অতএব তোমরা মনে রাখবে, তোমরা আক্রা শহর বাঁচানোর জন্য লড়াই করছো না, বরং তোমরা জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করছো মসজিদুল আকসা ও বায়তুল মোকাদ্দাস রক্ষার জন্য।’ এই চিঠি কবুতরের মাধমে পাঠিয়ে দিতে সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতিদের ডাকলেন।
তিনি তাদের বললেন, ‘এখন প্রত্যেক কমাণ্ডার ও সেনাপতির কাছে গিয়ে নির্দেশ দেয়ার শক্তি ও সময় আমার নেই। আমার শরীরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে তা আমি জিহাদে সর্বোত্তম পন্থায় ব্যয় করতে চাই। তোমরা তোমাদের সৈন্যদের বলো, তারা যেন আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ও তার মাধ্যমে আমরা যে দ্বীন পেয়েছি সেই দ্বীনের জন্য স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করে।
আমি যদি তোমাদের নির্দেশ দিতে নাও পারি, জিহাদের জন্য আল্লাহ কোরআনের যে নির্দেশ দিয়েছেন সেই নির্দেশের কথা স্মরণ করে ওরা যেন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। একথা যেন কেউ চিন্তা না করে, তারা সুলতান আইয়ুবীর আদেশে ও তার জন্য লড়ছে।
তোমাদের এ কথা আমি এ জন্যই বললাম, এমন সময়ও আসতে পারে, যখন সৈন্যদের নির্দেশ দেয়ার জন্য তোমরা আর বেঁচে থাকবে না। আমি জানি, আমার মতই তোমরাও তোমাদের জীবন আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিয়েছো। এই জীবনের মূল্য আল্লাহ কি দেবেন তা তিনিই ভাল জানেন। এ নিয়ে কোন চিন্তা করার সময় এখন আমাদের হাতে নেই।’
সুলতান আইয়ুবীর এ ভাষণ ছিল যেমন আবেগদীপ্ত তেমনি উদ্দীপনাময়। তাঁর আবেগ এমন অবস্থায় ছিল, মা তার শিশুকে হারিয়ে ফেললে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় অনেকটা সে রকম।
সুলতান আইয়ুবীর উপদেষ্টা কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ সময় আমি সুলতান আইয়ুবীকে অনেকবার বলেছি, সুলতান, তোমার শরীর ও স্বাস্থ্যের দিকে একটু নজর দাও। তুমি তোমার দেহটাকে এবাবে ধ্বংস করে দিতে পারো না। আল্লাহকে স্মরণ করো, জয় পরাজয় তো তাঁরই হাতে।’
সুলতানের চোখে তখন অশ্রু বয়ে যেতো। তিনি আবেগ কম্পিত কণ্ঠে বলতেন, ‘বাহাউদ্দিন! আমি বায়তুল মোকাদ্দাস ও মসজিদুল আকসা খৃষ্টানদের দ্বারা কলংকিত হতে দেবো না আমি সে পবিত্র স্থান অপবিত্র হতে দেবো না, যেখান থেকে আমাদের প্রিয় নবী আল্লাহর দরবারে গিয়েছিলেন।
যে মসজিদে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ পড়েছিলেন আমরা বেঁচে থাকতে সেই ঘর আবার নাপাক করবে নাসারারা? না বাহাউদ্দিন, তা হতে পারে না। আমি মরে গেলেও বায়তুল মোকাদ্দাস খৃষ্টানদের হাতে তুলে দেবো না।’
কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ আরও বলেছেন, ‘এক রাতে তিনি এতই অস্থির ছিলেন যে, সে রাতে আমি তার কাছেই থাকতে বাধ্য হই। তার চোখে কোন ঘুম ছিল না। আমি কোরআনের কয়েকটি সূরা পাঠ করলাম। তাকে বললাম, ‘সালাহউদ্দিন, এগুলো তুমিও পড়তে থাকো।’
তিনি চোখ বন্ধ করে নিলেন। আমি দেখলাম, তাঁর ঠোঁট নড়ছে। তিনি আয়াতগুলো পাঠ করতে করতে শুয়ে পড়লেন। শুয়ে তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘ইয়াকুবের কোন সংবাদ এলো না? সে কি শহরে প্রবেশ করতে পারবে?’
