» » ভণ্ডপীর

বর্ণাকার

তার সৌন্দর্যে চাপল্য নেই, আছে পবিত্রতা ও নির্মলতার দুর্লভ অস্তিত্ব। সে যে কেবল নর্তকী নয় এটা তার কথাতেও ফুটে উঠতো।

এক রাতে সরদার তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি শুধু আমাকে খুশী করার জন্যই নাচো? আমার সাথে রাত কাটাতে কি তুমি আনন্দ পাও?’

‘আমার জওয়াব শুনে আপনি হয়তো খুব খুশী হতে পারবেন না!’ রায়াদী বললো, ‘সত্যি কথা বললে আপনি ক্ষেপে যান কিনা সেই ভয় পাচ্ছি।’

‘না, না! ভয়ের কিছু নেই। তুমি তোমার মনের কথা খুলে বলতে পারো, আমি কিছুই মনে করবো না।’

রায়াদী তখন বললো, ‘অসহায়ত্বই আমাকে এক মনলোভা খেলনা বানিয়ে দিয়েছে। আপনি যখন আশ্বাস দিয়েছেন তখন আমি আমার মনের কথা আপনাকে খোলামেলাই বলতে চাই। সত্যি কথা হলো, আপনাদের প্রতি আমার মনে আছে চরম ঘৃণা। তবু আমি আপনার সব আদেশ এ জন্যই মেনে নেই যে, এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। বলতে পারেন, আমি আমার অন্তরে আপনাদের ব্যাপারে চরম ঘৃণা লালন করি।’

‘তুমি তো জানো, তোমার এমন তিক্ত কথার জন্য তোমার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি?’ সরদার বললো, ‘আমি তোমার এমন কমনীয় দেহ আর সুন্দর মুখ শকুনের খোরাক বানাতে পারি?’

‘জানি, এবং সেটাই হবে আমার জন্য বড় পুরস্কার।’ রায়াদী বললো, ‘আমার জন্য কঠিন শাস্তি হলো এখনো আমার মাথা আমার দেহের সাথে আছে আর আপনার মত শকুন আমার দেহ ও আত্মা কুরে কুরে খাচ্ছে। আপনি নিজেকে যোদ্ধা ও বীর বলে মনে করেন। আপনার সেই বীরত্ব তো আমি দেখছি। এক অসহায় বালিকাকে বন্দী করে আপনি খুব গর্ববোধ করছেন। আপনার তলোয়ার ও পৌরুষ এক অসহায় নারীকে ক্রীতদাসী বানাতে চাচ্ছে।

আমার মনের বিরুদ্ধে আপনি আমার উপর কর্তৃত্ব চালাতে পারেন, কিন্তু আমি আপনার ওপর খুশী কিনা এ কথা জিজ্ঞেস করতে পারেন না। বরং আমি এই দাবী করতে পারি, আমার সঙ্গ ও আমার নাচ আপনার মনে আনন্দ জাগায়। আপনি নন, বরং আমিই আপনার ওপর অনুগ্রহ করছি।’

এত কঠিন কথার পরও সরদার না রেগে বললো, ‘আমি শক্তি দিয়ে তোমাকে বশীভূত করতে চাই না, চাই ভালবাসা দিয়ে তোমার মনে একটু জায়গা করে নিতে। আমি যদি তোমার সামনে সোনা ভর্তি ডালা এনে রেখে দিয়ে তোমার অনুগ্রহ চাই তবে কি তুমি আমাকে স্বামী বলে মেনে নেবে?’

‘না!’ রায়াদী উত্তর দিল, ‘আমি যে পুরস্কার চাই সে পুরস্কার তোমার কাছে নেই। সে পুরস্কার আমাকে জীবনে একজনই দিয়েছিল, কিন্তু আজ সে বেঁচে নেই। তোমরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমার শরীরের উপর তার কোন লোভ লালসা ছিল না। সেই একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে ভালবাসা দিতে পেরেছিল এবং আমার ভালবাসা নিতে পেরেছিল। ভালবাসার কথা তোমাদের মুখে মানায় না। লালসা আর ভালবাসা এক জিনিস নয়। তোমরা তো সব শকুন, শিয়াল। আর নেকড়ে!’

‘সে তোমাকে যে ভালবাসা দিয়েছিল যদি আমি তোমাকে সেই ভালবাসা দেই, তবে?’

