» » মহাসমর

বর্ণাকার

খৃষ্টানদের এ অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ হলে তারা শহরে প্রবেশের নতুন উপায় সন্ধান করতে লাগলো। শহর প্রাচীরের বাইরে একটি বড় পরিখা ছিল। এই খন্দক পার হওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়াল খৃষ্টানদের জন্য। তারা সে খন্দকটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলার উদ্যোগ নিল।

শত শত ক্রুসেড সৈন্য লেগে গেল মাটি ভরাটের কাজে। শহরের প্রতিরক্ষা বাহিনীর তীর সে পর্যন্ত পৌঁছাতো না। মুজাহিদ বাহিনীর এক কমাণ্ডার বললো, ‘যারা আগে শহীদ হতে চাও তারা আমর সাথে এসো।’

সে একদল মুজাহিদ নিয়ে ফটক পার হয়ে চলে এলো শহরের বাইরে। এসেই এ দুঃসাহসী সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্রুসেড বাহিনীর উপর। তাদের তীব্র আক্রমণে শত শত খৃষ্টান সৈন্য তীরবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগলো সেই খন্দকের ভেতরেই।

খৃষ্টান সেনারাও মরিয়া হয়ে উঠল। তারাও পাল্টা তীর ছুঁড়তে শুরু করল। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার শপথ নিয়েই ছুটে গিয়েছিল শহরের বাইরে। ফলে সেখানে তীব্র লড়াই শুরু হয়ে গেল।

দেখা গেল সেই খন্দকটি এবার মাটির পরিবর্তে খৃষ্টানদের মৃত লাশে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খৃষ্টানরা সেই লাশ সরানো বা দাফনের সুযোগ পেলো না। তারা খন্দকের ভেতর কয়েক হাজার লাশ রেখে পিছু হটতে বাধ্য হ’ল। সুলতান আইয়ুবীর জানবাজ কমাণ্ডো বাহিনী তাদের ধাওয়া করে এগিয়ে গেল খন্দক পর্যন্ত। কিন্তু এত কিছুর পরও খৃষ্টানদের অবরোধ দুর্বল না হয়ে বরং আরো দৃঢ় হ’ল। সামান্য মুসলিম সৈন্যের এই প্রতিরোধ তাদের ক্ষিপ্ত করে তুললো।

শহরবাসী সৈন্যদের সাথে সুলতান আইয়ুবীর যোগাযোগ চলছিল পত্রবাহী কবুতরের মাধ্যমে। অপর এক যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এক লোক, যার নাম ছিল ইশা আল উমওয়াম। সে চিঠি কোমরে চামড়ার ওয়াটারপ্রুফ বেল্টে ঢুকিয়ে সমুদ্র সাঁতরে শহরে প্রবেশ করতো। রাতের অন্ধকারে সে শহরে আসতো, অন্ধকারেই আবার বিদায় হয়ে যেতো। কখনও প্রয়োজন হলে থেকে যেতো শহরেই।

শত্রুদের জাহাজগুলো ঘিরে রেখেছিল আক্রা শহর। তাকে শত্রুদের নোঙ্গর করা জাহাজের গা ঘেঁষে চলাচল করতে হতো। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে চিঠি আদন প্রাদান করতো।

সে শহরে নিরাপদে পৌঁছতে পারলে আকাশে কবুতর উড়িয়ে দিত। পায়রাটি উড়ে মুসলমানদের শিবিরে চলে এলে তারা বুঝতে পারতো, ইশা নিরাপদেই শহরে পৌঁছেছে। তারাও তখন তার কবুতর উড়িয়ে ফেরত পাঠাতো।

একদিন রাতে সে এমনি সাঁতার কেটে আক্রা শহরে যাওয়ার জন্য রওনা হ’ল। ওখানে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাকে দেয়া হ’ল এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা ও একটি চিঠি। সে স্বর্ণমুদ্রা ও চিঠিটি কোমরে বেঁধে সমুদ্রে নেমে পড়ল।

সে স্বর্ণমুদ্রা ও চিঠি নিয়ে রওনা হয়ে যাওয়ার পর সুলতান আইয়ুবী তার পাঠানো কবুতরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু কোন কবুতর তার কাছে থেকে ফেরত এলো না। সুলতান চিন্তিত হলেন। পরের দিনও কোন কবুতর ফেরত না এলে তিনি মনে করলেন, সে ধরা পড়েছে।

কয়েকদিন পর শহরে সংবাদ পৌঁছলো, ইশার লাশ আক্রা শহরের উপকূলে ভাসছে। সোনার মোহরগুলো তখনও তার দেহের সাথে বাঁধা। লাশের অবস্থা খুবই খারাপ। ঘটনা হচ্ছে, সে সোনার ভারে সাঁতার দিতে না পারায় ডুবে গিয়েছিল।