এবাবে আল্লাহর কালাম পড়তে পড়তে এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুমানোর কয়েক মিনিট পর ছটফট করতে করতে আবার তিনি জেগে উঠলেন। আবার ঘুমালেন। আবার জেগে উঠলেন।
সুলতান আইয়ুবীর তাঁবু থেকে আক্রার প্রাচীর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। শহরের বাইরে ক্রুসেড বাহিনীর সমাবেশকে মনে হচ্ছিল মৃত পোকা-মাকড়ের ওপর এক দঙ্গল ডাসা পিঁপড়াড়ে বসে আছে। পোকাটাকে ঢেকে ফেলেছে পিঁপড়ের ঝাঁক। রাতের আক্রার প্রাচীরের উপর মশালের চলাফেরা লক্ষ্য করছিল আইয়ুবীর সঙ্গের সৈন্যরা। দেখছিল কিভাবে খৃষ্টানদের নিক্ষেপ করা আগুনের গোলাগুলো প্রাচীরের উপর দিয়ে ভেতরে গিয়ে পড়ছে। প্রাচীর থেকেও গোলা ছুটে আসছে বাইরে খৃষ্টান বাহিনীর ওপর। সুলতান আইয়ুবী তার কমাণ্ডোদের বললেন, ‘যাও, আক্রমণ চালাও।’
কমাণ্ডো বাহিনী ছুটে গেল শত্রুর দিকে। তীব্র আঘাত হানলো খৃষ্টান বাহিনীর ওপর। আক্রার মাটিতে লটিয়ে পড়ল রক্তাক্ত লামের স্তুপ। আহতদের চিৎকার ভারী হয়ে উঠছিল রাতের আকাশ।
ঘুমের মধ্যে সুলতান আইয়ুবী বার বার ইয়াকুব, ইয়াকুব বলে নৌবাহিনীর এক ক্যাপ্টেনকে ডাকছিলেন।
ইয়াকুব নৌবাহিনীর এক সাহসী ক্যাপ্টেন। তার নেতৃত্বেই আক্রা শহরে একদল কমাণ্ডোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সমুদ্র উপকূল ঘেরাও করে রেখেছিল খৃষ্টান বাহিনী। সেই বাহিনীর চোখ এড়িয়ে তাদের পৌঁছতে হবে শহরে।
শহরের তিন দিকই ছিল সমুদ্রবেষ্টিত। বিশাল সমুদ্র উপকূল জুড়ে নোঙর করা ছিল ক্রুসেড বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলো। এদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে শহরে অস্ত্র ও খাদ্য সামগ্রী পাঠানো ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সুলতান আইয়ুবী ক্যাপ্টেন ইয়াকুবকে বললেন, ‘শহরে খাদ্য ও অস্ত্র পাঠানো দরকার।’
ইয়াকুব বললো, ‘আপনি অনুমতি দিলে এ দায়িত্ব আমি নিতে পারি।’ এভাবে ক্যাপ্টেন ইয়াকুব নিজেই এক কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।
ক্যাপ্টেন ইয়াকুব ছিলেন হলবের অধিবাসী। চাকরী জীবনের শুরুতে যোগ দিয়েছিলেন সুলতান আইয়ুবীর স্থল বাহিনীতে। সেখান থেকে তাকে নেয়া হয় কমাণ্ডো দলে। কমাণ্ডো ট্রেনিং শেষে তাকে নৌবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়।
তার সৈন্য সংখ্যা ছিল ছয়শো পঁচিশ। ওখান থেকে চারশো সৈন্য তিনি রাতের আঁধারে আক্রায় পাঠিয়ে দিলেন। অবশিষ্ট দুইশো পঁচিশ জন সৈন্য নিয়ে ইয়াকুব বৈরুত চলে গেলেন। সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য বোঝাই করলেন।
জাহাজে খাদ্য সামগ্রী ও অস্ত্র বোঝাই করে তিনি আবার আক্রার পথ ধরলেন। তিনি জাহাজে প্রচুর খাদ্য সামগ্রী তুলেছিলেন যা দিয়ে আক্রাবাসী দীর্ঘ দিন খেয়ে পরে যুদ্ধ করতে পারবে।
ইয়াকুব তার সৈন্যদের বললেন, ‘আমাদের জান চলে যেতে পারে কিন্তু এ রসদপত্র আক্রা পৌঁছাতেই হবে। ক্রুসেড বাহিনী আমাদের উপকূলে ভিড়তে দেবে না।
উপকূলের কয়েক মাইল দূরে জাহাজ নোঙর করা হবে। সেখান থেকে রাতের আঁধারে নৌকা নিয়ে তোমরা চলে যাবে। আক্রা পৌঁছতে পারলে মাল খালাস করে আবার ফিরে আসবে। এভাবেই সব মাল আামদের খালাস করতে হবে।’
