সেই মুহূর্তে এক সেনাপতি পত্রবাহক কবুতরের পায়ে একটি চিঠি বেঁধে তাকে আকাশে উড়িয়ে দিল।
চিঠিতে সে লিখলো, ‘আগামীকাল সকাল পর্যন্ত যদি আমাদের কাছে কোন সাহায্য না পৌঁছে আর আপনি বাইরে থেকে অবরোধ ভঙ্গ করতে না পারেন তবে শহরের পতন ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
কারণ শহরের শিশুরা ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার করছে। শহর পুড়ে ধ্বংস হচ্ছে। সৈন্য সংখ্যা আর সামান্যই রয়েছে। যারা বেঁচে আছে তাদেরও অনেকে আহত। বাকীরা দীর্ঘ একটানা যুদ্ধে ক্লান্ত। লাশের মতই এখন অসাড় হয়ে গেছে তাদের দেহগুলো।
সুলতান আইয়ুবী চিঠি পড়ে কেঁদে ফেললেন। তিনি তার সমস্ত বাহিনীকে একত্রিত করলেন। সমস্ত শক্তি একত্রি করে তিনি দু’রাকাত নফল নামাজ পড়লেন।
সৈন্যদের বললেন, ‘মুজাহিদ ভাইয়েরা আমার! অনেক দিন হয়ে গেল আমরা এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে আছি। শহরের ভেতর যে সব ভাইয়েরা ছিল তাদের অনেকেই আল্লাহর দরবারে চলে গেছে। বাকীরা জীবিত থেকেও মৃতের মতই। ওখানে আমাদের শিশুরা খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে। যে কোন সময় শহরের পতন হতে পারে।
এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। ছয় লাখ খৃষ্টান এসেছিল আমাদের দশ হাজার সৈন্য শেষ করতে। আমরা ওদের অর্ধেক সৈন্য খতম করে দিয়েছি।
এ রকম অসম যুদ্ধের নজির পৃথিবীতে এক বদর যুদ্ধ ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাবে না। সেদিন আল্লাহর সাহায্যে আল্লাহর সৈনিকরাই বিজয়ী হয়েছিল। আজও আল্লাহর সাহায্য আছে বলেই আমরা এখনও শত্রুর তিন লাখ সৈন্যকে খতম করার পরও টিকে আছি বহাল তবিয়তে। আমরা আল্লাহর আরো সাহায্য চাই এবং বিজয় চাই।
এসো আজ আমারা শপথ করি, বিজয় না নিয়ে আমরা কেউ আর ময়দান থেকে ফিরে আসবো না। হয় আমরা জয়ী হবো নইলে শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চলে যাবো মালিকের দরবারে।
তাকে বলবো, ‘তোমার প্রিয় বান্দাদের রক্ষা করার জন্য দুনিয়াতে কেবল তোমাকেই রেখে এসেছি। আমারা তোমার হুকুম অমান্য করিনি। বীর খ্যাতি লাভের জন্য নয়, সম্রাজ্য বিস্তারের জন্য নয়, আমাদের সব প্রচেষ্টা ছিল তোমাকেই খুশী করার জন্য। আমরা তোমার প্রতিশ্রুত জান্নাতের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তোমার শাহী দরবারে হাজির হয়েছি। হে রাব্বুল আলামীন, তুমি আমাদের কবুল করো।’
