ওদের থেকে আমরা মাত্র পরেরো বিশ গজ দূরে ছিলাম। আমরা এক পা দু পা করে ধীরে ধীরে পিছনে সরতে শুরু করেছি মাত্র, তখন বসা মেয়েটি মাথা দিয়ে ইশারা করে আমাদের  কাছে ডাকলো। আমরা আর এক পা পিছনে রেখেছি, মেয়েটি আবারও ইশারা করল। দেখলাম তার চোখে অশ্রু। এ সময় আমি এক অবিশ্বাস্য শব্দ শুনে ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেলাম। মেয়েটি স্পষ্ট উচ্চারণে বললো, ‘পালিয়ে যেও না আল আস। আমাদের দেখো। আমরাও মানুষ।’

সহসাই আমার হাত আমার কোমরে চলে গেল। নিজের ইচ্ছায় নয়, যেন অলৌকিক শক্তি বলে কোষ থেকে আমি তলোয়ার বের করে ফেললাম।

তারপর আমার ভেতর এ শক্তি কোত্থেকে এলো আমি নিজেই জানি না, দেখলাম আমার পদক্ষেপ সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমার সৈন্যরা চিৎকার করে বললো, ‘সামনে যেও না আল আস। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।’

কিন্তু তখন আমার মধ্যে কোত্থেকে যেন সাহস ও শক্তি দুই-ই ফিরে এসেছে। আমি তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করে চলেছি। আমি মেয়েটির কাছ থেকে তিন চার গজ দূরে দাঁড়িয়ে গেলাম।

সে ধীর ধীরে উঠে দাঁড়ালো। ও খুব দুর্বলভাবে আমার দিকে আসতে লাগলো। আমি দেখলাম মেয়েটির পা টলছে। সে টলতে টলতে আরেক পা সামনে বাড়ালো। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল আর সে এমনভাবে আমার সামনে পড়ে গেল যে, তার মাথা আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। তার মাথার চুলগুলো আমার পা ঢেকে দিল।

আমি বিবস্ত্র এক নারীর গায়ে হাত দিতে ইতস্তত করছিলাম। সে যদি বিবস্ত্র নাও হতো তবুও আমি ভয় পেতাম। কিন্তু আমাকে তো দেখতে হবে, এ সত্যি মানুষ, নাকি প্রেতাত্মা। আমি ওখানে হাটু গেড়ে বসে পড়লাম। হাত দিয়ে তার হাতের নাড়ীর স্পন্দন পরীক্ষা করলাম। মানুষের নাড়ীর মতই তারও নাড়ীর স্পন্দন চলছে, তবে খুবই দুর্বলভাবে।

আমার ধারণা ছিল, প্রেতাত্মা ও জ্বীনদের স্পন্দন থাকে না। আমি জলদি অন্য মেয়ের কাছে গেলাম। তার শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা। যদিও তখন মাথার ওপর কড়া সূর্য জ্বলছিল, আর সেই উত্তাপে আমরা ঘামছিলাম।

দেখলাম সেই মেয়ের নাড়ীতে কোন স্পন্দন নেই। অর্থাৎ তার দেহে প্রাণ নেই। তার মুখ খোলা ও চোখ এক দিকে স্থির হয়ে আছে। তার শরীরে মৃত্যুর সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট।

আর যে আমার সামনে পড়েছিল তার শরীর ছিল গরম। এরা জ্বীন ও প্রেতাত্মা নয়। আল্লাহ আমাকে বোধশক্তি ও সাহস দিলেন। আমি আমার সঙ্গীদের ডাকলাম। আমাদের সাথে পানির মশক ও খাবার ছিল। আমি বললাম, ‘জলদি পানি ও দুটি চাদর আনো।’

সাথীরা চাদর ও পানি আনল। তখনও সূর্য মাথার উপর আসেনি। টিলার ছায়াঘেরা জায়গায় ওদের সরিয়ে আনলাম আমরা। একটি চাদর নিচে বিছিয়ে দিয়ে সেখানে শুইয়ে দিলাম ওদের। অন্য চাদর দিয়ে উভয় নারীর বিবস্ত্র শরীর ঢেকে দিলাম।

বেচে থাকা মেয়েটির খোলা মুখে অল্প অল্প পানির ফোটা দিতে থাকলাম। পানি শীঘ্রই তার গলার মধ্য দিয়ে দেহে প্রবেশ করল।