১১৯১ সালের ৮ই জুন। ইয়াকুবের জাহাজ আক্রা থেকে তখনও কয়েক মাইল দূরে। ক্রুসেড বাহিনীর চল্লিশটি যুদ্ধ জাহাজ ইয়াকুবের জাহাজকে ঘিরে ফেলল।
ইয়াকুব জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘জাহাজ আক্রার দিকে চলতে থাকবে। ওরা বাঁধা দিলে যুদ্ধ হবে। কিন্তু জাহাজের গতি কমাবে না।
ক্রুসেড বাহিনী তাদের থামতে বললো। কিন্তু জাহাজ তো থামলোই না, উপরন্তু ইয়াকুবের সৈন্যরা ক্রুসেড বাহিনীর দিকে তা করে কামানের গোলা ছুঁড়তে লাগলো।
চল্লিশটি জাহাজ একযোগে আক্রমণ করল তাদের। তারা প্রাণপণে যুদ্ধ করল। যুদ্ধ চলছিল, জাহাজও আক্রার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
ইয়াকুবের জানবাজ সৈন্যরা ক্রুসেড নৌবহরের প্রচুর ক্ষতিসাধন করল। চারটি জাহাজ ডুবে গেল ক্রুসেড বাহিনীর। ইয়াকুবের জাহাজ তখনও ছুটছে উপকূলের দিকে। কিন্তু তার গতি পড়ে গেছে। খৃষ্টানদের গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে জাহাজের পাল।
ফরাসী ঐতিহাসিক ডিভেনসুফ লিখেছেন, ‘তারা যখন যুদ্ধ করছিল তখন মনে হচ্ছিল, তারা কেউ মানুষ নয়। ভূতের মত তারা লড়ছে এবং অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে।’
কিন্তু তারা ঘেরাও থেকে বের হতে পারলো না। ইয়াকুবের অর্ধেক সেনা তীর ও গোলার আঘাতে মারা গেল। আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় লড়তে লাগলো বাকী সৈন্যরা।
ইয়াকুব যখন দেখলো, জাহাজের পাল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়ায় জাহাজের গতি থেমে গেছে এবং খৃষ্টান নৌবাহিনীর সৈন্যরা তীর খেয়েও ছুটে আসছে জাহাজের দিকে তখন তার বুঝতে বাকী থাকল না, অচিরেই খৃষ্টান সৈন্যরা জাহাজে উঠে আসবে এবং দখল করে নেবে জাহাজ। তখন ইয়াকুব তার জানবাজদের ডেকে বললো, ‘আল্লাহর কসম! আমরা সম্মানের সাথে মরবো। শত্রুরা এ জাহাজ দখল করতে ছুটে আসছে। কিন্তু এর খাদ্য সামগ্রী ও অস্ত্রসস্ত্র আমরা শত্রুদের হাতে তুলে দিতে পারি না। তোমরা হাতিয়ার ফেলে হাতে কুড়াল তুলে নাও। জাহাজে কুড়াল মেরে ডুবিয়ে দাও এ জাহাজ। জাহাজের মধ্যে পানি ঢুকলে সহজেই এটা ডুবে যাবে। তখন আর ক্রুসেড বাহিনী আমাদের মাল সামান হস্তগত করতে পারবে না।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা যায়, যে সব সৈন্যরা জীবিত ছিল তারা পাটাতনের নিচে গিয়ে জাহাজ ভাঙ্গা শুরু করল। জাহাজের তল ছিদ্র হলে সাগরের পানি জাহাজে প্রেবেশ করতে শুরু করে। কোন সৈন্যই জাহাজ থেকে বেরিয়ে সাঁতরে বাঁচার চেষ্টা করেনি, সকলেই জাহাজের সাথে সমুদ্র তলে ডুবে গেল।
সুলতান আইয়ুবী যখন এই মর্মান্তিক ঘটনা শুনলেন তখন তিনি তাঁবু থেকে বের হলেন। তার ঘোড়া সর্বদা প্রস্তুত থাকে। তিনি লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়ে হুকুম দিলেন, ‘জলদি দফ ও নাকাড়া বাজাও।’
সঙ্গে সঙ্গে দফ ও নাকাড়া বেজে উঠল। এটা আক্রমণের সংকেত। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সৈন্যরা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে মাঠে এসে সমবেত হ’ল। সুলতান আইয়ুবী সমবেত সৈন্যদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘মুজাহিদ ভাইসব! আজ শত্রুদের ব্যুহ ভেদ করে আক্রার প্রাচীরের কাছে পৌঁছাতে হবে তোমাদের।’