আক্রার শাসনকর্তা মীর কারাকোশ ও সেনাপতি আলী ইবনে আহমদ মাশতুত দু’জনই ছিলেন জিন্দাদীল মুজাহিদ। তারা বরাবর সুলতানকে এই খবর পাঠাতে লাগলেন, ‘সুলতান, আপনি নিশ্চিত থাকুন, পরিস্থিতি যত নির্মম ও কঠিনই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই আমরা অস্ত্রসমর্পন করবো না। তবে শহরের এই সামান্য সৈন্য দিয়ে অবরোধকারীদের হটিয়ে দেয়া হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আপনি বাইরে থেকে খৃষ্টানদের উপর প্রবল চাপ বজায় রাখলে তারা শহরে আক্রমণ করার ফুসরত পাবে না। নইলে তারা শহরে আক্রমণ করে বসতে পারে। খৃষ্টানরা প্রবল স্রোতের মত শহরে ঢুকতে শুরু করলে সামান্য ক’জন মুজাহিদের পক্ষে এখানে টিকে থাকই কঠিন হবে।’ তারা আরো লিখলেন, ‘অবরোধ দীর্ঘায়িত হলে শহরে খাদ্য ও অস্ত্রসস্ত্র পাঠাতে হবে। সৈন্য সাহায্য পাঠানো সম্ভব হলে শহরের ভেতর থেকেও অবরোধকারীদের ওপর হামলা করা সম্ভব।’

সুলতান আইয়ুবী বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ভাবলেন। কিন্তু শহরে সাহায্য পাঠানো এক জটিল সমস্যা। চারদিকে ঘেরাও করে রেখেছে খৃষ্টানরা। এ অবস্থায় ইচ্ছে করলেও তিনি যখন তখন সাহায্য পাঠাতে পারছেন না। এমন কোন ফুটো নেই, যে ফুটো দিয়ে তিনি সৈন্য বা খাদ্য সাহায্য ভেতরে পাঠাবেন।

ইশা আল উমওয়ামের শাহাদাতের পর সুলতান আইয়ুবী আরো একবার স্থলভাগের অবরোধকারীদের ওপর চড়াও হলেন। তবে এবার কেবল আঘাত হেনে শত্রুদের বিপুল ক্ষতি সাধনই তার লক্ষ্য ছিল না বরং অবরোধের জাবাবে পাল্টা অবরোধ করে বসলেন তিনি।

খৃষ্টানদের সামনে শহর এবং শহরে অবস্থানকারী সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা আর পেছনে স্বয়ং সুলতান আইয়ুবী এবং তার ক্ষুদ্র বাহিনী।

দু’পাশের শত্রুবেষ্টিত হলেও খৃষ্টানদের দুর্ভাবনার তেমন কিছুই ছিল না। কারণ তখনও ওরা ভাবছিল, সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী এতই নগন্য যে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

খৃষ্টানদের বিশাল বাহিনীর তুলনায় মুসলমানদের বাহিনী হাতির কাছে মশার সমান। কিন্তু দুর্ভাবনার কারণ একটাই, আইয়ুবীর বাহিনী বসে থাকে না এবং ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিও নেয় না। বরং তারা পরিকল্পিতখভাবে একটু একটু করে খৃষ্টান বাহিনীকে খেয়ে ফেলতে চেষ্টা করছে।

সুলতান আইয়ুবীর অবরোধের পর দু’পক্ষেই আবার তুমুল সংঘর্ষ হয়। ব্যাপক ক্ষতি হয় উভয় পক্ষে। তারপর সংঘর্ষের প্রচণ্ডতা কমে এলে দুই বাহিনী আবার যার যার অবস্থানে দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

এ সময় সুলতান আইয়ুবীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। তার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। অসুখের কারণ, অত্যধিক রাত্রি জাগরণ ও শরীরের উপর বেশী অত্যাচার। তৃতীয় কারণ ছিল মানসিক। চারদিক শুধু লাশ আর লাশ। দু’পক্ষেরই সৈনিকদের মৃত লাশ স্তুপ হয়ে পড়ে আছে ময়দানে। পচাঁ ও গলিত লাশের দুর্গন্ধ এত বেশী যে, সেখানে নিশ্বাস নেয়াই দুঃসাধ্য হয়ে উঠল।

এ সব কারণে সুলতান আইয়ুবীর শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেল। তিন চার দিন তিনি শয্যা থেকে উঠতেই পারলেন না। তিনি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন, হায়! আক্রা শহরে কি হাত ছাড়া হয়ে যাবে?