তিনি বললেন, ‘এখন আমরা সবাই দু’রাকাত নফল নামাজ পড়বো। নামাজ পড়ে আমরা কেউ ক্যাম্পে ফিরে যাবো না, অজু অবস্থায় সবাই আল্লাহর সেই হুকুম বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে যাবো, যেখানে তিনি মুমীনদের সম্বোধন করে বলেছেন, ‘‘তোমরা হয় মারো অথবা মরো।’’ আমরা আমাদের মালিকের এই হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। আমরা মারবো অথবা মরবো। তৃতীয় কোন পথ খোলা নেই আমাদের জন্য।
সুলতান আইয়ুবী তার জানবাজদের নিয়ে ময়দানে গেলেন। তিনি এমন প্রচণ্ড আক্রমণ চালালেন যা তার অতীতের সকল ইতিহাস অতিক্রম করে গেল।
এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাস লেখে এমন কোন ঐতিহাসিকের আবির্ভাব ঘটেনি পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত। মানুষের চোখ ইতিহাসের পাতায় এমন রক্তপাত দেখেনি কখনও। এই সংঘর্ষের নির্মমতা মানুষের কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। ঐতিহাসিকরা শুধু লিখেছেন, ‘মানুষের বিবেক এত রক্তের স্রোত কখনও কল্পনা করতে পারে না।’
বিরতিহীনভাবে যুদ্ধ চলেছে সারা দিন। পশ্চিম আকাশে সেই রক্তের আলপনা। টকটকে লাল রক্ত যেমন এক সময় কালচে রঙ ধারণ করে তেমনি সেই আলপনা মুছে কালো হয়ে গেল আকাশের রঙ। সেই কালো রঙ ছড়িয়ে পড়ল বিশ্ব চরাচরে। ঘন কৃঞ্চ অন্ধকারে অতলে ডুবে গেল পৃথিবী। আক্রার শহর, খৃষ্টানদের ক্যাম্প, মুসলমানদের তাঁবু সব তলিয়ে গেল সেই অন্ধকারে।
রাত নেমে এলো। মেঘে ঢাকা অন্ধাকার রাত। আকাশে তারা নেই, চাঁদ নেই, আছে শুধু ভয়ংকর, ভীতিকর অন্ধকার। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হ’ল না।
সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতি ও সৈনিকদের বললেন, ‘আমরা এখনও মারা যাইনি, বিজয়ও ধরা দেয়নি আমাদের হাতে। অতএব মুজাহিদরা! আজকের রাত আমাদের বিশ্রামের জন্য আসেনি। আমরা হয় জয়ের নিশান নিয়ে ফিরে যাবো শিবিরে, সেখানে বিশ্রাম নেবো পরম প্রশান্তিতে, নতুবা যুদ্ধ করতে করতে চলে যাবো অনন্ত শান্তির রাজ্যে।
মুসলমান সৈন্যরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে কাঁপিয়ে তুললো যুদ্ধের ময়দান। এই আওয়াজে ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল খৃষ্টান সৈন্যদের হৃদয়তন্ত্রীতে।
মধ্য রাত। সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধ করতে করতে এতটাই কাবু হয়ে গেলেন যে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেলেন ঘোড়া থেকে। তাকে এনে তাঁবুতে শুইয়ে দেয়া হ’ল। যুদ্ধ চলতে লাগলো।
এই যুদ্ধে তিনি ভীষণভাবে আহত হয়েছিলেন। যখন সংজ্ঞা ফিরলো দেখলেন বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি। অসম্ভব ক্লান্তিতে হাত-পা অসাড় হয়ে আছে। তিনি দুর্বল কণ্ঠে প্রথম যে প্রশ্নটি করলেন তা হচ্ছে, ‘যুদ্ধ কি শেষ হয়ে গেছে?’