প্রথমেই ঘোড়া ছুটালেন তিনি। তার পিছনে ছুটলো অশ্বারোহী বাহিনী। তাদের পিছনে তীরন্দাজ ও পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা ছুটলো লড়াকুর বেশে। তীব্র বেগে তারা যখন ছুটে গেল বিশাল ক্রুসেড বাহিনীর কাছে, ওরা ভয়ে প্রথমে পিছিয়ে গেল কয়েক কদম।
কিন্তু ততক্ষণে মুজাহিদ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের ওপর। বাধ্য হয়ে রুখে দাঁড়াতে হ’ল ওদের।
দৃশ্যতঃ এ আক্রমণ দেখে মনে হচ্ছিল, মুজাহিদরা এলোপাথাড়ি আঘাত হানছে। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী এবাবেই আঘাত হানার জন্য গত দুই দিন তার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারা পরিকল্পিতভাবেই ক্রুসেড বাহিনীর ওপর এলোপাথাড়ি আঘাত হেনে যাচ্ছিল।
মুসলমানদের এমন ক্ষিপ্ত আক্রমণ দেখে ক্রুসেড বাহিনীর কমাণ্ডার তার তীরন্দাজদের হুকুম দিল, ‘দূর থেকে ওদের নিশানা করো। ওদের সামনে পড়ে আমাদের সৈন্যরা কচু কাটা হয়ে যাচ্ছে।’
ক্রুসেড তীরন্দাজরা ধুনকে তীর জুড়লো। নিশানা করল ক্ষিপ্ত মুসলিম সৈন্যদের। প্রাথমিক ধাক্কার হতবিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে তাদের পদাতিক বাহিনীও প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে গেল। তারও একটু পর প্রস্তুত হয়ে ময়দানে এলো ক্রুসেড বাহিনীর অশ্বারোহীদল।
তীরন্দাজ বাহিনী তীর বর্ষণ করছিল। কিন্তু তাতে মোটেই ভড়কালো না মুসলিম বাহিনী। তারা তাদের গতি অব্যাহত রেখেই সামনে এগিয়ে গেল।
এ আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সুলতান আইয়ুবী নিজে। তাকে বেষ্টন করে এগিয়ে যাচ্ছিল মামলুক সেনাদল। তারা এগুচ্ছিল বিদ্যুৎ গতিতে। ক্রুসেড তীরন্দাজরা নিশানা ঠিক করার সুযোগ পাচ্ছিল না। তারা এলোপাথাড়ি তীর ছুঁড়তে আরম্ভ করল।
ময়দানে ক্রুসেডদের সংখ্যা ছিল বেশুমার। হামলাকারী সৈন্যদের দেখে মনে হচ্ছিল, মুসলিম বাহিনী আত্মাহুতি দিতে যাচ্ছে। অশ্বারোহীরা ছুটছিল এঁকেবেঁকে, যাতে তীরন্দাজদের তীর তাদের গায়ে না লাগে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধ এক সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করল। খৃষ্টান বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগলো মুজাহিদদের বেপরোয়া আঘাতে। তারা এমনভাবে ময়দানে ছড়িয়ে পড়ল যে, তাদের দেখাই যাচ্ছিল না। ময়দানে শুধু খৃষ্টান বাহিনীই দেখা যাচ্ছিল। এমন বেপরোয়া আক্রমণে যেন কেয়ামত নেমে এলো। ক্রুসেড বাহিনী প্রবল শক্তিতে মুসলমানদের আঘাত প্রতিহত করতে লাগলো।
এ যুদ্ধ তখনই শেষ হ’ল যখন সন্ধ্যার আঁধারে ছেয়ে গেল পৃথিবী। খৃষ্টানদের বহু সৈন্য হতাহত হ’ল। ময়দানে পড়ে রইলো অসংখ্য লাশ ও আহত সৈনিক।
কিন্তু এত কিছুর পরও মুসলিম বাহিনী কাঙ্ক্ষিত সফলতা লাভ করতে পারলো না। যে প্ল্যানে সুলতান আইয়ুবী আক্রমণ চালিয়েছিলেন সে পরিকল্পনা সফল হ’ল না তার। তিনি আক্রার প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না।