সুলতান আইয়ুবী তার তাঁবুতে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন। তার মুষ্ঠিমেয় কমাণ্ডো সৈন্য তখনও আক্রার কাছে বিশাল ক্রুসেড বাহিনীর উপরে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন কোন পক্ষই আর দয়ামায়ার ধার কাছ দিয়ে যাচ্ছে না। যে যেখানে যেভাবে পারছে শত্রু নিধন করে যাচ্ছে।

সুলতান আইয়ুবী দশ হাজার সৈন্য শহরে রেখে বাইরে থেকে এতদিন ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন তার হাতে গড়া কমাণ্ডো বাহিনী নিয়ে। তাদের সংখ্যাও ছিল প্রায় সৈন্যদের সমানই।

এদের অনেকেই এর মধ্যে শহীদ হয়ে গেছে। অল্প যে ক’জন বেঁচে আছে তারা ভাসছে রক্তের ওপর। সম্ভবত ফিলিস্তিনের ইতিহাস সবচাইতে রক্তাক্ত সময় পার করছিল সেই দিনগুলোতে।

যুদ্ধ চলছিল প্রতিদিন। কোন পক্ষেই অবরোধ সরানোর কোন লক্ষণ দেখা গেল না। খৃষ্টানরা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী তাদের সংখ্যাধিক্যের জন্য, মুসলমানরাও আশাবাদী, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সহায় থাকবেন।

সুলতান আইয়ুবী শহরের সৈন্যদের কথা ভাবলেন। আসার সময় তিনি সেখানে যে দশ হাজার সৈন্য রেখে এসেছিলেন যুদ্ধে তাদের অনেকেই শহীদ হয়ে গেছে। তবে বাকীরা এখনও লড়ছে ঈমানের জোরে। এই ঈমানী শক্তির কোন তুলনা নেই। তাদের অর্ধেক সাথী আল্লাহর দরবারে রওনা হয়ে যাওয়ার পরও তাদের সাহস ও তৎপরাতায় কোন ভাটা পড়েনি। অপর পক্ষে এ লড়াই শুরু হওয়ার সময় অবরোধকারী ক্রুসেড বাহিনী ছয় লাখ সৈন্য নিয়ে ময়দানে নেমেছিল। এর মধ্যে তাদের এক লাখের মত সৈন্য মারা গেছে। তার পরও তাদের সৈন্য এখনও বেঁচে আছে পাঁচ লাখের মত।

সুলতান পাঁচ হাজার মুজাহিদের হাতে এক লাখ খৃষ্টান সৈন্য নিহত হওয়ার পরও খুশী হতে পারলেন না। তিনি হিসাব করে দেখলেন, এই হারে চলতে থাকলে ভেতরের দশ ও বাইরের দশ মোট বিশ হাজার সৈন্যের হাতে মারা যাবে চার লাখ। কিন্তু তখনও খৃষ্টানদের হাতে থেকে যাবে দুই লাখ সৈন্য। তাই তিনি যুদ্ধের ধারা পাল্টাবার প্রয়োজন অনুভব করতে লাগলেন। সুলতান আইয়ুবী ক্রুসেড বাহিনীর পশ্চাতে অর্থাৎ শহরের বাইরে ছিলেন বলে এতদিন যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। তাঁর কাছে যে দশ হাজার কমাণ্ডো ছিল তাদের অধিকাংশই ছিল মামলুক বংশের। এদের উপর সুলতানের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল অপরিসীম।

তারা তাঁর বিশ্বাসের অমর্যাদা করেনি। ক্রুসেড বাহিনীর উপর উপর্যুপরি প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে তাদের। কিন্তু বিশাল বাহিনীকে এই ক্ষুদ্র বাহিনী দিয়ে এখনও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। সুলতান গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন।

একে তো তাদের সৈন্য সংখ্যা বহুগুণ বেশী, তার ওপর তারা আইয়ুবীর অশ্বারোহী বাহিনী যাতে অতর্কিত আক্রমণ চালাতে না পারে সে জন্য পথে নানা জায়গায় বড় বড় গর্ত করে রেখেছে। এই সব খন্দক সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের জন্য বিরাট অসুবিধা ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। কারণ অশ্বারোহীরা দ্রুত আক্রমণ চালাতে গেলেই তাদের ঘোড়া আরোহীসহ গর্তে পড়ে যায়।