‘আমি না আমার আত্মা ভালবাসার পিপাসু।’ সে বললো, ‘সেই পবিত্র ভালবাসা তুমি কোথায় পাবে? প্রকৃত ভালবাসা দিতে বা পেতে হলে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সেই ত্যাগ তুমি স্বীকার করতে পারবে না। তুমি আমার ভালবাসা নয় শরীরের কাঙাল, মিছেমিছি কেন এক নারীকে ভালবাসার প্রলোভন দেখাচ্ছো?’

‘সত্যি বলছি, তোমাকে আমি প্রলোভন দেখাচ্ছি না। তোমার জন্য আমি যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। বলো, তুমি আমার কি পরীক্ষা নিতে চাও?’

সরদার দৃঢ় কণ্ঠে কথাগুলো বলে মদের পিয়ালা হাতে তুলে নিল। পিয়ালা মুখে লাগাবে এমন সময় রায়াদী দ্রুত তার কাছ থেকে পিয়ালাটি কেড়ে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বললো, ‘তুমি অনেক কথা বলেছো, এখন আমার কথা শুনে নাও। মদ তোমার জ্ঞান বুদ্ধি গুলিয়ে দেবে। তোমার মনের আবেগ, ভালবাসার আলো সব অন্ধকার দিয়ে ঢেকে দেবে!

তুমি জানতে চেয়েছো, তুমি প্রকৃত ভালবাসা দিলে আমি তা গ্রহণ করবো কিনা? এবার আমার মতামত শুনে নাও। সত্যিকার ভালবাসা যদি তুমি দিতে পারো তবে অবশ্যই আমি তা গ্রহণ করবো। কিন্তু তুমি আমাকে সত্যি ভালবাসো তা প্রমাণ করতে হবে! তুমি তোমার প্রকৃত ভালবাসা দেখাও।

যদি আমার আত্মা তোমার ভালবাসার সুবাস পায় তবে সে ঠিকই তাতে সাড়া দেবে। তখন আমি তোমার সাথে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে হাসি মুখে ছুটে যাবো। যে কোন বিপদ মাথা পেতে নেবো, তোমার সাথে মরুভূমিতে ছুটে বেড়াবো নিশ্চিন্ত মনে। ভালবাসা পেলে তোমার সঙ্গী হয়ে মরতেও আপত্তি নেই আমার।’

সরদার পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তার এলোমেলো চুল বাতাসে দোল খাচ্ছে। চোখে মায়াময় সম্মোহনী। সেখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের সুস্পষ্ট দোলাচল। একটু আগেও সেখানে ছিল সীমাহীন অবজ্ঞা ও ঘৃণা। আর সেই ঘৃণা কত নির্ভয়ে প্রকাশ করলো মেয়েটি। এমন সরলতা কেবল তার পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব যার মধ্যে এখনো মানবিক প্রেমপ্রীতি ও মায়ার আবেশ রয়েছে।

তার হাত থেকে মেয়েটি যখন মদের পিয়ালা কেড়ে নিয়ে দূরে ফেলে দিল তখনই তার ভেতরটা কেমন যেন নড়ে উঠলো। তার পৌরুষ ও চেতনা শিথিল হয়ে এলো। সে এমন অসহায় বোধ করলো যেন তার নিজের ওপর নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এই মেয়ে যেন তাকে যাদু করেছে। এখন তার কথায় উঠবস করা ছাড়া সে আর কিছুই কল্পনা করতে পারছিল না।

এটা পুরুষের স্বভাব যে, সে দশ জন লোকের সাথে লড়াই করতে পারে, বাঘের সাথে যুদ্ধ করতে পারে কিন্তু যে নারীকে সে পছন্দ করে সে যদি একবার বলে, ‘আমি তোমাকে ঘৃণা করি’ তখন সে পুরুষ বালির স্তুপের মত ধ্বসে যায়। সরদারের মনের অবস্থাও এখন অনেকটা সে রকম। যে লোক যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর সাথে লড়েছে সে এখন এক নারীর কাছে আত্মসমর্পন করে বসে আছে।

‘আমি তোমাকে আমার কোন সাথীর খেলনা হতে দেবো না।’