এমন আক্রমণ এটাই প্রথম ও শেষ নয়। আক্রার অবরোধের দু’বছর কেটে গেল। এই দু’বছরের মধ্যে সুলতান আইয়ুবী পিছন থেকে এমন আকস্মিক ও বেপরোয়া আক্রমণ বহুবার চালিয়েছেন। প্রত্যেক আক্রমণেই জানবাজ সৈন্যরা বীরত্বের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
ইতিমধ্যে সুলতান আইয়ুবীর সাহায্য এসে গেল মিশর থেকে। হলব এবং হারানের আমীরদের দেয়া সৈন্য ও রসদ সাহায্যও পাওয়া গেল সামান্য পরিমাণে। ছুটতে যাওয়া সৈন্যরাও নিজ নিজ ক্যাম্পে গিয়ে কাজে যোগ দিল। তাদের একটা অংশও শামিল হ’ল সুলতানের সাথে। যুদ্ধও চলতে লাগলো তীব্র থেকে তীব্রতর।
বিশাল বাহিনী আর প্রচুর লড়াইয়ের পরও ক্রুসেড বাহিনী আক্রা শহরে প্রবেশ করতে পারলো না। অবরোধ করতে এসে তারা নিজেরাই এখন অবরোদের মধ্যে পড়ে গেল।
এভাবে দীর্ঘ দিন কেটে গেলে খৃষ্টান সৈন্যদের অন্তরে ভয় ঢুকে গেল। কারণ প্রতিদিনই তাদের সংখ্যা অল্প অল্প করে কমছিল। তাদের মনে হ’ল, এভাবে চলতে থাকলে তারা কেউ জীবিত দেশে ফিরে যেতে পারবে না। তার আগেই কোন একদিন সেও ময়দানে লাশ হয়ে পড়ে থাকবে। তখন তার সাথীরা সেই লাশ কোন খন্দকে ফেলে দিয়ে ভরাট করবে খন্দক। তারপর সেখানে মাটি ফেলে তার ওপর দিয়ে তারা তৈরী করে নেবে তাদের চলাচলের পথ।
ক্রুসেড বাহিনীর সংখ্যা যেমন ছিল অপরিমেয়, তেমনি তাদের লাশের সংখ্যাও ছিল অগুনতি। এত বেশী লাশের সংখ্যা দেখে সাহসী খৃষ্টান সৈন্যদের মনোবল ক্রমেই আরো কমতে লাগলো। একদিন দেখা গেল, তাদের সাহস কমতে কমতে নিঃশেষ হয়ে এসেছে। এমনকি সম্রাট রিচার্ডের মনেও আতংক দেখা দিল।
মুসলিম সৈন্যদের মনোবল প্রবল বাঁধার মুখেও শুরুতে যেমন ছিল তেমনি অটুট রইলো। কারণ তাদের মনে একই সাথে দু’টো প্রাপ্তির স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, এর যে কোন একটি পেলেই তারা খুশী। আর সে স্বপ্ন দুটো ছিল, বিজয় অথবা শাহাদাত।
এ সময় সম্রাট রিচার্ড সুলতান আইয়ুবীর কাছে সন্ধির দূত বিনিময় শুরু করেন। রিচার্ডের দূত আসতো সুলতান তকিউদ্দিনের কাছে। তকিউদ্দিন সন্ধির শর্তাবলী ও প্রস্তাব সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দিতেন।
রিচার্ডের দাবী ছিল দুটো, বায়তুল মোকাদ্দাস, যাকে তারা জেরুজালেম বলে সেটা তাদের কাছে হস্তান্তর করা আর হাতিনের যুদ্ধের ময়দান থেকে পাওয়া পবিত্র ক্রুশটি তাদেরকে ফেরত দান। প্রথম দিকে দাবী ছিল তিনটি। অপর দাবীটি ছিল, এ যাবত সুলতান আইয়ুবী খৃষ্টানদের কাছ থেকে যে সব এলাকা দখল করেছেন তা ফেরত দেয়া। এখন এ দাবীটি তিনি ছাড় দিতে সম্মত হয়েছেন।
সুলতান আইয়ুবী জেরুজালেমের নাম শুনলেই উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। কিন্তু তবুও তিনি সন্ধির ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যেতে তকিউদ্দিনকে পরামর্শ দেন। তাকে বলেন, ‘তুমি সম্রাট রিচার্ডের সাথে কথা চালিযে যাও।’
প্রায় সব ঐতিহাসিক একমত যে, সম্রাট রিচার্ড ও তকিউদ্দিন এই আলোচনা চালাতে গিয়ে একে অন্যের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। তকিউদ্দিন যখন সম্রাট রিচার্ডের কাছে যেতেন তখন তার বোন জিয়ানও তাদের কাছে থাকতো। এতো বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও তকিউদ্দিন সম্রাট রিচার্ডের শর্ত মেনে নিতে পারছিলেন না। এই মেলামেশা ও দেখা সাক্ষাতের মধ্যেও আক্রার যুদ্ধ সমান তালেই চলছিল। রক্তারক্তি আরও তীব্রতর হচ্ছিল। অবরুদ্ধ আক্রাবাসীদের অবস্থা আরও করুণ ও শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। ইউরোপীয় সম্রাটদের মধ্যে ফ্রান্সের সম্রাট অগাষ্টাস ও ইংল্যাণ্ডের সম্রাট রিচার্ড এরা দু’জনই ক্রুসেড যুদ্ধের নেতৃত্ব দান করছিলেন।