আমার সঙ্গীরা আমাকে বাঁধা দিতে লাগলো। বললো, ‘আপনি নিজেকে বিপদে ফেলবেন না। এরা মানুষ নয় চলুন পালিয়ে যাই কিন্তু তখন আমার মনে কোন বিপদের আশংকা ছিল না। আমি সাথীদের বাধা উপেক্ষা করে মেয়েটির শুশ্রূষা করতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটির চোখ ধীরে ধীরে খুলে গেল। সে তার হা করা মুখটা বন্ধ করে নিল। ইশারায় সে আবার পানি চাইল। আমি তার মুখে আরও পানি ঢেলে দিলাম। পরে একটি খেজুরের প্যাকেট খুলে তার হাতে খেজুর দিলাম। সে উঠে বসতে চেষ্টা করল। আমি তাকে ধরে বসিয়ে দিলে সে বসে খেজুর খেতে লাগলো।

আল আস এহতেশামকে ঘটনা শুনাচ্ছিল। ‘খেজুর খেয়ে সে  আবারও পানি পান করল। সে ছিল খুবই ক্ষুধার্ত। খেজুরের পোটলাটার দিকে সে করুণ চোখে তাকালো।

আমি তাকে আমাদের যে খাবার ছিল তা খেতে দিলাম। সে গোগ্রাসে খেতে শুরু করলে আমি তাকে বাঁধা দিয়ে বললাম, ‘আস্তে ধীরে খাও। একবারে বেশী খাওয়া ঠিক নয়, কম করে খাও।’

তার পেট কত দিন ধরে খালি আল্লাহ মালুম। সে খেতেই থাকল। আমি তার সামনে থেকে খাবার সরিয়ে নিলাম। সে দুর্বল কণ্ঠে বললো, ‘আমি তোমার ভাষা বুঝতে পারছি। তুমি শুধু আমাকেই খাওয়াচ্ছো, ওকে দিচ্ছো না কেন? ও কি মরে গেছে?

আমি বললাম, ‘ওর আর কোনদিন খাওয়ার দরকার পড়বে না।’

সে আবার আমকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কে?’

আমি বললাম, ‘আমি সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডো সেনা।’

তার মধ্যে কেমন একটা ভীতি ভাব লক্ষ্য করলাম।। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছো?’

‘আমরা সাবাই বায়তুল মোকাদ্দাস যাচ্ছি।’

মেয়েটির চোখের আলো যেন দপ করে নিভে গেল। দুর্বল কণ্ঠে সে বললো, ‘তবে তো আমার বাঁচার কোন আশাই রইলো না।’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি তুমি মুসলমান নও।’

‘কিন্তু…’

সে আমার কথা শেষ হতে দিল না। বললো, ‘আমি  মিথ্যা বলবো না। এখন আর সত্য-মিথ্যায় আমার কিছু আসে যায় না। তাই আমি যা বলবো, সত্য কথাই বলবো। আমার কথা শুনে ইচ্ছা করলে তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারো, তাতেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি তো মরেই গেছিলাম।’

আমি তাকে বাঁধা দিয়ে বললাম, ‘তুমি আমাদের শুধু বিশ্বাস করাও, তুমি জ্বীন পরী কিছু নও, তুমি মানুষ।’

তার মুখে তখন এক টুকরো ফিকে হাসি ফুটে উঠল। ধীরে ধীরে তার চেহারার রংও পরিবর্তন হচ্ছিল। কারণ পেটে কিছু দানাপানি পড়ায় তার শরীরে রক্ত চলাচল শুরু হয়েছিল। কিন্তু ক্লান্তিতে তার চোখে ঘুম চেপে আসলো।

ঘুমে সে এতোটাই কাতর হয়ে গেল যে, সে কিছু বলতে গিয়েও আর বলতে পারলো না। সে শিশুর মত ঘুমে ঢলে পড়ল ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

জীবনে আমাদের বহু মানুষ খুন ও হত্যা করতে হয়েছে। কমাণ্ডো আক্রমণ করতে গিয়ে আমরা চোখের সামনে আমাদের অনেক সাথীকে শহীদ হতে দেখেছি। মানুষের মৃত্যু আমাদের কাছে নতুন বিষয় ছিল না। কিন্তু আমরা কখনও অন্যায়ভাবে কাউকে মারিনি বা মারতে যাইনি।

ও একটি মেয়ে। এই মেয়ে যদি আমাদের শত্রুও হয় তবু তার উপর হাত উঠানো অন্যায়। একটি অসহায় মেয়েকে নির্যাতন করার শিক্ষা আমরা পাইনি, বরং এ ধরনের কাজকে আমরা আমাদের জন্য কবিরা গুনাহ মনে করি!