খন্দক ছিল আক্রা শহরের বাইরেও। ক্রুসেড বাহিনী সেই খন্দক পার হয়ে শহরে প্রবেশ করতে পারছিল না। ওদিকে ময়দানে লাশের স্তুপ। সেই লাশের দুর্গন্ধে তাদের অবস্থাও কাহিল। কমাণ্ডাররা সৈন্যদের বললো, ‘এই লাশগুলো তুলে নিয়ে খন্দকে ফেলে দাও’।

বিরাট রণাঙ্গন থেকে লাশগুলো কুড়িয়ে এনে সৈন্যরা সেই লাশ খন্দকে ফেলতে লাগলো। প্রশস্ত খন্দক ক্রুসেড বাহিনীর মৃত সৈন্য ও ঘোড়ার লাশে ভরাট হতে লাগলো।

লাশের গন্ধে ছুটে এলো শত শত শকুন। তারা খন্দকে বসেই সে সব লাশ খেতে লাগলো। এই শকুনের ঝাঁকের মধ্যেও প্রায় প্রতিদিনই একটা পায়রা আক্রা থেকে উড়ে সুলতান আইয়ুবীর ক্যাম্পে যায় আবার সেখান থেকে উড়ে আক্রাতে চলে আসে।

একদিন ইংল্যাণ্ডের সম্রাট রিচার্ড তার তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সঙ্গে তার বোন জিয়ান ও বগদত্তা রাণী বিরাঙ্গারিয়া।

তিনি লক্ষ্য করলেন, একটি পায়রা একা একা উড়ে যাচ্ছে তাদের মাথার ওপর দিয়ে। তিনি জিয়ানকে বললেন, ‘পায়রাটাকে লক্ষ্য করো।’

জিয়ান বললো, ‘পায়রাটাকে আমি আগেও দেখেছি। সব সময় একাই উড়ে। কখনও ওর সাথে কোন সঙ্গী দেখিনি।’

রিচার্ড তার বোনকে বললেন, ‘এরপর যখনই পাখীটাকে দেখতে পাবে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাজপাখী লেলিয়ে দেবে ওর পিছনে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই কবুতর আমাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে।’

সম্রাট রিচার্ডের বয়স হয়েছে। তিনি তার যুবতী বোনকে সঙ্গে রেখেছেন তাকে রাজকার্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তুলতে। তার ইচ্ছা, বায়তুল মোকাদ্দাস জয় হয়ে গেলে দেশে ফিরেই তিনি তার বোনের বিয়ের দিকে মন দেবেন।

এই বোনটির জন্য তার বড়ই মায়া হয়। কিছু দিন আগে বোন জিয়ানকে তিনি সিসিলের সম্রাটের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কপাল মন্দ বোনের, বিয়ের পরপরই সম্রাট মারা যান। বোন জিয়ান যৌবন কালেই বিধবা হয়ে ফিরে আসে ভাইয়ের কাছে।

সে এতই সুন্দরী ছিল যে, হাজার নারীর মাধ্যেও তার রূপ ঝলমল করতো। মনে হতো, রাজকুমারী এখানে একজনই আছে, আর সেই রাজকুমারীর নাম জিয়ান।

জিয়ান সম্রাটের কথা শুনে হেসে দিল। জিয়ানের হাসি শুনে সম্রাট রিচার্ড তাকালেন তার দিকে, বললেন, ‘হাসছো কেন?’

জিয়ান তাকে উল্টো প্রশ্ন করল, ‘ভাইয়া! এই কবুতরটি মারা গেলে সেই সাথে আইয়ুবীও কি মারা যাবেন?’

‘এই কবুতরটি পত্রবাহক, পোষা পায়রা, জিয়ান!’ রিচার্ড বললেন, ‘এই পাখীর এক পায়ে একটি চিঠি বাঁধা আছে। আক্রা শহর থেকে চিঠিটা পাঠানো হচ্ছে সুলতান আইয়ুবীর কাছে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আবার চিঠি লিখে কবুতরটির পায়ে বেঁধে আকাশে উড়িয়ে দেবেন। এভাবেই সুলতানের সব খবর আক্রাবাসী এ চিঠির মাধ্যমে পেয়ে যায়।

আক্রাবাসীদের মনে সাহস ও প্রেরণা জোগায় এ কবুতর। নইলে অবরুদ্ধ কয়েকটি লোক আমাদের বিশাল বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে এভাবে টিকে থাকতে পারতো না।’

‘এত বিশাল বাহিনী থাকার পরও আপনারা শহরটি গুড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন?’