‘না সুলতান! মুজাহিদরা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আপনি আহত, তাই আপনাকে সরিয়ে আনা হয়েছে ময়দান থেকে।’
ভোর। প্রভাতের আলোয় সুলতানকে দেখতে হ’ল এক বেদনাদায়ক দৃশ্য। এ দৃশ্য দেখার আগে মরে গেলে ভাল হতো, কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা তো বান্দার জানা থাকার কথা নয়। তিনি দেখলেন, আক্রার প্রাচীরে খৃষ্টানদের পতাকা উঠানো হচ্ছে।
খৃষ্টান সৈন্যরা প্রাচীরের ভাঙ্গা স্থান দিয়ে প্রবল বেগে প্রবেশ করছে শহরে। সেদিনটিও ছিল জুম্মাবার। তারিখটা ছিল ৫৮৭ হিজরীর ১৭ই জমাদিউস সানি মুতাবেক ১২ই জুলাই ১১৯২ সাল।
আল মাশতুত ও কারাকুশ খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে সর্ব শক্তি দিয়ে লড়াই করলেও তার সৈন্যরা এতটাই ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিল যে, যুদ্ধ করার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল তাদের। খৃষ্টান সৈন্যরা বানের পানির মত শহরে প্রবেশ করা শরু করলে হাতিয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য হ’ল তারা।
কিছুক্ষণ পর। সুলতান আইয়ুবী এমন এক দৃশ্য দেখলেন যার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি দেখতে পেলেন, ক্রুসেড বাহিনী প্রায় তিন হাজার মুসলমান বন্দীকে রশি দিয়ে বেঁধে শহরের বাইরে টেনে আনছে। তাদের মধ্যে সৈন্য এবং শহরের সাধারণ মানুষও ছিল।
তাদের এক স্থানে এনে দাঁড় করানো হ’ল। নিরস্ত্র তিন হাজার বনি আদম দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে মুখে মৃত্যুর আতঙ্ক। খৃষ্টান সেনারা চারদিক থেকে তাদের ঘিরে দাঁড়ালো। তার পর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই নিরস্ত্র জনতার ওপর। সুলতান আইয়ুবী ও মুসলমান সৈন্যরা কল্পনাই করতে পারেনি, ক্রুসেড বাহিনী এমন অমানবিক বর্বরতায় মেতে উঠতে পারে।
যখন নিরস্ত্র বন্দীদের উপর ক্রুসেড বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন বাইরের মুসলমান সৈন্যরা কোন রকম নির্দেশ ছাড়াই সে সব খৃষ্টান সৈন্যদের উপর মার মার কাট কাট করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ততক্ষণে বন্দীদের অনেকেই শহীদ হয়ে গেছে। উভয়ের মধ্যে আরো এক দফা প্রবল সংঘর্ষ হ’ল।
যুদ্ধের তাণ্ডবতা, আহতদের আর্তচিৎকার, লাশের দুর্গন্ধ এসব দেখে ইতিমধ্যে সম্রাট রিচার্ডও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সুলতান আইয়ুবী আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। বিগত যুদ্ধে আহত হওয়ার পর তিনি এখন পুরোপুরি শয্যাশয়ী।
সম্রাট রিচার্ডের ওপর বিশ্ব খৃষ্টান সম্প্রদায়ের আশা ও ভরসা ছিল, তিনি বিজয়ী না হয়ে ফিরবেন না। তারা তাকে দুঃসাহসী ও ব্যঘ্র হৃদয়ের অধিকারী জানতো।
কিন্তু আক্রার অবরোধ তার মনোবল একেবারে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হলেও যে বিভীষিকার মধ্য দিয়ে এই বিজয় অর্জিত হ’ল সেই বিভীষিকার কথা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।
মাত্র কয়েক হাজার মুসলমানের এই বীরত্ব দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। এও কি সম্ভব? কয়েক হাজার সৈন্য বছরের পর বছর ঠেকিয়ে রেখেছে ছয় লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনীকে! অকাতরে জান দিয়েছে।
সামান্যতম ভয়-ভীতিও তাদের স্পর্শ করতে পারেনি! আক্রা জয় করতেই যদি এত মূল্য দিতে হয় তাহলে বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করতে কি পরিমাণ মূল্য দিতে হবে? চিন্তাটা মনে এলেই তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন।
কিন্তু জাতি তাকে বীর বলে জানে। নিজের আকাশচুম্বী মর্যাদাকে তিনি কি ধূলায় মিশিয়ে দিতে পারেন? না, পারেন না। যে বিজয় তিনি অর্জন করেছেন তাতে এখন বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হওয়া ছাড়া উপায় নেই তার। তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন।
সাগরের উপকূল ধরে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন তিনি। পথে তাকে আসকালান ও হায়ফার মত গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বসতি পাড়ি দিতে হবে।
সুলতান আইয়ুবী সম্রাট রিচার্ডের মনোভাব বুঝতে পারলেন। রিচার্ড এসব শহর ও লোকালয় দখল করে সেখানে তার ক্যাম্প করবে। তারপর এই দুই শহরকে নিজের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানিয়ে সেখান থেকে আক্রমণ করবে বায়তুল মোকাদ্দাস।
সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাসের জন্য আরও অনেক কোরবানী দিতে রাজী ছিলেন। তিনি আদেশ দিলেন আসকালান দুর্গকে ধ্বংস করে দাও। এই শহর ও কেল্লাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করো!