‘ভাইজান!’ জিয়ান তার ভাই রিচার্ডকে বললো, ‘আমি কিন্তু সফলাতা লাভ করতে যাচ্ছি। সুলতান তকিউদ্দিন আমার ভালবাসা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমি তার মধ্যে সেই দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি না, যে দুর্বলতার কথা আপনি মুসলমান আমীর ও নেতাদের সম্পর্কে বলে থাকেন। সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে কিন্তু তার ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। সে বরং আমাকেই আমার ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলেছে।’
‘আমার মনে হচ্ছে তুমি তোমার রূপের যাদুতে তাকে বশ করতে পারোনি, যেমনটি পারে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েরা।’
রিচার্ড বললেন, ‘তকিউদ্দিন এখনও ঈমানের বলে যথেষ্ট বলিয়ান। আমি নিজেই তার সাক্ষী। আমি তাকে বলে দিয়েছি, ‘তুমি যদি জিয়ানকে বিয়ে করতে চাও তবে তোমাকে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর তোমার ভাইয়ের কাছে দাবী জানাতে হবে, তারা যেন উপকূলীয় রাজ্যগুলো তোমাকে দিয়ে দেয়। ওখানে কেবল তোমাদের দু’জনের শাসন চলবে।’
রিচার্ড বললেন, ‘সে তার উত্তরে বললো কি জানো? সে বললো, ‘সে কথা তোমার বোনকেই জিজ্ঞেস করো। আমি তাকে ততটুকু ভালবাসি সে যতখানি আমাকে ভালবাসে, তার বেশিও নয় কমও নয়।’
আমি তাকে বলেছি, ‘তার সাথে মেলামেশা ও ভালবাসাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তোমাদের ভালবাসা যদি তোমাদের মনকে এক সূত্রে বাঁধতে না পারে তবে সেখানে আমি বিয়েতে রাজি হই কি করে? আগে তোমরা এ ব্যাপারে একমত হও।’
রিচার্ড তার বোনকে বললো, ‘জিয়ান! শিকার জালে আটকা পড়েছে। কিন্তু এই কৃতিত্ব তুমি তখনই দাবী করতে পারবে, যখন জাল গুটিয়ে তাকে উপরে তুলতে পারবে। তবে জাল গুটানোর সময় তুমি আয়নায় তোমার চেহারা দেখে নিও।’
‘সে কথা আমার স্মরণ আছে, ভাইজান।’ জিয়ান প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, ‘ভাইজান! একটা খারাপ খবর আছে। আমার দুটি দাসীর কোন খোঁজ পাচ্ছি না। রাতে তারা আমার কাছেই ছিল, কিন্তু ভোর থেকে তাদের দেখা যাচ্ছে না।
সম্রাট রিচার্ড চিন্তিত মনে বললেন, ‘এটা তো খুব চিন্তার কথা! তারা কি মুসলমান?’ তিনি চেহারায় দুশ্চিন্তা ধরে রেখেই বললেন, ‘মুসলামন না হলে ওরা পালাবে কেন? আর যদি মুসলামন হয়ে থাকে তবে তো তারা পালাবেই। আমরা যেভাবে মার খাচ্ছি তাতে ওদের পালিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।’
‘হ্যাঁ, তারা সিসিলির মুসলিম মেয়ে।’ জিয়ান বললো, ‘তবে তারা বিয়ের পর থেকেই আমার সাথে ছিল। বিয়ের পর সিসিলির শ্বশুর বাড়ীতে গিয়েই আমি ওনাদের পেয়েছিলাম।’