‘আমি এটাকে সাদরে গ্রহণ করি।’ রায়াদী বললো, ‘আমি আত্মহত্যা করবো না, কারণ এটা ভীরুতা। আমি পালাবার চেষ্টাও করবো না, কারণ পালিয়ে যাওয়ার মত কোন জায়গা নেই আমার। আমি তোমাকে ছলনা ও করবো না, কারণ ছলনা করার প্রয়োজন আমার ফুরিয়ে গেছে। আমার আত্মা মরে গিয়েছিল, যদি তাকে তুমি বাঁচিয়ে তুলতে পারে তবে তা তোমারই থাকবে।’

সে রায়াদীর একটি হাত চেপে ধরে বললো, ‘আজ আমি প্রথম অনুভব করলাম, তোমার মনে কত ব্যথা ও জ্বালা। আমি তোমার ব্যথার সাথী হতে চাই।’

রায়াদী যেন নতুন করে জীবন পেলো। সে তার প্রিয় ব্যথাতুর একটি গানে গুনগুনিয়ে সুর তুললো।

‘তুমি তো নর্তকী জানতাম, গানও গাইতে পারো?’

‘হ্যাঁ, আমি গানও করি।’ রায়াদী বললো, ‘কিন্তু সেই গান গাই, যাতে বেদনা আছে, কষ্টের কান্না আছে। সে গুন গুন করে গাইতে লাগলো, কাফেলা চলেছে হেজাযের পথে……’

গান তো নয়, রায়াদীর কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ছিল অন্তর নিঙড়ানো কান্নার ব্যাকুল ধ্বনি। গানের ভাষায় মূর্ত হয়ে উঠছিল তার ভালবাসা, তার অন্তরের বেদনা ও কষ্ট। তার স্বপ্নের সেই রাজকুমার যেন তাকে আবার আশা ও আলোর পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হেজাযের পথে শহীদ হওয়া রাজকুমারের হাত ধরে সে হেঁটে যাচ্ছিল চন্দ্রালোকিত মরুভূমি মাড়িয়ে। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।

সামিয়ানার ভেতরের পরিবেশ পাল্টে গেল। সেখানে এখন করুণ সুরের অবিচ্ছিন্ন ধারা বয়ে যাচ্ছে। রায়াদী আপন মনে গান গেয়ে যাচ্ছে। ক্রমে তার গানের তালে আরও বেদনাময় হয়ে উঠলো।

তার আবেগে যেন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সে জন্য সরদার পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল বসে ছিল। এক সময় রায়াদী বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো, খৃস্টান সরদারের চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে। সরদার অনুভব করলো, এমন ঘুমের ভাব তার আগে কখনও আসেনি। প্রতি রাতে সে মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে যেতো এবং সেই মাতাল অবস্থাতেই সে ঘুমিয়ে যেতো। আজ সে মদ পান করেনি, কিন্তু ঘুম তাকে ঠিকই চেতনার রাজ্য থেকে দূরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

যখন সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল তখন রায়াদী গান থামিয়ে তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো। লোকটি পালংকের উপর শুয়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে রায়াদীর মনে একই সাথে জমা হচ্ছিল ক্ষোভ, ঘৃণা, প্রেম ও সহানুভূতির বিচিত্র ভাব। বার বার তার চেহারা পাল্টে যাচ্ছিল।

অনেকক্ষণ নিরবে সে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলো। এক সময় কোমর থেকে খঞ্জর বের করে শক্ত মুঠোতে ধারণ করলো। তারপর খঞ্জর বাগিয়ে সে এগিয়ে গেল ঘুমন্ত খৃষ্টানের দিকে।

সে খঞ্জরের মাথা খৃস্টানের গর্দানের শাহ রগের কাছে নিল। কি মনে করে সেই খঞ্জর ঘুরিয়ে নিজের বুকের ওপর ধরলো। আবার সেখান থেকে খঞ্জর সরিয়ে খৃস্টানের গর্দান বরাবর হাত উঠালো। এ সময় তাঁবুর দরজার কাছে কেউ চুপ থাকার সংকেত সূচক ‘ইশশ’ শব্দ করলো।

রায়াদী দ্রুত খঞ্জর সরিয়ে তাকালো দরজার দিকে। দেখলো, সামিয়ানার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেই সুন্দর যুবক, যাকে সে খৃষ্টানদের বন্ধু ভাবলেও সে ছিল আইয়ুবীর গোয়েন্দা, হাসান ইদরিস।