সুলতান আইয়ুবীর সেনাপতি ও উপদেষ্টারা এই ঘোষণা শুনে সবাই হতবাক হয়ে গেল। ‘এতবড় শহর! এত মজবুত কেল্লা? সব গুড়িয়ে দেবো?’
সুলতান আইয়ুবী গর্জন করে বললেন, ‘শহর আবার আবাদ করা যাবে। নতুন করে আবার গড়ে তোলা যাবে কেল্লা। মানুষ জন্ম হতেই থাকবে, প্রয়োজনে তারাই গড়ে নেবে নিজেদের কেল্লা ও আবাস। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন এ মুহুর্তে বায়তুল মোকাদ্দাস রক্ষা করা।’
ক্রুসেডদের বিশাল বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে। তারা এই কেল্লা ও জনপদকে নিজেদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানিয়ে নিক তা আমি চাই না। তাদের আক্রমণ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসকে বাঁচাতে হলে এখন এ না করে উপায় নেই। বিকল্প কোন পথ থাকলে এমন হুকুম আমি দিতাম না।’
সবাই বুঝলো, সুলতান আইয়ুবী ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি যা বলছেন তাতে তার রণকুশলতাই প্রমাণিত হচ্ছে। এই রণক্লান্ত সিপাহসালার যুদ্ধের আইন শৃংখলা ও রণকৌশল সম্পর্কে কতটা সজাগ ও সর্তক এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি তাই আরেকবার প্রমাণ করলেন।
সুলতান আইয়ুবীর নির্দেশে তার ক্ষুদ্র একটি কমাণ্ডো দল পিছু নিল খৃষ্টান বাহিনীর। তারা সুলতান আইয়ুবীর সেই বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত পথ ধরলো। তারা খৃষ্টান বাহিনীর ডানে বায়ে ও পেছনে ঝটিকা আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো ক্রুসেডারদের।
কমাণ্ডোরা হঠাৎ আর্বিভূত হতো এবং ছো মেরে গোশত তুলে নেয়ার মত যতটুকু পারতো ক্ষতি করে অদৃশ্য হয়ে যেতো। তাদের আক্রমণ হতো আকস্মিক ও এলোপাথাড়ি। সম্রাট রিচার্ডের বাহিনী তাদের ভয়ে অস্থির ও তটস্থ হয়ে গেল।
এই কমাণ্ডো বাহিনীর অধিকাংশ আক্রমণ হতো রাতে। কোন কোন রাতে একাধিকবার বা একাধিক জায়গায়ও এ আক্রমণ চালাতো কমাণ্ডোরা। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করে অদৃশ হয়ে যেতো।
এমনিভাবে ক্রুসেড বাহিনীর অগ্রগতি পদে পদে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তাদের রসদপত্রও নিরাপদ ছিল না। রিচার্ড স্বসৈন্যে আসকালান গিয়ে সাময়িক বিরতি ও বিশ্রাম নেয়ার কথা ভাবলেন।
তিনি তার বাহিনীকে দ্রুততর করে যখন আসকালান গিয়ে পৌঁছলেন তখন আসকালানের অবস্থা দেখে তিনি সীমাহীন বিস্ময়ে কাতর হয়ে গেলেন। তিনি দেখতে পেলেন আসকালান কেল্লা ও শহর বলে কিছু নেই। সবাই এক বিশাল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে আছে।
সেখানকার মুসলিম বাসিন্দাদের বায়তুল মোকাদ্দাস রক্ষায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। শিশু এবং নারীদেরও সরিয়ে নেয়া হয়েছিল অন্যত্র।
চরম বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলেন রিচার্ড। আর সামনে বাড়বেন নাকি পিছিয়ে যাবেন ভাবলেন খানিক। তিনি বুঝতে পারছিলেন, জেরুজালেমে তাকে অর্ভর্থনা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে মুসলিম বাহিনী।