‘কারণ আমারা ওদের সাথে পারছি না। তুমি দেখতে পাচ্ছো, আমাদের পাথর বর্ষণের ফলে ওদের প্রাচীরের উপরের দিকের কয়েক স্থান ধ্বসে গেছে। কিন্তু তারা অস্ত্র সমর্পন করছে না। এই সাহসের পিছনে আছে সামান্য এই কবুতর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কবুতরটি যদি সুলতানের সাথে তাদের যোগাযোগ না রাখতো তবে অনেক আগেই তারা আত্মসমর্পন করে ফেলতো।’

‘আপনার আসল লক্ষ্য তো জেরুজালেম, যা এখনও বহু দূরে। আপনারা জেরুজালেম না গিয়ে এখানে বসে আছেন কেন?’

জিয়ান বললো, ‘যদি আক্রা দখল করতেই কয়েক বছর লেগে যায় তবে কি আপনি আপনার জীবদ্দশায় জেরুজালেমের মুক্তি দেখে যেতে পারবেন?’

আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, আক্রা শহরে মাত্র দশ হাজার সৈন্য আছে ওদের। এ কথা মুসলমান যুদ্ধবন্দীরাও স্বীকার করেছে। কিন্তু আমাদের সৈন্য সংখ্যা এখনও পাঁচ লাখের বেশী আছে।

অবরোধ ১১৮৯ সালের আগষ্ট মাসের ১৩ তারিখে শুরু হয়েছে, এখন ১১৯১ সালের আগষ্ট মাস। এর মধ্যে পার হয়ে গেছে দুইটি বছর। ভাইয়া! এই দুই বছরেও যখন তোমরা ছয় লাখ সৈন্য নিয়ে মাত্র দশ হাজার অবরুদ্ধ সৈন্যকে পরাজিত করতে পারোনি তখন তোমরা তাদের আদৌ পরাজিত করতে পারবে কি না এ প্রশ্ন কি এসে যায় না?

তোমরা দুই বছরে আক্রার দুর্গ প্রাচীরের সামান্য ক্ষতিসাধন ও মেঞ্জানিক দিয়ে শহরের কিছু অংশে আগুন লাগানো ছাড়া আর কোন সফলতা লাভ করতে পারোনি। আমার তো মনে হচ্ছে, তোমরা এ শহরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারবে না।

সম্রাট রিচার্ড রাণীকে বললেন, ‘তুমি একটু তাঁবুতে যাও।’ বিরাঙ্গারিয়া সেখান থেকে চলে গেলেন।

রাণী চলে যাওয়ার পর রিচার্ড তার বোন জিয়ানকে বললেন, ‘মহান ক্রুশ ও পবিত্র জেরুজালেমের শপথ, এর সম্মানের জন্য আমি আমার জীবন বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত। আমি মনে করি প্রতিটি খৃষ্টানেরই এমন মনোভাব থাকা দরকার। জিয়ান, আজ থেকে তুমি ভুলে যাও তুমি আমার বোন। তুমি মনে করো, তুমি এই ক্রুশের এক কন্যা। তুমি জানো, আমাদের পবিত্র ক্রুশটি এখন মুসলমানদের হাতে।

আর তুমি এটাও জানো, পবিত্র জেরুজালেম, যেটা আমাদের পয়গম্বরের তীর্থ স্থান, সেটাও এখন মুসলমানদের অধিকারে। তুমি জানো, আক্রা দখল করা আমাদের মূল টার্গেট নয়। আমাদের মূল টার্গেট এখন ইসলাম তথা মুসলিম জাতিকে দুনিয়া থেকে নির্মূল করা।

জিয়ান! তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছো, মুসলমানরা কি মরণপণ যুদ্ধ করছে। এরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। এই যে অল্প ক’জন মুসলমান, এরাও জয়লাভের আশা নিয়েই যুদ্ধ করছে।

আমি এখানে এই প্রথমবার এসেছি এবং তাদের যুদ্ধ করা দেখতে পাচ্ছি। তাদের আবেগ ও প্রেরণার এই উন্মাদনার কথা গল্পে শুনেছি, এখন তা স্বচক্ষে দেখতে পেলাম।

তবে আমি শুনেছি, মুসলমানদের শুধু মেয়েরাই কব্জা করতে পারে। মুসলমানদের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল, তার পিছনে আমাদের মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার লোভ, সম্পদের মোহ, মদ ও নারীর নেশা মুসলমানদের মধ্যে আমাদের মেয়েরাই চালু করেছে।

‘কিন্তু তারা সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীকে কব্জা করতে পারলো না কেন? প্রশ্ন করল জিয়ান।

‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী এক ঈমানদার সাচ্চা মুসলমান। যতক্ষণ মুসলমানরা তাদের ঈমানকে মজবুত রাখতে পারে ততক্ষণ তাদের কিছুতেই কাবু করা যায় না। সে ঈমানদার বলেই তাকে আমরা তার লক্ষ্য বিচ্যুত করতে পারিনি।