হাসান ইদরিস ইশারায় রায়াদীকে নিজের কাছে ডাকলো। রায়াদী খঞ্জরটি খাপে পুরে কোমরে গুঁজে নিয়ে এগুলো তার দিকে।

হাসান ইদরিস অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, ‘বাইরে এসো, গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’

রায়াদী প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো তার দিকে। যাবে কি যাবে না যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। হাসান ইদরিস আবারও তাকে ইশারা করলো। রায়াদী সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে তাঁবুর বাইরে পা রাখলো।

হাসান ইদরিস তাকে বললো, “আজ রাতে এ লোক একা এ তাঁবুতে রয়েছে। অন্যরা অনেক দিনের জন্য দূরে চলে গেছে। এ ব্যক্তি আমার হেফাজতে আছে। ঘুমন্ত লোককে আমরা হত্যা করি না। একে যে হত্যা করবে সে আমার হাতে মারা যাবে। তুমিই তো তাকে বলেছো, আমি আত্মহত্যা করবো না, কারণ এটা ভীরুতা, আমি পালাবোও না, কারণ পালাবার মত কোন জায়গা আমার নেই। আর আমি ছলনাও করবো না। কিন্তু তুমি ঘুমন্ত লোককে হত্যা করতে চাচ্ছো, এটা কি প্রতারণা ও ছলনা নয়?’

‘তুমি কি তাকে কি বলে দেবে যে, আমি তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করতে চেয়েছিলাম? তার গর্দানে খঞ্জর ধরেছিলাম?’ বায়াদী প্রশ্ন করলো এবং একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘বলে দিও। তখন সে আমাকে হত্যা করবে আর তাতেই আমার মঙ্গল হবে। সে তোমাকেও পুরস্কার দেবে আর তাতে তোমারও লাভ হবে।’

‘এ লোককে আমিও দারুণ ঘৃণা করি। তুমি যেমন ঘৃণা করো তারচেয়ে বেশী।’ হাসান ইদরিস বললো, ‘তবু আমি তাকে হত্যা করিনি এবং কিছুই বলবো না। এমনকি তুমি যে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে তাও তাকে বলবো না।’

‘এর বিনিময়ে তুমি আমার কাছে কি পুরস্কার চাইবে?’ রায়াদী প্রশ্ন করলো, ‘আমার কাছে তো দেয়ার মত কিছু নেই। তুমি কি আমাকেই পুরস্কার হিসাবে গ্রহণ করতে চাও?’

‘না, না।’ হাসান ইদরিস বললো, ‘আমার কোন পুরস্কারের প্রয়োজন নেই। আমি কেন ঘৃণা করার পরও তাকে হত্যা করছি না, জানতে চাও?’

রায়াদী বললো, ‘বলো।’

সে রায়াদীকে একটু দূরে নিয়ে গেল এবং স্বর পাল্টে তাকে বললো, ‘আমিও তোমার মত হেজাযের এক মুসাফির। আমি যে রাতে তোমাকে ছিনিয়ে এনেছিলাম সে রাতেই তুমি আমাদেরকে তোমার জীবন কাহিনী শুনিয়েছিলে। তুমি তোমার মনের আবেগ গোপন না করে আমাদের সামনে সবটাই প্রকাশ করেছিলে। আমি তখন থেকেই চিন্তা করছিলাম তোমাকে পূণ্য লাভের এমন পথ বাতলে দেবো যাতে আল্লাহ খুশী হন।’

‘কেন তুমি এমন চিন্তা করতে গেলে? চিন্তান্বিত রায়াদীর প্রশ্ন।

হাসান ইদরিস বললো, ‘কারণ আমিও তোমার মত হেজাযের মুসাফির। বিশেষ প্রয়োজনে আমি এই খৃস্টানদের সাথে আছি। কাজ শেষ হলেই আমি আমার পথে পা বাড়াবো।’

‘কাজটা কি?’