আসকালানে রিচার্ডের আর বিশ্রাম নেয়া হ’ল না। তিনি বাহিনীকে যাত্রা করার হুকুম দিলেন। পথে তারা যতগুলো কেল্লা পেলো সেগুলোর সবাই ছিল ধ্বংসবিধ্বস্ত।
সম্রাট রিচার্ড যতই এগিয়ে যাচ্ছিলেন ততই তার মানসিক অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হতে লাগলো।
তিনি চিন্তা করে দেখলেন, মুসলমানরা এক অদ্ভুত জাতি। যে জাতি ধর্মের জন্য এতো কোরবানী দিতে পারে তাদেরকে দুনিয়া থেকে উৎখাত করা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়।
তিনি বুঝতে পারলেন, সামনে তার জন্য কঠির সময় অপেক্ষা করছে। বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করা এতো সহজ হবে না।
আক্রা বিজয়ের পর ফ্রান্সের সম্রাটের সাথে তার কথোপকথনের কথা স্মরণ করলেন সম্রাট রিচার্ড। ফ্রান্সের সম্রাট তাকে বলেছিল, ‘বায়তুল মোকাদ্দাসের অভিযানে আমিও আপনার সাথে থাকবো।’
‘তাহলে আমরা কি এখানে থেকে একত্রেই রওনা দেবো?’
‘তা বোধ করি ঠিক হবে না। আপনি আগে রওনা হয়ে যান কয়েকদিন পর আমি রওনা হই। এক সাথে রওনা হলে আইয়ুবীর বাহিনী আমাদের পিছু নিতে পারে। আর আলাদা রওনা হলে ওরা দ্বিধায় পড়বে। ভাববে, আমরা ওদের পিছু নিলে অবশিষ্ট খৃষ্টান সৈন্যরা আমাদেরও পিছু নিতে পারে। তারা বর্তমান অবস্থায় এমন ঝুঁকি নেবে বলে মনে করি না।’
আজ সম্রাট রিচার্ড একটি দুঃসংবাদ শুনতে পেলেন। ফ্রান্সের সম্রাট অগাষ্টাস আক্রা গে অব লজিয়ানের হাতে তুলে দিয়ে নিজে ফ্রান্সে ফিরে যাচ্ছেন। তিনি জেরুজালেম উদ্ধার অভিযানে আসবেন না। কারণ আক্রা দখল করতে গিয়ে তিনি নিজরে প্রচুর ক্ষতি করে ফেলেছেন। আক্রার জয়ও সে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবে না। তিনি ক্ষতির পরিমাণ আর বাড়াতে চাচ্ছেন না বলেই দেশে ফিরে যাবেন। এ খবর সম্রাট রিচার্ডের মনোবল আরো ভেঙে দিল।
খৃষ্টানরা আক্রা দখল করে নিয়েছিল বটে কিন্তু মুসলমানরা তাদের কোমর ভেঙে দিয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী আক্রা হাতছাড়া হওয়ায় খুব আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু এই যুদ্ধে যে তারই পরিকল্পনা সফল হয়েছিল ঐতিহাসিকরা তা একবাক্যে স্বীকার করেছেন। সুলতানের পরিকল্পনা ছিল তিনি শত্রুদের সামরিক শক্তি আক্রাতেই শেষ করে দেবেন। বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। আক্রাতেই শেষ করে দেবেন। বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। আক্রা জয় করে মোটেও তারা খুশী হতে পারেনি। আক্রাতে তাদের যে পরিমাণ শক্তি ক্ষয় হয়েছে সে তুলনায় এটা কোন বিজয়ই ছিল না।
আক্রার অবরোধ না থাকলে সুলতান আইয়ুবী তার কমাণ্ডো বাহিনীকে আবার তার বিশেষ রণকৌশল গ্রহণ করতে বললেন। সেই পুরনো রণকৌশল, ‘আঘাত করো আর পালিযে যাও।’
রাত হলেই শুরু হতো এ অতর্কিত আক্রমণ। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, মুসলিম কমাণ্ডোরা রাতে ঝড়ের মত আঘাত হানতো ক্রুসেড শিবিরে। তারা ওদের পিছন থেকে বা পাশ থেকে আক্রমণ চালাতো। বহু ক্ষয়-ক্ষতি সাধন করে নিরাপদে আবার পালিয়ে যেতো।