আমি আমার সঙ্গীদের বললাম, ‘সূর্য মাথার উপর উঠে আসছে। টিলার দিকে তাকাও। একটু পরই এখানকার ছায়া সরে যাবে। সামান্য বিশ্রাম করে নাও। এ যখন জাগবে তখন আমরা তাকে সাথে নিয়ে রওনা দেবো।’

আমার এক সাথী বললো, ‘হয়তো এরা খৃষ্টান গোয়েন্দা। আমাদের আসার খবর পেয়ে এখানে ফাঁদ পেতেছে।’

অন্য এক সাথী বললো, ‘এমন ভয়ংকর জায়গায় মেয়ে গোয়েন্দাদের কি কাজ থাকতে পারে? নিশ্চয়ই এরা মানুষ না। এরা ডাইনী বা প্রেতাত্মা। আমাদের উচিত ওর এই ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিয়ে এখন থেকে দ্রুত সরে পড়া।’

‘আমার ধারণা, আমাদের কমাণ্ডোরা মিশর ও ফিলিস্তিনের সীমান্তে যে তৎপরতা চালাচ্ছে , তাতে শঙ্কিত হয়ে খৃষ্টানরা ষড়যন্ত্রের জাল পাতছে। এই মেয়ে দুটি তার অংশ। আমাদের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার জন্য তাদের এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে ক্রুসেড গোয়েন্দারা।’ বললো আরেকজন।

কিন্তু এসব কথা আমার বিশ্বাস হ’ল না, তা হ’ল তাদের সাথে দু’চার জন পুরুষ থাকতো।

সূর্য অস্ত যাওয়ার একটু আগে সে জেগে উঠল। আমি তার কাছে বসলাম। সে পানি চাইলো। আমি তার হাতে পানি তুলে দিলাম। সে পানি পান করে কিছু খাবার চাইলো। আমি আমাদের খাবার থেকে তাকে কিছু খাবারও দিলাম। খাওয়ার পর সে সুস্থির  হয়ে কথা বলতে লাগলো।

তার কণ্ঠ তখনও দুর্বল থাকলেও চিন্তা শক্তি সতেজ হয়ে উঠল। সে পাশের মেয়েটির দিকে ইশারা করে বললো, ‘একে দাফন করে দাও’।

আমার সিপাইরা দ্বীনদার মানুষ ছিল। একজন তার চাদর দান করল। সঙ্গীরা কবর খোদাই করল এবং লাশটিকে সেই চাদরে ঢেকে দাফন করে দিল।

আল আস  এহতেশাককে বললো, ‘মেয়েটিকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কোত্থেকে এসেছো? কোথায় যাবে? তোমাদের এই অবস্থা কেন?’

মেয়েটি চুপ করে রইলো, কোন জবাবা দিল না। সে বরং উল্টো আমাকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি তোমার খোদাকে দেখেছো?’

‘হ্যাঁ, দেখেছি। আমি আমার খোদাকে দেখেছি তার সৃষ্টির মধ্যে, তার অফুরন্ত রহমতের ধারায়।’

সে বললো, ‘আমিও তোমার খোদাকে দেখেছি। আমি এই মাত্র তাকে দেখলাম, তার কথা শুনলাম। হয়তো তুমি বলবে এটা আমার স্বপ্ন। কিন্তু না, এটা স্বপ্ন নয়, এটাই বাস্তব। খোদা আমাকে বলেছেন, ‘আমি তোমাকে এমন চোখ দিয়েছি, যে চোখ দিয়ে তুমি অন্ধকারেও সব দেখতে পাবে। এমনকি আগামী সময়টাও দেখতে পাবে।’

খোদা আমাকে আরো বলেছেন, ‘তুই যদি আবার তোর পাপের কথা স্বরণ করিস বা চিন্তা করিস তবে তোর খঞ্জর তোর চোখ অন্ধ করে দেবে।’ খোদা আমাকে একথাও বলেছেন, ‘আমি তোকে এমন স্থানে পাঠিয়ে দেবো যেখানে থেকে আমি আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে নিয়েছিলাম।’

সে এমন ধরনের অনেক কথাই বললো। তার কথায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, মরুভূমির কঠিন যাত্রা এবং প্রচণ্ড বিপদ তার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। এখন সে নিরেট এক উন্মাদিনী।

সে আমকে বললো, ‘তুমি আমার শরীর কেন ঢেকে দিলে? যেভাবে ছিল সেভাবে থাকলে কি ক্ষতি হতো? আমার তো এখন শরীরের কোন অনুভূতি নেই। আমি এখন শুধু আত্মাসর্বস্ব প্রাণী! আত্মা যদি পবিত্র হয়ে যায় তবে দেহে ময়লা লাগবে কেমন করে?