‘সে কথাই তোমাকে বলতে চাই।’ হাসান ইদরিস বলে যেতে লাগলো। গভীর মনযোগের সাথে তার কথা শুনতে লাগলো রায়াদী।

হাসান ইদরিসের কথা রায়াদী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে গেল। সুলতান আইয়ুবীর এই গোয়েন্দা জানতো তাকে কি কথা বলতে হবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে এই সুন্দরী নারীর হৃদয় জয় করে নিল।

হাসান ইদরিস তাকে বললো, ‘এবার তুমি চলে যাও। এই খৃস্টানের মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করো। তাকে হত্যা করে নয়, বাঁচিয়ে রেখেই আমাদের কাজ হাসিল করতে হবে।’

রায়াদী তার কাছ থেকে যেতে চাচ্ছিল না। হাসান ইদরিস তাকে জোর করে যেতে বাধ্য করলো। রায়াদী নতুন এক স্বপ্ন নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

তারা তিন চার দিন এভাবেই রাতে গোপনে দেখা করলো। হাসান ইদরিস রায়াদীকে নতুন প্রেরণা ও স্বপ্ন-কল্পনার যাদুতে আচ্ছন্ন করে নিল।

রায়াদী তাকে হেজাযের কথা জিজ্ঞেস করতো। হাসান ইদরিস আবেগময় ভঙ্গিতে তাকে শোনাতো হেজাযের আকর্ষণীয় বর্ণনা।

দিনের বেলায় হাসান ইদরিস চেষ্টা করতো, যেখানে তাকে যেতে দেয়া হয় না সেখানে আসলে কি আছে জানতে। কিন্তু এ পর্যন্ত সে কিছুই জানতে পারেনি। এক রাতে সে রায়াদীকে বললো, ‘এই লোকেরা পাহাড়ের মধ্যে কিছু লুকিয়ে রেখেছে। তারা এখানে কি লুকিয়ে রেখেছে সে কথা জানতেই আমি এখানে এসেছি।’

রায়াদী বিস্মিত হয়ে বললো, ‘কেন, এখানো জানতে পারোনি এখানে কি আছে? আমি তো সে খবর এরই মধ্যে সংগ্রহ করে ফেলেছি। এখানে আছে যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম! সরদার আমাকে বলেছে, এখানে আগ্নেয়াস্ত্র ও আগুন জ্বালানোর জন্য পেট্রোল জাতীয় তেলের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়েছে। এত বেশী তেল এখানে জমা করা হয়েছে যে, আশপাশের মুসলমানদের সমস্ত শহর আগুন দিয়ে পুড়িয়েও তা শেষ হবে না। নিঃসন্দেহে এখন আমি সরদারের ক্রীতদাসী ও আশ্রিতা। কিন্তু সেও আমার এমন বাধ্য যে, সে আমার হুকুমের তাবেদার হয়ে গেছে।’

‘তুমি কি এতে খুশী যে, তোমার মনীব তোমার চাকরের মত বাধ্য?’

‘না!’ রায়াদী উদাস ভঙ্গিতে উত্তর দিল, ‘আমার আত্মা কখনও এতে খুশী হতে পারে না। আমাকে যারা হেজাযের পথ থেকে ধরে এনেছিল তারা বলেছিল, খোদা তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট। তুমি এমন নেকীর কাজ করো যাতে খোদা তোমার গোনাহ ক্ষমা করে দেন।

আমি তো সেই নেকী লাভের জন্যই হেজাযের পথে রওনা হয়েছিলাম। যে আমাকে হেজায নিয়ে যাচ্ছিল সে বলেছিল, আমরা হজ্জ করে পাক পবিত্র হয়ে যাবো। আর সেখানে বিয়ে করে পবিত্র জীবন যাপন করবো। কিন্তু আমি তো এখন আরো পাপের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। হয়তো এ জন্য আল্লাহ আমাকে আরো শাস্তি দিয়ে যাবেন।’

‘না, এখন তুমি যে কাজ করছে তাতে আল্লাহ খুশী হবেন। জমজমের পানি নয়, তোমাকে পবিত্র করবে আগুন।’ হাসান ইদরিস হেসে বললো, ‘তুমি হেজায যেতে পারোনি তাতে দুঃখ করো না। তুমি হেজাযের অনুসারীদের সাহায্য করো, আল্লাহ তোমার প্রতি খুশী হবেন। তাতেই তোমার আত্মা পবিত্র হয়ে যাবে, তুমিও মুক্তি পাবে।’

‘কে সেই হেজাযের অনুসারী?’ রায়াদী বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কাকে আমি সাহায্য করবো? কিভাবে করবো? আর তুমি কোন আগুনের কথা বলছে, যে আগুন আমাকে পবিত্র করতে পারে?’