এভাবে তারা ক্রুসেড বাহিনীর কেবল জানমালের ক্ষতি করতো তা নয়, বরং রাতের পথ পথ চলায় কমাণ্ডো ভীতি থাকার কারণে তাদের একমাসের পথ পাড়ি দিতি লেগে যেতো তিন মাস। সুলতান আইয়ুবী ক্রুসেড বাহিনীকে পথে দেরী করিয়ে দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো জোরদার করে তুলতে চাচ্ছিলেন।
‘জিয়ান! কিছু একটা করো! পবিত্র ক্রুশের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করো।’ রিচার্ড তার বোন জিয়ানকে বললেন, ‘তকিউদ্দিনকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে নাও। আমরা যুদ্ধ করে বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করতে পারবো না। তকিউদ্দিনকে নিয়ন্ত্রণে এনে আরেকটি রক্তাক্ত সংঘাত থেকে রক্ষা করো যিশুর পুত্রদের।’
‘তুমি বলেছিলে তাকে ভালবাসার লোভ দেখোতে, যেনো সে ভালবাসার জন্য পাগল হয়ে যায়। আমি তোমাকে মা মেরীর কসম খেয়ে বলতে পারি, তার মনে আমি ভালবাসার যে ঝড় তুলে দিয়েছি তাতে সে দিওয়ানা হয়েই আছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, সে আমাকে প্রচণ্ড ভালবাসে।’
জিয়ান বললো, ‘এই অভিযানের মধ্যেও সে আমার সাথে দেখা করেছে। সে যদি আমাকে পাগলের মত ভাল না বাসত তবে কিছুতেই তা সম্ভব হতো না। কিন্তু তাকে যখনই বলি তুমি খৃষ্টান হয়ে যাও, সে তখন বলে, ‘না, জিয়ান, বরং তুমি মুসলমান হয়ে যাও।’
সে আমার শর্ত আমাকেই ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ‘তুমি বলছো, তুমি খোদার পথে আমাকে ডাকছো। আমি বলছি, ‘আমি তোমাকে খোদার পথে ডাকছি।’ তাহলে তো দেখা যাচ্ছে আমরা উভয়ে একই পথে চলতে চাই। সুতরাং এসো আমরা এক কাজ করি, আমরা দু’জনেই এক সাথে আল্লাহর পথ আঁকড়ে ধরি।
তোমার ধর্ম অনেক পুরনো কিন্তু আমারটা টাটকা, নতুন। এমন তরতাজা ধর্ম রেখে পুরনো ধর্ম কেন আমরা আঁকড়ে ধরে রাখবো? আল্লাহর সর্বশেষ বাণীই হোক আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল।’ এবার বুঝো, সে কতটা ফাজিল হয়েছে।’
সুলতান আইয়ুবী তকিউদ্দিন ও তার দুই পুত্রকে কাছে ডেকে তাদের আদর করে বললেন, ‘আমি তোমাদের মনে দুটো শব্দ গেঁথে দিয়ে যেতে চাই। শব্দ দুটো হ’ল, ইসলাম ও বায়তুল মোকাদ্দাস।’
তিনি তার সেনাপতিদের ডেকে বললেন, ‘এতদিন আমরা আক্রার যুদ্ধ করিনি, যুদ্ধ করেছি বায়তুল মোকাদ্দাস প্রতিরক্ষার। আমি খৃষ্টানদের আক্রায় ডেকে না নিলে এই দু’বছর ওরা কি করতো? ওরা কি বসে থাকতো? ফিরে যেতো নিজেদের দেশে? কখনওই না। তারা সম্মিলিত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো বায়তুল মোকাদ্দাসে। অতএব আমরা খৃষ্টানদের অগ্রযাত্রা দু’বছরের জন্য পিছিয়ে দিতে পেরেছি। সেই সাথে আমরা ওদের শক্তি ও মনোবল শুষে নিয়েছি।’
তকিউদ্দিন একদিন সুলতানের সাথে একাকী দেখা করলেন। বললেন, ‘সম্রাট রিচার্ড তার বোনকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চান।’
‘কিন্তু কোন শর্তে, কেন?’ জানতে চাইলেন সুলতান।
‘তার শর্ত বড় মারাত্মক ও ভয়ানক। তিনি আমাকে ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে বলেছেন।’
‘তোমার কি ইচ্ছা? তুমি কি তোমার ধর্ম ত্যাগ করে রিচার্ডের বোনকে পেতে চাও?’