‘মুসলমানের জন্ম যেখানেই হোক না কেন তাদের ঈমান, আবেগ ও চেতনা একই থাকে।’ রিচার্ড বললেন, ‘সে জন্যই আমরা এ জাতিটাকে এত বেশী ভয় করি। বলতে পারো, এ জন্যই তাদের পিছনে আমরা লেগে আছি যেন তারা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। ওরা এখানে এসে দেখতে পেলো, আমরা তাদের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। ফলে সুযোগ মত তারা তাদের জাতির কাছে চলে গেছে।’
সম্রাট রিচার্ড সঠিক কথাই বলেছিলেন। ভাই-বোন যখন খৃষ্টান শিবিরে বসে এসব আলাপ করছিল সে সময় এই দুই মেয়ে বসা ছিল সুলতান আইয়ুবীর সামনে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে নিয়ে যাওয়া হ’ল।
তারা সুলতানের সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল। তারা বলছিল, ‘আমাদের কিছু কথা আছে যা শুধু সুলতান আইয়ুবীর কাছেই আমরা বলতে চাই।’
তাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর সামনে হাজির করলে তারা সুলতান আইয়ুবীকে জালালো, ‘আমরা সিসিলিতে জন্মগ্রহণ করেছি এবং সেখানেই প্রতিপালিত হয়েছি। শৈশবেই আমরা রাজবাড়ীর কাজে নিযুক্ত হই।
রাজবাড়ীতেই আমাদের কৈশোর ও প্রথম যৌবনের দিনগুলো পার হয়ে যায়। রাজকুমারী জিয়ান রাণী হয়ে আমাদের সম্রাটের কাছে এলে আমাদের চেহারা-সুরত ও শারীরিক গঠন দেখে আমাদের দু’জনকে রাণী জিয়ানের সেবিকা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
সিসিলিতে সে সময় মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় খৃষ্টানদের কাছাকাছি ছিল। এই কারণে সেখানে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি যথেষ্ট সজীব ছিল। আমরা মেয়ে হলেও ধর্মের প্রতি ছিল আমাদের আন্তরিক টান ও ভক্তি।
মেয়েরা সুলতানকে জানালো, ‘জিয়ান বিধবা হয়ে গেলেন তখন সম্রাট রিচার্ড তার বোনকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। জিয়ানের দাসী হিসাবে আমরাও চলে এলাম তার সাথে।
এখানে এসে দেখতে পেলাম, আমাদের প্রভুরা আমাদের ধর্ম ও জাতির বিরুদ্ধে কেবল যুদ্ধ করছে না বরং ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য নানারকম ষড়যন্ত্র করছে।
এতে আমাদের মন খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। আমরা তখন তাদের কাছ থেকে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
মাননীয় সুলতান! আপনিই বলুন, আমরা কি মুসলমান নই? আমাদের দেহে কি মুসলিম পিতার রক্ত বইছে না? তাহলে কি করে আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে তাদের সাথে থাকতে পারি?
কাফেরদের বিরুদ্ধে এই জিহাদে আমরা শরীক হতে চাই। আপনি আমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করুন এবং আমাদেরদ ময়দানে যাওয়ার অনুমতি দিন।’
একহারা চমৎকার স্বাস্থের অধিকারী এই মেয়ে দুটি শুধু শারীরিক গঠনেই আকর্ষণীয় ছিল না, কথাবর্তায়ও যথেষ্ট চটপটে এবং বুদ্ধিমতি মনে হ’ল। সুলতান তাদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমরা ষড়যন্ত্রের কথা বললে, কি ধরনের ষড়যন্ত্রের খবর জানো তোমরা?’
তারা বললো, ‘রাজকুমারী জিয়ান সম্রাট রিচার্ডের নব বধূকে বলছিল, ‘সুলতান সালাহউদ্দিনের ভাই তকিউদ্দিনকে জালে আটকে ফেলেছে।’
‘ওকে জালে আটকেছিস, নাকি নিজে তার জালে ধরা দিয়েছিস?’