তিনি তার মুসলমান ভাই, যাদের আমরা নানাভাবে লোভ দেখিয়ে হাত করেছিলাম, তলোয়ারের জোরে তিনি তাদেরকে নিজের অধীন করে নিয়েছেন। তিনি তাদের প্রাণে আবার ইসলামী প্রেরণা ও জোশ জাগিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন।’

জিয়ান বললো, ‘আমিও সেই সব মেয়েদের ত্যাগের কথা শুনেছি। তারা মুসলমান শাসনকর্তা ও পদস্থ রাজকর্মচারীদের বশ করে ইসলামের বহু ক্ষতি সাধন করতে সমর্থ হয়েছে। তারা সেখানে গোয়েন্দাগিরি ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। যদি তারা সফল হতো তবে আমাদের আজ নতুন করে লড়াইতে নামতে হতো না।’

‘আমি একে ব্যর্থও বলতে পারি না।’ সম্রাট রিচার্ড বললেন, ‘যদি মুসলমানদের জাতীয় চেতনাকে ধ্বংস করার কাজে আমরা মেয়েদের ব্যবহার না করতাম তবে মুসলমানরা বহু আগেই শুধু ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম নয় বরং অর্ধ ইউরোপ অধিকার করে ফেলতো।

আমরা নারীর রূপের মোহ ও আকর্ষণে অধিকাংশ মুসলিম আমীর, উজির ও সেনাপতিদের ফেলতে পেরেছিলাম বলেই তারা সম্রাট হওয়ার লোভে নিজেদের জাতীয় ঐক্য ধ্বংস করে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল।

জিয়ান, একবার ভেবে দেখো, তারা নিজেদের সামরিক শক্তি নিজেদের ওপর ব্যবহার না করে যদি আমাদের ওপর করতো তাহলে কি অবস্থা হতো আমাদের?

তাদের নিঃশেষ হওয়া শক্তির সাথেই আমরা পেরে উঠছি না, যদি সমগ্র জাতিকে এক করে তারা আমাদের বিরুদ্ধে একবার দাঁড়াতে পারতো তবে যিশুর সন্তানরা মাথা গোঁজার মত একটু ঠাঁইও পেতো না দুনিয়ার কোথাও। তাই আমাদের মেয়েদের সাধনা ব্যর্থ হয়েছে এমন কতা তুমি বলতে পারো না।’

‘আপনি এসব কথা আমাকে কেন শোনাচ্ছেন?’ জিয়ান বললো, ‘আপনারন কথায় নিরাশার ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে, আমি কি আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারি?’

‘আমি তো তোমাকে শুরুতেই বলেছি, তুমি যে আমার বোন সে কথা ভুলে যাও। তুমি এখন ক্রুশের কন্যা। এই ক্রুসেড যুদ্ধে তোমাকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং আমার বিশ্বাস তুমি তা পারবে।

তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, আমরা মুসলামনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও তাদের সাথে আপসের আলোচনাও চলছে। আমরা একে অপরের সাথে দূত বিনিময় করে চলেছি। আমার সাথে দেখা করার জন্য সুলতান আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিন এসেছিলেন। আমি তাঁকে আমাদের শর্তগুলো মেনে নিতে বলেছি।

কিন্তু  তিনি তা মানতে প্রস্তুত নন। আমি তাকে বললাম, ‘তোমরা জেরুজালেম ও মহান ক্রুশটি আমাদের দিয়ে দাও, আর যে সব এলাকা খৃষ্টান শাসন ছিল সে এলাকা ছেড়ে চলে যাও, আমরা ফিরে যাবো। আমরা কোন মুসলমান দেশ দখল করতে এখানে আসিনি। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী এর একটি শর্তও মানতে রাজী হচ্ছেন না।’

‘আপনি নিজেই সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাঙ্গে দেখা করছেন না কেন?’

‘তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান না।’ সম্রাট রিচার্ড বললেন, ‘তিনি এখন অসুস্থ! মনে হয় তার ভাই তকিউদ্দিনই সালাহউদ্দিনের নামে সব কাজকর্ম চালিয়ে নিচ্ছে। আমি তার মধ্যে একটি দুর্বলতা দেখেছি। সে সুন্দর ও সুপুরুষ। তাকে আমার মনে হয়েছে প্রফুল্ল মনের এক সজীব মানুষ। আমি এই লোকটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই। কিন্তু এ কাজ তো তোমার, আমি কেমন করে সেটার সমাধা করবো?’

‘আপনি কি সেই ছলনার কাজ আামাকে দিয়ে করাতে চাচ্ছেন যে কাজ আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেয়েরা করতো?’