‘আমি দুটোই পেতে চাই।’
‘তবে তাকে ইসলামে দীক্ষিত করো। সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে তবে তার সাথে তোমার বিয়েতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না।’
‘আমি আপনার কাছে বিয়ের প্রশ্ন নিয়ে আসিনি।’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি, আমি বিস্মিত হচ্ছি, রিচার্ডের মত বীর ও সাহসী যোদ্ধা কেমন করে এই চালাকী ও ধূর্তামীর পথ ধরতে পারে। তাকে আমি একজন সম্মানিত সম্রাট বলেই জানতাম। কিন্তু একজন সাহসী সম্রাট এতদূর নামতে পারে আমার ধারণা ছিল না। বিষয়টি আমি আপনাকে জানাতে চাচ্ছিলাম।’
‘কেন, তুমি কি রিচার্ডের বোনকে ভালবাস না?’ সুলতান তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
‘আমি স্বীকার করি তার বোনকে আমি ভালবাসি।’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘কিন্তু আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমি আমার ধর্মের সাথে কোন গাদ্দারী ও মুনাফেকী করবো না।’
‘তাহলে তুমিও জেনে রাখো, সেও তার ধর্মের সাথে গাদ্দারী করবে না।’
‘জাহান্নামে যাক সে।’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘এই যুদ্ধ রিচার্ড কখনও বায়তুল মোকাদ্দাস দখল নিতে পারবে না।’
তখন সুলতান আইয়ুবীর মুখে ফুটে উঠল এক টুকরো হাসি। সেই হাসি বলছিল, মানুষের হৃদয় বড় অদ্ভুত জিনিস। ও যে কখন কাকে ভালবাসবে এই খবর দুনিয়ার কেউ বলতে পারে না। নইলে তুমি কি জানতে না, জিয়ান ভিন্ন ধর্মের এবং তোমার জাতির দুশমন, যার সাথে তুমি এখনও লড়াই করছো। তাহলে এ অবস্থায় তাকে ভালবাসতে গেলে কেন?
সুলতান আইয়ুবীর সাথে তকিউদ্দিনের এসব কথা হচ্ছিল তখন, যখন সম্রাট রিচার্ড বায়তুল মোকাদ্দাসের অদূরে সামরিক ঘাঁটি করে বসে আছেন। এখানে আক্রার চেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনা, কারণ খৃষ্টান ও মুসলমান উভয়েই বায়তুল মোকাদ্দাসকে মনে করে তাদের ধর্মীয় তীর্থস্থান। পবিত্রভূমির জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত উভয় জাতি।
সম্রাট রিচার্ড এখানে এসেই যুদ্ধ করার পরিবর্তে আবার দূত পাঠালেন আইয়ুবীর দরবারে। জানালেন, শর্ত মানলে তিনি যুদ্ধ করে অযথা লোক ক্ষয় করতে চান না।
সুলতান আইয়ুবী রিচার্ডের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে দূতকে বিদায় করে দিলেন। এর দু’দিন পর সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা খবর দিল, ‘সম্রাটা রিচার্ড ভীষণ অসুস্থ। এমন অসুখ যে তাঁর জীবনের আশংকা রয়েছে।
সুলতান আইয়ুবী রাতে তাঁবু থেকে বের হলেন এবং সম্রাট রিচার্ডের তাঁবুর দিকে যাত্রা করলেন। একমাত্র তকিউদ্দিন ছাড়া তিনি কোথায় যাচ্ছেন এ কথা কাউকে জানালেন না। তকিউদ্দিন সুলতানের অভিপ্রায় জেনে হেসে বললেন, ‘অমুক স্থানে রিচার্ডের বোন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনি তাকে সঙ্গে নিলে সম্রাটের কাছে সহজেই পৌঁছাতে পারবেন।’
রাজকুমারী জিয়ান তার যেখানে দাঁড়ানোর কথা সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে যখন ঘোড়ার পদধ্বনি শুনলো দৌড়ে গেল ঘোড়ার কাছে। ব্যাকুল কণ্ঠে বললো, ‘তুমি এসেছো তকিউদ্দিন?’