‘ওই একই কথা।’ সে বললো, ‘তকিউদ্দিনের অন্তরে আমার জন্য যেমন ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছে তেমনি তাকেও আমি ভালবেসে ফেলেছি।’
‘তাহলেই মরেছিস। ওরকম শত্রুকে কেউ ভালবাসা দেয়? তোকে তো ভালবাসতে বলা হয়নি, ভালবাসার অভিনয় করতে বলা হয়েছিল।’
‘তাই তো করছি। তকিউদ্দিনকে বলেছি, ‘তুমি তোমার ধর্ম বদলে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করো তাহলেই আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে।’ জিয়ান বললো, ‘তারপরে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করা ও জেরুজালেম পুনর্দখল করা কোন কঠিন কাজ হবে না।’
এই মেয়েরা সুলতানকে জানালো, তকিউদ্দিন ও জিয়ান এরা পরস্পর কখন কোথায় সাক্ষাত করে। তারা বললো, ‘এই সংবাদ আপনাকে জানানোর জন্যই আমরা পালিয়ে এসেছি।’ সুলতান আইয়ুবী মেয়ে দুটিকে সসম্মানে দামেশকে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।
সুলতান আইয়ুবী এই মেয়েদের রিপোর্টকে সত্য বলেই বিশ্বাস করলেন। কিন্তু তিনি ভেবে পেলেন না, তার সহোদর ভাই কি করে তাকে ধোঁকা দিতে পারে?
তিনি তার প্রতিটি সেনাপতিকেই বিশ্বাস করতেন এবং তাদের উপর নির্ভর করতেন। কিন্তু যখন তার ভাই তকিউদ্দিন ও দুই ছেলে আফজাল ও মালেক আল জাহের তার পাশে এসে দাঁড়ালো তখন তার পেরেশানী আরো অনেক কমে গেল।
ইদানিং ক্রুসেড বাহিনীর পিছন থেকে যে আক্রমণ চালানো হয় তার নেতৃত্বে তিনি এদেরকেই পাঠিয়ে দেন। শরীর অসুস্থ থাকে বলে কদাচিৎ তিনি নিজে ময়দানে যান।
তকিউদ্দিনকে তিনি খৃষ্টান সম্রাটদের সাথে আপোষ আলোচনার কাজে লাগাচ্ছিলেন। বিশেষ করে সম্রাট রিচার্ডের সাথে আলোচনা চলছিল তারই মাধ্যমে। কারণ রিচার্ড তার সাথে আলোচনা করতেই বেশী পছন্দ করেন।
আক্রার যুদ্ধ শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছে ছিল। মুসলমানদের কঠিন অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল দিন দিন। কারণ বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চল থেকে সাহায্য আসতে শুরু করেছে।
মুজাহিদরা তাদের অভিযান ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর করছে। খৃষ্টান সৈন্যদের মনোবল ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তকিউদ্দিনের আপোস আলোচনাও চলছে নিয়মিত। ইদানিং তিনি এই আলোচনার কাজে এতই ব্যস্ত থাকেন যে, সুলতান তাকে কমই কাছে পাচ্ছেন। সুলতান জানতে পেরেছেন, ময়দানে যাওয়ার সময়ও তার খুব একটা হয়ে উঠে না।
সুলতানের শরীর খারাপ। ইদানিং যুদ্ধ চালাচ্ছে তার সেনাপতি ও ছেলেরা। তিনি শুধু সংবাদ পান, আজ অমুক দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে তারা দুশমনের প্রচুর ক্ষতি সাধন করেছে। পরে তারা অমুক দিক দিয়ে আক্রমণ করেছে।
সুলতান আইয়ুবীর ছেলেরা এখন ভালই কাজ দেখাচ্ছে। তারা পুরোপুরি যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। ময়দান এবং সেনা ক্যাম্পেই এখন কেটে যায় তাদের বেশীর ভাগ সময়। বাপের সাথে দেখা করারও সময় পায় না তারা।
আক্রার প্রাচীর এক স্থানে ক্রমাগত পাথর বর্ষণে ধ্বসে গিয়েছিল। খৃষ্টান বাহিনী সে পথে শহরে প্রবেশ করার জন্য অনেকবারই চেষ্টা করেছে। কিন্তু যতবারই তারা ওই পথে শহরে ঢুকতে চেয়েছে ততবারই মুসলিম সৈন্যদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে সরে আসতে হয়েছে তাদের।
আক্রাবাসী প্রাণপণ শক্তি দিয়ে এমনি এক অভিযান রুখে দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। উভয় পক্ষই মরিয়া হয়ে লড়ছে। ফলে হতাহত ও লাশের স্তুপ বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।