‘হ্যাঁ!’ রিচার্ড বললেন, ‘তাকে তুমি জয় করো, ভালবাসার অভিনয়ে বন্দী করো তাকে। বলো, তাকে তুমি বিয়ে করতে চাও। আমি তোমাদের সব রকম সাহায্য ও মধ্যস্থতা করবো। আমি তখন সালাউদ্দিনকে বলবো, ‘আপনি সাগর উপকূলের রাজ্যগুলো আপনার ভাই ও আমার বোনকে ছেড়ে দিন। আমি উভয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবো।’

তুমি তকিউদ্দিনকে বুঝাও, সে যেন ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। যদি তাতে রাজি না হয় তাতেও আপত্তি নেই। তাকে বলো, সে তোমাকে গ্রহণ করলে চিরদিনের মত খৃষ্টান ও মুসলামনদের দ্বন্ধের অবসান হয়ে যাবে। সে উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোর বাদশাহ হলে কোন খৃষ্টান সম্রাট আর তা দখল করতে আসবে না। আমি আশা করি তুমি তাকে সুলহতান সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারবে।’

জিয়ান কিছুক্ষণ নিরব থাকল। সম্রাট রিচার্ড গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। সম্রাট রিচার্ড গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিযে রইলেন তার দিকে। জিয়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মুখ না তুলেই বললো, ‘আচ্ছা, আমি চেষ্টা করে দেখবো।’

‘মুসলমানদের এমনি ছলনা দিয়েই মারতে হয়।’ রিচার্ড বললেন, ‘আমি যুদ্ধক্ষেত্রে এদের পরাজিত করতে প্রাণপণ চেষ্টা করবো। কিন্তু সে চেষ্টা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। হয়তো সে সময় পর্যন্ত আমি বেচেঁই থাকবো না। আমাকে শিঘ্রই ইংল্যাণ্ড ফিরে যেতে হবে। সেখানকার অবস্থাও বেশী ভাল নয়। বিরোধী চক্র আমার অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করছে।’

যে কবুতরটি রিচার্ডের মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল সেটি সুলতান সালাহউদ্দিনের তাঁবুর ওপর গিয়ে বসলো। এক রক্ষী দৌড়ে গিয়ে কবুতরের পায়ে বাধাঁ চিঠি খুলে সুলতানের তাঁবুর মধ্যে নিয়ে গেল।

সুলতান আইয়ুবী তখন অসুস্থতার কারণে খুবই দুর্বল অনুভব করছিলেন। চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন তিনি। চিঠি এসেছে শুনেই তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠে বসলেন। চিঠিটি রক্ষীর হাত থেকে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন তিনি।

আক্রা শহরের সৈন্যদের সাথে সুলতানের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এই পত্রবাহক কবুতর। চিঠি পাঠিয়েছেন আক্রা শহরের দু’জন সেনাপতি আল মাশতুত ও বাহাউদ্দিন কারাকুশ। এই দু’জনই অসাধারণ সাহসী ও বিচক্ষণ সেনাপতি ছিলেন।

তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন অবরোধে থেকে তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে উঠেছে। শহর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শত্রু সেনারা কান পেতে আছে কখন আক্রার সেনাদল অস্ত্র সমর্পন করবে এই ঘোষনা শোনার জন্য। তবে তারা জানিয়ে দিয়েছে মুসলামান সৈন্যরা কোনদিন অস্ত্র সমর্পনের ট্রেনিংই পায়নি।

এই চিঠিতে মাশতুত ও কারাকুশ সুলতান আইয়ুবীকে আবারও জানিয়েছেন, যা তারা ইতিপূর্বে বহুবার সুলতানকে জানিয়েছেন, ‘আপনি এমন আশা করবেন না যে, আমরা জীবিত অবস্থায় আত্মমর্পন করবো।’

তারা লিখেছে, ‘আপনি আপনার সঙ্গের সৈন্যদের বলবেন, তারা যেন খৃষ্টান বাহিনীর পশ্চাৎ দিক থেকে প্রবল আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সব সময় তাদের সন্ত্রস্ত করে রাখে। সৈন্যদের আরো বলবেন, আমরা শাহাদাতের পেয়ালা পান করার জন্য উন্মুাখ হয়ে আছি, তারাও ইচ্ছা করলে আমাদের সঙ্গী হতে পারে।

খৃষ্টানদের আক্রমণে আক্রা শহর অর্ধেকটা পুড়ে গেছে। আমাদের দশ হাজার সৈন্যের অর্ধেক এরই মধ্যে শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চরে গেছে আল্লাহর দরবারে। অবশিষ্ট পাঁচ হাজার মুজাহিদ পরিপূর্ণ আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও ভয়শূন্য হৃদয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের নিঃশেষ করার আগে কোন বেদ্বীন ও কাফের এ শহরে ঢুকতে পারবে না।