‘হেজাযের অনুসারী সুলতান আইয়ুবী।’ হাসান ইদরিস বললো, “আর আগুন হচ্ছে যুদ্ধের দাবানল। এই পাহাড়ের মধ্যে যুদ্ধের যে সরঞ্জাম জমা করা হয়েছে তুমি আমাকে সেখানে পৌঁছে। দাও, এতেই তুমি প্রকৃত কল্যাণ ও মুক্তির সন্ধান পাবে। তোমার অতীতের সব গোনাহ আল্লাহ মাফ করে দেবেন।’

রায়াদী জানতে চাইলো সুলতান আইয়ুবী সম্পর্কে। হাসান ইদরিস তাকে শোনালো সুলতান আইয়ুবীর সংকল্পের কথা। সে তাকে খৃষ্টানদের পরিকল্পনার কথাও জানালো। মুসলমানদের বাঁচানোর জন্য আইয়ুবীর জানবাজ বাহিনী কি করতে চাচ্ছে খুলে বললো তাকে। এতে খৃষ্টানদের প্রতি রায়াদীর ঘৃণা ও ক্ষোভ আরো বাড়লো। হাসান ইদরিসের কথা শুনে সে বুঝতে পারলো, হক ও বাতিলের লড়াইটা আসলে কি এবং এ সংঘর্ষে হকের পথে থাকাটা কত জরুরী।

পরের দিন হাসান ইদরিস দেখলো, রায়াদী ঘোড়ার পিঠে চড়ে খৃষ্টান সরদারের সাথে কোথাও যাচ্ছে। ওরা যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকে হাসান ইদরিসদের যাওয়া নিষেধ। হাসান বুঝলো, রায়াদী কাজে নেমে পড়েছে।

রাতে রায়াদী সরদারকে ঘুম পাড়িয়ে তাঁবুর বাইরে এলো। সে জানে সরদারের এ ঘুম সহজে ভাঙবে না। কারণ হাসান ইদরিস তাকে একটা ছোট পাউডারের কৌটা দিয়েছিল। বলেছিল, ‘এখান থেকে কিছু পাউডার মদের সাথে মিশিয়ে সরদারকে পান করাবে। ভয় নেই, এতে সরদার মরবে না। তবে আরামের ঘুম হবে। সেই পাউডার সে আজ মদের সাথে মিশিয়ে খাইয়েছে সরদারকে।

তাঁবু থেকে বেরিয়ে রায়াদী সেখানে গিয়ে পৌঁছলো যেখানে হাসান ইদরিস তার জন্য অপেক্ষা করছিল। রায়াদী বললো, ‘সেখানে বিরাট আকারের পর্বত গহ্বর। খৃষ্টানরা খোদাই করে তাকে আরো প্রশস্ত ও বিস্তৃত করে নিয়েছে। লম্বা ও চওড়ায় এত বড় গহবর যে, মুখ থেকে তার সবটা দেখা যায় না।’

‘তুমি কি গহবরের ভেতরে ঢুকেছিলে?’

‘হ্যাঁ, সেখানে আমি হাজার হাজার পেট্রোলের মটকা ও হাড়ি দেখেছি। সেই সাথে আছে তীর, ধনুক, বর্শা, তলোয়ার, খাদ্য সামগ্রী, তাঁবু, কাপড় এবং অপরিমেয় জিনিষপত্র।’

‘তিনি তোমাকে সেখানে নিলেন?’

‘কেন নেবেন না? আমি কি তার শত্রু? আমি তো তার রাণী। আমি সরদারের কাছে শিশুর মত বায়না ধরলাম। বললাম, যে পাহাড়ের পাশে তোমরা অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছো আমি সেখানে যাবো। আমি দেখতে চাই আমার হবু স্বামী আমাকে যা বলছে তা সত্যি, নাকি আমাকে পটানোর জন্য গপ্পো মারছে।’

তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই দেখবে। কাল সকালেই আমি তোমাকে সেখানে বেড়াতে নিয়ে যাবো। কিন্তু সাবধান, সেখানে যা দেখবে তা নিয়ে কারো সাথে গল্প জুড়ে দিও না।

আমি বললাম, তুমি আমাকে এত বোকা ভাবো কেন? ওগুলো যে গোপন জিনিস তা কি আমি জানি না।’

তারপর সকালে ঘুম থেকে উঠে সত্যি সত্যি তিনি আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন।