সে সব সময় এমন কথাই বলে। তাতে আমার বিশ্বাস হয়ে গেছে, সে মানুষ, ভুত প্রেত কিছু নয়। সে আমাকে জানানোর আগেই আমার জানা হয়ে গেছে, সে খৃষ্টান মেয়ে। ওরা আমাদের আমীর, মন্ত্রীবর্গ ও সেনাপতিদের গাদ্দার বানানোর কাজে নিয়োজিত ছিল। ওরা গোপন তথ্য গ্রহণ করে খৃষ্টানদের কাছে সরবরাহ করতো। ওদের রূপের মোহ ও প্রেমের ছলাকলায় পড়ে গাদ্দারেরা দেশ বিক্রি করতেও কুণ্ঠাবোধ করতো না।

তার কথা যত আধ্যাত্মিকতামণ্ডিতই হোক না কেন, আমার সন্দেহ হ’ল, হয়তো তার এ সবটাই ভান, নিছক অভিনয়। আসলে তার কিছুই হয়নি, সে এসব কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছে, যাতে আমি তাকে পাগলী মরে করে তার পছন্দমত স্থানে পৌঁছে দেই।

আমি তাকে বললাম, ‘তুমি আমাকে সত্যি করে বলো, তোমরা দু’জন আসলে কোথায় যাচ্ছিলে?’

সে এবারও কোন জবাব দিল না। আমি তাকে ধমক দিলাম, চাপ প্রয়োগ করলাম। কিন্তু সে অর্থহীন প্রলাপ বকে আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছিল। আমি আমার সঙ্গীদের সাথে পরামর্শ করলাম। তারা বললো, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন আমাদের রওনা করা উচিত।’

‘ওকে সঙ্গে নিয়ে নাও। হয়তো মাথা ঠিক হলে তার পরিচয় আমরা জানতে পারবো।’

আমি তাকে বললাম, ‘তুমি আমাকে বোকা ও হাবা গোছের লোক ভাবছো। তাই আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছো। ঠিক আছে, তাহলে তুমি এখানেই থাকে, আমরা যাই।’

সে বললো, ‘আমি অবশ্যই আমার পরিচয় তোমাকে বলবো। তবে এখন নয়, সময় হলেই তুমি জানতে পারবে আমি কে? আপাতত তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো।’

সূর্য ডোবার পর আমি তাকে আসবাবপত্র বহনকারী ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে দিলাম। তারপর আমরা আবার রওনা হয়ে গেলাম বায়তুল মোকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা পথ চললাম। কারণ রাতে রোদ থাকে না বলে রাতেই পথ চলতে আরাম। সে জন্য আমরা সারা রাত পথ চলতাম এবং দিনে বেশীরভাগ সময়ই বিশ্রাম নিতাম।

আমি আমার সৈন্যদের বললাম, ‘আমি যদি মেয়েটিকে নির্জনে নিয়ে যাই তাহলে কি তোমরা কিছু মনে করবে? আমরা কমাণ্ডো সেনা, অপরিচিত একটি মেয়েকে সঙ্গে রাখা যেমন বিপজ্জনক তেমনি অসহায় একটি মেয়েকে এই নির্জন পাহাড়ী পথে ছেড়ে যাওয়াও মানবতা পরিপন্থী। এমনটি কিছুতেই আমাদের বিবেক সায় দেবে নো। তাই আমি মেয়েটির পরিচয় ও তার উদ্দেশ্য জানতে চাই।’

আমার সঙ্গীরাও আমার সাথে একমত হ’ল, এ মেয়ের উদ্দেশ্য আমাদের অবশ্যই জানা দরকার। এবং তারা এ কাজের দায়িত্ব আমাকেই দিল।

আমার সৈন্যরা আগে আগে চলতে লাগলো। আমি আমার মালবাহী ঘোড়ার সাথে তাদের পিছনে চলতে লাগলাম। কিন্তু মেয়েটি তখনও আগের মতই সর্তক। সে আগের মতই এলোমেলো কথাবার্তা বলতে লাগলো।