আপনি শহরবাসীর চেতনা ও আবেগের কথা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। তারা দিনে এক বেলা আহার করে আর দুই বেলার আহার সৈন্যদের জন্য পাঠিয়ে দেয়। আমাদের মেয়েরাও আমাদের সহযোগিতা করতে সর্বোতভাবে। তারা প্রত্যেকেই ঘরের পাশের ফাঁকা জায়গায় সবজির চাষ করছে যেন আমাদের দান করতে পারে। পুরুষের মত মেয়েরাও এখন এক বেলা খাবার গ্রহণ করছে।’

চিঠিতে প্রাচীরের অবস্থাও লিখেছেন তারা। লিখেছেন, ‘খৃষ্টান সৈন্যরা মেঞ্জানিক দিয়ে ক্রমাগত পাথর নিক্ষেপ করে শহরের প্রাচীরের কয়েক স্থান ভেঙ্গে ফেলেছে। তবে প্রাচীরের উপরের অংশই নষ্ট হয়েছে তাতে, নিচের অংশ এখনও অটুট আছে। গম্বুজ ধ্বসে পড়েছে।

শত্রুরা শহরের বাইরের খন্দকের কয়েকটি স্থান তাদের সৈন্যদের লাশ দিয়ে ভরাট করে ফেলেছে। এই ভরাট করার কাজে তারা মৃত সৈন্য এবং মৃত ঘোড়া ব্যবহার করেছে। তার ওপর মাটি দিয়ে তারা চলাচলের মত রাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে পথে যখনই শত্রু সৈন্য প্রাচীরের কাছে আসতে চেষ্টা করেছে, আমরা তাদের পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছি।

যুদ্ধের ব্যাপারে এখন আমাদের আরও নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা দরকার। আপনি যখন ঢোলের শব্দ শুনবেন তখন শত্রুর ওপর পিছন থেকে প্রবল বেগে আক্রমণ করবেন। আমরা তখনই ঢোল বাজাতে আরম্ভ করবো যখন ক্রুসেড বাহিনী প্রাচীরের উপর আক্রমণ চালাবে।

অথবা আমরা শত্রুর ওপর আক্রমণ করার আগেও ঢোল বাজাতে পারি যাতে তখন আপনারাও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। যতক্ষণ তাদের অস্তিত্ব থাকে বা আমরা নিঃশেষ হয়ে না যাই।

আমরা আরো চিন্তা করছি, রাতে গোপনে শহর থেকে বের হয়ে আমরা তাদের জাহাজে চড়াও হবো এবং পেট্রোল ঢেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দেবো। আপনি আমাদের এ পরিকল্পনা অনুমোদন করলে জানাবেন।’

সুলতান আইয়ুবী দুর্বল শরীর ও জ্বরের বেগ নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। তিনি কাতেবকে ডেকে চিঠির উত্তর লিখতে বসলেন, কাতিব সঙ্গে সঙ্গে তা লিখে নিচ্ছিল।

চিঠি লেখা শেষ হলে তিনি কাতেবকে বললেন, ‘পুনশ্চ দিয়ে আরো লিখ, ‘তোমাদের জন্য সামান্য সংখ্যক জানবাজ কমাণ্ডো সৈন্য পাঠালাম। কোন খাদ্য সামগ্রী তাদের দেইনি নিতে অসুবিধা হবে বলে।

তারা রাতে সাগর পথে শহরের উপকূলে পৌছবে। না, কোন জাহাজে চড়ে যাবে না ওরা, ওরা যাবে সাঁতরে। তোমরা ওদের শহরে ঢুকার পথ করে দেবে।

আল্লাহর প্রিয় বান্দারা! এখন তোমাদের একমাত্র আল্লাহই সহায়। ইসলামের উপর এখন কঠিন সমস্যা চেপে আছে। এটা আমারই দোষ। আমিই ক্রুসেড বাহিনী আক্রাতে ডেকে এনেছিলাম বায়তুল মোকাদ্দাসকে বাঁচানোর জন্য।

আমার ইচ্ছে ছিল, শত্রুদের আমরা এখানেই ব্যস্ত রাখবো যাতে ধীরে ধীরে তাদের শক্তি ও সাহস কমতে থাকে। শত্রুদের সমস্ত শক্তি এখানে শেষ করে দিতে পারলে তারা আর বায়তুল মোকাদ্দাসে অভিযান চালাতে পারবে না।