‘ওখানে সেই অস্ত্রভাণ্ডারের নিরাপত্তার জন্য তারা কি ব্যবস্থা নিয়েছে?’ জানতে চাইলে হাসান ইদরিস।

‘গহ্বরের সামনে দু’জন প্রহরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।’ রায়াদী বললো, ‘তবে গহ্বরের মুখ খোলা। আর গহ্বর থেকে দেড়-দুইশ গজ দূরে প্রহরীদের থাকার জন্য একটা ক্যাম্প আছে। ডিউটি শেষ হলে পাহারাদাররা ওখানেই বিশ্রাম নেয়। ক্যাম্পের সামান্য দূরে দেখলাম একটা তাঁবু। তাঁবুর বাইরে এক বুড়ো লোক বসে বসে ঝিমুচ্ছে।

সরদার তাকে পা দিয়ে গুতো দিয়ে সচেতন করে বললো, “কি খবর দরবেশ সাহেব! কোন কষ্ট হচ্ছে না তো? সময় মত খাওয়া দাওয়া পাচ্ছো তো?’

বৃদ্ধ দুর্বল স্বরে বললো, ‘জনাব, আমাকে কবে মুক্তি দেবেন? আমাকে এখন যেতে দিন।’

সরদার অবজ্ঞার স্বরে বললো, ‘আর কটা দিন অপেক্ষা করো। এতো অধৈর্য হচ্ছো কেন? ধৈর্য ধরো, অনেক পুরস্কার পাবে।’ এটা সম্ভবত সেই দরবেশ, যার কথা তুমি আমাকে বলেছিলে।’

‘হ্যাঁ।’ হাসান ইদরিস বললো, ‘এটা খৃস্টানদের সেই প্রতারণা; যে প্রতারণা মুশেলবাসী ও মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।’

রায়াদী হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার খবর তো এনে দিলাম। এবার বলো, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করেছেন?’

‘হ্যাঁ রায়াদী। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, মেহেরবান। নিশ্চয়ই তিনি তোমার গুনাহখাতা মাফ করে দেবেন। এসো আমরা দু’জন আমাদের সফলতা এবং আমাদের অনিচ্ছাকৃত এবং ইচ্ছাকৃত পাপের জন্য তওবা করে তার কাছে ক্ষমা চাই।’

মোনাজাত শেষ হলে দু’জন যাত্রা করলো। অতি সাবধানে পা ফেলছে ওরা। রাতের আঁধার তাদেরকে সাহায্য করছে। তারা পাহাড়ের সরু গলি দিয়ে চলতে চলতে থেমে যেতো। চারদিকে সতর্ক ফেলে দেখে নিত ভাল করে। তারপর আবার পথ চলতো।

দিনের বেলা ঘোড়ায় চড়ে গিয়েছিল বলে জায়গাটা কাছেই মনে হয়েছিল রায়াদীর। এখন হাঁটতে গিয়ে অনুভব করলো, দূর মোটামুটি মন্দ নয়। এক সময় তারা পৌঁছে গেল লক্ষ্যস্থলে।

হাসান দূর থেকেই দেখতে পেলো গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আছে দুই প্রহরী। তাদের পাশে মশাল জ্বলছে। মশালের লাঠি মাটিতে পোতা। হাসান ইদরিস পা টিপে টিপে পাহারারদের একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেল। রায়াদীকে একটু দূরে সরিয়ে রেখে এক পাথরের আড়ালে বসে গেল সে। তারপর প্রহরীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আস্তে করে একটা কাশি দিল।

এক প্রহরী চমকে উঠে বললো, ‘কে?’

হাসান এ প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো। প্রহরী সন্দেহের দোলায় দুলতে দুলতে দু’পা এগিয়ে গেল। অন্ধকারের জন্য সে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না।

প্রহরী আরো কয়েক কদম এগিয়ে পাথরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। হাসান ইদরিস সন্তর্পনে উঠে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে তার গলা এমন জোরে চেপে ধরলো যে, তার আর শব্দ করার উপায় রইলো না।

হাসান এক হাতে প্রহরীর গলা পেঁচিয়ে রেখে অন্য হাতের খঞ্জর দিয়ে তার বুকে দু’তিন ঘা বসিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো কিন্তু তার শরীর নিথর হওয়ার আগ পর্যন্ত ওভাবেই সে প্রহরীর গলা চেপে ধরে রাখলো। যখন বুঝলো, আর কোন দিন নড়াচড়া করতে পারবে না সে, তখন হাসান লাশটি আস্তে করে নামিয়ে রাখলো মাটিতে।