অর্ধেক রাত পার হয়ে গেল। আমরা এক স্থানে যাত্রা বিরতি করলাম। আমি তাকে সবার থেকে দূরে এক তাঁবুতে রাখলাম। শুধু আমার তাঁবুটিই তার কাছে থাকল।

রাতে আমি তাকে আর একবার জিজ্ঞেস করলাম, সে এখন কোথায় যেতে চায়। সে বললো, ‘তুমি যেখানে নিয়ে যেতে চাও আমি সেখানেই যাবো।’

আমি বললাম, ‘আমি তোমাকে জেলখানায় নিয়ে যাচ্ছি।’

সে বললো, ‘অসুবিধা কি? জেলখানাতেও তো আল্লাহ আছেন।’

বুঝলাম, সে এভাবে ধরা দেবে না। তার ইচ্ছে জানতে হলে আমাকে অন্য পথ ধরতে হবে।

আমি তাই করলাম। আমি তার সাথে প্রেম করতে চাইলাম। আসলে আমি চাচ্ছিলাম, ও আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলুক। আমাকে বিশ্বাস করুক। কিন্তু এতেও কোন কাজ হ’ল না। সে আমার ফাঁদে ধরা দিল না।

আমি ভাবলাম, সে যেহেতু খৃষ্টান মেয়ে তাই সে আমার সাথে দরকাষাকষি করবে। আমাকে বলবে, ‘আমাকে অমুক খৃষ্টান এলাকায় বা শহরে রেখে এসো। বিনিময়ে তুমি যা চাও তাই পাবে।’

কিন্তু তার মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। সে আমার কোন কথাই গ্রাহ্য ও কর্ণপাত করল না। শেষে আমি আমার তাঁবুতে ঘুমোতে চলে গেলাম।

পরের দিন রাত আগের রাতের মতই আমাদের তাঁবু দুটি পাশাপাশি। তার কাছ থেকে কথা আদায়ের চেষ্টা বাদ দিলাম আমি। সত্যি কথা বলতে কি, এ ব্যাপারে আমি অনেকটা নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম, বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছে ওকে গোয়েন্দা বিভাগের হাতে তুলে দেবো। ওরা বুঝবে, এক মেয়ের কাছ থেকে কিভাবে কথা বের করতে হবে।

পাহাদার ছাড়া দলের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমিও আমার তাঁবুতে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনও ঘুম আসেনি আমার। এমন সময় সে এলো আমার তাঁবুতে। গত দু’দিন চেষ্টা করেও আমি যা পারিনি আজ বিনা চেষ্টাতেই তা পেয়ে গেলাম। সে তার পরিচয় আমার কাছে খুলে বললো। সেই প্রথম আমি জানতে পারলাম, সে কে এবং কোত্থেকে এসেছে।

সে বললো, ‘আমি তোমার কাছে মিথ্যা বলতে পারবো না বলে এই দু’দিন তোমার কোন প্রশ্নের জবাব দেইনি। আমার ভয় হচ্ছিল, পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি আমাকে হত্যা করে ফেলবে। এই ভয়ে আমি মুখ বন্ধ করেছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম, মুখ বন্ধ রেখেও তো আমি বাঁচতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত আমি মুখ না খুললে শুধু এই অপরাধেই তো তোমরা আমাকে হত্যা করতে পারো। তখন আমি মত পাল্টালাম। এখন তুমি বলো, তুমি কি আমার পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করে ফেলবে? তাহলে আরো দু’দিন বাঁচার আশায় আমি না হয় মুখ বন্ধ করেই থাকবো।’

আমি তাকে বললাম, ‘লড়াইয়ের সময় প্রতিপক্ষকে আমরা সহজেই হত্যা করতে পারি। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় কাউকে সহজে হত্যা করার অনুমতি আমাদের নেই। তুমি যত বড় অপরাধীই হও না কেন, বিচার না করে কোন শাস্তি দেয়ার এখতিয়ার আমাদের কারো নেই।’

আর আমরা কমাণ্ডো বাহিনী, কারো বিচার করার অধিকারও আমাদের নেই। আমরা বড়জোর তোমাকে আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে পারি। তারা তদন্ত করে দেখবে তোমার দেয়া ভাষ্য ঠিক আছে কিনা। তারপর তারা তোমাকে আদালতে সোপর্দ করবে। আদালতই নির্ধারণ করবে তোমার কি শাস্তি হওয়া উচিত। অতএব তুমি নির্দ্বিধায় তোমার পরিচয় বলতে পারো। এতে তোমার কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না।’