সুলতান আইয়ুবী ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। জিয়ানকে বললেন, ‘অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বসো। আমি তকিউদ্দিন নই সালাহউদ্দিন।’
বিস্মিত জিয়ান বললো, ‘আপনি!’
‘হ্যাঁ, শুনলাম তোমার ভাই গুরুতর অসুস্থ। ভয় নেই, আমি তাকে একটু দেখতে চাই। তিনি হয়তো আমার পরিচয় জানতে পারলে আমাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেবেন না। তাই আমি তোমার সহযোগিতা চাই। আমাকে তুমি তার তাঁবুতে পৌঁছে দাও।’
বিস্মিত জিয়ান বললো, ‘কিন্তু…!’
‘না, কোন কিন্তু নেই। বললাম তো তোমার ভয়ের কিছু নেই। আমি একা এবং নিরস্ত্র। সম্রাটের রক্ষী বাহিনীর ওপর তোমার আস্থা থাকা উচিত।
জিয়ান আর কথা বাড়ালো না। বললো, ‘চলুন।’
জিয়ান ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে চাইলো। তিনি বললেন, ‘না, তুমি ওখানেই বসে থাকো।’
জিয়ানকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে লাগাম ধরে নিরবে হেঁটে চললেন আইয়ুবী। গন্তব্য সম্রাট রিচার্ডের তাঁবু। জিয়ান কিছু বললো, কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তা বুঝতে পারলেন না। বললেন, ‘তোমার ভাষা আমার ভাই বুঝতে পারে, আমি বুঝি না।’
সুলতান আইয়ুবী সম্রাট রিচার্ডের তাঁবুতে প্রবশে করলেন। রিচার্ড সত্যিই কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি সুলতান আইয়ুবীর সাথে কথা বলার জন্য দোভাষীকে ডেকে আনালেন।
সুলতান আইয়ুবীই আগে বললেন, ‘আপনার বোনকে সামলান। আমার ভাই তার ধর্ম ত্যাগ করবে না। আর আপনি আমাকে বলুন, আপনার অসুখটা কি? আমি আপনার অসুখের কথা শুনে দেখতে এসেছি।
আপনি মোটেই ভাববেন না, আপনার অসুখের খবর পেয়ে আমরা কোন অন্যায় সুযোগ নেবো। যুদ্ধ আপাতত মুলতবী থাকবে। যতদিন আপনি সুস্থ হয়ে না উঠবেন ততদিন আমার সৈন্যরা আপনার উপর কোন আক্রমণ চালাবে না। আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন, পরে যুদ্ধ হবে।’
বিস্মিত সম্রাট রিচার্ড অবাক হয়ে উঠে বসলেন বিছানায়। চোখে তার বিস্ময়ের ঘোর। বললেন, ‘সালাহউদ্দিন, আপনি!’
তার বিস্ময়মাখা কণ্ঠ থেকে সহসা বেরিয়ে এলো, ‘সত্যিই আপনি মহান! সালাহউদ্দিন! সত্যি আপনি এক অনন্য যোদ্ধা।’