এরপর হাসান ইদরিস লাশটি টেনে পাথরের আড়ালে নিয়ে গেলো। লাশটি ওখানে নিয়ে সে নিজেও সেই পাথরের আড়ালে আবার বসে পড়লো। সেখানে বসেই সে অপেক্ষা করতে লাগলো অপর প্রহরীর জন্য।

সাথীকে ফিরতে না দেখে অপর প্রহরী তাকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু কেউ তার ডাকের উত্তর পেল না।

সেই প্রহরী ব্যাপার কি দেখার জন্য এবার নিজেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো। পাথরের কাছে এসে সেও আগের প্রহরীর মত থমকে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখতে লাগলো। কিন্তু আশেপাশে কাউকেই দেখতে পেলো না সে। খুঁজতে গিয়ে তার মনে হলো অন্ধকারে তার সামনে মাটিতে কি যেন পড়ে আছে। সে গা এগিয়ে পড়ে থাকা জিনিসটার কাছে গিয়ে তার সাথীকে মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পেলো।

সে ঝুঁকে তাকে দেখতে গেল আর এই সুযোগে হাসান ইদরিসে তার গলায় এমন ফাঁস লাগিয়ে দিল যে, তার আর চিৎকার করারও সুযোগ রইলো না।

হাসান দ্বিতীয় প্রহরীকে পাকড়াও করতেই রায়াদী তার লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে এলো এবং অপেক্ষা না করে দ্রুত ছুটে গেল গুহামুখের মশালের কাছে। সে একটি মশাল মাটি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গুহার ভেতর ঢুকে গেল।

হাসান ইদরিস দ্বিতীয় প্রহরীকে হত্যা করে উঠে দাঁড়ালো। তার অন্য সঙ্গীরা তখন ক্যাম্পের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। গুহার মুখে কি ঘটেছে কিছুই তারা জানতে পারলো না।

হাসান ইদরিস আস্তে করে ডাকলো রায়াদীকে কিন্তু রায়াদীর কোন সাড়া নেই। যেখানে তাকে রেখে এসেছিল সেখানে নেই রায়াদী। হাসান এবার ছুটলো গুহার মুখের দিকে। দেখলো সেখানকার একটি মশাল উধাও। যা বুঝার বুঝে গেল হাসান। সে কালবিলম্ব না করে অপর মশালটি হাতে নিয়ে ঢুকে গেল গুহার ভেতরে।

ইতিমধ্যে গুহার মধ্যে জ্বলে উঠলো আলো। হাসান দেখলো, রায়াদী দৌড়ে বাইরে চলে আসছে। তার কাপড়ে আগুন ধরে গেছে। সে ছুটছে পাগলের মত।

ঘটনা হচ্ছে, রায়াদী গুহার মধ্যে ঢুকেই দেখতে পেলো হাজার হাজার পেট্রোলের ড্রাম ও হাড়ি। এতে আগুন দিলে কি ঘটবে জানা ছিল না রায়াদীর, সে আবেগের চোটে এক হাড়ির মুখে মশাল ঠেসে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠলো আগুন। সে জানতো না, এই তেল দপ করে জ্বলে উঠে মুহূর্তে কেমন করে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আগুন রায়াদীকে ঘিরে ফেললো এবং তার পরণের কাপড়েও আগুন লেগে গেল।

হাসান ইদরিস ছুটলো রায়াদীকে বাঁচাতে। সে যখন তাকে ধরলো ততোক্ষণে তার সুন্দর দেহ খামছে ধরেছে লকলকে আগুন। তার রেশমের মত কোমল চুল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। হাসান ইদরিস তার পোড়া শরীর জড়িয়ে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি খেল। রায়াদীর কাপড়ের আগুন নেভাতে গিয়ে নিজের হাত পুড়িয়ে ফেললো। কাপড়ের আগুন নিভলেও অগ্নিদগ্ধ রায়াদী তখন জ্ঞান হারিয়েছে। পুড়ে গেছে শরীরের বিভিন্ন অংশ। চোখ ঝলসে গেছে। পুড়ে গেছে চোখের ভুরু।